কানাডা আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য স্থল সীমান্ত বন্ধ করেছে। তবু আরও উদ্বাস্তু এসেছে

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩: যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবেশ করা আশ্রয়প্রার্থীর স্রোত ঠেকাতে চলতি বছর কানাডা একটি পদক্ষেপ নেয়, যা প্রথম দেখায় ছিল দ্রুত সাফল্য: কয়েক দিনের মধ্যে সীমান্তের অননুমোদিত পথে ধরা পড়া লোকের সংখ্যা কমে আসে। খবর ওয়া লোন ও আনা মেহরার পাপেরনি-রয়টার্স।

কিন্তু পাঁচ মাস পর, কানাডায় উদ্বাস্তু হবার আবেদন জানানো লোকের সার্বিক সংখ্যা কমার পরিবর্তে বেড়েছে। এখন অনেকে বিমানে আসছেন, অনেকে ফেরত পাঠানোর ভয় না করে সীমান্তপথ গলে ঢুকে পড়ছেন এবং আশ্রয় প্রার্থনার আবেদন না করতে পারা পর্যন্ত লুকিয়ে থাকছেন। অভিবাসীদের সঙ্গে কাজ করেন এমন লোকেরা রয়টার্সকে এসব তথ্য দিয়েছেন।

আবেদনকারীদের বিপুল সংখ্যা দেখিয়ে দিচ্ছে মরিয়া লোকেদের জন্য দরোজা বন্ধ করে দেয়া দেশগুলোর পক্ষে কতটা কঠিন এবং অভাবিত সংখ্যক আশ্রয়প্রার্থী কত বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।

চলতি গ্রীষ্মে টরন্টোতে মাথা গোঁজার জায়গার সন্ধানে সংগ্রাম করতে থাকা হাজারও মানুষ রাস্তার ওপর ঘুমিয়েছে।

উইনিপেগ ইউনিভার্সিটির অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এবং হিউম্যান রাইটস প্রোগ্রামের পরিচালক শনা ল্যাবম্যান বলেন, “মূল বাস্তবতা এই যে, সুরক্ষার প্রয়োজন পূরণে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার কোনও কার্যকারিতা নেই।”

“সেটি কেবল লোকেদের আরও বেপরোয়া করে তোলে।”

কানাডা অভিবাসীদের স্বাগত জানাতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করে এবং মারাত্মক শ্রমিক ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে ২০২৫ সালের মধ্যে রেকর্ড সংখ্যক পাঁচ লাখ নতুন পারমানেন্ট রেসিডেন্ট গ্রহণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। তবে দেশটি মুখ্যত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির আওতায় আশ্রয়প্রার্থীদের আগমন নিরুৎসাহিত করে। চুক্তি অনুযায়ী উভয় দেশ আশ্রয়প্রার্থীদের ফিরিয়ে দেবে।

আশ্রয়প্রার্থীরা নিউ ইয়র্ক থেকে কানাডায় ঢুকছেন রক্সহ্যাম রোড ধরে। ২০২৩ সালের ২৪ মার্চ শুক্রবার নিউ ইয়র্কের চ্যামপ্লেইনে। দি কানাডিয়ান প্রেস/রাইয়ান রেমিওর্জ

তার পরও কেবল গত বছরই অননুমোদিত সীমান্তপথে ৩৯ হাজারের বেশি আশ্রয়প্রার্থী কানাডায় ঢুকেছে। এদের বেশিরভাগ নিউ ইয়র্কের রক্সহ্যাম রোডের একটি ধুলি ধূসর রাস্তা দিয়ে কুইবেকে আসেন, যার ফলে প্রদেশটি দ্রুতই স্বীকার করে নেয় যে তারা আশ্রয়প্রার্থীদের প্রবেশ সামলাতে পারছে না। আশ্রয়প্রার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় দ্রুত আবেদন প্রক্রিয়াকরণ ও তাদের বৃহত্তর গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে কানাডার সুনামে আকৃষ্ট হন।

পরিস্থিতির প্রতি সাড়া দিয়ে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র গত মার্চে তাদের দুই দশকের পুরনো আশ্রয়প্রার্থী সম্পর্কিত চুক্তি দ্য সেফ থার্ড কান্ট্রি এগ্রিমেন্ট সংশোধন করে। চুক্তিটি এখন দুই দেশের মধ্যকার ৪,০০০ মাইল দীর্ঘ স্থল সীমান্তের শুধু আনুষ্ঠানিক প্রবেশপথ বা স্থলবন্দরে কার্যকর না হয়ে পুরো সীমান্তেই কার্যকর হবে।

সম্প্রসারিত চুক্তির ফলে অননুমোদিত সীমান্ত পথে রোধ করা মানুষের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমিয়ে আনে।

কিন্তু সার্বিকভাবে, কানাডায় প্রবেশ করা আশ্রয়প্রার্থীদের সংখ্যা বেড়েছে। জুলাই মাসে কানাডায় উদ্বাস্তুর মর্যাদা পাবার আবেদনের মোট সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১২,০১০ টি- যা একক মাসের হিসাবে অন্ততপক্ষে ২০১৭ সালের জানুয়ারির পর সর্বোচ্চ এবং গত মার্চের ১০,১২০টিকে ছাড়িয়ে গেছে। এটি কানাডার অভিবাসন, উদ্বাস্তু ও নাগরিকত্ব বিষয়ক দপ্তরের হিসাব।

নিরাপত্তার দাবি

সংখ্যাটা অনেক বেশি হবার কিছু কারণ হল বেশি বেশি মানুষ বিমানবন্দরে অথবা অভিবাসন দপ্তরের স্থানীয় অফিসে আবেদন পেশ করছেন। সরকারী হিসাবে দেখা যায়, অনেকে আবেদন করছেন কানাডায় আসার কয়েক দিন, সপ্তাহ বা কয়েক মাস পর।

জুলাই মাসে যত আবেদন জমা পড়েছে তার মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পড়েছে বিমানবন্দরে। এই সংখ্যা মার্চের চেয়ে প্রায় ১৬ শতাংশ বেশি। যারা অভিবাসন দপ্তরে জমা দিয়েছেন তাদের সংখ্যা জুলাই মাসে জমা পড়া মোট আবেদনের প্রায় ৫৪ শতাংশ, যা মার্চের চেয়ে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বেশি। বছরের প্রথম অর্ধে আবেদনকারীরা যেসব দেশ থেকে এসেছেন সেগুলোর শীর্ষ পাঁচটি হলো মেক্সিকো, হাইতি, তুরস্ক, কম্বোডিয়া ও ভারত।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্প্রতি আশ্রয়প্রার্থীদের বিষয়ে একটি চুক্তি কার্যকর করেছে যার আওতায় দেশগুলো কিছু অভিবাসীকে দ্রুত ফেরত পাঠাতে পারবে। ব্রিটেন সরকার আশ্রয়প্রার্থীদের রুয়ান্ডায় পাঠানো সহজতর করার একটি আইন পাশ করতে যাচ্ছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন এমন বিধি চালু করেছে যাতে কেউ অবৈধভাবে সেদেশে প্রবেশ করলে তার আশ্রয় পাওয়া আরও কঠিন হবে।        

ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর রিফিউজি স্টাডিজের গবেষক ক্রেইগ ডেমিয়ান স্মিথ বলেন, “আশ্রয়প্রার্থনার সিদ্ধান্ত যারা নিচ্ছেন তাদের জন্য কানাডা হতে পারে অধিকতর সম্ভাব্য পছন্দ।”

এ বিষয়ে কানাডার অভিবাসন বিষয়ক মন্ত্রীর সাক্ষাৎকার পাওয়া যায়নি।

তার দপ্তরের একজন মুখপাত্র রেমি ল্যারিভিয়েরি এক বিবৃতিতে বলেন, “বিশে^ অভিবাসী ও উদ্বাস্তুর নজীরবিহীন প্রবাহ দেখা যাচ্ছে। আর কানাডা এই প্রবণতা থেকে মুক্ত নয়।”

ল্যারিভিয়েরি বলেন, “অননুমোদিত” ক্রসিংয়ে অনুপ্রবেশ মোকাবিলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি সংশোধন করেছে এবং এর “সম্প্রসারণের অর্থ এই নয় যে, কানাডায় আদৌ আশ্রয়প্রার্থনার আবেদন করা যাবে না।”

‘বাজে খেলোয়াড়রা’

অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, কানাডায় আসার কয়েকদিন বা সপ্তাহ পর আবেদন পেশ করা ব্যক্তিদের কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্প্রসারিত চুক্তির একটি ধারা প্রত্যাহারের আশা করছেন, যাতে বলা হয়েছে যে, কোনও আশ্রয়প্রার্থীকে সীমান্ত অতিক্রমের দুই সপ্তাহের মধ্যে ফেরত পাঠানো হবে যদি না তারা একটি ছোট ছাড় পায়।  

এটি অনেককে গোপনে, কখনও চোরাকারবারীদের সহায়তায় সীমান্ত পেরুতে এবং দুই

সপ্তাহ না পেরুনো পর্যন্ত লুকিয়ে থাকতে প্ররোচিত করেছে।

মন্ট্রিলের উদ্বাস্তু সেন্টার জানায়, গত সপ্তাহে তারা এক দিনে চারটি পরিবারকে সাহায্য করেছে যারা স্থলপথে কানাডায় প্রবেশ করে এক পক্ষকাল লুকিয়ে ছিলো।

কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক আবদুল্লাহ দাউদ রয়টার্সকে বলেন, “দুর্ভাগ্যক্রমে এটি তাদের জন্য খুব নিরাপদ চত্বর নয়। এটি বাজে খেলোয়াড়দের উৎসাহিত করে যারা এইসব লোকেদের সুযোগ নেয়।”

টরন্টোতে জেএফসি রিফিউজি সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক লোলি রিকো বলেন, সেখানে সম্প্রতি আসা ব্যক্তিদের প্রায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশই জানান, তারা চোরাকারবারীর সহায়তায় গোপনে কানাডায় প্রবেশ করেছেন এবং লুকিয়ে থেকেছেন।

রায়টার্স কানাডার বৃহত্তম নগরী টরন্টোতে সম্প্রতি আসা ১০ ব্যক্তির সাথে কথা বলেছে যারা উদ্বাস্তু হিসাবে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। তারা এসেছেন সুদান, উগান্ডা, মেক্সিকো এবং অন্যান্য দেশ থেকে। সবাই এসেছেন বিমানযোগে বৈধ ভিসা নিয়ে। কেউ কেউ এখানে আসার কয়েক দিন বা সপ্তাহের মধ্যে উদ্বাস্তু হবার আবেদন জানিয়েছেন।

তারা সবাই পারিবারিক সহিংসতা থেকে শুরু করে নানা কারণে দেশ ছাড়লেও তাদের আকর্ষণ করেছে একটি অভিন্ন বিষয়। সেটি হলো, মানবাধিকার রক্ষা ও আশ্রয়দানের বিষয়ে কানাডার সুনাম।

যুদ্ধ-বিধ্বস্ত সুদান থেকে আসা ৩৫ বছরের নারী হানা বাখিত বলেন, “আমি প্রথম যে দেশটির কথা ভেবেছি সেটি কানাডা।” তিনি মে মাসে ভিজিটরস ভিসার জন্য আবেদন করেন, জুলাই মাসে কানাডায় উড়ে আসেন এবং দুই সপ্তাহ পর উদ্বাস্তু হিসাবে আবেদন করেন।

তিনি একটি মসজিদে এবং একটি গির্জায় রাত কাটাচ্ছেন, টরন্টোর কেন্দ্রীয় আশ্রয় কেন্দ্রে একটি আসনের জন্য প্রতিদিন ফোন করছেন, তাকে কেবলই বলা হচ্ছে আসন খালি নেই। তার পরও কানাডায় আসতে পেরে তিনি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছেন।