কানাডায় আসার ২০ বছরের মধ্যে দেশটি ছেড়ে যাচ্ছেন ১৫ শতাংশেরও বেশি অভিবাসী
আবাসনের চাপ বেড়ে যাওয়ায় অভিবাসন সংখ্যা স্থিতিশীল করা হচ্ছে : সীমিত করা হয়েছে স্টুডেন্ট পারমিট
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : স্ট্যাটক্যান এর এক রিপোর্টে বলা হয় পারমানেন্ট রেসিডেন্ট হিসাবে কানাডায় আসার ২০ বছরের মধ্যে দেশটি ছেড়ে যাচ্ছেন ১৫ শতাংশেরও বেশি অভিবাসী। তারা হয় স্বদেশে ফিরছেন অথবা অন্য কোনও দেশে অভিবাসী হয়ে যাচ্ছেন। নতুন এক সমীক্ষায় এই তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। স্ট্যাটক্যান এর সূত্র উল্লেখ করে গত ২ ফেব্রুয়ারি সিটিভি নিউজ এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা ১৯৮২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়কালে অভিবাসীদের অভিবাসনের বিষয়টি খতিয়ে দেখেছে, যা সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়।
সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে যে, ১৯৮২ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে আসা অভিবাসীদের ৫.১ শতাংশ এদেশে আসার পাঁচ বছরের মধ্যে অন্য কোথাও অভিবাসন নিয়েছে।
সমীক্ষা অনুযায়ী, কিছু অভিবাসী হয়তো কোনও এক পর্যায়ে কানাডা ছেড়ে যাবার পরিকল্পনা করে থাকতে পারে, তবে এই অভিবাসনের সঙ্গে কানাডার শ্রমবাজার অথবা সমাজে একাত্ম হবার ক্ষেত্রে অনেক অভিবাসী যে সঙ্কটে পড়েন তারও সম্পৃক্ততা থাকতে পারে।”
স্ট্যাটক্যান তার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলেছে, “এই সময়টা সেই মেয়াদকালের প্রতিফলন হতে পারে যে, কতটা সময় ধরে অভিবাসীরা একটি চাকরি খুঁজে পাওয়া এবং থাকার জায়গা করতে পারার অব্যাহত চেষ্টার মাধ্যমে কানাডার সমাজে একাত্ম হবার প্রয়াস পেয়েছেন।” “কিছু অভিবাসী হয়তো একাত্ম হবার ক্ষেত্রে সঙ্কটের মুখে পড়লে চলে যেতেন অথবা একারণে যেতেন যে, তারা শুরু থেকেই যাবার ইচ্ছা পোষণ করতেন।”
সমীক্ষায় দেখা যায়, অভিবাসীদের অভিবাসনের সঙ্গে কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য জোরালোভাবে সম্পর্কিত, যেমন সন্তান থাকা, এদেশে আসার ক্যাটাগরি এবং জন্মের দেশ।
যেসব অভিবাসীর কানাডা ত্যাগের সম্ভাবনা বেশি
উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, যেসব অভিবাসীর জন্ম তাইওয়ান, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, হংকং অথবা লেবাননে এবং সেইসব অভিবাসী যারা বিনিয়োগকারী এবং উদ্যোক্তা ক্যাটাগরিতে এসেছেন তাদের কানাডা ত্যাগের সম্ভাবনা বেশি। ওইসব দেশে জন্মগ্রহণকারী অভিবাসীদের ২৫ শতাংশের বেশি কানাডায় আসার ২০ বছরের মধ্যে এই দেশ ছেড়ে গেছেন। স্ট্যাটক্যান লিখেছে, “এসব দেশ তাদের নাগরিকদের কাছে অব্যাহতভাবে আকর্ষণীয় থেকে গেছে জীবনযাত্রার উচ্চ মানের কারণে কিংবা কানাডায় এসে বসবাস করা ছিল তাদের বৃহত্তর অভিবাসন কৌশলের অংশ।”
উচ্চতর শিক্ষাস্তরের অভিবাসীদের অভিবাসনের সম্ভাবনা স্বল্প শিক্ষিত অভিবাসীদের চেয়ে বেশি।
সমীক্ষায় আরও যোগ করা হয় যে, বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তা ক্যাটাগরিতে আসা অভিবাসীদেরও কানাডা ত্যাগের সম্ভাবনা সেবাদানকারী এবং উদ্বাস্তু হিসাবে আসা অভিবাসীদের চেয়ে বেশি।
বিনিয়োগকারী ক্যাটাগরিতে আসা অভিবাসীদের ৪০ শতাংশের বেশি এবং উদ্যোক্তা ক্যাটাগরিতে আসা অভিবাসীদের ৩০ শতাংশ এদেশে আসার ২০ বছরের মধ্যে দেশত্যাগ করেছে। স্ট্যাটক্যান ব্যাখ্যা করে এভাবে: “এই ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত হন ধনাঢ্য অভিবাসীরা যাদের অত্যন্ত ভ্রমণশীল থাকার প্রবণতা রয়েছে Ñ এমনকি এরা এদেশে আসার পরও Ñ ভবিষ্যতে কানাডা ছেড়ে যাবার ইচ্ছা পোষণ করে।”
এর বিপরীতে, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা অথবা জ্যামাইকায় জন্ম নেয়া অভিবাসীদের কানাডা ত্যাগের সম্ভাবনা কম। সমীক্ষায় দেখা গেছে, কানাডায় আসার ২০ বছর পর ওইসব দেশে জন্মগ্রহণকারী অভিবাসীদের ১০ শতাংশেরও কম সংখ্যক কানাডা ছেড়ে গেছেন।
সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী, যাদের কখনও সন্তান হয়নি তাদের কানাডা ছেড়ে যাবার সম্ভাবনা, সন্তান আছে এমন অভিবাসীদের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
এছাড়াও, অপেক্ষাকৃত বয়োবৃদ্ধ অভিবাসীদের কানাডা ত্যাগের সম্ভাবনা সর্বোচ্চ। ৬৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সে এদেশে আসা অভিবাসীদের মধ্যে ১০.৭ শতাংশ পারমানেন্ট রেসিডেন্সি পাবার পাঁচ বছরের মধ্যে কানাডা ছেড়েছেন।
এই সংখ্যা ২৫ শতাংশেরও বেশি হয়ে যায় এদেশে আসার ২০ বছরের মাথায়। অন্যদিকে ১৮ ও ২৪ এর মধ্যে যাদের বয়স সেইসব অভিবাসীর মাত্র ১৫ শতাংশের কিছু বেশি সংখ্যক এদেশে আসার ২০ বছরের মধ্যে কানাডা ছাড়েন।
সমীক্ষায় দেখা যায়, যেসব অভিবাসী কানাডায় থেকে যান তাদের চেয়ে কানাডাত্যাগী অভিবাসীদের রয়েছে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য।
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যে, “উদাহরণস্বরূপ, কানাডায় জন্মগ্রহণকারীদের চেয়ে সচরাচর অভিবাসীদের উচ্চস্তরের শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকায় এইসব অত্যন্ত দক্ষ শ্রমশক্তির দেশত্যাগ কানাডার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর নির্দিষ্ট নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।”
‘ধরে রাখার হার বেশ উঁচু’
অন্টারিওর কিংস্টনের কুইন্স ইউনিভার্সিটির পলিসি স্টাডিজ স্কুলের সহযোগী অধ্যাপক ডন ড্রামন্ড বলেন, কানাডার “অভিবাসী ধরে রাখার হার বেশ উঁচু” এবং তিনি মনে করেন, সমীক্ষায় উদ্ঘাটিত তথ্যগুলি তুলে ধরেছে যে, কানাডার একটি “সাফল্যের কাহিনী” আছে।
এক ই-মেল বার্তায় তিনি সিটিভিনিউজ.সিএ-কে বলেন, “বিপরীত প্রেক্ষিতে তাকালে দেখা যাবে, ৯৫ শতাংশ অভিবাসী প্রথম কয়েক বছর অবস্থান করেছেন এবং ৮৩ শতাংশ থেকেছেন ২০ বছর ধরে।”
তিনি বলেন, একই সময়ে, সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে, কানাডার একটি ব্যাপক অর্থনৈতিক একীকরণ কৌশল রয়েছে।”
তিনি লিখেছেন, “বিদেশী সার্টিফিকেটের স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে মন্থরতা এবং চরম পর্যায়ের ব্যর্থতা তালিকায় বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। “কিন্তু এখানেও অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে, যার প্রমাণ মেলে বিদেশী নার্সদের সার্টিফিকেটের স্বীকৃতিদানের মধ্যে। এই অগ্রগতি অর্জনে যে দীর্ঘ সময় লেগেছে সেটি অত্যন্ত দৃষ্টিকটু।”
তার ওপর, তিনি বলেন, কানাডার আবাসন সঙ্কটের নিরসন দরকার। “এটি বিশেষ করে অভিবাসীদের ক্ষেত্রে গুরুতর, যারা সংখ্যাগুরু, যারা বৃহত্তর মেট্রোপলিটন এলাকায় বাস করতে চায়।” তিনি লিখেছেন, “কানাডায় বাড়ি এবং এমনকি বাড়িভাড়াও অত্যন্ত চড়া। ক্যালিফোর্নিয়া ও নিউ ইয়র্কের অল্প কিছু এলাকা ছাড়া কানাডায় আবাসন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল। অভিবাসীদের বৃহৎ সংখ্যা আবাসনের চাহিদা বাড়িয়ে দেওয়ায় সঙ্কট আরও বেড়েছে।”
আবাসনের চাপ বেড়ে যাওয়ায় অভিবাসন সংখ্যা স্থিতিশীল করা হচ্ছে
এদিকে গৃহায়ন মন্ত্রী সিন ফ্রেসার ও অভিবাসনবিষয়ক মন্ত্রী মার্ক মিলার বলেছেন, আবাসন খাতে চাপ বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার প্রতি বছর এদেশে নিয়ে আসা মানুষের সংখ্যায় স্থিতিশীলতা আনার লক্ষে কাজ করছে।
২০২২ সালের অভ্যন্তরীণ নথিপত্রের ওপর ভিত্তি করে দি কানাডিয়ান প্রেস গত ১১ জানুয়ারী রিপোর্ট করেছে, যাতে দেখা যায়, অভিবাসন দপ্তরের কর্মচারীরা তাদের ডেপুটি মন্ত্রীকে সতর্ক করেছেন যে, অভিবাসনে বড় ধরণের বৃদ্ধি ঘটানো হলে গৃহায়ন ও পরিষেবার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
কেন্দ্রীয় সরকার চূড়ান্ত পর্যায়ে কানাডায় প্রতি বছর স্বাগত জানানো পারমানেন্ট রেসিডেন্টের সংখ্যা ২০২৫ সালে পাঁচ লাখে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়Ñ যা ২০১৫ সালের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।
সম্প্রতি প্রকাশ করা এক যৌথ বিবৃতিতে লিবারেল দলের দুই মন্ত্রী অভিবাসন স্তর উন্নীত করার সিদ্ধান্তের পক্ষাবলম্বন করেন এবং যুক্তি দেখান যে, অভিবাসন কানাডার মহামারী-উত্তর পুনরুদ্ধার কর্মসূচিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, “মহামারীর পর আমরা অভিবাসন বৃদ্ধি না করলে অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়ে পড়তো। চরম শ্রমিক সঙ্কটের মুখে পড়া ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ হয়ে যেত। স্বাস্থ্যসেবাসহ যেসব সামাজিক পরিষেবা কানাডীয়দের প্রয়োজন সেগুলির প্রাপ্যতা আরও বিলম্বিত হতো অথবা কঠিনতর হয়ে পড়ত।”
তবে মন্ত্রী মিলার ও ফ্রেসার এটাও বলেন যে, আবাসন সংক্রান্ত চাপ সরকারকে তার অভিবাসন এবং একইসঙ্গে অস্থায়ী রেসিডেন্ট গ্রহণের লক্ষমাত্রা সমন্বয় করার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
মিলার ২০২৬ সালের জন্য কানাডায় আসা পারমানেন্ট রেসিডেন্টের সংখ্যা পাঁচ লাখে সমান রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা ২০২৫ সালের মত একই।
স্টুডেন্ট পারমিট দুই বছরের জন্য সীমিত করা হয়েছে
শুধু অভিবাসন নয়, কানাডায় তীব্র আবাসন সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকার স্টুডেন্ট পারমিট দুই বছরের জন্য সীমিত করেছে। সিবিসি নিউজ এই তথ্য জানায়।
গত জানুয়ারি মাসে অভিবাসনবিষয়ক মন্ত্রী মার্ক মিলার ঘোষণা করেছেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার আগামী দুই বছরের জন্য স্টুডেন্ট পারমিট দেয়া সীমিত রাখবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষিত লক্ষ এবং আবাসন বাজারে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ওপর ক্রমবর্ধমান বিরূপ প্রভাব নিয়ে সৃষ্ট উদ্বেগের প্রেক্ষিতে এমন ঘোষণা এলো।
সরকার বলছে, ২০২৪ সালে তারা তিন লাখ ৬০ হাজারের মত আন্ডারগ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট পারমিট অনুমোদন করবে। অর্থাৎ পারমিটের সংখ্যা ২০২৩ সালের চেয়ে ৩৫ শতাংশ কমানো হবে।
মোট হ্রাসকৃত সংখ্যা প্রতিটি প্রদেশ ও টেরিটোরির মধ্যে বণ্টন করা হবে শিক্ষার্থীদের সংখ্যার ভিত্তিতে। কেন্দ্রীয় সরকার বলেছে, এর ফলে “যেসব প্রদেশে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সর্বাধিক অনিশ্চিত প্রবৃদ্ধি হয়েছে সেসব প্রদেশে পারমিটের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পাবে।”
মিলার বলেন, কয়েকটি প্রদেশে পারমিট হ্রাসের মোট পরিমাণ আনুমানিক ৫০ শতাংশ হবে।
প্রদেশ ও টেরিটোরিগুলো প্রদত্ত পারমিট তাদের আওতাধীন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কীভাবে বণ্টন করবে সে সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারবে। পারমিট সীমিত করা হচ্ছে দুই বছরের জন্য; ২০২৫ সালে কতগুলি পারমিট দেওয়া হবে তা চলতি বছর শেষে পুনর্মূল্যায়ন করা হবে।
মিলার বলেন, সীমিতকরণ আরোপের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার কিছু ছোট ছোট প্রাইভেট কলেজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
মিলার বলেন, “কিছু প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান ক্যাম্পাসে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা ও শিক্ষার্থীদের সহায়তার ব্যবস্থা নিশ্চিত না করে এবং তাদের কাছ থেকে উচ্চহারে টিউশন ফি আদায় করে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছে, এমনকি তাদের আন্তর্জাতিক ছাত্র ভর্তির কোটার অতিরিক্ত ছাত্র ভর্তি করেছে যা গ্রহণযোগ্য নয়।”
সিবিসির পাওয়ার অ্যান্ড পলিটিক্স অনুষ্ঠানে সোমবার দেয়া সাক্ষাৎকারে মিলার কানাডায় থাকার আশা করেন এমন শিক্ষার্থীদের ভুয়া ব্যবসায়িক ডিগ্রি দেয় এমন ডিগ্রি বিক্রির প্রতিষ্ঠানের বিষয়েও কথা বলেন। মন্ত্রী বলেন, কানাডায় এ ধরণের “শত শত” শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সক্রিয় থাকতে পারে এবং “গত কয়েক বছরে এ সংখ্যায় বিস্ফোরণ ঘটেছে।”