টরেটক্কা টরন্টো
চীন-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক -২০
কাজী সাব্বির আহমেদ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
২০২৩ সালের মার্চে শি চিনপিং চীনের ‘রাবার-স্ট্যাম্প’ পার্লামেন্টের ভোটে তৃতীয়বাবের মতন প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত হওয়ার পর ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস-এর তিন হাজার সদস্যের উদ্দেশ্যে দেয়া তার প্রথম ভাষণে তিনি চীনের সামরিক শক্তিকে ‘গ্রেট ওয়াল অব স্টিল’ হিসেবে গড়ে তোলার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেন। চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির অবিসংবাদিত নেতা মাও সেতুং ১৯৩৮ সালে ন্যাশনালিস্ট কোয়ামিনতাং-এর সাথে গৃহযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে লিখেছিলেন, ‘হু এভার হ্যাজ এন আর্মি হ্যাজ দি পাওয়ার’ যার আলঙ্কারিক বাংলা অনুবাদ হচ্ছে ‘বন্দুকের নলই হচ্ছে সকল ক্ষমতার উৎস’। মাও পরবর্তী চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির নেতাদের মধ্যে শি চিনপিং-ই হচ্ছেন একমাত্র নেতা যিনি আধুনিক কম্যুনিস্ট চীনে আবারও মাও-এর ডকট্রিন ফিরিয়ে আনতে তৎপর। সেই তৎপরতার অংশ হিসেবে তিনি চীনের সামরিক শক্তির উত্থানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। চেয়ারম্যান মাও-এর ভাবশিষ্য হিসেবে তিনি মনে করেন যে পৃথিবীর বুকে একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে একটি শক্তিশালী আর্মি। কারণ ‘বন্দুকের নলই হচ্ছে সকল ক্ষমতার উৎস’।
তবে ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের উদ্দেশ্যে এই বক্তব্য দেয়ার কিছুদিন আগে শি চিনপিং ওয়াশিংটনকে দায়ী করেন চীনকে ‘নিয়ন্ত্রণ এবং দমন’ করার জন্য আমেরিকার গৃহীত নীতির জন্য। তার কথার সূত্র ধরে চীনের ফরেন মিনিস্টার ছিন কাং ওয়াশিংটনকে এই বলে সতর্ক করে দেন যে আমেরিকা যদি সম্ভাব্য ‘কনফ্লিক্ট এবং কনফ্রনট্রেশন’ এড়াতে চায় তবে তাদেরকে এই ‘নিয়ন্ত্রণ এবং দমন নীতি’ থেকে সরে আসতে হবে। চীনের বিখ্যাত ‘রেনমিন তা-সুয়ে’ বা পিপলস ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ শ্রি ইনহোং বলেন যে, ২০২২ সালের নভেম্বরে ইন্দোনেশিয়াতে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং-এর সাথে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পর থেকেই লক্ষ্য করা যচ্ছে যে আমেরিকা চীনকে দমন করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এই ‘নিয়ন্ত্রণ এবং দমন নীতি’-র মধ্যে রয়েছে তাইওয়ানের সামরিক শক্তির বৃদ্ধির লক্ষ্যে তাদেরকে বিপুল পরিমাণে আধুনিক সমরাস্ত্র সরবরাহের চুক্তি, মাইক্রো প্রসেসরের প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চীনের টেক কোম্পানীগুলোকে বিশেষ করে হুয়াওয়েই-এর প্রবেশাধিকার খর্ব এবং আমেরিকাতে রপ্তানীযোগ্য চীনের পণ্যসামগ্রীর প্রতি কড়া নজরদারী। এছাড়াও রয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধে আমেরিকার স্বার্থের বিরুদ্ধে চীনের অবস্থানের কারণে চীনের বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনা। এই ‘নিয়ন্ত্রণ এবং দমন নীতি’-র সমালোচনা করে প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং বলেন যে আমেরিকা চীনকে বাধ্য করছে কঠোর পদক্ষেপ নিতে। ফলশ্রুতিতে সরকারের সিদ্ধান্ত হচ্ছে ২০২৩ সালের সামরিক খাতে বাজেট শতকরা সাত দশমিক দুই বৃদ্ধি করা যেটা অর্থমূল্যে সেটা দাঁড়ায় ২২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হবে চীনের সামরিক বাহিনী ‘পিপলস লিবারেশন আর্মি’-কে আধুনিকায়ন করার জন্য। সেই সাথে তিনি এই আশা ব্যক্ত করেন যে চীনের জনগণও চীনের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য যে কোন বিদেশী শক্তির মোকাবিলা করতে পিছপা হবে না। উল্লেখ্য যে, ২০২১ সালে চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির শততম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে শি চিনপিং দৃঢ় কন্ঠে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে যদি কোন দেশ চীনকে কটাক্ষ, নিপীড়িত কিংবা বশীভূত করার চেষ্টা করে তবে চীনের জনগণ সেই দেশের মাথা ইস্পাতের তৈরি গ্রেট ওয়ালের সাথে ঠুকে গুঁড়িয়ে দিবে। তখন তার দেয়া এই কড়া হুশিয়ারীতে পশ্চিমা দেশগুলি নড়েচড়ে বসেছিল। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল যে চীন এখন অনেক বদলে গেছে। ফলে ২০২৩ সালের মার্চে দেয়া অনুরূপ হুশিয়ারীতে ওয়াশিংটন তৎক্ষণাৎ তার মুখপাত্র নেড প্রাইস-এর মাধ্যমে চীনকে আশ্বস্ত করে যে আমেরিকা কোনভাবেই চীনের সাথে সংঘাতে জড়াতে চায় না। তারা চীনের প্রতি কোন নিয়ন্ত্রণ কিংবা দমন নীতি গ্রহণ করেনি বরং আমেরিকা চীনের সাথে ন্যায্য এবং গঠনমূলক প্রতিযোগিতাতে বিশ্বাসী। কূটনৈতিক এই রেটোরিকের আড়ালে আমেরিকা কিন্তু তলে তলে ঠিকই চীনকে প্রতিহত করার জন্য জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতকে নিয়ে তৈরি করে কোয়াড। চীনও বোকা নয়, তাই সে বসে না থেকে মনোনিবেশ করে তার সামরিক শক্তিকে ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস স্ট্যান্ডার্ড’-এ নিয়ে যাওয়ার প্রকল্পে।
বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী সামরিক বাহিনী ‘পিপলস লিবারেশন আর্মি’-র জন্ম ১৯২৭ সালে যখন চেয়ারম্যান মাও-এর নেতৃত্বে চীনের কম্যুনিস্ট পার্টি গৃহযুদ্ধে লিপ্ত ছিল ন্যাশনালিস্ট কোয়ামিনতাং-এর সাথে। গেরিলা ধাঁচের এই আর্মি ছিল মূলত জনগণের আর্মি। সেই সময়কার ‘রিপাবলিক অব চায়না’-র ‘পিপলস রেভ্যুলেশনারি আর্মি’-র ভেতরকার কম্যুনিস্ট ভাবধারার সদস্যরা এসে যোগ দেয় চেয়ারম্যান মাও-এর গেরিলা বাহিনীতে যা কিনা রেড আর্মি নামে পরিচিত ছিল। ১৯৩৪-৩৫ সালে কোয়ামিনতাং-এর শক্তিশালী ‘পিপলস রেভ্যুলেশনারি আর্মি’-র সাথে কৌশলগত লড়াইয়ের অংশ হিসেবে রেড আর্মির সদস্যরা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে সাউদার্ন প্রভিন্স চিয়াংশি থেকে পিছু হটে সবাই এসে মিলিত হয় চীনের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত শানশি প্রভিন্সের ইয়ান’আন শহরে। দীর্ঘ এক বছর ব্যাপী এই দুষ্কর পদযাত্রাতে চেয়ারম্যান মাও নিজে ‘ফার্স্ট রেড আর্মি’-র নেতৃত্বে ছিলেন। রেড আর্মির এই দীর্ঘ পদযাত্রাকে ‘লং মার্চ’ নামে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়ে থাকে যে এই ‘লং মার্চ’-এর কারণেই চেয়ারম্যান মাও কম্যুনিস্ট পার্টির একজন অবিসংবাদিত নেতাতে পরিণত হন। কিন্তু ‘সেকেন্ড সাইনো-জাপানিজ ওয়ার’-এর সময় (১৯৩৭ থেকে ১৯৪৫ সাল) কম্যুনিস্ট পার্টি এবং কোয়ামিনতাং একত্রে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। সেই সময় রেড আর্মি ‘এইটথ রাউট আর্মি’ এবং ‘নিউ ফোর্থ আর্মি’ নামে ‘পিপলস রেভ্যুলেশনারি আর্মি’-এর দুইটি পৃথক ইউনিট হিসেবে যোগ দেয়। ১৯৪৫ সালে জাপানের আত্মসমর্পনের পরও কম্যুনিস্ট পার্টি রেড আর্মির এই দুইটি ইউনিটকে আলাদা করে রাখে। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে দলীয় সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ‘এইটথ রাউট আর্মি’ এবং ‘নিউ ফোর্থ আর্মি’ এই দুইটি পৃথক ইউনিট একীভূত করে তৈরি করা হয় ‘পিপলস লিবারেশন আর্মি’। ১৯৪৯ সালে ‘পিপলস লিবারেশন আর্মি’ কোয়ামিনতাং-কে গৃহযুদ্ধে পরাজিত করে ফলে কম্যুনিস্ট পার্টির হাতে গঠিত হয় নয়া চীন বা ‘পিপলস রিপাবলিক অব চায়না’। ১৯৪৯ সালেই কম্যুনিস্ট পার্টি ‘পিপলস লিবারেশন আর্মি’-কে ঢেলে সাজাতে শুরু করে। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ‘পিপলস লিবারেশন আর্মি’-এর গ্রাউন্ড ফোর্সের পাশাপাশি যোগ করা হয় এয়ারফোর্স এবং তার কিছুদিন পরে নেভী। প্রথম দিকে পিপলস লিবারেশন আর্মির একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য ছিল সাধারণ কৃষক। তখন সেনা সদস্য এবং অফিসারদের মধ্যে কোন র্যাং কিং ছিল না। কিন্তু ১৯৫৫ সালে পিপলস লিবারেশন আর্মিতে র্যাং কিং প্রথা চালু করা হয়।
১৯৫০ সালে পিপলস লিবারেশন আর্মির একটি অংশ ‘পিপলস ভলান্টিয়ার আর্মি’ নামে কোরিয়ান যুদ্ধে অংশ নেয় এবং এই যুদ্ধের কারণে চীনের বিমানবাহিনীর চৌকসতা অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়। ১৯৬২ এবং ১৯৬৭ সালে পিপলস লিবারেশন আর্মির গ্রাউন্ড ফোর্স ভারতের সাথে সীমান্ত নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্তু এই যুদ্ধে তারা তেমন সুবিধা করতে পারেনি। কালচারাল রেভ্যুলেশনের আগে পিপলস লিবারেশন আর্মি কম্যুনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক কর্মকান্ডে বিশেষ প্রভাব ফেলতে সক্ষম ছিল যা কিনা কম্যুনিস্ট পার্টির লীডারদের জন্য ছিল কিছুটা অস্বস্তিকর। ১৯৬৫ সালে কালচারাল রেভ্যুলেশনের প্রারম্ভেই পিপলস লিবারেশন আর্মি থেকে র্যাংকিং প্রথাকে বিলুপ্ত করা হয়। চীনের আর্মির এই পদক্ষেপে অনুপ্রাণিত হয়ে সেই সময় আলবেনিয়া তার দেশের আর্মি থেকেও র্যাংকিং প্রথা বিলুপ্ত করে। একই অনুপ্রেরণায় ১৯৭৫ সালে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের একজন খেতাবপ্রাপ্ত কর্নেল (অবঃ) র্যং কবিহীন সেনাবাহিনী গঠনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ‘সিপাহী বিপ্লব’ ঘটিয়ে ফেলেন। তার এই হঠকারিতার কারণে দেশের মানুষের কাছে তিনি একজন খলনায়কে পরিণত হন। চীন ১৯৭৯ সালে সাইনো-ভিয়েতনামিজ যুদ্ধের পর পিপলস লিবারেশন আর্মিকে ঢেলে সাজাতে শুরু করে। কারণ এই যুদ্ধে তারা তাদের যথাযথ দক্ষতা দেখাতে ব্যর্থ হয়। এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে র্যাংকিং প্রথা ব্যতীত চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠিত করা যায় না, যা কিনা একটি আধুনিক এবং কার্যকরী সামরিক বাহিনী গঠনের পূর্বশর্ত। তাই ধীরে ধীরে পিপলস লিবারেশন আর্মিতে আবারও র্যাংকিং প্রথা চালু করা শুরু হয় যা কিনা ১৯৮৮ সালে গিয়ে পূর্ণতা পায়। এছাড়া পিপলস লিবারেশন আর্মির উপর কম্যুনিস্ট পার্টির পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপনের লক্ষ্যে চীনের তদানীন্তন প্যারামাউন্ট লীডার দেং শিয়াওপিং ১৯৮১ সালে সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের চেয়ারম্যান পদের দায়িত্ব নেন। তিনি নিয়ম করে দেন যে কম্যুনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারির অন্যান্য দায়িত্বের মধ্যে একটি হবে সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করা। অর্থাৎ কমান্ডার-ইন-চীফের দায়িত্ব পার্টির জেনারেল সেক্রেটারির উপর থাকাতে পিপলস লিবারেশন আর্মির উপর কম্যুনিস্ট পার্টির পূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় থাকবে।
‘ফু কোয়া, ছিয়াং বিং’ (রিচ কান্ট্রি, স্ট্রং মিলিটারি) -চীনা চার ক্যারেকটার বা শব্দের এই রাজনৈতিক মন্ত্র বা স্লোগানের জন্ম হয়েছিল ‘ডেমোক্রাসি ওয়াল’-এর সময়। দেং শিয়াওপিং চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি হয়ে ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি জনগণকে তাদের রাজনৈতিক মনোভাব প্রকাশের জন্য পরোক্ষভাবে কিছুটা উৎসাহিত করেছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৮ সালের নভেম্বরে থিয়েনআনমেন স্কয়ারের কাছাকাছি ‘শি-তান’ সড়কের পাশে একটি লম্বা ইটের দেয়ালে জনগণ বড় বড় অক্ষরে লেখা পোস্টার লাগাতে শুরু করে। তখন এই স্লোগান সম্বলিত একটি পোস্টার দেখা যায় সেই দেয়ালে। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে দেং শিয়াওপিং অবশ্য এই ‘ডেমোক্রাসি ওয়াল’-এর কালচার বন্ধ করে দেন। ‘ফু কোয়া, ছিয়াং বিং’ এই সেøাগানে উচ্চারিত হয়েছে একটি সমৃদ্ধ এবং শক্তিশালী চীনের যা কিনা চীনের জনগণ এবং সরকার উভয়েরই কাম্য। সেই জন্যে সরকার শক্তিশালী মিলিটারি গঠনের জন্য যখনই সামরিক খাতে ব্যয় বাড়িয়েছে জনগণ সেটাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাগত জানিয়েছে। আশির দশকের গোড়াতে চীন সরকার উপলব্ধি করে যে রাজনৈতিক কারণে এক সময় তাইওয়ান হয়ে উঠবে তাদের প্রধান সামরিক টার্গেট। কারণ পশ্চিমা দেশগুলি বিশেষ করে আমেরিকার প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় তাইওয়ান যে কোন মুহুর্তে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারে। অপরদিকে সাউথ চায়না সী-তে বিশেষ করে স্পার্টলি দ্বীপপুঞ্জে চীনের দখল ধরে রাখতে চীনের প্রয়োজন আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত একটি চৌকস মিলিটারি। তাই ১৯৮৫ সালে দেং শিয়াওপিং ‘কোয়ালিটি ওভার কোয়ান্টিটি’-এর উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সেই মোতাবেক শুরু হয় পিপলস লিবারেশন অব আর্মির সদস্য সংখ্যা কমিয়ে আনার অভিযান। একই সাথে চলে সামরিক প্রযুক্তির আধুনিকায়ন। ১৯৯৫ সালের ঘটনা, আমি তখন ‘বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব পোস্টস এন্ড টেলিকম্যুনিকেশনস’-এ মাস্টার্স করছি। হঠাৎ একদিন দেখি আমাদের ফরেন স্টুডেন্টস অফিসের এক ক্লার্ক খুব উৎফুল্ল মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বয়সে তরুণ সেই ক্লার্কের সাথে আমার বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। কারণ জিজ্ঞেস করতে সে জানাল যে, চীন রাশিয়ার একটি পুরাতন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ‘মিনস্ক’ কিনেছে। এর আগেও চীন অবশ্য ১৯৮৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে থেকে একটি পুরাতন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ‘এইচএমএএস মেলবোর্ন’ কিনেছিল। সেই তরুণ ক্লার্কটি উচ্ছ্বসিত কারণ চীন পুরাতন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলির নকশা এবং কলাকৌশল পর্যবেক্ষন করে এখন নিজেই এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার তৈরি করতে পারবে। আমি সেদিন টের পেয়েছিলাম যে চীনের জনগণ কিভাবে ‘ফু কোয়া, ছিয়াং বিং’ সেøাগান দ্বারা প্রভাবিত। তাই ১৯৯৯ সালের ৭ই মে তারিখে সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে অবস্থিত চীনের এ্যাম্বাসী যখন ন্যাটোর বোমাবর্ষণে ক্ষতিগ্রস্থ হয় তখন চীন সরকারের পাশাপাশি জনগণও ভীষণভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। চীন নতুন করে আবার অনুভব সেই পুরানো ‘ফু কোয়া, ছিয়াং বিং’ (রিচ কান্ট্রি, স্ট্রং মিলিটারি) সেøাগানের মাহাত্ম্য। দেশের নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য স্ট্রং মিলিটারির কোন বিকল্প নেই।
চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং-এর ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল মিলিটারির উর্দি বা ইউনিফর্ম গায়ে চড়িয়ে। ১৯৭৯ সালে ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর তিনি তার প্রভাবশালী পিতার বদৌলতে যোগ দেন তখনকার ডিফেন্স মিনিস্টার জেনারেল কং পিয়াও-এর জুনিয়র সহকারী হিসেবে। এই পদের কারণে তাকে তখন মিলিটারির ইউনিফর্ম পরতে হত। তিন বছরের এই চাকরির মেয়াদকালে তাকে পিপলস লিবারেশন আর্মির অনেক ক্ল্যাসিফাইড বা গোপনীয় ফাইল নিয়ে কাজ করতে হয়। ফলে পিপলস লিবারেশন আর্মি কিভাবে কাজ করে সেই সম্পর্কে তার একটি স্পষ্ট ধারণা জন্মে। বলা হয়ে থাকে সেখান থেকেই মিলিটারির প্রতি বিশেষ করে মিলিটারি প্যারেডের প্রতি তার এক প্রকার ‘অবসেশন’ তৈরি হয়। যে রকম অবসেশন আমরা দেখতে পাই উত্তর কোরিয়ার সুপ্রিম লিডার কিম জং-উন-এর ভেতর। ২০১২ সালে কম্যুনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি পদে নিয়োগ পাবার পর শি চিনপিং একই সাথে সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের চেয়ারম্যানের পদও পেয়ে যান। অর্থাৎ তিনি হয়ে যান পিপলস লিবারেশন আর্মির কমান্ডার-ইন-চীফ। তার পূর্বে অন্য কোন কমান্ডার-ইন-চীফের মিলিটারি ক্যারিয়ার ছিল না। তিনিই চীনের প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি কিনা মিলিটারির আধুনিকায়নের উপর সবচেয়ে বেশী জোর দিয়েছেন এবং চীনের সামরিক শক্তি বা ‘হার্ড পাওয়ার’-কে ব্যবহার করেছেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য। তার রাজনৈতিক এমবিশন ‘চায়নিজ ড্রিম’ রূপায়নের জন্য ‘সফট পাওয়ার’ এবং ‘হার্ড পাওয়ার’ এই দুই ধরণের ক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে তিনি জোর দেন। ‘সফট পাওয়ার’-কে সমৃদ্ধ করার জন্য প্রথমে তিনি ঐতিহ্যবাহী ‘সিল্ক রোড’-এর আদলে চীনকে কেন্দ্র সারা পৃথিবী জুড়ে একটি যোগাযোগ ব্যবস্থার অবকাঠামো গড়ে তোলার প্রকল্প হাতে নেন যা কিনা ‘বেল্ট এন্ড রোড’ নামে পরিচিত। দ্বিতীয়ত, ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’ প্রকল্পের মাধ্যমে তিনি চীনের হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিগুলিকে এমনভাবে বুস্ট-আপ করা শুরু করেন যাতে চীন এআই, ফাইভ-জি, এরোস্পেস, সেমিকন্ডাক্টর, ইলেক্ট্রিক ভেহিকল এবং বায়ো-টেক এরিয়াতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ বিশেষ করে আমেরিকা থেকে যেন এগিয়ে যেতে পারে। ‘সফট পাওয়ার’ খাতের এই দুইটি প্রকল্পকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য প্রয়োজন ‘হার্ড পাওয়ার’ বা সামরিক শক্তির উত্থান। তাই তিনি পিপলস লিবারেশন আর্মিকে ঢেলে সাজাতে উদ্যোগ দেন। প্রথমে তিনি নামেন দূর্নীতি দমন অভিযানে। সেই অভিযানে প্রায় একশত জেনারেলকে তিনি দূর্নীতি কিংবা অবিশ্বস্ততার অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন করেন। তার প্রতি অনুগতদেরকে জেনারেলের পদে নিয়োগ দিয়ে তিনি পিপলস লিবারেশন আর্মিতে তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করেন। তারপর মনোযোগ দেন ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স’ এবং ‘এন্টি শীপ ব্যালাস্টিক মিসাইল’ প্রযুক্তির মাধ্যমে নৌবাহিনীর আধুনিকায়নের। ২০৪৯ সালের মধ্যে শি চিনপিং পিপলস লিবারেশন আর্মিকে পরিণত করতে চান একটি এমন এক ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস’ শক্তিতে যাতে কিনা যে কোন গ্লোবাল যুদ্ধে তারা ‘ফাইট এন্ড উইন’ করার ক্ষমতা রাখবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে চীনের এই সামরিক শক্তির আধুনিকায়নের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা। ফলে সহজেই তাইওয়ানকে চাপের মুখে রাখা যাবে এবং সেই সাথে সাউথ চায়না সী-তে পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করা যাবে। শি চিনপিং চীনের সামরিক শক্তির প্রথম প্রয়োগ করেন ২০১৩ সালে। তখন চীন সাউথ চায়না সী-র স্পার্টলি দ্বীপপুঞ্জে ড্রেজিং করে বিশেষ কিছু স্ট্র্যাটেজিক পজিশনে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করা শুরু করে। শি চিনপিং নিজে এই প্রকল্পের দেখভাল করেন। চীনের গণমাধ্যমে এই কৃত্রিম দ্বীপ তৈরির কাজকে চিত্রিত করা হয় ‘বিল্ডিং এ গ্রেট ওয়াল অ্যাট সী’ (সমুদ্রে গ্রেট ওয়াল তৈরি করা) হিসেবে। গণমাধ্যমের এই প্রচারণা একদিক থেকে সত্য, কারণ এর ফলে সাউথ চায়না সী-র বিতর্কিত অঞ্চলে চীনের আগ্রাসী মূর্তি দেখে অন্যান্য দাবীদার দেশগুলির মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দেয়। বিশেষ করে ফিলিপিন্সের। কারণ স্পার্টলি দ্বীপপুঞ্জের মালিকানা নিয়ে চীনের সাথে তাদের বিরোধ চলছে। ফিলিপিন্সকে সামরিক সাহায্য দিতে আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া এখন সেখানে প্রায়ই তাদের যুদ্ধ জাহাজ পাঠায়। ফলে চীনের নৌবাহিনীকে দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করতে হয় সেই সব যুদ্ধ জাহাজগুলিকে। গত দশ বছরের বেশী সময় ধরে চীন তার নৌবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করতে পেরেছে বলেই আজ তারা বলিষ্ঠভাবে তাইওয়ান এবং সাউথ চায়না সী ইস্যুতে পশ্চিমা শক্তিকে রাজনৈতিক এবং সামরিকভাবে প্রতিহত করতে পারছে। অন্যদিকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ‘বেল্ট এন্ড রোড’ প্রকল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চীনকে প্রথমে আফ্রিকার দেশগুলিতে নজর দিতে হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে আফ্রিকার জিবুতীতে চীন একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে। সেটিই ছিল চীনের প্রথম ওভারসীজ মিলিটারি বেইজ। এরপর প্রশান্ত মহাসাগরের কিছু দ্বীপরাষ্ট্র যখন তাইওয়ানকে বাদ দিয়ে চীনকে স্বীকৃতি দেয়া শুরু করে তখন চীন তাদেরকে ‘নিরাপত্তা প্রদান’-এর চুক্তি করে। বিশেষ করে সলোমন দ্বীপের সাথে এই চুক্তি সম্পন্ন হওয়ায় অস্ট্রেলিয়া বেশ বিপাকে পড়ে যায়। কারণ তাদের গোড়দোরায় চাইনিজ মিলিটারির বিচরণ তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। বর্তমানে চীন আরও ১৯টি দেশে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সম্ভাবনা বিবেচনা করে দেখছে। স্বাভাবিকভাবেই চীনের এই সামরিক শক্তির উত্থান পশ্চিমা বিশ্বের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখা যাচ্ছে যে দেং শিয়াওপিং-এর রাজনৈতিক দর্শন ‘চায়না শুড হাইড ইটস স্ট্রেংথ এন্ড বিড ইটস টাইম’ (উপযুক্ত সময় না আসা পর্যন্ত শক্তি প্রদর্শন থেকে বিরত থাকা) থেকে শি চিনপিং সরে এসেছেন। কারণ তিনি মনে করেন সামরিক শক্তি প্রদর্শনের এখনই উপযুক্ত সময়। (চলবে)
কাজী সাব্বির আহমেদ
কলাম লেখক । টরন্টো