আমি মারা গেলে আমার জন্য কেউ কী কষ্ট পাবে!
জসিম মল্লিক
১৯৮৩ সাল থেকে প্রকৃত বাঁচার জন্য লড়াই শুরু হয় আমার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, বাড়ি থেকে টাকা পয়সা নিব না। মা এবং মেঝ ভাইয়ের উপর চাপ তৈরী করতে চাই না। মা চেয়েছিলেন আমি যেনো কোথাও না যাই। বরিশালে থেকেই পড়াশুনা করি। মাকে খুশী করার জন্য বরিশাল বিএমকলেজে ভর্তিও হয়েছিলাম। কিন্তু একটা সময়ে আমাকে আর আটকে রাখা যায়নি। বরিশাল ছাড়ার জন্য মন আকুলি বিকুলি করছিল। কেনো বরিশাল ছাড়তে চাই, কেনো ঢাকা চলে যেতে চাই নিজেও জানি না। শুধু জানি আমাকে ঢাকা যেতে হবে। যদিও ঢাকায় আমার কেউ নাই। ঢাকা শহরটা চিনিও না ঠিকমতো। মানুষজন কাউকেই চিনিনা, আমাকেও কেউ চেনে না। তারপরও এক কাক ভোড়ে সদরঘাট নামলাম লঞ্চ থেকে। আসার পর থেকেই শুরু হলো এক লড়াই। অনন্ত লড়াই। একটা দুইটা শার্ট, প্যান্ট, একজোড়া জুতা সম্বল করে পথচলা শুরু হয়। একবেলা খাই তো আর এক বেলা স্রেফ উপোস দেই। প্রায়ই ভাবি বরিশাল ফিরে যাব কিন্তু যাওয়া হয় না। ১৯৮৩ সালে তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কন্ট্রিবিউটার হিসাবে কাজ শুরু করি। সেটাই আমার অফিসিয়াল ইনকামের শুরু। পয়সার জন্য তখন অন্যান্য পত্রিকায়ও লিখতাম। কিছুদিন টিউশানিও করেছি।
সেই যে শুরু হয়েছে জীবন সংগ্রাম আজও থামেনি। বাষট্টি পূর্ণ হয়েছে আমার। বাইশ বছর বয়সে শুরু করেছিলাম সেই থেকে ননস্টপ চল্লিশ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছি। বাঁচার জন্য, স্বাচ্ছন্দের জন্য করতে হচ্ছে। ৬৫তে কানাডায় অফিসিয়াল রিটায়ার করার আদর্শ সময়। মাঝে মাঝে নিজেকে ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত করতে চাইনা। শেষ ইচ্ছা হচ্ছে শুধু ঘুরে বেড়াব। যে সব দেশে যাইনি সে সব দেশে যাব। কত স্বপ্নইতো মনের মধ্যে লালন করি। সব স্বপ্ন কী পূরণ হবে! আমার ছেলে মেয়েরাও চাচ্ছে আমি ঘুরে বেড়াই। লাইফ এনজয় করি। আমি বাইশ বছর বয়সে শুরু করলেও আমার ছেলে মেয়েরা শুরু করেছে আরো কম বয়সে। স্কুলে থাকতেই সামার জব দিয়ে কর্মসংস্থানের শুরু। পনেরো বছর বয়স থেকে কখনও আমার কাছ থেকে টাকা পয়সা চেয়ে নেয়নি। নিজেদের খরচ নিজেরাই চালিয়েছে। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কাজ করেছে দুজনেই। সেই তুলনায় ওদের সংগ্রাম আমার চেয়ে কম নয়। যদিও এটাই এখানকার কালচার। বাবা মায়ের উপর ডিপেডেন্ট হতে চায় না, যেমন হতে চাইনি আমি।
অবসর জীবন কেমন হবে সেটা ভেবে শঙ্কিত হই মাঝে মাঝে। যখন বৃদ্ধ হব তখন কি ওল্ডহোমে যেতে হবে! সেখানে কেমন লাগবে! গল্প করার সঙ্গী পাব! বা অসুস্থতায় যদি ভুগি কে পাশে থাকবে! কেউ কী থাকবে! ছেলে মেয়ে স্ত্রী! কে জানে। যখন আমরা তরুণ থাকি তখন বার্ধ্যেেকর কথা ভাবি না। বুঝতেও পারি না একদিন সময় ঘনিয়ে আসবে। জ্বরা, রোগ, শোকে আক্রান্ত হবো। নিঃসঙ্গতা ঘিরে ধরবে। তবে শরীরের বয়স যাই হোক মনের বয়স বাড়তে দেওয়া যাবে না। দুঃশ্চিন্তা, স্ট্রেস এসব ছুড়ে ফেলে দিয়ে মনকে প্রফুল্ল রাখতে হবে। সুস্থ্য থাকতে হবে। যা করতে ভাল লাগে তাই করতে হবে। যাকে ভাল লাগে তার সাথে মিশতে হবে। আবর্জনা বর্জন করতে হবে। তবে ওল্ড এজে কিছুতেই বিদেশে থাকব না। কেউ পাশে থাকুক আর না থাকুক নিজের জন্মস্থানে ফিরে যাব। সেই প্রক্রিয়া শুরু করেছি। অনেকেই বলে কানাডায় চিকিৎসার জন্য হলেও থাকতে হবে। আমি সেটা মানি না। আমার দেশেও অনেক ভাল চিকিৎসা আছে। অনেক ভাল ডাক্তার আছে। শুধু চিকিৎসা যে কেবলই বাণিজ্য নয় মানবসেবাও সেই বোধ তৈরী হতে হবে। দেশে ফিরে গিয়ে মানবসেবায় নিয়োজিত করব নিজেকে। সুস্থ্যভাবে যেনো আমার মৃত্যু হয়, ঘুমের মধ্যে এই স্বপ্ন আমার। আল্লাহ নিশ্চয়ই আমার ইচ্ছা পূরণ করবেন।
আমার শৈশব, কৈশোরকালটা যতই সাদামাটা থাকনা কেনো সেখানে ভালবাসার কোনো কমতি ছিল না। সাধারণ এক কিশোর ছিলাম আমি কিন্তু সেটাই ছিল বিরাট আনন্দের। তখন আমার মা ছিল, ভাই বোনরা ছিল, খেলার সাথীরা ছিল। মনের মধ্যে সবসময় একটা আনন্দের শিহরন কুল কুল করে বয়ে যেতো। মা ছিল বলে নিজেকে কখনও অসহায় মনে হয়নি। মনে হতো আমি কখনও একলা না। মনে হতো আমার মা পাশে আছে। সবার ছোট ছিলাম বলে মা চোখে চোখে রাখত। মা ছিল আমার শক্তির জায়গা। মা যতদিন বেঁচে ছিল যত দূরেই ছিলাম কোনো শূণ্যতা অনুভব করিনি। বড় হয়ে সংসার শুরু করার পরও মায়ের কাছে সবসময় বুদ্ধি পরামর্শ নিতাম। এখন যেমন অর্ক অরিত্রির কাছ থেকে পরামর্শ নেই। ওরা ঠান্ডা মাথার মানুষ। সঠিক পরামর্শ দিতে পারে। ওদের কাছে গেলে মনে হয় যেনো আবার ছোট হয়ে গেছি। শৈশবে ফিরে গেছি। সোনাঝড়া শৈশব। আবার শিশু হয়ে কোলে ফিরে গেছি যেনো। খেলার সাথীদের যেনো দেখতে পাই চোখ বন্ধ করলেই।
আগে অনেক ব্যাপার নিয়েই মাথা ঘামাতাম, কখনও কখনও জড়িয়ে পড়তাম। কখনও প্রকাশ্যে কখনও মনে মনে। কেউ একটা অন্যায় করছে প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়তাম, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরতাম। কেউ আমার সাথে খারাপ আচরণ করছে, অপমান করছে প্রতিক্রিয়া দেখাতাম। কেউ পিছনে কুৎসা রটনা করছে মেজাজ বিগরে থাকত। কেউ ভুল বুঝছে ভুল ভাঙ্গানোর জন্য চেষ্টা করতাম। সবার সাথে ব্যালেন্স করতে চাইতাম। কেউ একজন লেখা চাইছে পত্রিকার মান বিচার না করেই লেখা দিয়ে দিতাম। জগতের মানুষের যত সমস্যা সব যেনো আমার একলার। কেউ কাজ পাচ্ছে না তার জন্য কাঁজ খুঁজছি, নিজের জন্য না, অন্যের জন্য মানুষের কাছে রিকোয়েষ্ট করছি। সেটা কি দেশে কি বিদেশে। কেউ একজন বই প্রকাশ করবেন, প্রকাশক খুঁজে দেওয়ার কাজ করছি। কারো সাহায্য দরকার সাহায্য করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যাই, কারো চিকিৎসা দরকার সে চিন্তা আমার। কেউ বাসা ভাড়া দিতে পারছে না তাও আমার সমস্যা। কারো বাসা ভাড়া দরকার, বাসা খুঁজে দেওয়ার দ্বায়িত্ব আমার। এমনি অনেক কিছু আমি আমার উপর চাপিয়ে দেই। নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় পাইনা।
কেউ একজন দেশ থেকে এসেছে তাঁকে এয়ারপোর্ট থেকে পিকআাপ করা, তাঁকে সময় দেওয়া, বেড়ানো, আপ্যায়ন করা এসব দ্বায়িত্ব আমার। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো, গিফট দেওয়া এগুলোও বাদ যায় না। যখন দেশে যাই গিফট কিনে নিয়ে যাই। কার কি দরকার জানতে চাই। তাছাড়া নানা জনের নানা অনুরোধ থাকে। সবাইকেই খুশী করতে চাই। কিন্তু কেউই খুশী হয় না। দেশে গিয়েও মুক্তি নাই। সাবারই কিছু দাবী থাকে। যার আছে তারও থাকে। আমার চেয়ে ভাল আছে তারও থাকে। রেষ্টুরেন্ট খেতে বসলে প্রায়শই বিল আমি পরিশোধ করি, সেটা কি দেশে কি বিদেশে। যদিও এসব আমি আনন্দ নিয়ে করি। যখন স্কুলে পড়তাম তখন মালেক ভাইর মালাই আইসক্রিম খেতে পারতাম না, ঘটি গরম খেতে পারতাম না পয়সার জন্য। সবাই খেতো আমি দেখতাম। তাই আমি খাওয়াতে ভালবাসি। আমি যে এতো ভাবি সবার ব্যাপারে কিন্তু অবাক হয়ে দেখি আমাকে নিয়ে কেউ তেমন ভাবে না, আমাকে কারো কিছু দিতে ইচ্ছে করে না। আমি কিছু প্রত্যাশাও করি না। প্রত্যাশা করলেই কষ্ট বাড়ে। প্রত্যাশাহীন প্রপ্তিতেই লুকিয়ে থাকে আনন্দ।
যাদের জন্য আমি কিছুই করি না, করার কথা মনেও থাকে না তারাই দেখি আমার জন্য ভাবে, আমার জন্য করে। আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে কেউ কেউ আমাকে শর্তহীন ভালবাসা দেয়। এরাই হচ্ছে প্রকৃত মানুষ। এই ধরণের মানুষের বড় অভাব আজকাল। একদল আছে শুধু পেতে চায়। মনে করে এটা তাদের প্রাপ্য, তাদের অধিকার। প্রকৃতপক্ষে মানুষ নিজেকে নিয়েই বেশি ভাবে। নিজের সুখটাই আগে দেখে। ত্যাগের মানুষিকতা বেশি মানুষের নাই। খুব অল্প মানুষের সাথে আপনার মনের মিল ঘটবে। সময়ের বিচারে প্রতিফলিত হয় কে আপন, কে পর। সামান্য কারণে বা সামান্য ভুলে যদি স¤পর্ক ভেঙ্গে যায় তাহলে ধরে নিতে হবে সেটা কোনো স¤পর্কই ছিল না। সেই সম্পর্কে কোনো ফাঁক ছিল। ত্রুটি ছিল। বস্তুত মানুষ খুবই অসহায়। সে কারণে আমি আর আগের মতো সব ব্যাপারে মাথা ঘামাই না। নাক গলাই না। প্রতিক্রিয়া দেখাই না। যে যেভাবে বাঁচতে চায় বাঁচুক। যে যেভাবে সুখী হতে চায় হোক। সবাই স্বাধীন মানুষ। একক মানুষ। অনন্য মানুষ। আমি আমার পরিবারের লোকদের উপরও কখনও কিছু চাপিয়ে দেইনি। আমার উপরও কেউ কিছু চাপিয়ে দিক তা চাই না। আমাকে কন্ট্রোল করুক চাই না।
আমি কোনো পারফেক্ট মানুষ না। কেউই পারফেক্ট না। আমার অনেক ভুলত্রুটি আছে। সেগুলো মেরামতের চেষ্টা প্রতিনিয়ত করি আমি। পুরোটা পারি না। একদিকে সারাইকর কিছু কিছু মেরামত করে দিয়ে যায় অন্য দিকে আবার হারি পাতিলে টোল পড়ার মতো দাগ লেগে যায়। পৃথিবীতে কিছুই স্থায়ী না। কোনো কিছু নিয়ে বেশি বেশি ভেবে ফায়দা নেই। আকড়ে থেকে লাভ নেই। মোহ ত্যাগ করতে হবে। পৃথিবীতে কার্যকারন ছাড়া কিছুই ঘটে না। সবকিছুর পিছনেই কোনো কারণ লুকানো থাকে। তাই যা কিছুই ঘটুক সেটা মেনে নিয়েই বাঁচতে হবে। সহজভাবে নিতে হবে। বিপদ আপদ যেমন থাকে, মুক্তিও থাকে। যত বড় বিপদ হোক সেটাকে ওভারকাম করতে হবে। নিজেকে নিজের সুখী করতে হবে। কখনও কখনও নিজেকে অনেক কিছু থেকে সাসপেন্ড করতে হয়। প্রত্যাহার করে নিতে হয়। মনে রাখতে হবে সবকিছু আমাদের হাতে নেই, সবকিছু আমাদের কন্ট্রোলে নেই।
কয়দিন থেকে একটা আজব বিষয় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটা হচ্ছে মৃত্যু। মৃত্যুর পর কার কেমন প্রতিক্রিয়া হবে সেটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এমন না যে মৃত্যু কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা। মৃত্যু স্বাভাবিক। বেঁচে থাকাটাই অস্বাভাবিক। এই যে এখনও বেঁচে আছি অবাক লাগে ভাবতে। প্রতিটা দিনই যেনো এক একটা বোনাস। আমার বয়সী কতজনইতো চলে গেছে! ষাটের পর থেকেই যাওয়ার মিছিল শুরু হয়। কত বন্ধু, আত্মীয়, পরিচিতজন চলে গেছেন! অন্যের মৃত্যুর পর কার কেমন প্রতিক্রিয়া হয় সেটা নিজেই দেখতে পাই। নিজে কেমন প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করি তাও দেখি। আমার মৃত্যুর পর কেমন প্রতিক্রিয়া হবে? সেটা দেখতে পাব না বটে তবে অনুমান করতে পারি। আমার ইমাজিনেশন অনেক ভাল। তাই আমি ধারনা করতে পারি আমার মতো এলেবেলে মানুষের মৃত্যুর পর শোকের আয়ু কেমন হবে, কতক্ষণ স্থায়ী হবে। কিছু মৃত্যু আছে মনে দাগ ফেলে দিয়ে যায়। সহজে ভোলা যায় না। যেমন আমার মায়ের মৃত্যু, আমার বোন সাজুর মৃত্যু, আমার বড় ভাইয়ের মৃত্যু, তার মেয়ে মৌরির মৃত্যু। আসলে যার সাথে যার এটাচমেন্ট বেশি থাকে তার মৃত্যুই বেশি কষ্ট দেয়। স্মৃতিগুলো হানা দেয়। আমি খুবই স্মৃতিকাতর মানুষ। সামান্য ঘটনা অসামান্য হয়ে মনে বাজে।
যেমন হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। তিনি কেনো এতো তাড়াতাড়ি চলে গেলেন! তার আরো অনেককিছু দেওয়ার ছিল বাংলা সাহিত্যকে। যেমন বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী। তার মতো আধুনিক সম্পাদক আর আমি দেখিনি। মুন্নু সিরামিকের রশিদ খান মুন্নুর মৃত্যু ছিল বেদনার আমার কাছে। সৈয়দ লুৎফুল হকের মৃত্যু ছিল কষ্টের। আমার কয়েকজন বন্ধুর মৃত্যুও আমাকে বেদনায় নীল করেছে। যেমন মিনার মাহমুদ, মোহন খান, মোস্তাক আহমেদ, জালাল মল্লিক, সাঈদ ভরসা, সিজার ভাই এ রকম আরো অনেকের মৃত্যুই আছে তালিকায়। আমার কয়েকজন আত্মীয়র মৃত্যুও কষ্টদায়ক ছিল আমার জন্য। যেমন আমার বড় দুলাভাই। আমাকে অনেক আদর করতেন মানুষটা। আমার শশুরের মৃত্যুও কষ্টের আমার জন্য। আমাদের বাড়ির কয়েকজন মুরুব্বির মৃত্যুও তাই। বিদেশেও আমার কয়েকজন প্রিয় মানুষ মারা গেছেন। যেমন কবি ইকবাল হাসান। কোভিডের সময়ও অনেকে চলে গেছেন। তখন থেকেই মৃত্যু যেনো ডালভাত হয়ে গেছে। প্রতিদিন এতো মৃত্যুর সংবাদ দেখতাম যে শোক করারও সময় পেতাম না। আমরা সবাই তখন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম, কখন এসে হানা দেবে যমদূত। আমি প্রতিদিন আমার প্রিয় মানুষদের কথা স্মরণ করি। নামাজ পড়ে তাদের আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করি।
আমি মারা গেলে আমার জন্য কেউ কী কষ্ট পাবে! আমি চাই রোগে শোকে কষ্ট না পেয়ে, কাউকে কষ্ট না দিয়ে হুট করে চলে যেতে। ঘুমের মধ্যে হলে আরো ভালো। মৃত্যুর আগে কী আমার প্রিয় দুই সন্তানের মুখ দেখতে পাব! আমার আশা কী পুরণ হবে! আমি চাই আমার বাবার কবরে শায়িত হতে। আমি কিছুতেই চাই না আমার কবর কানাডার মাটিতে হোক। কিন্তু আমি জানিনা আমার আশা পূরণ হবে কিনা। কিছুই জানা যায় না। সবকিছু অনিশ্চিত। অর্ক, অরিত্রি ফেসবুক করে না, জেসমিন ফেসবুকে তেমন এক্টিভ না, কখনও কিছু পোষ্ট দেয় না তাই আমি মারা গেলে দ্রুত কেউ জানবে না। আত্মীয়রা জানবে। তাদের মাধ্যমে অন্যরা জানলেও জানতে পারে। আমার ফেসবুক বন্ধুরা যখন জানবে তখন যথানিয়মে ইন্নালিল্লাহ..রাজেউন লিখবে। সাবাই লিখবে না। কেউ কেউ কপি করে পেষ্ট করে দেবে। নিয়মরক্ষা। আমিও এমন করি। যারা আমাকে চেনে, যাদের সাথে দেখা হয়েছে, সখ্যতা হয়েছে তারা একটু বেশি কষ্ট পাবে। যাদের সাথে বিভিন্ন সময় কাজ করেছি তারাও ব্যাথিত হবে। বিশেষকরে আমার বিচিত্রার বন্ধুরা। যাদের কষ্ট দিয়েছি তারা হয়ত মাপ করে দেবে আমাকে। আমি নিজে কারো উপর রাগ ক্ষোভ পুষে রাখিনি। নিজের ভুলের জন্য সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি অনেক আগেই। যারা আমার লেখা নিয়মিত পড়তেন তারা একটু খারাপ লাগবে। ভাববে আহা মানুষটা চলে গেলো! আর লেখা পড়তে পারব না!
টরন্টোতে মারা গেলে আত্মীয়রা বাসায় আসবে। জেসমিন কাঁদবে। তারা ওকে শান্তনা দেবে। দ্রুতই মসজিদে জানাজা ও দাফনের তোরজোড় শুরু হয়ে যাবে। কেউ কেউ কাফনে ঢাকা মুখটা দেখতে চাইবে। মৃত্যুর পর দেখতে কেমন লাগবে কে জানে! বরিশালে ভাই বোন, আত্মীয়রা ফোন করে খবর নেবে। আহা চলে গেলো বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। কেউ কেউ দু’ফোটা চোখের পানি ফেলবে। যেসব মসজিদে আমি দান করতাম সেগুলোতে একদিন দোয়া হবে। দেশের দু’একটি খবরের কাগজে মাঝের পৃষ্ঠায় সিঙ্গল কলামে নিউজ হলেও হতে পারে। টরন্টো বা আমেরিকার যেসব পত্রিকায় আমি নিয়মিত লিখেছি তারা প্রথম বা শেষের পৃষ্ঠায় নিউজ ছাপতে পারে। টিভির খবরেও বলতে পারে হয়ত। সবই অনুমান করি। এমনটা নাও হতে পারে। একদিন আমার এই প্রিয় শহরের বন্ধুরা হয়ত একটা স্মরণ সভা করবে। সেখানে আমাকে নিয়ে কিছু স্মৃতিচারন হবে। লেখালেখি নিয়ে তেমন কথা হবে না। ব্যাক্তিগত স্মৃতিচারন বেশি হবে। সবার মুখ থাকবে অপেক্ষাকৃত গম্ভীর, শোকের একটা আবহ থাকবে। সেই অনুষ্ঠানে জেসমিন উপস্থিত থাকলে মাথায় ওড়না দিয়ে নিরবে বসে থাকবে, সবার কথা শুনবে, নারীরা ওকে ঘিরে থাকবে। তিন ঘন্টার অনুষ্ঠান শেষে সবাই যে যার মতো ঘরে ফিরে যাবে। শোকের আয়ূ বেশিদিন বা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না।
জেসমিন বড়জোর এক দু’দিন কাজে যাবে না। আত্মীয়রা খাবার পাঠাবে প্রথম এক দুই দিন। অর্ক অনেক কষ্ট পাবে কিন্তু ভেঙ্গে পড়বে না। বড় সন্তান বলে সে শক্ত থাকবে, মা আর বোনের পাশে দাঁড়াবে যা সাধারণতঃ সে করে থাকে। খাতিজা আর সাদ কষ্ট পাবে। মনে মনে ভাববে আমাদের অনেক আদর করত মানুষটা। প্রতিদিনের একঘেয়ে রুটিন জীবন থেকে জেসমিন মুক্তি পাবে। কেউ আর খাওয়া দাওয়া নিয়ে ত্যাক্ত করবে না, প্রতিদিন ফ্রেস রান্না করতে হবে না। এটা খাবনা, ওটা খাবনা বলে বায়নাক্কা থাকবে না। সবকিছু মিলিয়ে এক ধরণের স্বস্তির জীবন ফিরবে। দীর্ঘ অভ্যাসের পরিবর্তন হবে। একদিন সব স্বভাবিক হয়ে যাবে। শোক ভুলতে না পারলে মানুষ বাঁচতে পারত না। জেসমিনও শোক ভুলে যাবে। আবার হাসবে, বেড়াবে, প্রিয় খাবার রান্না করবে তারমধ্যে কখনও হঠাৎ মনে পড়বে, লোকটা বড্ড জ্বালিয়েছে সারাজীবন। এখন আর জ্বালাতন করার কেউ নাই। কিছুদিন যেতে না যেতেই আমার সংগ্রহের বই বা আমার লেখা বইগুলো সরিয়ে ফেলবে সেলফ থেকে। ওগুলোর স্থান কোথায় হবে অনুমান করতে পারি। কে আর জজ্ঞাল বহন করে বেড়ায়! আমার ব্যবহৃত কাপরচোপড়, জুতা স্যান্ডেল স্যালভেশন আর্মিতে দান করে দেবে। আমার কম্পিউটার, হার্ডডিস্ক, লেখার টেবিল, নোট বুক সরিয়ে ফেলবে। অপ্রকাশিত লেখাগুলো কোনোদিন আর আলোর মুখ দেখবে না।
বছর ঘুরে মৃত্যুদিবস আসবে। প্রতিবছর আসবে। ততদিন কি আর কেউ মনে রাখবে! মনে হয় না। যাদের সাথে ফেসবুকে ছিলাম তারা অবচেতনে আনফ্রেন্ড বাটনে চাপ দেবে। যাদের কাছে আমার ফোন নম্বর ছিল তারা ডিলিট করে দেবে। ফেসবুককে বলা আছে আমার মৃত্যুর পর আমার একাউন্ট মুছে ফেলতে। ইন্সটাগ্রামে আর নতুন কোনো ছবি পোষ্ট থাকবে না। যেসব সাইটে নিয়মিত লিখতাম যেমন বিসিসিবি, পেন্সিল, পোয়েম ওয়ার্ল্ড, বেঙ্গলি টাইমস, বাসভূমি সেখানে নতুন কোনো লেখা থাকবে না আর। যেসব প্রত্রিকায় নিয়মিত লিখছি আর কখনও লেখা ছাপা হবে না। একদিন সবাই ভুলে গেলেও গুগল কখনও ভুলবে না। সার্চ বাটন চাপলে ভেসে উঠবে নাম, পরিচয়, ছবি। আর একজন কখনও ভুলবে না সে হচ্ছে অরিত্রি। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে অরিত্রি! বুক ফেটে কান্না আসবে কিন্তু প্রকাশ করবে না। কাউকে দেখতে দেবে না। চাপা স্বভাব। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদবে। বাসায় আসলে আর কখনও বলবে না, বাবা চা বানাও। বাবার চেয়ে কন্যাদের আর কেইবা বেশি ভালবাসে!।
আমার চাওয়াগুলো খুউব ছোট। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চাওয়া। ক্ষুদ্র মানুষের ক্ষুদ্র চাওয়া। এতোটাই ক্ষুদ্র যে চোখে দেখা যায় না। আমি অল্পে সন্তুষ্ট একজন মানুষ। কেউ মিষ্টি করে একটু কথা বললেও গলে যাই। মনে হয় তার জন্য জীবন দিয়ে দেই। কেউ ডেকে এককাপ চা খাওয়ালে খুশীতে ডগমগ হয়ে যাই। বিনিময়ে তার জন্য কী করব ভেবে অস্থির হই। অথচ আমার উল্টো টাইপ মানুষ অনেক আছে। তাঁদের জন্য যতই করি কিছুতেই মন পাই না। যত তাদের জন্য ভাবি তত তারা দূরে সরিয়ে দেয়। যত ভালবাসি তত অবহেলা পাই। পক্ষান্তরে আমিও ভালবাসার মানুষকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি, উপেক্ষা দিয়েছি। সবকিছুরই একটা বিচার আছে। টরন্টোতে যখন প্রথম আসি তখন সোশ্যাল ওয়ার্কারের কাজ করতেন একজন আপা একদিন আমাকে বললেন, শোনেন জসিম, কাউরে কইলজা কাইট্টা টুকরা টুকরা কইরা খাওয়ালেইও মন পাইবেন না। কথাটা সত্য। মাঝে মাঝে কথাটা খুউব মনে হয়। এমন না যে আমি মানুষের কাছে কিছু চাই। কোনো কিছুর প্রত্যাশা নিয়ে বসে আছি। আমি কারো উপর কোনো কিছুর জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারি না। যেনো কারো মনে না হয় আমি বিব্রত করছি। কারো বোঝা হতে চাইনি কখনও। কিন্তু তারপরও ভালবাসার একটা দাবী থাকে। অবচেতনে এই দাবী প্রতিষ্ঠিত হয়। ভালবাসার মানুষের কাছে তখন কিছু চাইতে দ্বিধা করি না। দ্বিধা করবো না।
তবে সঠিক মানুষ চিনতে প্রায়শঃই আমরা ভুল করি। যার কাছে কিছু প্রত্যাশা করি দেখি সেই প্রত্যাখান করে। যার কাছে প্রত্যাশা করি না সেই পাশে দাঁড়ায়। পৃথিবীতে সবসময় কিছু রহস্য থাকে। মানুষের চরিত্রের রহস্য, সম্পর্কের রহস্য, মনের রহস্য, প্রকৃতির রহস্য। এই রহস্য কিছুতেই ভেদ করা যায় না। মাঝে মাঝে এমন হয় যে সামান্য কারণে হতাশায় ভেঙ্গে পরি, ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাই। মনে হয় এই হতাশা কাটিয়ে আর উঠে দাঁড়াতে পারব না। গভীর শঙ্কা নিয়ে জীবন যাপন করি। উদ্বেগ উৎকন্ঠায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাই। খাওয়া থাকে না, ঘুম থাকে না এমন হয়। মনে হয় জীবনের আশা, স্বপ্নের এখানেই সমাপ্তি। জীবনে আসলে নিরবচ্ছিন্ন কোনো সুখ নাই। নিরবচ্ছিন্ন দুঃখও নাই। যখন খুব কাছের মানুষও তুচ্ছ কারণে ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দেয় তখন কষ্ট পাই। কিন্তু কারো ভুল শুধরে দিতে যাই না। জানি একদিন সে তার ভুল বুঝতে পারবে বা হয়ত কখনোই বুঝবে না। এটাই জীবন। আমিও অনেক ভুল করি। কোনো একটা সম্পর্কই চিরস্থায়ী না। বন্ধু চিরকাল বন্ধু থাকে না, স্বামী-স্ত্রী চিরকাল স্বামী বা স্ত্রী থাকে না, প্রেমিক থাকেনা প্রেমিক, আত্মীয়তার সম্পর্কও ভেঙ্গে যায়। ভাই বোনের সাথেও দূরত্ব তৈরী হয়। এই বৈপরীত্ব নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে।
তবে যতই হাতাশায় আক্রান্ত হই না কেনো, যতই আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় বিরাট বিপদের সম্মুখীন হয়েছি, যতই মনে হোক না কেনো জীবনটা বুঝি শেষ হয়ে গেছে তারপরও মনের গহীন কোনে সবসময় একটা আশার প্রদীপ টীম টীম করে জ্বলে। মনে ভাবি একদিন ঠিক হতাশা কাটিয়ে উঠতে পারব, বিপদ থেকে মুক্তি পাব। মাথার উপর ভেঙ্গে পড়া আকাশটা হঠাৎ দূরে সরে যাবে। এভাবেই বিপদ থেকে মুক্তি মেলে মানুষের। জীবনে বিপদ আপদ থাকবে, আবার মুক্তিও থাকবে। জীবন এমনই দু’হাত ভরে দেয় আবার কেড়েও নেয়। একটা দরজা বন্ধু হয়ে গেলে দুটো দরজা খুলে যায়। জীবনে কিছুই অনিবার্য না। কেউই অনিবার্য না। কারো জন্যই জীবন থেমে থাকবে না। কোনো কিছু না পেলেও জীবন বৃথা হয়ে যায় না। একসাথে চল্লিশ পঞ্চাশ বছর সংসার করার পরও একজন কেউ যখন চলে যায় অপরজনকে তো বেঁচে থাকতে হয়। বেঁচে থাকে। আমার জীবনটা সবসময় মিরাকল। শিশুকাল থেকেই। আমার স্বপ্নের কথা কেউ জানে না। খুব সঙ্গোপনে এসব আমি লালন করি। আজও তা অব্যাহত আছে। যেহেতু আমার চাওয়াগুলো ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র তাই যা পাই সেটাই আমার কাছে বড় হয়ে আসে। আমি যতখানি মানুষের ভালবাসা পেয়েছি বা পাই তার কাছে ছোট ছোট অবহলো, উপেক্ষা অতি তুচ্ছ। ওসব গোনায় না ধরলেও চলে। ভালবাসলেই ভালবাসা পাওয়া যায়।
ঢাকা ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
জসিম মল্লিক
লেখক ও সাংবাদিক
টরন্টো