বৈধ করার পর থেকে গাঁজা-সংশ্লিষ্ট গাড়ি দুর্ঘটনার হার বৃদ্ধি পেয়েছে ‘ব্যাপক ভাবে’

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : অটোয়া হাসপাতালের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গাঁজা-সংশ্লিষ্ট (cannabis) গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হয়ে অন্টারিওর জরুরী বিভাগে আসা ব্যক্তিদের বার্ষিক হার গত ১১ বছরের সময়কালে নাটকীয়ভাবে বেড়েছে।

গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত জামা নেটওয়ার্ক ওপেন-এর সমীক্ষায় ২০১০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে জরুরী কক্ষে আসা গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত লোকদের মধ্যে কতজনের ক্ষেত্রে গাঁজার সংশ্লিষ্টতা ছিল সেটি বিবেচনায় নেয়া হয়। সমীক্ষায় ২০১৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকার গাঁজা বৈধ করার পর থেকে গাঁজা সেবন এবং গাড়ি চালনার অভ্যাসের পরিবর্তনও পরীক্ষা করা হয়। সমীক্ষার প্রধান লেখক ড. ডেনিয়েল মাইরান যিনি অটোয়া ইউনিভার্সিটির ফ্যামিলি মেডিসিন বিভাগের চোলাই গবেষণা ইন্সটিটিউটের ফেলো, বলেন, “আমাদের উপাত্ত গাঁজার অনিষ্টকর প্রভাব এবং গাড়ি দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে।” 

“২০১০ সালে অন্টারিওতে গাঁজা-সংশ্লিষ্ট সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের জরুরী কক্ষে আসার হার বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল খুবই বেশি।”

তিনি আরও বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে জরুরী বিভাগে আসার সঙ্গে মারিজুয়ানার (গাঁজা) ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে বলে সমীক্ষায় দেখা গেছে। মারিজুয়ানা বৈধ করার পরই এটা ঘটেছে।

গাঁজা সেবনের কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে আসা লোকের সংখ্যা ২০১০ সাল থেকে এখন অবদি বেড়েছে ৪৭৫.৩ শতাংশ। ছবি : গেটি ইমেজেজ

কানাডায় ২০১৮ সালের ১৭ অক্টোবর মারিজুয়ানার বৈধতা দেওয়া হয়। ২০২০ সালে স্ট্যাটিস্টিক্স কানাডার রিপোর্টে দেখা যায়, এই বৈধতা দেয়ার বিষয়টি এর ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার সাথে সম্পর্কিত ছিল, বিশেষ করে ২৫ বছর ও তার বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে। বৈধতা দেয়ার পাশাপাশি দেশে ড্রাইভিং আইনে সংশোধনী আনা হয় এবং রক্তে টেট্রাহাইড্রোকানাবিনল (টিএইচসি) স্তরের মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। 

এর কারণ, কানাডার মাদকাসক্তি কেন্দ্রের (Canadian Centre on Substance Use and Addiction) মতে গাঁজা গাড়ি চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান এবং শারীরীক সচলতার ক্ষমতা বিনষ্ট করতে পারে এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়।

বছরের পর বছর গাঁজা সেবনের হার বাড়তে থাকায় মাইরান ও তার গবেষক দল গাঁজা-সংশ্লিষ্ট ড্রাইভিং প্রতিবন্ধকতায় কোনও পরিবর্তন ঘটেছে কিনা সেটি পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছেন।

মাইরান গ্লোবাল নিউজকে বলেন, “বৈধতা দেয়ার পর্যায়ে জনস্বাস্থ্যের প্রধান উদ্বেগগুলির মধ্যে ছিল এটাই যে, এর ফলে গাঁজা সেবন করে গাড়িচালনা এবং সেজন্যে সড়ক নিরাপত্তার সঙ্কট বাড়তে পারে।”

“এমন বিপুল পরিমাণ তথ্যাদি রয়েছে যাতে দেখা যাচ্ছে, গাঁজা সেবনে লোকেদের গাড়ি চালনার সক্ষমতার ক্ষতি করতে পারে, তবে তা গাড়ি চালনার নিরাপত্তার কারণে গাঁজা সম্পর্কিত বিধিমালা পরিবর্তন করতে গেলে কী হতে পারে সে সম্পর্কিত স্পষ্ট প্রশ্নের চেয়ে কম।”

বৃদ্ধির পরিমাণ ৪৭৫%

সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, গাঁজা-সংশ্লিষ্ট সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে জরুরী বিভাগে আসা লোকের সংখ্যা ২০১০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বেড়েছে ৪৭৫.৩ শতাংশ।

গবেষকরা দেখেছেন, ওই সময়ের মধ্যে অ্যালকোহন পানের সাথে সংশ্লিষ্ট গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসা লোকের হার বেড়েছে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ।

এই উপাত্ত সংগ্রহের জন্য গবেষকরা অন্টারিওর জরুরী বিভাগে আসা দুর্ঘটনায় আহতদের (মোটর গাড়ি চালক, পথচারী ও সাইকেল চালক) চিকিৎসার রেকর্ড পরীক্ষা করেন। তারা ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের রেকর্ডগুলি পরীক্ষা করেন।

এরপর গবেষকরা ক্যানাবিজ (গাঁজার ভিন্ন প্রকার) সংশ্লিষ্টতার নথিপত্রের সন্ধান করেন। মাইরান ব্যাখ্যা করে বলেন, “কেউ গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হয়ে জরুরী বিভাগে এলে চিকিৎসকরা এই দুর্ঘটনার সাথে ক্যানাবিজ সেবনের ভূমিকা আছে বলে ধারণা করেছেন কিনা।”

গবেষণায় দেখা যায়, ক্যানাবিজ বৈধকরণের পর (২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের মার্চের মধ্যবর্তী সময়ে) এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গাড়ি দুর্ঘটনায় আহতদের জরুরী বিভাগে চিকিৎসা নেবার ত্রৈমাসিক হার ৯৪ শতাংশ বেড়ে যায়। এটি বৈধ করার সময় ক্যানাবিজজাত দ্রব্য নির্দিষ্ট করে সীমিত সংখ্যক স্টোরে বিক্রির অনুমতি দেয়া হয়েছিল।

আর, অধিকতর বেশি সংখ্যক স্টোরে এবং ক্যানাবিজজাত আরও নানা দ্রব্য বৈধ করে দেয়া হলে (২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে) গবেষকরা এর ব্যবহারে বৃহত্তম বৃদ্ধি লক্ষ করেন, হারের দিক থেকে যা ছিল ২২৩ শতাংশ।

সমীক্ষার লেখকরা উল্লেখ করেন যে, বৈধ করার আগে থেকেই ক্যানাবিজ সংশ্লিষ্ট গাড়ি দুর্ঘটনায় আহতদের জরুরী বিভাগে চিকিৎসা নেওয়ার ঘটনা বাড়ছিলো। আর বাজারে বিপণন শুরুর পরিণতিতে হয়তো এর পরিমাণ আরও বেড়েছে।

সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে যে, তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের, বিশেষ করে পুরুষদের ক্ষেত্রে “ক্যানাবিজ-সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনায় আহত হবার বাড়তি ঝুঁকি আছে।”

ক্যানাবিজ-সংশ্লিষ্ট গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হয়ে জরুরী বিভাগে আসা ব্যক্তিদের প্রায় অর্ধেকের অ্যালকোহল পানের ইতিহাস আছে বলেও সমীক্ষায় দেখা যায়।

জখমের প্রকৃতি সম্পর্কে মাইরান বলেন, এগুলি “গুরুতর” ধরণের। তিনি বলেন, “ক্যানাবিজ সংশ্লিষ্ট গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হয়ে জরুরী বিভাগে আসা যেসব ব্যক্তির নথিপত্র রাখা হয়েছে তাদের ৪৯.৫ শতাংশ হাসপাতালে ভর্তি হন এবং ২১ শতাংশ ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে।”

“আর এর তুলনায়, সাধারণ গাড়ি দুর্ঘটনায় আহতদের মাত্র ছয় শতাংশকে হাসপাতালে এবং মাত্র ১.৮ জনকে আইসিইউতে ভর্তি হতে হয়েছে। সুতরাং আমরা যাদের নিয়ে কথা বলছি তাদের ক্ষেত্রে আইসিইউতে ভর্তির সম্ভাবনা ২০ গুণ বেশি।”

সমস্যাটি সারা দেশের

সমীক্ষাটি অন্টারিওর ওপর কেন্দ্রীভূত হলেও মাইরান মনে করেন, একইরকম পরিবর্তন সারাদেশেই ঘটে থাকতে পারে। তিনি বলেন, “১০, ১৫ বছর ধরে ক্রমেই আরও বেশি বেশি মানুষ ক্যানাবিজ  সেবন

করছে, আর বেশি মানুষ এটি সেবন করায় ক্যানাবিজে বুঁদ মানুষের গাড়ি চালানোর ঘটনাও বাড়ার সম্ভাবনা।”

যদিও এখন এই বিষয়ে গবেষণা সীমিত, তিনি বলেন, ক্যানাবিজ-সংশ্লিষ্ট গাড়ি দুর্ঘটনার নিরসন ও রোধের জন্য ভবিষ্যতে আরও সমন্বিত গবেষণা হবে বলে তিনি আশাবাদী।

ট্রাফিক ইনজুরি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (TIRF) গবেষণা সহযোগী স্টিভ ব্রাউন বলেন, কয়েক বছরে ক্যানাবিজ-সংশ্লিষ্ট গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার বাড়তে দেখেছে তার প্রতিষ্ঠান।

টিআইআরএফ-এর সারাদেশে মৃত্যুর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত কানাডায় গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত চালকদের মধ্যে ২১.৫ শতাংশ গাঁজাসেবি ছিলেন বলে পরীক্ষায় ধরা পড়েছে। তবে ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের শেষ পর্যন্ত সময়কালে এই সংখ্যাটা ২৬.৪ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।

তিনি বলেন, “আরেকটি বিষয় বিবেচনা করার মত যে, নিহত যেসব চালকের গাঁজা সেবনের রেকর্ড পাওয়া গেছে তাদের বেশিরভাগ অ্যালকোহলও পান করতেন।”

“এটি একান্তই অন্টারিওর সমস্যা নয়,” যোগ করেন তিনি।

“ক্যানাবিজ পজিটিভ চালকের শতকরা হার ২০১৮ সালের অক্টোবরের পর বেড়েছে। সেটা কিছু প্রদেশে ঘটেছে পরিমিত হারে, কিছু প্রদেশে বেশ স্পষ্টভাবে।”