স্বপ্ন ও স্মৃতিগুলো পাশপাশি চলে

জসিম মল্লিক

হুমায়ূন আহমেদের কেমোথেরাপি চলছে তখন। আমি নিশ্চিত তিনি সুস্থ হয়ে তার প্রিয় বাংলাদেশে ফিরে যাবেন। এবং আগের মতোই বিরামহীন লিখবেন। আমি হুমায়ূন আহমেদের লেখা পছন্দ করি। শুধু পছন্দ করি এটা বললে ঠিক মতো বলা হয় না। খুউবই পছন্দ করি। বলতে গেলে আমি তার সব লেখাই পড়ি। তার কোনো নতুন লেখা আর পড়বো না এটাতো হতে পারে না! যতদিন বেঁচে থাকবো হুমায়ূন পড়তে চাই। আমি যখন প্রথম সাবের ভাইয়ের ফেসবুক ওয়ালে দেখলাম সিঙ্গাপুরে চেকআপ করতে গিয়ে হমায়ূন আহমেদের কোলন ক্যান্সার ধরা পরেছে এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য নিউিইয়র্কে আসছেন তৎক্ষনাৎ ফেসবুকে আমার ওয়ালে লিখলাম,  হুমায়ূন আহমেদের জন্য দোয়া করুন। যদিও প্রতিক্রিয়া হয়েছিল মিশ্র। আসলে যারা হুমায়ূন আহমেদের লেখা ভালোবাসেন তারাই কেউ কেউ ক্ষুব্দ হয়েছেন। তারা তার লেখক সত্ত্বা আর ব্যক্তি সত্ত্বাকে এক করে ফেলেছেন। ব্যক্তি হুমায়ূন আর লেখক হুমায়ূন এক হবেন সব সময় এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। তিনি আমাদের যা দিয়েছেন সেজন্য তার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

হুমায়ূন আহমেদ এর আগে সর্বশেষ নিউইয়র্কে এসেছিলেন ২০০৯ সালে। মুক্তধারা আয়োজিত বই মেলা এবং বাংলা উৎসবে যোগ দিতে এসেছিলেন। তার সাথে ছিলেন স্ত্রী শাওন ও পুত্র নিষাদ। সে সময় আমিও নিউইয়র্কে গিয়েছিলাম। হুমায়ূন আহমেদের সাথে সেটাই ছিল আমার সর্বশেষ সাক্ষাৎ। সে সময় হুমায়ূন আহমেদ আমাকে তার আত্বজীবনীমূলক লেখা ’বলপয়েন্ট’- এ অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন। পুরো অনুষ্ঠানে খুউব প্রানোবন্ত ছিলেন তিনি। কলকাতা থেকে সমরেশ মজুমদারও এসেছিলেন সে সময়। হুমায়ূন আহমেদ আবারো নিউইয়র্কে এসেছেন কিন্তু এবার তিনি এসেছেন অসুস্থতার সাথে লড়তে। এ লড়াইয়ে তিনি জয়ী হবেন নিশ্চিত। জীবনে অনেক লড়াই সংগ্রাম করেছেন। সবটাতেই জয়ী হয়েছেন। এবারও হবেন।

সেটা আশির দশকের কথা। তখন আমি কিছুদিন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় বইয়ের রিভিউ লিখেছি। একবার শাহারিয়ার ভাই আমাকে হুমায়ূন আহমেদের একটা বই দিলেন রিভিউ করতে। ছোট্ট্ একটি বই। বইটার নাম এখন ভুলে গেছি। রিভিউ প্রকাশিত হলো। সেখানে আমি বুদ্ধদেব গুহর ‘একুট উষ্ণতার জন্য’ উপন্যাসের এক জায়গায় মিল খুঁজে পেলাম। নায়িকা গোসল করছেন। দরজার ফুটো দিয়ে একজন সে দৃশ্য দেখছে এর রকম একটা ব্যাপার ছিল। এ ঘটনায় হুমায়ূন আহমেদ খুউব ক্ষুব্দ হয়েছিলেন। তিনি সমালোচনা পছন্দ করেন না। যদিও জীবনে অনেক সমালোচনা তাকে সহ্য করতে হয়েছে। শাহরিয়ার ভাই রেগে মেগে আমার রিভিউ লেখা বন্ধ করে দিলেন। এর পর থেকে আর কেনোদিন বইয়ের রিভিউ লিখিনি। কোনো বিচিত্র কারণে হুমায়ূন আহমেদ বিচিত্রার লোকদের পছন্দ করতেন না। যদিও আজকের হুমায়ূন আহমেদ তৈরীতে বিচিত্রার শাহদত চৌধুরীর বিরাট ভূমিকা আছে।

আমি আজও যেমন মাসুদ রানা সিরিজ মন দিয়ে পড়ি তেমনি হুমায়ূন আহমেদের লেখাও পড়ি। তিনি কখনও আমাকে ছেড়ে যান না। আমি প্রতি বছর দেশে যাই। এই দীর্ঘ ভ্রমনে হুমায়ূন আমার সঙ্গী। সেটা ছিল ২০০০ সাল। আমি নিউইয়র্ক থেকে লন্ডন এসেছি। লন্ডন থেকে এক সপ্তাহ পর ঢাকা চলে যাবো। উঠেছি মিডলসেক্স এলাকায় ব্রেড এ্যান্ড ব্রেকফাষ্ট টাইপ একটা হোটেলে। সে সময় আমি ভুল করে হুমায়ূন আহমেদের দুটো বই হোটেলে ফেলে এসেছিলাম। একুশে বইমেলা থেকে হুমায়ূন আহমেদের বই এখনও কেনা হয় আমার। হুমায়ূন না থাকলে প্লেন যাত্রা বোরিং হয়ে উঠে। হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসার খবর প্রতিদিন প্রথম আলো থেকে জানতে পারি প্রথম। এছাড়াও আমি মুক্তধারার বিশ্বজিৎ সাহাকে ফোন করেছি কয়েকবার। ই-মেইল করেছি। হুমায়ূন আহমেদের জন্য আমার খারাপ লাগে। এমন না যে তিনি আমাকে খুউব চিনতেন। তিনি আমার প্রিয় লেখক। আমাদের ছেড়ে অকালে চলে গেলেন। ক্যান্সারের কাছে পরাভূত হলেন শেষপর্যন্ত। হুমায়ূন আহমেদের আরো অনেক কিছু দেওয়ার ছিল বাংলা সাহিত্যে। তার মৃত্যু আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে।

শৈশবকাল থেকেই স্বপ্ন দেখতাম আমি অনেক ঘুরে বেড়াব। দূর দূরান্তে চলে যাব। যদিও আমার কোথাও কেউ চেনা নাই, কিভাবে যেতে হয় জানিনা। আমার পাসপোর্ট নাই, ভিসা নাই, টাকা পয়সা নাই। কিন্তু স্বপ্ন আছে। ভ্রমণ কাহিনী পড়ে পড়ে স্বপ্ন তৈরী হয়েছিল। প্লেন দেখলেই উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। বিস্মিত হয়ে ভাবতাম পাখির মতো ছোট্ট জিনিসটা গুম গুম শব্দ করে কোথায় যায় কে জানে! কোথা থেকেই বা এসেছে! অবাক কান্ড! বাস্তব সম্ভব হোক বা না হোক স্বপ্ন দেখতে কোনো সমস্যা নাই। স্বপ্ন দেখতে পয়সা লাগে না, কেউ জানতেও পায় না। গোপন সব স্বপ্ন ছিল আমার। আজও আমার স্বপ্ন শেষ হয়নি।

আমি লন্ডন শহর নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম, প্যারিস নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম, টোকিও নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম, সুইজারল্যান্ড নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম, কোলকাতা নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম, দার্জিলিং নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম, তাজমহল নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম, নায়াগ্রা নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। আমি ঢাকা শহর নিয়েও স্বপ্ন দেখতাম, বিচিত্রা পত্রিকা নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। গুলিস্তান, বাইতুল মোকাররম নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। বই পড়ে এইসব জায়গা চিনেছি। বই পড়ে স্বপ্ন তৈরী হয়েছিল। যদি বই না পড়তাম তাহলে এসব কিছুই ঘটত না জীবনে। আমার জীবনে আজব সব ঘটনা ঘটেছে। যা ঘটার কথা ছিল না তাই ঘটেছে। আমার নিজের জীবনটাই একটা গল্প। অথচ আমি খুবই সাধারণ জীবন যাপন করেছি, সাধারণভাবে বেড়ে উঠেছি। প্রতি পদে লড়াই করেছি। আমি শুধু টিকে থাকতে চেয়েছি। আমি কোনো মেধাবী কেউ না, কোনো যোগাযোগও নাই কারো সাথে। প্রকৃতির নিয়মেই অনেক কিছু ঘটে জীবনে। প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে যায় সেসব।

আমি কখনো কানাডায় আসব ভাবিনি। কানাডা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। নিউইয়র্কেই আমার বসতি হতে পারত। সে সম্ভবনা যথেষ্টই ছিল। নিউইয়র্কে আমার অনেক বন্ধু, স্বজন আছে। অনেক আপনজন আছে। আমার বইয়ের পাঠক আছে। নিউয়র্কের রাস্তা দিয়ে হাঁটলে মনে হয় আমি বাংলাদেশেই আছি। কি নাই এই শহরে! সব আছে। বাংলা পত্রিকা আছে, টেলিভিশন আছে, বইমেলা আছে, গ্রোসারি আছে, রেষ্টুরেন্ট আছে, ডাক্তার আছে, কবিরাজ আছে, উপন্যাসিক আছে, কবি আছে, সাংবাদিক আছে, শিক্ষক আছে, রাজনীতিবিদ আছে, মারামারি, কাইজ্যা আছে, লুঙ্গি আর ম্যাক্সি পড়ে রাস্তায় ঘোরার লোক আছে, পানের পিক ফেলার লোক আছে, ফুটপাথে ডাটা শাক বিক্রী করা আছে। ঢাকা শহরে যা নাই তা নিউইয়র্কে আছে। নিউইয়র্ক একটা মিনি বাংলাদেশ। দেশের বাইরে সবচেয়ে বেশি বাঙলার চর্চা এবং কর্মকান্ড নিউইয়র্কে হয়।

হঠাৎ একদিন খবর আসল বন্ধু চিনা আর নেই। আমি তখন ঢাকায়। দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশদিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর চিনা আর থাকল না। দেশের খ্যাতনামা ফ্যাশন ডিজাইনার এমদাদ হক। সেদিনই বনানী গোরস্তানে চিরদিনের জন্য রেখে আসল। বহুবছর পর গেলাম চিনাদের উর্দ্ুেরাডের বাড়িতে। ৯ হায়দারবক্স লেনের সেই চিরচেনা বাড়িটি খুঁজে পেতে মোটেও কষ্ট হলো না। চারিপাশের অনেককিছু বদলে গেলেও বাড়িটি এখনও আগের মতোই মাধা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। চারতলা বাড়িটার প্রতিটি মানুষ, প্রতিটা কর্ণার, প্রতিটি ইট বালু, খাট, চেয়ার টেবিল আমার চেনা ছিল। আমি নিজেই ওই বাড়ির একজন হয়ে উঠেছিলাম। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় যখনই বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ হয়ে যেতো ওই বাড়ির চারতলার চিলেকোঠায় আমার আশ্রয় হতো। চিনার জন্য এটা সম্ভব হলেও একসময় বাড়ির প্রতিটি সদস্য আমাকে আপন করে নিয়েছিল। খালাম্মা ছিলেন তার অন্যতম। আমি যেনো তার আর এক সন্তান হয়ে উঠেছিলাম। যখন ওই বাড়িতে গেলাম বাড়িটাকে মনে হলো একটা মৃতপুড়ি। বিষাদে ভরপর। খালাম্মার শুন্য রুমটায় একটু বসলাম। মনটা হাহাকার করে উঠল। কেমন ছন্ন ছাড়া লাগল বাড়িটা। কেউই আর থাকে না বলেই এমন মনে হয়েছে। সবাই ছিল বাড়িতে শুধু একজন ছিল না সে হচ্ছে চিনা। অন্ধকারময় সিঁড়ি ভেঙ্গে যখন নেমে আসছিলাম বাইরে কখন একসময় আবিষ্কার করলাম আমি কাঁদছি!

সেটা মধ্য আশির কথা। তখন আমি বিচিত্রায় কাজ করতে শুরু করেছি। টুকিটাকি কাজ। ছোট খাট রিপোর্ট। শাহরিয়ার কবির, কাজী জাওয়াদ, মাহমুদ শফিক, আলমগীর রহমান, মাহফুজউল¬াহ, সাজ্জাদ কাদির বা মঈনুল আহসান সাবেরের মতো ডাকঁসাইটে সাংবাদিকদের সামনে আমি চোখে পড়ার মতো না। তখন মুনতাসির মামুন বা আনু মোহাম্মদরা বিচিত্রায় দাপটের সাথে লেখেন। আমি তাদের মুগ্ধ হেয়ে দেখি। বিচিত্রার প্রান পুরুষ শাহদত চৌধুরী, দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদক শামসুর রাহমান, সম্পাদক আহমেদ হুমায়ূন বা সাহিত্য সম্পাদক আহসান হাবিবের মতো তারকারাতো ধরাছোঁয়ার বাইরে। ভয়ে ভয়ে অফিসে ঢুকি। কোনো রিপোর্ট জমা দিয়ে শঙ্কায় থাকি ছাপা হবেতো! শাহরিয়ার কবির যদি রিপোর্ট এডিট করেন তাহলে তার টেবিলের সামনে হাটু কাঁপা অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকি। না জানি কত কি ভুল আছে। হয়ত বলবেন এটা কি লিখোছো কিছুইতো হয় নাই! শামীম আজাদ যা করতে বলেন তাই করি। তার ’জীবন এখন যেমন’ বিভাগে সহযোগিতা করি।

ঢাকা শহরে থাকি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি এবং বিচিত্রার মতো পত্রিকায় লিখি। এই তিনই খুব বিস্ময়কর ঘটনা। সেই সময় বিচিত্রার মতো মহা প্রতাপশালী পত্রিকায় লেখার সুযোগ পাওয়া চাট্টিখানি কথা না! আমি কোনোদিন বরিশালের গন্ডি থেকে বের হতে পারবো তাইতো ভাবিনি। তাছাড়া ঢাকা শহরে আমার কেউ নাই। কেউ আমাকে চেনেও না। একজন কাছের আত্মীয় পর্যন্ত নাই। শুধু দু’একজন বন্ধু ছাড়া। স্বপ্নের লেখকদের সামনে থেকে দেখবো এই আশায় মায়ের চোখের পানিকে উপেক্ষা করে চলে এসেছিলাম ঢাকায়। এর মধ্যে একদিন কাজী জাওয়াদ বললেন, জসিম তোমাকে ঢাকার বাইরে যেতে হবে। রিপোর্ট করতে হবে। শুনে আমি মহা উত্তেজিত এবং আতংকিত।

উত্তেজিত কারণ আমি প্রথম প্লেনে চরবো। ছোটবেলায় যখন পে¬ন উড়ে যেতো আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কেমন করে পে¬নটা মেঘের ভেলায় ভেসে যায়। কেমন অজানার পানে হারিয়ে যায়। ছোট্ট পাখীর মতো জিনিসটা কোথায় যে যায় কে জানে। ভাবতাম আমি কি কোনোদিন পে¬নে চরতে পারব! নিজেই নিজেকে উত্তর দিতাম না চরব না। সেই আমি পে¬নে চরে জীবনের প্রথম ফিল্ড রিপোর্ট করতে যাব। এসব কি হচ্ছে! সত্যি সত্যি পে¬নে চরে রাজশাহী গেলাম। সেখান থেকে গাড়িতে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো জয়পুরহাট। এবং সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছেন রফিক আজাদ। স্বপ্নের কবি রফিক আজাদ। তাকে প্রথম সামনা সামনি দেখে কেমন শিহরিত হলাম! এই সেই কবি যার লেখা পড়ে মুগ্ধ হই। সেখানে আরো একজন কবি ছিলেন। কবি বেলাল চৌধুরী। ভাবা যায়! রফিক আজাদই সাংবাদিকদের নিয়ে আসার মূল উদ্যোক্তা।

জয়পুরহাটে বেক্সিমকোর একটা নতুন ফ্যাক্টরী উদ্বোধন হবে। মোলাসেস থেকে চিটাগুর তৈরী হবে এই রকম কিছু একটা। উদ্বোধক মোশাররফ হোসেন। বিসিআইসির চেয়ারম্যান তখন তিনি। উদ্বাধনের পর রাতের দিকে রফিক আজাদের সাথে আমরা বগুড়া চলে এলাম। উঠলাম পর্যটন কর্পোরেশনের মোটেলে। সেটাই আমার জীবনের প্রথম হোটেল বাস। একই সঙ্গে অনেক কিছু ঘটে যাচ্ছে জীবনে। রাত তখন গভীর। রফিক ভাই ডাকলেন তার রুমে। আমি গেলাম। বলল খাবে নাকি! কখনও খেয়েছো! আমি লজ্জায় ভয়ে লাল হয়ে বললাম না। বললেন একটু ট্রাই করো। ট্রাই করলাম। বেশ ভালভাবেই করলাম। আকন্ঠ। সে রাতে কখন একসময় বিছানায় লুটিয়ে পরেছি নিজেই জানি না।

পরদিন সকালে অনেকেই ফিরতি ফ্লাইটে ঢাকা চলে গেলো। সেই রাতে আমার বগুড়া থেকে সৈয়দপুর পর্যন্ত যাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। আমি সকালে রফিক ভাইয়ের সাথে পুরো রাস্তা মাইক্রোবাসের পিছনের সীটে শুয়ে ঢাকা আসলাম। গাড়িতে অসহ্য শরীরের কষ্ট আর বমি করতে করতে আসলাম। রফিক ভাই পরম মমতায় আমার যত্ন করলেন, পৌছে দিলেন ঘরে। এবং কয়েকবার ফোন করে খবরও নিলেন। সেই প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি, রোমান্টিক কবি রফিকের আজাদের সাথে টরন্টোতে আবার দেখা হলো। শেষ বারও এই টরন্টোতেই দেখা হয়েছিল। সেটা ছিল ২০০৮ সাল। প্রয়াত মিশুক মুনিরের বাসায়।

প্রতিটা মানুষকেই কখনও না কখনও বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখী হতে হয়। একজীবনে মানুষ কত যে বিব্রত হয় তার কোনো লেখাযোখা নাই। সব ঘটনা মনে রাখাও সম্ভব না। অনেক ছোটো খাট কারণে যেমন মানুষ বিব্রত হয়  তেমনি আবার অনেক বড় কারণেও অনেকে বিব্রতবোধ করে না। বিষয়টা নির্ভর করে পরিস্থিতির উপর। ব্যক্তির উপর। ধরা যাক একজনকে সম্বর্ধনা দেয়া হচ্ছে, তার সম্পর্কে কেউ এমন সব অবাস্তব প্রশংসা করছে যা শুনে সম্বর্ধিত ব্যক্তি বিব্রত হচ্ছেন। একজন লেখককে যদি রবীন্দ্রনাথের সাথে তুলনা করা হয় তাহলে সে বিব্রত হবে। রবীন্দ্রনাথের সাথে কেউ তুলনীয় না। শুধুমাত্র রাজনীতিবিদরা বিব্রত হন না। সবকিছু তাদের গা সহা। তাদের চোর বললেও ব্রিবত হন না, ফেরেশতা বললেও হন না। তাদের বিব্রত হওয়া চলে না। অন্য অনেকের মতো আমার জীবনেও অনেক বিব্রত হওয়ার ঘটনা আছে। খুব তুচ্ছ তুচ্ছ ঘটনা তাও মনে আছে। তিনটি ঘটনা শেয়ার করছি।

তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। তখন থেকেই আমি সিনেমার পোকা। আমি বিরামহীণ সিনেমা দেখতে পারি। স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখার গল্প অনেকবার করেছি। সে সময় শুক্রবার মর্নিং শোতে ইংরেজী সিনেমা চলত। বরিশাল বিউটি সিনেমায় ’হানিমুণ অব দ্যিা টেরর’ নামে একটি সিনেমা মুক্তি পেল। ইংরেজী সিনেমা সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা নাই। শুধু বাংলা সিনেমা দেখি। রাজ্জাক কবরীর সিনেমা হলেই দেখতে ছুটে যেতাম। হানিমুন অব দ্যা টেরর ছবির পোষ্টারে লেখা ছিল ’শুধুমাত্র প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য’। আমাদের ক্লাসের নাসির ছিল একটু পাকা। বলল, ঘটনা আছে চল যাই দেখে আসি। একদিন সত্যি সত্যি গেলাম। ডিসি ক্লাসের টিকিট কেটে ঢুকতে যাচ্ছি দেখি আমার বড় ভাই। বড় ভাইকে আমরা যমের মতো ডড়াই। তার ভয়ে রীয়ার স্টলের টিকিট কেটে ঢুকতে যাচ্ছি দেখি আমার মেঝ ভাই। সেও বড় ভাইর ভয়ে রীয়ার স্টলে এসেছে! সেদিন মেঝ ভাই আমাকে দেখে ফেলাটা ছিল ভয়ানক ব্রিবতকর!

কবরী আমার প্রিয় অভিনেত্রী। স্কুলে পড়ার সময় চিত্রালী পত্রিকা থেকে কবরীর সাদা কালো ছবি কেটে বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখতাম। রাত গভীর হলে দেখতাম। কবরীর হাসি নিয়ে আমি চিত্রালী এবং পূর্বনীতে অনেকগুলো লেখা লিখেছিলাম। এমনকি আমি মনে মনে কবরীর বাড়ির বাগানের মালিও হতে চেয়েছি। একবার এক ঈদে রাজ্জাক কবরীর ’রংবাজ’ ছবিটা মুক্তি পেল। ছবিটা কিভাবে দেখব সুযোগ পাচ্ছিলাম না। তক্কে তক্কে ছিলাম। একদিন সুযোগ এসে গেলো। বড় আপা রংবাজ সিনেমাটা দেখতে যাবেন। বড় আপাকে বললাম আমিও দেখতে চাই। আপা কিছুতেই আমাকে নেবন না। কেনো নেবেন না কে জানে! অনেক অনুনয় বিনয় করার পর রাজী হলেন। সিনেমা চলছে। গান হচ্ছে ,আয় হায় হায় রঙ্গিলা রঙ্গিলা রে, রিম ঝিম ঝিম বরষায় মন নিলা রে, আমি যে কি করি আহারে সুন্দরী জানি না কখন সে মন নিলরে..গানের শেষে দু’জনেই ঝোপের আড়ালে চলে যায়। কবরী তখন সিক্ত বসনা। ভয়াবহ অবস্থা! দু’জনেই শুয়ে পরেছে। রাজ্জাকের পায়ের নিচে কবরীর দুই পা ছটফট করছে। কেনো করছে কে জানে! বড় আপা এই দৃশ্যটির সময় আমার দিকে কড়া চোখে তাকাচ্ছিল। সিনেমা থেকে বের হয়ে বলল, তোকে  আর কোনোদিন সিনেমা দেখতে নিয়ে যাব না।

আর একটি ব্রিবতকর ঘটনা। সেটা ১৯৯৭ সাল। জেমস ক্যামেরনের টাইটানিক তখন মুক্তি পেয়েছে। বিশ্বজুড়ে তোলপাড়। ঢাকার মধুমিতায় বিরামহীন চলছে। আমি একদিন গেলাম দেখতে। আমার সাথে আমার ছেলে অর্ক। অর্ক’র বয়স তখন সাত। ঠিকঠাক মতো দেখছি সিনেমা। অর্ক তখন থেকেই ভাল ইংরেজী বোঝে এবং বলতে পারে। স্কলাস্টিকার পোলাপান একটু পাকনা হয়। আমার ধারণা আমার চেয়ে ভাল বোঝে অর্ক। এক পর্যায়ে সেই আলোচিত দৃশ্য। কেট তার বস্ত্র খুলছে আর লিউনার্দো সেই অপরূপ দেহ বল¬বির স্কেচ করছে। বেশ লম্বা দৃশ্য। আমি প্রায় ঘেমে যাচ্ছিলাম। কারণ আমি চা্চ্িছলাম না অর্ক এই দৃশ্যটা দেখুক। আগে জানলে কি আর নিয়ে আসতাম! মনে হচ্ছিল অর্ক’র চোখ চেপে রাখি। আর অর্কও অপার বিস্ময়ে সেই অচেনা দৃশ্য দেখছে। এর বহুবছর পর ২০০৩ সালে হলিউডে কেট উইন্সলেটের সাথে আমার দেখা হলো। তার ’লাইফ অব ডেভিড গেল’ ছবির প্রিমিয়ারে। নিকোলাজ কেজও ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে।

আমি কাউকে দেখলেই হেসে কুশল জানতে চাই। কোনো অনুষ্ঠানে গেলে সবাইকে লক্ষ্য করি। মাঝে মাঝে ভাবি লোকজন এতো চিন্তাগ্রস্থ কেনো! কেমন যেনো একটা শোকের আবহ। সবার মুখে কেনো হাসি লেগে থাকবে না! দেখলেই সুন্দর করে হাসবে। হাত বাড়িয়ে দেবে। ডেল কার্নেগী বলেছেন এমনভাবে হ্যান্ডশেক করবেন যেনো হৃদয়ের সবটুকু উষ্ণতা হাতে এসে ভর করে। অনেক সময় চেনা মানুষও দেখি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। হয়ত ভাবে একে কি আমি চিনি! আমি তখন হেসে বলি চিনতে পারছেন না!। আমরা কতকি ভুলে যাই। আমিও অনেক সময় চেনা মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। ভাবি কোথায় যেনো দেখেছি। কি যেনো নাম! কী বিব্রতকর অবস্থা। আচ্ছা আমরা যারা বিদেশে থাকি আমরা কেমন মানুষ! মাঝে মাঝে নিজেকে নিজেই এই প্রশ্ন করি। আমরা কি কেউ কারো বন্ধু! আমরা কি কেউ কাউকে চিনি! চেনা চেনা মনে হলেও আসলে কি চেনা! নতুন বন্ধু যেমন তেমনি পুরনো বন্ধুও কেমন অচেনা হয়ে যায় না!

এইযে বিদেশে আমরা একত্র হয়ে চলি, হাসি, খেলি, গল্প করি, খাই, বেড়াই তারপরও কি আমরা কেউ কারো আপন হতে পেরেছি! নির্ভলশীল হতে পেরেছি! কেউ কারো কাছে কি খোলা মনের হতে পেরেছি! কেউ কাউকে আমরা আস্থায় আনতে পেরেছি! একটা সংশয় সবসময় বাদুরের মতো ঝুলে থাকে না বুকের মধ্যে! কেমন যেনো সাবধানী সবাই। কথা বলি হিসাব করে। বেহিসাবি হতে কত যে ইচ্ছে করে! কেউ কারো মনের কথা কি জানি বা শেয়ার করি! যেটা বলি সবসময় কি তা মনের কথা! মুখে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় যতই প্রশংসা করি সবটুকুই কি মন থেকে! আচ্ছা বিদেশ কি আমাদের স্বার্থপর আর আত্মকেন্দ্রিক করে দিয়েছে। সবাই নিজেকে নিয়েই ভাবতে বেশী ভালবাসে। এমনকি আমাদের সন্তানরা পর্যন্ত। নাকি আমারই বোঝার ভুল!

বন্ধুত্বের মতো সম্পর্কগুলো অনেক সময় বায়বীয় লাগে। বন্ধুত্বের পারদ উঠা নামা করে। সকালে এক রকম বিকেলে বদলে যায় তার রং। আমার একজন সাংবাদিক বন্ধু একবার আমাকে বলল, আমি আমেরিকা বেড়াতে যেতে চাই। তুমি ব্যবস্থা করে দাও। আমি রিকমেন্ড করে তার ভিসার ব্যবস্থা করে দিলাম। সে আর ফিরে গেলো না। তার চাকরির ব্যবস্থাও করা হলো। এ বছর আমি যখন আমেরিকা গেলাম সে আমাকে এড়িয়ে গেলো। কেনো কে জানে। লন্ডনে আমার একজন নতুন বন্ধু হলো। অল্প দিনেই অনেক জানাশোনা। একদিন সে বলল তোমার সাথে বন্ধুত্ব শেষ! খুবই আকিস্মক। কিন্তু সে কারণ বলেনি। তাহলে কি ক্রুটি আমারই! মানুষ তার নিজের ভুলগুলো দেখতে পায় না। পেলে ভাল হতো। সম্পর্ক গড়া অনেক কঠিন কিন্তু ভেঙ্গে ফেলা কত সহজ। আমি সহজে কারো সাথে সম্পর্ক নষ্ট করি না। কিন্তু কেউ আমাকে দূরে সরিয়ে দিলে আমি দূরে সরে থাকি।

প্রবাসে এই যে প্রতিনিয়ত এতো কিছু করছি আমরা সবকিছুর পিছনেই মহত উদ্দেশ্য আছে বলেই ধরে নেয়া হয়। কিন্তু যখন উল্টোটা দেখা যায় যেমন কারো শুধু টাকা কামানোর উদ্দেশ্য, কারো পাল্টা কিছু করে দেখানোর উদ্দেশ্য, কারো নাম কামানোর উদ্দেশ্য, কারো ক্ষমতা দেখানোর উদ্দেশ্য, কারো অন্যকে সাইজ করার উদ্দেশ্য তখন খারাপ লাগে। এছাড়ও গ্রুপিং, পাল্টা গ্রুপিং, সংগঠন পাল্টা সংগঠন, অনুষ্ঠান পাল্টা অনুষ্ঠানও চোখে পরে। একাট্টা হয়ে কিছু করার ক্ষমতা আমাদের অর্জন করা দরকার। আমরা কেনো প্রতিদিন ভেঙ্গে গুড়ো গুড়ো হচ্ছি? তবে ব্যতিক্রমও আছে। আছে ভাল ভাল কাজ, অনুষ্ঠানাদি, সত্যিকার বন্ধুত্ব, ভালবাসা আছে, মায়া, মমতা, বিপদে পাশে দাঁড়ানো, সবই আছে..। প্রতিটা মানুষ অনন্য।

আমরা যারা বিদেশে থাকি আমরা কেমন মানুষ! আমরা কি কেউ কারো বন্ধু! আমরা কি কেউ কাউকে চিনি! চেনা চেনা মনে হলেও আসলে কি চেনা! নতুন বন্ধু চিনে ওঠা যেমন কঠিন তেমনি পুরনো বন্ধুও কেমন অচেনা হয়ে যায়। আমার একজন বন্ধু থাকে প্যারিসে, খুবই ঘনিষ্ঠ, তার বিপদে আমি অনেক হেল্প করেছিলাম। একবার আমি প্যারিসে গিয়ে তাকে ফোন করলাম সে আমার সাথে দেখা করেনি। তার সময় ছিল না। আমার যেসব বন্ধুরা বিদেশে থাকে তারা প্রায় আমাকে  বলে এখানে কেউ কারো বন্ধু না। কাল লন্ডন থেকে আমার আর এক পুরনো বন্ধু লিটনও একথাই বলছিল। এই জন্য ও বন্ধুহীন থাকে। এতেই ও অভ্যস্ত হয়ে গেছে। টরন্টোতে আমার একজন খুব পরিচিত মানুষ। কত সখ্যতা আমাদের! একসাথে কত আড্ডা দিয়েছি, খেয়েছি। সেদিন আমি হেসে তার কুশল জানতে চাইলাম কিন্তু সে আমাকে চিনলোই না। মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলো। এরপর যতবারই মুখোমুখী হয়েছি ততবারই অভ্যাস বসে হেসে কিছু বলতে যাই কিন্তু তখনই মনে পরে আরে সে তো আমাকে আর চেনে না! কিন্তু আমার একট্ওু জানতে ইচ্ছে করে না সে কেনো আমার উপর অখুশী!

একটা শ্রেণী আছে যারা অন্যকে ব্যবহার করছে, অন্যকে ঠকিয়ে লাভবান হচ্ছে। এরা নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য এমন সব আচরণ করে বা মিথ্যার আশ্রয় নেয় যা বিস্ময়কর। এদের খপ্পরে পরে অনেকেই সর্বশান্ত হয়েছে। ঘর ভেঙ্গেছে, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছে। যখন ভুল বুঝতে পারে তখন আর কিছু করার থাকে না। তবে ব্যতিক্রমও আছে। আছে সত্যিকার বন্ধুত্ব, প্রেম আছে, ভালবাসা আছে, স্বার্থহীণতা, মায়া, মমতা, বিপদে পাশে দাঁড়ানো এসবই আছে।

জসিম মল্লিক লেখক ও সাংবাদিক

টরন্টো