শুচিতা

(কানাডার দৈনন্দিন বাস্তবতার দিকে লক্ষ্য রেখে কাল্পনিক এই উপন্যাস ‘শুচিতা’। লিখেছেন কানাডা প্রবাসী নজরুল ইসলাম। )

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আভা বলে, আমরা জানি কমল একজন ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি, কিন্তু সে কেন অন্যের বাসায় রোজ রোজ যাবে এবং হইচই, ঝগড়াঝাঁটি করে অনাসৃষ্টি করবে?

ও তো একা যায় না, সুমিতও হুইল চেয়ার ঠেলে ঠেলে গিয়ে ওদের সঙ্গে যোগ দেয়। ওটা শুনে আমার মনে হয় যে সুমিত নিজেও মানসিক দিক থেকে সুস্থ না। তা ছাড়া ওকে হাসপাতাল থেকে মানসিক বিভাগে পাঠিয়েছে এবং অতিমাত্রায় উত্তেজিত হতে নিষেধ করেছে। কিন্তু সে জোরে কথা ও উত্তেজিত হওয়া ছাড়তে পারছে না।

শুচিতা বলে, মা, তুমি এখন বিশ্বাস করো, আমি কেন ওদের পছন্দ করি না। সুমিত আমার সঙ্গে একটা ব্যাপারেও কোনো রকম আলোচনা করে না। ওরা আমাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে, সব সময় আমাকে নিচু ঘরের মেয়ে হিসেবে ধরে।

বিকেলে সুলতা কল দিয়ে বলে, শুচিতা, তোমরা কেমন আছ?

আমরা ভালো।

তোমরা কেমন আছ?

তুমি কী জানো আমরা বাসা বদলি করেছি?

না, তোমরা তো আমাকে কিছু বলোনি। আমরা বাসা চেঞ্জ করে পাশের বিল্ডিংয়ে এসেছি, তুমি এসে একবার আমাদের দেখে যেয়ো।

সুমিত কেমন আছে?

ও গতকাল হাসপাতালে গেছে এবং ডাক্তার ওকে মেডিসিন দিয়েছে। বলেছে, এক মাস পরে আবার যেতে।

শুচিতা টেলিফোন রেখে দিয়ে বলে, মা, সুলতা আমাকে কল দিয়েছে এবং বলে যে ওরা বাসা চেঞ্জ করেছে। আমি জানি এ ব্যাপারে ওদের কোনো কিছু বলিনি।

ভালো করেছ, না হয় ওরা বলবে কোত্থেকে শুনেছ, ইত্যাদি ইত্যাদি। তার চেয়ে কিছু না বলে থাকা ভালো। ওরা প্রয়োজন মনে করলে বলবে, না বলে চুপ করে থাকবে।

প্রিতম বলে, সুলতাকে বলতে পারতে, একবার এসে ধ্রুবকে দেখে যাওয়ার জন্য।

শুচিতা বলে, বাবা, আমি চাই না ওরা এখানে এসে আমার সঙ্গে ঝামেলা করুক। ওরা ওদের মতো থাকুক এবং আমি আমার মতো থাকি।

কত দিন এভাবে থাকবে?

যত দিন থাকতে পারি থাকব, না পারি একটা কিছু করব। এখন এ ঝামেলা থেকে দূরে থাকা ভালো। কমলের বিরুদ্ধে পুলিশ কেস এবং ওকে অ্যারেস্ট করেছে, এদিকে তাদের ইমিগ্রেশন কেস এ পর্যন্ত মীমাংসা হয়নি।

এতে কি কেসের ওপর কোনো প্রভাব পড়তে পারে?

না, বাবা এটা তো ক্রিমিনাল কেস না, কাজেই কোনো অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না। তবে সব ধরনের ঝামেলা থেকে দূরে থাকা ভালো। সে যা-ই হোক, ভালোয় ভালোয় তাদের কেস মীমাংসা হলেই হলো।

সুমিত কী ডাক্তারের কাছে গেছে?

শুনেছি গিয়েছে; তবে তার রিপোর্ট সম্পর্কে কিছু বলতে পারি না, আমি ওকে জিজ্ঞেস করিনি। ওরা কেউ আজকাল আমাদের খোঁজ খবর নেয় না। তা ছাড়া ওরা নানা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে।

পর্ব: ৭

আজ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া। সারারাত অবিরত শুভ্র তুষার, ঘরের বাইরে ড্রাইভওয়ে, রাস্তা, সর্বত্র সাদা পেঁজা তুলার মতো জমা হচ্ছে। রাস্তায় মিউনিসিপ্যালিটির গাড়ি দিয়ে তুষার পরিষ্কার করে লবণ ছিটাচ্ছে। কিন্তু বাড়ির আঙিনা ও ড্রাইভওয়ে পরিষ্কার না করলে ঘরের দরজা খোলা বা গ্যারাজে এবং ড্রাইভওয়ে থেকে গাড়ি বের করে কাজে যাওয়া যাচ্ছে না। তা ছাড়া অতি অল্প সময়ের মধ্যে ঠান্ডায় তুষার পাথর হয়ে জমে বরফ হলে গাড়ি বা পায়ে হাঁটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। মারিয়ার কোনো অনুশোচনা নেই, তাকে কাজে যেতে হবে না। সে নিজে একা থাকে। কিন্তু নিচে বেজমেন্টে ভাড়াটে ইয়ং ছেলে প্রদীপ যত অসুবিধাই হোক কাজে যেতে হবে। স্নো পরিষ্কার না করলে সে আজ গাড়ি বের করতে পারবে না।

প্রদীপ ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঘরের দরজা খুলতে পারছে না। পুরা ড্রাইভওয়ে পরিষ্কার না করলে ঘর থেকে বের হয়ে গাড়ি স্টার্ট দেওয়া কোনো ক্রমেই সম্ভব হবে না। মারিয়া ডিম মামলেট করে রুটি টোস্টারে দিয়ে আস্তে আস্তে নিচে নেমে দরজা নক করে ডাকে প্রদীপকে।

প্রদীপ দরজা খুলে বলে, হাই মারিয়া।

মারিয়া বলে, আমি রুটি ও ডিমের মামলেট করেছি তোমার জন্য।

কেন, মারিয়া তুমি কষ্ট করবে?

বাইরে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, আমি ব্রেকফাস্ট করছি, তাই ভাবলাম তোমার জন্যও করি।

থ্যাংক ইউ মারিয়া। আমার জন্য সকালের ব্রেকফাস্ট তৈরি করার কোনো দরকার ছিল না। আমি কাজে যাওয়ার সময় রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু নিয়ে কাজে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করি।

আজ না হয় আমার দেওয়া ব্র্যাকফাস্ট খেলে। তা তুমি কি আজ কাজে যাবে?

হ্যাঁ। কাজে যেতে হবে। বাইরে আজ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, না গেলে হয় না?

যত দুর্যোগই হোক, কাজে যেতে হবে। যেতে হলে বাসে যাও; আজ গাড়ি নেওয়া নিরাপদ হবে না।

ঠিক আছে মারিয়া।

তুমি কাপড় ছেড়ে নাশতা করো, ততক্ষণে আমি কফি নিয়ে আসি।

গধৎরধ ংড় শরহফ ড়ভ ুড়ঁ!

মারিয়া কফি নিয়ে এসে বলে, লোক এসে স্নো ক্লিন করতে দেরি হবে। ওরা অনেক বাড়িতে স্নো ক্লিন করে তবে এখানে আসবে ওদের সময়মতো। ঠিক আছে, আমি বাসে যাব।

গরম কাপড়, জ্যাকেট, মাথায় উলেন হ্যাট, পায়ে গরম মোজা, বুট, হাতে গ্ল­াভস পরে দুপুরের লাঞ্চ ব্যাগ নিয়ে প্রদীপ আস্তে আস্তে বাস স্টপের দিকে গিয়ে দেখে লাইন ধরে অনেক লোক বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। বাইরে প্রচণ্ড ঠান্ডা, সে ঠান্ডায় কাঁপতে থাকে। প্রদীপ চিন্তা করছে আজ কাজে যাবে কি, দেখি শুচিতাকে কল দিয়ে সে কী বলে?

সেলুলার ফোন উঠিয়ে বলে, হ্যালো শুচিতা! তুমি কি আজ কাজে যাবে?

না, আমি কাজে যাব না, অসুস্থ বলেছি। আমি বাস স্টপে দাঁড়িয়ে ভাবছি কী করব?

শুচিতা বলে, আজ অফিসে লোকজন কম হবে। তুমি না গেলে বলে দাও আমি আজ কাজে আসব না। আচ্ছা দেখি কী করা যায়। বাস এসেছে কিন্তু ভেতরে দাঁড়ানোর মতো অবস্থা নেই। কয়েকজন ওঠার পর বাস ড্রাইভার দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। আরও প্যাসেঞ্জার এসে লাইনে দাঁড়িয়েছে। অতিরিক্ত ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে। সে অফিসে কল দিয়ে বলে, আমি তো আসতে পারছি না। আমার গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না। মি. এডওয়ার্ড, কারখানা ম্যানেজার বলে, না পারলে আর কী করবে, রেস্ট নাও, আগামী দিন দেখা হবে।

প্রদীপ হাসতে হাসতে বাসায় গিয়ে দরজা খুলতেই মারিয়া বলে, কী ব্যাপার, তুমি ফেরত এলে?

প্রদীপ বলে, বস আমাকে আজকের জন্য ছুটি দিয়েছে। আবহাওয়া খারাপ। আজ অনেকেই কাজে যাবে না। সে বলে, দেখি মারিয়া তোমার স্নো সভেল দিয়ে দরজার সামনে একটু পরিষ্কার করে লবণ দিয়ে রাখি।

মারিয়া খুশি হয়ে বলে, পারলে একটু করে রাখো। সে গ্যারেজের চাবি নিয়ে সভেল এনে দরজার সামনে পরিষ্কার করে বলে, আমার গাড়ি না সরালে ওরা বরফ পরিষ্কার করতে পারবে না। মারিয়া বলে, ওদের জন্য অপেক্ষা করো। পুরা বাড়িতে মারিয়া একা থাকে এবং বেজমেন্টে প্রদীপকে রেখেছে এই ভেবে যে বাসা খালি রাখা ঠিক না, তা ছাড়া সময়-অসময় দরকার হতে পারে।

মারিয়ার দুই মেয়ে এবং এক ছেলে কেউ মারিয়ার সঙ্গে থাকে না। ওরা যার যার নিজস্ব সংসার নিয়ে আলাদা থাকে এবং মাঝেমধ্যে মাকে এসে দেখে যায়। তার স্বামী নিকোলাস মারিয়ার সঙ্গে বনিবনা হয়নি, যে জন্য সে ডিভোর্স নিয়ে গত ১০ বছর আলাদা থাকে।

নিকোলাস ১৯৪৬ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর ইতালি থেকে শিপে অনেকের সঙ্গে একত্রে কানাডা রিফিউজি হিসেবে এসেছে। সে সময় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে এ দেশে লাখ লাখ লোক রিফিউজি হিসেবে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করেছে। তাদের অধিকাংশই অন্টারিও, ভ্যাঙ্কুভার, আলবার্টা, সাস্কাচুয়ান আরও অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। যে জন্য কানাডাকে বলা হয় রিফিউজি কান্ট্রি। নিকোলাস পরে দেশে গিয়ে বিয়ে করে মারিয়াকে নিয়ে এসেছে। ওই সময় এখানে নিজের পছন্দমতো কোনো কাজ পাওয়া যেত না। যেখানে যা পেত করে জীবন বাঁচাত। নিকোলাস ও তার স্ত্রী মারিয়া আলবার্টা এবং সব শেষে অটোয়া ছেলেমেয়ের সুবিধার জন্য গিয়ে স্থায়ীভাবে বাস করে।

এ দেশে ছেলেমেয়েরা বড় হলে মা-বাবার সঙ্গে থাকে না, ওরা আলাদা থাকে। মা-বাবা অবসর জীবনে হয় বাসায় নতুবা সিনিয়র হোমে থাকে। মারিয়া বাড়ি ছেড়ে সিনিয়র হোমে থাকা পছন্দ করে না। সে বলে, তার প্রতিবেশীরা তার আপনজন, সবাই খোঁজখবর নেয়, তাই সে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বা সিনিয়র হোমে যেতে চায় না। যদিও ডিভোর্স নিয়েছে, নিকোলাস মাঝেমধ্যে এসে মারিয়াকে বাজার করে দিয়ে খোঁজখবর নিয়ে যায়। মারিয়া বলে, আমরা ডিভোর্স নিয়েছি, তবে এখনো ও বন্ধু হিসেবে একে অপরের খোঁজখবর নিই।

মারিয়া বলে, আমরা যে সময় এ দেশে এসেছি, সে সময় কানাডার কোনো শহরই ততটা সম্প্রসারণ হয়নি। শহর ছিল ছোট এবং কাজের সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টিও হয়নি। যে যা পেত কোনো রকমে জীবন ধারণ করত; তবে সে সময় বাড়িঘর ও খাওয়া খাদ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ছিল। এ দেশে এত ব্যাপক স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটি ছিল না।

প্রদীপ মারিয়াকে বলে, আমি এখানে একা একা কী করি; বরং আংকেলের বাসায় গিয়ে দিনটা কাটিয়ে আসি। মারিয়া বলে, শুচিতা কি আজ ছুটি কাটিয়েছে?

হ্যাঁ। তাহলে যাও গল্প এবং খাওয়াদাওয়া করে দিনটি কাটিয়ে এসো।

দিনের ১০টার দিকে বাইরের লোক এসে বাসার ড্রাইভওয়ে পরিষ্কার করার পর প্রদীপ গাড়ির স্নো পরিষ্কার করে আস্তে আস্তে পিৎজা নোভায় গিয়ে দুইটা লার্জ সাইজ পিৎজা ও কোক নিয়ে শুচিতাদের বাসায় গিয়ে দুপুরের লাঞ্চ টাইমে উপস্থিত। ধ্রুব প্রদীপকে দেখে চিৎকার করে বলে, আংকেল পিৎজা এনেছে, পিৎজা এনেছে। সবাই হাসে এবং বলে, পিৎজা ধ্রুবর পছন্দের, দেখো তোমাকে দেখে কী রকম চিৎকার শুরু করেছে।

শুচিতা বলেছে, মা, আজ একটু খিচুড়ি রান্না করো, তাই আভা আজ খিচুড়ি রান্না করেছে। প্রিতম হাসতে হাসতে বলে, ভালোই হলো তুমি এসেছ। খেতে বসে প্রদীপ বলে, আমি বরাবরই আন্টির হাতের রান্না পছন্দ করি। আমি যে সময় এ বাসায় থাকতাম অনেক সময় খিদে লাগলে রাতে ঘুম থেকে উঠে গিয়ে নিজে ফ্রিজ খুলে কিছু খেয়ে নিতাম। কাউকে কিছু বলতাম না। শুচিতা হেসে বলে, আমি টের পেতাম, তবে কিছুই বলতাম না।

বিকেলে আবহাওয়া একটু পরিবর্তন হলে শুচিতা বলে, প্রদীপ, ধ্রুবকে নিয়ে চলো আমরা একটু শপিং মল থেকে ঘুরে আসি।

প্রদীপ বলে, চলো যাই। ধ্রুবর কাপড় নেই, ওর জন্য দেখি কী কেনা যায়। ওরা ঘুরতে ঘুরতে ধ্রুবর জন্য কিছু কাপড় কিনে রেস্টুরেন্টে গিয়ে রাতের খাওয়া খেয়ে প্রিতম ও আভার জন্য কিছু খাবার এনে বাসায় এসে প্রদীপ বলে, আমি বাসার দিকে যাই।

আভা বলে, কেন না খেয়ে যাবে?

প্রদীপ বলে, আন্টি, আমরা বাইরে খেয়ে এসেছি এবং তোমাদের জন্য খাবার এনেছি।

আভা বলে, তোমরা আমাকে বলবে না? আমি তোমাদের জন্য রান্না করেছি। শুচিতা বলে, মা, আমি জানতাম না। ধ্রুব বাইরে খাবে তাই প্রদীপ আমাদের রেস্টুরেন্টে নিয়ে খাওয়াইছে এবং তোমাদের জন্যও এনেছে।

আভা বলে, প্রদীপ, তোমাকে কালকের জন্য খাবার দিয়ে দিচ্ছি। তুমি একা থাকো, ফ্রিজে রেখে দেবে এবং কাল খেতে পারবে।

আন্টি, আমার ফ্রিজেও খাবার আছে, তা ছাড়া মারিয়া একা থাকে সব সময় কিছু না কিছু রান্না করলে আমার সঙ্গে শেয়ার করে। আপনি দিতে চান, না করব না। তবে বেশি কিছু দেবেন না।

ঠিক আছে কমই দেব। সব ধরনের খাবার মিলিয়ে এক দিনের খাবার দিয়ে বলে, ফ্রিজে রেখে দিয়ো এবং কাল বের করে খাবে।

আন্টি, আপনি যা দিলেন আমার দুই দিন আর রান্না করতে হবে না। ধ্রুবকে একবার কোলে নিয়ে আদর করে বলে, এবার যাই। ধ্রুব হাত উঠিয়ে বলে নুব।

প্রদীপ গাড়ি চালাচ্ছে আর মনে মনে ভাবছে দেশে মা-বাবা, ভাইবোনকে ফেলে এসে এখানে আংকেল-আন্টি ও শুচিতাকে পেয়ে যাক কিছুটা সময় ভালো যাচ্ছে।

প্রদীপ বাসায় ফিরে আসার পর মারিয়া বলে, তোমার দিনটা কেমন কাটছে?

হ্যাঁ, ভালো কাটছে।

সুমিতের সঙ্গে শুচিতার আজকাল বিশেষ কথাবার্তা হয় না। সুমিত অসুস্থ, মন থেকে ভেঙে পড়েছে এবং শুচিতা কল দিলে ও অনেক সময় সে ফোন হ্যাং আপ করে। সুমিত মনে করে শুচিতা মন থেকে প্রদীপকে ভালোবাসে এবং ওকে সব সময় ওর সঙ্গে চলাফেরা করে বলে অনেকে দেখেছে।

রাতে শুচিতা সুমিতকে কল দিয়ে বলে, তুমি কেমন আছ?

সুমিত বলে, তুমি আজ এক মাস আমার কোনো খোঁজখবর নাওনি। শুচিতা বলে, আমি এটা-সেটা নিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলাম যে জন্য তোমার কোনো খবর নিতে পারিনি।

সুমিত বলে, তোমার এমন কী ব্যস্ততা যে পাঁচ মিনিটের জন্যও কল দিয়ে খোঁজ নিতে পারোনি। এই বলে টেলিফোন রেখে দেয়।

শুচিতা পুনরায় কল দিলে সুলতা টেলিফোন উঠিয়ে বলে, কী খবর, তুমি কেমন আছ?

আমরা ভালো। সুমিতকে টেলিফোন করেছিলাম, সে টেলিফোন রেখে দিয়েছে।

সুলতা বলে, ওর মেজাজ ভালো নেই। এখন তোমাকে গালিগালাজ করবে। তার চেয়ে তুমি এখন রেখে দাও এবং পরে মেজাজ ঠান্ডা হলে কল দিয়ো।

শুচিতা টেলিফোন রেখে দিয়ে আভাকে বলে, মা, তোমরা বলো সুমিতের সঙ্গে কথা বলতে ওকে টেলিফোন করেছিলাম। সে টেলিফোন রেখে দিয়েছে।

আভা বলে, তোমার যেভাবে ভালো হয় সেভাবেই চিন্তা করে চলবে, আমরা তোমার কোনো কাজে কোনো দিন বাধা দিইনি এবং আজও দেব না।

পরদিন অফিসে গিয়ে মনিকা ও আজিজের সঙ্গে লাঞ্চ ব্রেকে বসে শুচিতা বলে, সুমিতের অবস্থা ভালো নেই, কাল টেলিফোন করেছিলাম, ও জবাব না দিয়ে টেলিফোন রেখে দিয়েছে। মনিকা বলে, ও টেলিফোন উঠিয়ে তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আমাদের কাছে। সুমিত বলে, তুমি প্রদীপের সঙ্গে আজকাল বেশি বেশি ওঠাবসা করো। তুমি এমনকি তোমার ছেলে ধ্রুবকেও নিয়ে দেখাতে যাও না।

শুচিতা বলে, তুমি কি এসব বিশ্বাস করো?

আমরা বলি, সুমিত, তুমি ভালো হয়ে চাকরি করে নিজে বাসা নিয়ে আলাদা থাকো, আস্তে আস্তে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সুমিত আপনা আপনি বকবক করতে থাকে। আমার মনে হয় সে প্রথম থেকেই কাজ খোঁজ করেনি বা এ ব্যাপারে উদাসীন ছিল। নতুবা এ দেশে পড়াশোনা করলে কাজ হবে না কেন?

কিন্তু সেভাবে সে চিন্তাভাবনা করেনি এবং সব সময় তোমার পেছনে লেগে ছিল। সে তো তুমি সবই দেখলে, আমি আর তোমাকে কী বলি। ওর ব্রেন অপারেশন, দুইবার হার্ট অ্যাটাক, ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে। তা ছাড়া মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে, যে জন্য কোনো কিছু ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করতে পারে না। এসব চিন্তা করলে আমার আপনা আপনি কান্না পায়, কিছুই ভালো লাগে না। শুধু একা একা কাঁদতে ইচ্ছা করে।

শুচিতা, সুমিত তোমাকে বিশ্বাস করে না। এটা সবচেয়ে বড় সমস্যা, যে জন্য তোমাদের একত্রে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। তা ছাড়া ও যে ধরনের অসুস্থ এবং তার ফ্যামিলি সাপোর্ট দিচ্ছে না। তুমি কীভাবে ওদের সঙ্গে থাকবে?

তুমি তো সবই আমার কথা বললে, আমি আর কী বলি?

শুচিতা লাঞ্চ বিরতি শেষ করে নিজের টেবিলে গিয়ে কাজ করে।

সুলতা বিকেলে কলেজ থেকে বাসায় না গিয়ে ধ্রুবকে দেখতে এসেছে। আভা ও প্রিতম ওকে দেখে বলে, তুমি কেমন আছ?

আন্টি, আমরা ভালো আছি, তবে দাদা ভালো নেই।

আভা বলে, জানি, কিন্তু সে কি ঠিকভাবে চিকিৎসা নিচ্ছে?

ওর ব্লাড প্রেশার আজকাল অনেক ওঠানামা করে। কোনো সময় হাই কোনো সময় লো থাকে। ডাক্তার ওষুধ দিচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই শরীরে স্বাভাবিক তাপমাত্রা আসে না। দুইবার বাথরুমে গিয়ে পড়ে গেছে এবং অ্যাম্বুলেন্স কল করে একবার হাসপাতালে নিয়ে সারা রাত রেখেছে এবং বিভিন্ন টেস্ট করে বাসায় পাঠিয়েছে। আর একবার ওকে বাসায় দেখে বলেছে, ফ্যামিলি ডাক্তারের কাছে যেতে। ও ফ্যামিলি ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না এবং ঠিকভাবে ওষুধ নেয় না।

শুচিতা ঘরে ঢুকতেই ধ্রুব দৌড়ে এসে দরজা খুলে বলে, মা, সুলতা এসেছে।

সুলতাকে খেতে দিয়েছ?

না, সুলতা খায়নি। ধ্রুব রোজকার মতো শুচিতার জুতা নিয়ে জায়গামতো রেখে দিয়েছে। সুলতা দেখে হাসে এবং বলে, দেখো মায়ের কেমন ভক্ত?

হ্যাঁ, ও আমার জুতা-স্যান্ডেল গুছিয়ে রাখতে জানে। তা ছাড়া আমার জামাকাপড় বেডের ওপরে দেখলে নিয়ে বলে, আমি হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখব। সবাই ওকে নিয়ে হাসে এবং বলে, ধ্রুব, তুমি অনেক কাজের।

শুচিতা সুলতাকে বলে, তুমি কেমন আছ?

হ্যাঁ, আমি ভালো আছি।

তুমি কেমন আছ?

ভালো, তুমি কখন এসেছ?

এই তো কয়েক মিনিট।

ধ্রুব শুচিতার ব্যাগ হাত থেকে নিয়ে বেডরুমে রেখে দিয়ে বলে, মা, তুমি হাত-মুখ ধুয়ে খেতে এসো, রান্না হয়েছে।

আচ্ছা, ঠিক আছে।

শুচিতা কাপড় ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে টেবিলে গিয়ে বসতেই আভা খাবার লাগিয়ে দিয়ে বলে, সুলতা, তুমি খেতে এসো। সুলতা বলে, আন্টি, আমি এখন খাব না, আমি আসছি একটু দেখা করার জন্য। শুচিতা বলে, এসো খাই আর কথা বলি। ধ্রুব গিয়ে সুলতাকে হাতে ধরে বলে, সুলতা, খেতে এসো। সুলতা বলে, ঠিক আছে, তুমি যখন বলছ, না খেয়ে কি থাকতে পারি? আমি বাইরে থেকে এসেছি, হাত-মুখ ধুয়ে খেতে আসি।

আভা আজ মুরগির মাংস, সবজি আর ডাল রান্না করেছে। প্রিতম বলে, সুলতা এসেছে আজ অতি সাধারণ খাবার। শুচিতা বলে, মা তো জানে না ও আসবে। সুলতা বলে, অত্যন্ত ভালো খাবার, এর চেয়ে আর বেশি কী খাব?

এক সপ্তাহ স্নো ছিল, আজ স্নো না থাকলেও রাস্তা বরফে অতিরিক্ত পিচ্ছিল এবং ঠান্ডা। এই ঠান্ডায় ঘর থেকে কারও বের হতে ইচ্ছে করে না। প্রিতম বলে, এটা ঠান্ডার দেশ, গাড়ি, বাড়ি, বাস, শপিং প্লাজা এবং কলে কারখানা সর্বত্রই তাপ দেওয়া থাকে। এ দেশের মানুষ ঠান্ডায় অভ্যস্ত, কলকারখানা ২৪ ঘণ্টা চলে। এই ঠান্ডায়ও কেউ ঘরে বসে থাকে না। এখানে এক দিকে তুষার পড়ে আরেক দিকে মিউনিসিপ্যালিটির লোক স্নো ব্লোয়ার দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করে এবং ওপর দিকে লবণ দিয়ে বরফ গলানো হয়। পরিষ্কার না করলে লোকজনের চলাচলের ব্যাঘাত ঘটে, অ্যাকসিডেন্ট হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। সুলতা বলে, আংকেল, এ দেশের বরফ সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার না করলে মানুষ ঘরে আটকা পড়বে।

রাতের ডিনারের পর সুলতা বলে, আমি বাসে বাসায় চলে যাব। প্রিতম বলে, এই ঠান্ডার মধ্যে তুমি বাসে যেতে পারবে না।

না আংকেল, আমি এক ব্লক হেঁটে গেলে বাস পাব।

শুচিতা বলে, না, বাবা তোমাকে গাড়ি দিয়ে নামিয়ে দেবে। বাবা, তুমি গাড়ি দিয়ে ওকে দিয়ে এসো। ধ্রুব বলে, আমি যাব।

ধ্রুব, তুমি কোথায় যাবে এই ঠান্ডায়?

সে আমি যাব বলে চিৎকার করে জামাকাপড় বের করে। শুচিতা বলে, ওকে রেখে যাওয়া যাবে না। বাবা, তোমরা যাবে ওকে গাড়িতে বসিয়ে রাখো এবং ১০ মিনিট পর চলে আসবে এই বলে ওকে গরম কাপড় পরিয়ে তৈরি করে বলে যাও ওদের সঙ্গে।

আভা বলে, আমি একটু দোকানে যাব কিছু কেনাকাটা লাগবে। সুলতাকে বিল্ডিংয়ের সামনে নামাতেই সে বলে, আংকেল, আপনারা ওপরে আসেন?

প্রিতম বলে, আজ নয় আর একদিন সুমিতকে দেখতে আসব। ওরা সুলতাকে নামিয়ে দিয়ে বাজার করে চলে আসবে। গ্রোসারি স্টোরের পার্কিং লটে গাড়ি পার্কিং করে বের হতেই ধ্রুব বরফের কুণ্ডলী পাকিয়ে খেলা শুরু করে। আভা বলে, ওটাই আসল, ও ঘরে থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে গেছে। তাই বাইরে আসার জন্য চিৎকার শুরু করেছে।

অতিরিক্ত ঠান্ডা। ধ্রুব, চলো ভেতরে যাই। কিন্তু ধ্রুব বরফ নিয়ে খেলবে। প্রিতম বলে, আভা তুমি ওকে নিয়ে এসো, আমি ভেতরে ঢুকি।

ধ্রুব ভেতরে ঢুকেই তার পছন্দের চকলেট, আইসক্রিম, বিস্কুট সেলফ থেকে নিয়ে বাস্কেটে ঢোকাচ্ছে। প্রিতম এবং আভা দেখে হাসে এবং বলে, ও জানে ওর পছন্দের জিনিস কোথায় থাকে। ওরা বাজার সেরে টিম হর্টন গিয়ে ডোনাট ও কফি নিয়ে বাসায় এসে বলে, এই দেখো শুচিতা, ধ্রুব কী কী এনেছে?

শুচিতা বলে, ধ্রুব জানে দোকানে কোন সেলফে কী কী আছে এবং উঠিয়ে নিয়ে বাস্কেট ভর্তি করে।

তাই না ধ্রুব?

ও হাসে।

ধ্রুব ব্যাগ থেকে সব বাজার নামিয়ে ওর পছন্দের ডোনাট বের করে শুচিতাকে বলে, খাও। কিচেন থেকে কফি কাপ এনে বলে, মাকে দাও। সবাই হাসে এবং বলে, দেখো মায়ের জন্য কত আদর। আভা বলে, আমরা সারা দিন ধ্রুবকে সামলাই। শুচিতার কিছুই চিন্তা করতে হয় না। সে সারা দিন কালার পেনসিল নিয়ে কাগজ ভর্তি করে কী কী আপন মনে আঁকতে থাকে। আবার নিজে নিজে হাসে এবং আমাদের দেখায়। যদি বলি বাহ্ কী সুন্দর হয়েছে, কী খুশি!

সুলতা বাসায় পৌঁছার পর সুমিত ও তার মা আরতি ওর সঙ্গে অনেক রাগ করে এবং বলে, তুমি কেন আমাদের না বলে শুচিতার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছ?

মা, আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে যাইনি। আমি ধ্রুবকে দেখতে গিয়েছি। ধ্রুব আমার জন্য কী রকম করল, আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না। সে আমার সঙ্গে গাড়িতে করে এসে আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেছে। ও অনেক বুদ্ধিমান ছেলে এবং দেখবে ভালো করবে। সে প্রতিমুহূর্ত আমাকে তার বিভিন্ন কাজ এনে দেখিয়েছে এবং না খাইয়ে আসতে দেবে না।

ওকে ছেড়ে আমি আসতে পারি?

আরতি বলে, তুমি ওকে নিয়ে আসতে বাসায়। মা, আমি বলছি আংকেলকে ওপরে আসতে। ওরা শপিংয়ে যাবে সে জন্য ওপরে ওঠেনি এবং বলেছে, একবার আসবে।

সুমিত বলে, আমি ওদের আর দেখতে চাই না, শুচিতা এখানে এলেই ঝগড়া হয়। আমার শরীর এত খারাপ, সে একদিন একটা টেলিফোনও করে না এবং খোঁজখবর নেওয়া পছন্দ করে না।

কমল বলে, আমাদের নিজেদের দোষত্রুটিও আগে দেখা দরকার, আমি ব্যক্তিগতভাবে শুচিতার কোনো দোষ খুঁজে পাচ্ছি না। ও সারাক্ষণ কাজ করে। আমরা ওর পেছনে লেগে থাকি, যা মোটেও ঠিক না। (চলবে)