কানাডায় নবাগত শিশুরা জটিল স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে
স্বাস্থ্যকর খাবারের দাম, বহুমুখি কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়ার সুযোগ ইত্যাদি নবাগতদের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : সাধ্যমত চেষ্টা করেও মোমিনা দেখছেন, তার বাচ্চাদের সক্রিয় রাখা ও স্বাস্থ্যকর খাবার জোগানো কষ্টকর। পাকিস্তান থেকে প্রায় সাত বছর আগে কানাডায় আসা এই একক মায়ের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হলো জিনিসের দাম।
অন্টারিওর রিভারডেল মহল্লার হ্যামিলটনে বসবাসরত রেজা সিবিসি নিউজকে বলেন, “আমি বিভিন্ন পণ্যের প্রোগ্রাম ও দাম জিজ্ঞাসা করি, সেগুলো অনেক দামি, আমার সাধ্যের বাইরে।”
রেজা বলেন, ১১ ও ৫ বছর বয়সী তার দুই বাচ্চা “ভালো করছে”, কিন্তু তিনি স্বীকার করেন যে, ওদের পুষ্টিকর খাবারের জোগান দিতে রীতিমত “লড়াই’ করতে হয়।
আর তার মত অন্য অভিবাসীদের প্রসঙ্গে রেজা বলেন, ভাষার বাধা এবং দীর্ঘ কর্মঘণ্টা বাবা-মায়েদের জন্য শিশুদের পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে উৎসাহিত করা কঠিন করে তুলতে পারে।
হ্যামিলটনের ম্যাকমাস্টার শিশু হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. গীতা ওয়াহি সিবিসি নিউজকে বলেন বলেন, নবাগত শিশুদের মধ্যে যে স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা যায় তাতে এ ধরণের বাধার অবদান থাকতে পারে।
ওয়াহি বলেন, পেশাগত কাজের মাধ্যমে তিনি লক্ষ্য করেছেন, ক্রমবর্ধমান সংখ্যক নবাগত শিশু স্থূলতা ও টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে।
তিনি বলেন, “বিশেষ করে শিশুর স্থূলতার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যে, এখানে আসার আগে নবাগত শিশুদের স্থূলতার হার প্রায়ই কম থাকে এবং সময়ের সাথে সাথে তাদের মধ্যে স্থূলতার হার বেড়ে কানাডার জনসংখ্যায় বর্তমান হারে পৌঁছে যায়।”
এই বিষয়টি উল্লেখকারী তিনিই একমাত্র ব্যক্তি নন।
ইমার্জিং রিসার্চ সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দেখতে পেয়েছে যে, জীবনযাত্রার পরিবেশের কারণে কানাডার অভিবাসী শিশুদের মধ্যেও প্রাপ্তবয়স্কদের জটিল স্বাস্থ্যসমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।
কানাডার শেষ গবেষণায় স্বাস্থ্যবান অভিবাসী প্রভাবের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে যেখানে একজন অভিবাসী নতুন দেশে এসে বসতি স্থাপনের পর তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে।
একই ঘটনা অন্য দেশ থেকে কানাডায় আসা শিশুদের ক্ষেত্রেও ঘটছে কিনা তা স্পষ্ট নয়, তবে গবেষকরা বলছেন, এমন প্রবণতা আছে যেখানে কিছু তরুণ অভিবাসীর ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যহীনতার আভাস মেলে।
ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটির মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. সোনিয়া আনন্দ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা নবাগত শিশুদের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্কদের মত জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা, যেমন ডায়াবেটিসের সংক্রমণকে “আতঙ্কজনক পর্যবেক্ষণ” হিসাবে বর্ণনা করেন।
সিবিসি নিউজকে বলেন তিনি বলেন, “শিশুর জটিল রোগ থাকার মানে, এটি তার ভবিষ্যত স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলবে এবং তার জীবনকাল সংক্ষিপ্তও করতে পারে। তাই আমি এটিকে একটি জরুরী সমস্যা বলে মনে করি।”
আনন্দ বলেন, ঝুঁকির কিছু কারণের মধ্যে আছে শিশুর জাতিগত পটভূমি, তার পরিবারের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, পুষ্টিকর খাবারের প্রাপ্যতা এবং কায়িক শ্রমের মাত্রা।
কানাডায় আসার পর অভিবাসী শিশুদের দ্রুত স্বাস্থ্যহানি ঘটে
এদিকে দ্যকনভারসেশন.কম এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দারিদ্র্যমুক্ত, স্বাস্থ্যকর সুখি ভবিষ্যৎ: এটাই কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে আসা বহু নতুন অভিবাসী ও শরণার্থীর প্রত্যাশা। কঠিন পরিস্থিতি ও খাদ্যাভাব পেছনে ফেলে এসে তারা উত্তর আমেরিকার দেয়া নিরাপত্তা এবং অপেক্ষাকৃত সচ্ছলতা বরণ করেন। কিন্তু খুব কম সংখ্যকই কল্পনা করতে পারেন যে, অভিবাসন তাদের পরিবারের কল্যাণ নষ্ট করবে এবং দ্রুত স্বাস্থ্যহানির দিকে ঠেলে দেবে।
প্রতিবেদনি তৈরী করেন ইউনিভার্সিটি অফ সাস্কাচুয়ান এর জনস্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক হাসান ভাতানপারস্ত এবং একই ইউনিভার্সিটির জনস্বাস্থ্য বিভাগের পোস্টডক্টরাল ফেলো জিনি লেন।
তারা বলেন, তার পরও গত ১৫ বছরের গবেষণা সমীক্ষাগুলোতে দেখা যায়, অভিবাসীরা কানাডীয়দের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো স্বাস্থ্য নিয়ে আসেনÑ তাদের মধ্যে স্বল্প সংখ্যকেরই জটিল রোগ যেমন হৃদরোগ, ক্যান্সার ও ডায়াবেটিস থাকেÑ কিন্তু কানাডায় অবস্থানের সময়টা দীর্ঘতর হবার সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে।
স্বাস্থ্যের এই অবনতি শিশুদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সাসকাচুন ইউনিভার্সিটির স্কুল অব পাবলিক হেলথ অ্যান্ড কলেজ অব ফার্মাসি অ্যান্ড নিউট্রিশনের প্রফেসার ও পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসাবে আমরা সম্প্রতি কানাডার প্রথম সমন্বিত গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করেছি যেখানে এদেশে আসার পর অভিবাসী ও শরণার্থী শিশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়।
অ্যাপ্লায়েড ফিজিওলোজি, নিউট্রিশন অ্যান্ড মেটাবলিজম শীর্ষক জার্নালে প্রকাশিত ওই গবেষণায় দেখা যায়, ওইসব শিশুদের অনেকের মধ্যে বেশ কিছু স্বাস্থ্যগত উদ্বেগের বিষয় এবং পুষ্টির ঘাটতি আছে।
উচ্চতর রক্তচাপ, অস্বাস্থ্যকর কোলেস্টেরল
হাসান ভাতানপারস্ত ও জিনি লেন বলেন, সাসকাচুনের সাসকাটুন এবং রেজিনা অঞ্চলে আমাদের গবেষণায় ৩০০ অভিবাসী ও শরণার্থী শিশুকে
পরীক্ষা করে দেখা যায়, নবাগত এসব শিশু প্রায়শ পাশ্চাত্যের খাদ্যতালিকা ও অলস জীবনযাত্রা গ্রহণ করে। কিছু বাবা-মা শিশুর অতিরিক্ত খাওয়া এবং পাশ্চাত্যের খাদ্য তালিকায় প্রচুর ক্যালরি থাকার বিপদ সম্পর্কে অসচেতন।
সব মিলিয়ে, দেখা গেছে, নবাগত শিশুদের মধ্যে রক্তচাপ প্রান্তসীমায় বা উচ্চ মাত্রায় পৌঁছে গেছে Ñ যা কানাডীয় শিশুদের চেয়ে যথেষ্ট বেশি।
আমাদের গবেষণার ৩৬ শতাংশ শিশুর ক্ষেত্রে জিঙ্ক বা দস্তা গ্রহণের অপর্যাপ্ততা দেখা গেছে যেটি শরীর গঠন ও বিকাশের জন্য অত্যাবশ্যক।
৫২ শতাংশ শিশুর শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা অস্বাস্থ্যকর স্তরের, অথচ কানাডীয় শিশুদের ক্ষেত্রে তা আছে মাত্র ৩৫ শতাংশের। উল্লেখ করার মত বিষয় যে, উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল বর্ধিত চাপ সৃষ্টির বড় ঝুঁকি।
অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু গ্রুপ, যেমন দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীরাÑ নির্দিষ্ট করে নারীরাÑ কানাডায় যত বেশিদিন ধরে বসবাস করেন ততই বেশি উচ্চ রক্তচাপে আক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন।
অ-ইউরোপীয় নবাগতরাও সময়ের সাথে সাথে কানাডায় জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তিদের তুলনায় তাদের নিজেদের স্বাস্থ্যের মূল্যায়ন এবং বডি মাস ইনডেক্স (BMI) বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবনতি দেখতে পান।
দারিদ্র্য ও উন্নতির সুযোগহীন চাকরি
স্বাস্থ্যের এই অবনতি কেন? হাসান ভাতানপারস্ত ও জিনি লেন তাদের প্রতিবেদনে বলেন, কানাডা অপেক্ষাকৃত প্রচুর খাবার, সুলভ স্বাস্থ্যসেবা এবং একটি মানসম্মত জীবনযাত্রার নিশ্চয়তা দেয় যা বিশে^ সর্বোচ্চ মানের। তাই গবেষণার ফলগুলি চলতি ধারনার বিপরীত মনে হতে পারে।
এর উত্তর নিহিত আছে অভিবাসী ও শরণার্থীদের পেছনে ফেলে আসা এবং এখানে এসে যে পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন সেই উভয় পরিস্থিতির মধ্যেই।
কিছু অভিবাসী এখানকার পরিস্থিতির কারণে আগের স্বপ্নগুলি বিপর্যস্ত দেখতে পান। তারা অপেক্ষাকৃত দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করেন, ক্যারিয়ারে উন্নতির সুযোগহীন এমন চাকরি করেন যা তাদের অভিজ্ঞতা ও সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ব্যর্থ। কেউ কেউ উচ্চতর যোগ্যতাসম্পন্ন পেশাজীবী হিসাবে কানাডায় আসেন, যারা নতুন দেশে তাদের সম্ভাবনার বিষয়ে আশাবাদী থাকেন, কিন্তু অর্থবহ, যথাযোগ্য সম্মানীর চাকরি খুঁজে পান না। কিছু অভিবাসী যারা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাত্রার স্বপ্ন দেখতেন তারা ভাষা ও শিক্ষাগত বাধার কারণে অর্থনীতির সর্বনিম্ন স্তরে কঠোর সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন।
কানাডায় জীবন মানিয়ে নেওয়ার চাপ অনেক অভিবাসী পরিবারের স্বাস্থ্যহানি ঘটায়। অনেকে অভিবাসনের ফলে তাদের সামাজিক সহায়তা নেটওয়ার্ক হারিয়ে ফেলেন। সাংস্কৃতিকভাবে যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়াও তাদের জন্য দুরূহ হতে পারে।
অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বাঁচা
নবাগতদের স্বাস্থ্য, খাদ্য তালিকা ও জীবনযাত্রাপ্রণালী নিয়ে আমরা অসংখ্য অভিবাসী ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর সঙ্গে কথা বলেছি। অনেক নবাগত কানাডায় ভালো মানের জীবনযাত্রা অর্জনের বিষয়ে তাদের আশা এবং তা অর্জনে নিত্যদিন যে কঠোর সংগ্রাম করতে হচ্ছে সেকথা বলেছেন।
প্রত্যাশিত জীবনযাত্রা বা কাঙ্খিত জীবন অর্জনে তাদেরকে যে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে তাতে কারও কারও কানাডার জীবন সম্পর্কে মোহভঙ্গ হয়েছে।
খাদ্য নিরাপত্তাহীন অভিবাসীর ক্রমবর্ধমান সংখ্যা প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে একজন সেবাকর্মী বলেন, “অভিবাসী ও শরণার্থীরা অস্তিত্ব রক্ষার অবস্থায় আছে, কারণ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও প্রফেসাররা শপিং কার্ট ঠেলার কাজ করছেন।”
গবেষণায় দেখা যায়, ব্যক্তি বিশেষ যখন প্রত্যাশিত পর্যায়ের আর্থ-সামাজিক লক্ষ অর্জনে সক্ষম হন, তখন জাতিগত গ্রুপগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্যগত বৈষম্য হ্রাস পেতে পারে। যেভাবে, দীর্ঘ সময় ধরে স্বল্প আয়ে বেঁচে থাকলে শস্তা অস্বাস্থ্যকর খাবারের দিকে ঝুঁকতে হতে পারে এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টিতে অবদান রাখতে পারে।
খাবারের প্রাচুর্য
ক্ষুধার সঙ্গে পরিচিত শরণার্থী শিশুদের পক্ষে খাওয়ার আগ্রহ সামলে রাখা কঠিন হতে পারে।
রেজিনায় একজন স্বাস্থ্যসেবা কর্মী বলেন, “প্রচুর মানুষ তাদের খাওয়ার ধরণ পাল্টে ফেলেন। সেকারণেই তাদের ওজন খুব বেশি বেড়ে যায়। এখানে খাবারের প্রচুর্য আছে।”
একজন অভিবাসী সেবাকর্মী যোগ করেন, “অনেক সময় শরণার্থী শিবিরে সামান্য খাবার পাওয়া শিশুরা এখানে এসে খুব বেশি পরিমাণে খায়।”
আরেকটি বিষয় এমন যে, অনেক দেশের সংস্কৃতিতে মোটাসোটা শিশুদের স্বাস্থ্যবান মনে করা হয়। একটি পরিবার আমাদের জানিয়েছে যে, মাংস খাওয়া তাদের জন্য একসময় বিলাসিতা ছিল, মাসে এক বা দু’বার তারা মাংস খেতেন। এখন তারা এটিকে একইসঙ্গে আকাঙ্খিত ও প্রয়োজনীয় দুটিই মনে করেন।