পৃথিবীর সব বাবাদের জয় হোক ..

শুভ্রা সাহা

বাবা গত হয়েছেন, কত কথা প্রাণে বাজে। কাজ থেকে ফিরলেই সন্ধ্যায় মন্দিরে যাবার জন্য ব্যাকুল হত বাবা। আমার পরম সৌভাগ্য কৃষ্ণ ভক্ত মা বাবার কন্যা আমি। বাবা, মা দুজনেরই জপের মালাটা সঙ্গী ছিল। প্রতিদিন রুটিন মত স্নান করে গীতা পাঠ না করে কোথাও বের হত না আর বলতো সীমু গীতা পড়াটা একদিনও বাদ যায় না যেন। অভিক দাদুকে take care করতো – উত্তম সুচিত্রার মুভি চালিয়ে দিয়ে। যখন আমি কাজে, বাবা তখন সবজী বাগান নিয়ে ব্যস্ত থাকতো, আমার রান্নার জন্য তরকারী কেটে রাখতো। weekend হলেই বাবাকে নিয়ে বেড়াতে যেতাম। বয়সের সাথে সব শক্তি যেন কোথায় পালিয়ে যায়। এখানে বিকেলে প্রতিদিন হাটতে যেত, হাটতে হাটতে সোমার বাড়ী গিয়ে বসে বসে ওর student দের গান সেখানো দেখতো। একদিন পথ হারিয়ে ফেলেছিল, মন্দিরের অনেকেই তাকে খুঁজতে বেড়িয়ে পরেছিল। কাজ পাগল মানুষ, সারাটা জীবন কাজের পেছনে ছুটেছে বিরামহীন। যখন যে কাজ হাতে নিত সেটা শেষ না করা অবদি স্বস্তি ছিল না।

তোমাতেই সব সুখ হে পিতা, তোমাতেই সব ভালো ।

বাবা মানুষকে খুব ভালবাসতো আর নিমেষেই মিশে যেত।শুধু আমার মা বা পরিবারের সবাই ছাড়াও পাড়া প্রতিবেশ আত্মীয় অনাত্মীয় সবাই তাকে ভীষণ ভালবাসতো। এই কানাডাতে টরেন্টতেও বাবা এল পরন্ত বয়সে-সকলেই তাকে ভালবাসতো। এখানে আমাদের পাড়ায় কারও সাথে দেখা হলেই জিজ্ঞাসা করে, how is your dad? বাবা যখন হাটতে বের হত তখন হাত নাড়িয়ে সবাইকে hello বলত। তেমন ভাল ইংরেজি না বলতে পারলেও তার বন্ধু কম নয়। এমন কি আমাদের পাশের এক চাইনিজ বৃদ্ধ couple যারাও ইংরেজি বলতে পারে না তারাও তার বন্ধু। আর এক সিনিয়র couple তারাও বাবার সাথে হাটতে বের হত তারা শুধু হিন্দি বলতে পারতো কিন্তু বাবা হিন্দি বোঝেনা। আসলে দেখলাম সোসাল হবার জন্য ভাষা অন্তরায় হয় না। ইচ্ছে থাকলে ভাষা ছাড়াও communicate করা যায়।

বাবার Canadian immigration sponsorship application টা process হতে অনেকটাই সময় নিল, Health Card ছিল না বলে ভয় হত, health insurance তো শুভংকরের ফাঁকি। যখন বাবার sponsorship Application approve হল, passport request পেলাম তখন পৃথিবী থেকে চির বিদায়ের সময় হয়ে গেল। এর মধ্যে দুজন ফটোবন্ধি হলেন। আমি বাবাকে দেখতে গেলাম দেশে আর তারপর দিন থেকেই বাবা অচেতন, যেন আমাকে final goodbye বলার অপেক্ষায় বসেছিল ।

বাবার সঙ্গে শুভ্রা সাহা

লেখা পড়াশেখানোর জন্য কি চেষ্টাটাই না ছিল তার। দুপুরে ঘুমানোর কোন উপায় ছিল না ছুটির দিনে। বাবা বলতো দিবা নিদ্রা অনাচার। তারপর শুরু হত অংক করানো। পুরানো কাগজের দোকান ঘেটে কিনে এনেছিল কে, পি, বোসের এলজাবরা আর যাদব বাবুর পাটিগনিত। স্কুলের পড়ার বাইরে বাবার এসব অত্যাচার অসহ্য লাগতো। সেই গ্রামার -tense conjugation, সেই translations – ডাক্তার আসিবার আগে রোগীটি মারা গেল। তারপর কোন কারকে কোন বিভক্তি। অফিস থেকে পুরানো ইংরেজি নিউজ পেপার নিয়ে আসতো আর আমাকে রিডিং পড়তে বলতো। শুধু তাই না, আবার বাংলা ও ইংরেজি ডিকটেশন লেখাতো তারপর ভুল বানান লাল কালি দিয়ে কেটে, খাতার উপরে লিখে দিত ১৩ টি বানান ভুল। সেই ভুল থেকে আজও বের হতে পারিনি।ভুল সবই ভুল, এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা। দিনের ক্লান্তি শেষে চোখে ঘুম নামলেই বাবাকে দেখি, এসে বলে – সীমু তোর হাতের লেখা একেবারে পড়ার অযোগ্য, কতবার বলি মাগো অক্ষর গুলো পরিস্কার করে লেখ। আদর্শ লিপিতে পড়িস নি – হস্তাক্ষর সুন্দর হইলে পরীক্ষায় অধিক নম্বর পাওয়া যায়। বাবাকে কে বোঝাবে আজকাল লেখা সব ঐ computer এ। আবার বলে সামনে বৃত্তি পরীক্ষা প্রায় ভোর হয়ে এলো, উঠে পড়তে বস- যে চাষা আলিস্য ভরে বীজ না বপন করে পক্ক শষ্য পাবে সে কোথায়? তোর দাদা বৃত্তি পেয়েছিল, তুই না পেলে তোর মা তো অনেক কষ্ট পাবে। ভোরের বেলা পড়লে মনে থাকে রে। বাবা কে বলি – আমি তো সেই কবেই আমার কৈশরকে, শৈশব কে পেছনে ফেলে এসেছে। এখন সেই আমাদের পিরোজপুরের বসত ভিটা থেকে আমি কত দুরে, সেখানে কেউ আর আমাকে নাম ধরে চিৎকার করে ডাকে না। বড় সাধারণ, সহজ সরল মানুষ কিন্তু তার জীবন প্রবাহ বড় বর্ণাঢ্য । মা আর আমারা তিন ভাই বোন, আত্মীয়,পাড়া পরশীদের নিয়ে বড্ড সুখী জীবন কেটেছে তার।

আমার মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল মেয়ে চাকরী করবে, নিজের পায়ে দাড়াবে।একদিন আমার ছোট্ট দুটি ছেলেকে  মায়ের কাছে রেখে, খুব ভোরে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা যারার ট্রেনে বাবা আর আমি, ট্রেনে তিল পরিমাণ ঠাঁই নেই । অধিকাংশ যাত্রীই বিসিএস এর প্রিলির পরীক্ষ দিতে যাচ্ছে । কোন রকমে একটু জায়গা খুঁজে বাবা আমাকে বসিয়ে দিল কিন্তু বাবা টানা তিন ঘন্টা দাড়িয়ে থেকে ঢাকায় পৌঁছাল। শুধু তাই নয়, তারপর পরীক্ষার হলের সামনে ছিল যতক্ষণ আমার পরীক্ষা শেষ না হয় । পরীক্ষা শেষে বিকেলের ট্রেনে আবার ময়মনসিংহ ফেরা। এমন কত শত স্মৃতি মনের কোনে ।

কত অভাগা মনে হয় নিজেকে, অনেক কিছু করার ছিল যার কিছুই করা হয়নি তার জন্য। বাবারা যে কেবল শুধু দিয়ে যায়। জীবনে যেটুকু যা হয়েছে সবই যে তাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা,পরিশ্রম আর আশীর্বাদে। শুনি দেহের খাচায় বন্দি এ আত্মা অবিনশ্বর , এ শরীর বদল হয়ে মানুষ কোথায় যায় ? জানিনা পরোলোকে কি আছে। জন্মালেই মৃত্যু অবধারিত। পাখি কখন জানি উড়ে যায়, আসলে এই কেমন পাখি এক বার উড়ে চলে গেলে আর ফিরে আসে না I পৃথিবী তার নিয়মে আবর্তিত হয়ে যাচ্ছে, সময়ে প্রিয় মানুষগুলো হারিয়ে যায়, আমরাও যাব ! বাবা মা বিহীন পৃথিবীটা কেমন হবে আমার জন্য কখনোই ভেবে দেখিনি। বাবা মায়ের এই পরম আশ্রয় যে একদিন থাকবে না সে কথা যে মনেই হয়নি কখনো। জীবনের গতিতে বাবা মায়ের এই চরম ঋণের কথা সে ভাবে ভাবাই হয়নি। বাবা মা নেই এটা এখোনো মেনে নিতে পারিনা, ঠিকই অন্তরে আছে সর্বদাই। আমরা ভাগ্যহীন সন্তানরা তাদের জন্য কিছুই করতে পারি না! বাবার আত্মার স্বর্গীয় শান্তি কামনা করি। ভগবতীয় কীর্তন দু:খ বিনাশন এবং অপার মানসিক শক্তির প্রলেপন। সমবেত হরিনামে ঈশ্বর প্রেম, নৈকট্য, বিরাটত্ব, ও মহত্ত্বের পরম মাধুর্য অনুভব করা যায়। অকুন্ঠ শ্রদ্ধায় প্রনাম, ঠাকুর সবাইকে শান্তি প্রদান করুন, ভগবানের পাদপদ্মে তাদের স্থান হোক। বিশ্বপিতার মধ্যেই বাবাকে খুঁজে ফিরি।

“তোমা হতে সব সুখ হে পিতা, তোমা হতে সব ভালো ।

তোমাতেই সব সুখ হে পিতা, তোমাতেই সব ভালো ।

তুমিই ভালো হে তুমিই ভালো, সকল-ভালোর সার ।

তোমারে নমস্কার হে পিতা, তোমার নমস্কার ।।“

শুভ্রা সাহা

টরন্টো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *