কানাডায় প্রবেশযোগ্যতা নিরূপণে IELTS পরীক্ষা হল ‘টাকা কামানোর যন্ত্র’

অভিবাসীদের জন্য বাধ্যতামূলক ব্যয়বহুল ল্যাঙ্গুয়েজ টেস্ট ২ বছরের বৈধতার মেয়াদ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রবক্তারা

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : প্রতি বছর কানাডায় আসেন হাজার হাজার অভিবাসী। তাদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে ভাষার পরীক্ষা দিতে হয়। কিন্তু পরীক্ষায় তারা যে স্কোর অর্জন করেন তার মেয়াদ পরের দুই বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। এই পরীক্ষা নিয়ে সমালোচকদের অনেক আপত্তির অন্যতম এই মেয়াদের বিষয়টি। খবর শ্লোক তালাতি – সিবিসি নিউজ।

কানাডা সরকার গত বছর চার লাখ ৩১ হাজার ৬৪৫ জন পারমানেন্ট রেসিডেন্টকে  বরণ করে নিয়েছে –  এটি ছিল রেকর্ড পরিমাণে বেশি। এদের বেশিরভাগের জন্যই ইংরেজি অথবা ফরাসী ভাষায় দক্ষ হওয়ার শর্ত ছিল।     

আবেদনকারীরা দুটি মাত্র স্বীকৃত ভাষার পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন। একটি কানাডার অভিভাসন সংস্থার (IRCC) আয়োজনে দ্য কানাডিয়ান ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ প্রফিসিয়েন্সি ইনডেক্স (CELPIP), অন্যটি দ্য ইন্টারন্যাশনাল ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ টেস্টিং সিস্টেম (IELTS)। উভয় পরীক্ষার জন্যই ব্যয় করতে হয় ২৫০ ডলারের বেশি এবং এর ফলাফলের বৈধতার মেয়াদ মাত্র দুই বছর। এছাড়াও আছে ফরাসী ভাষার পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা। সেটিরও মেয়াদ একই, ব্যয়ও প্রায় সমান।

ফিলিপিন্সের ম্যানিলায় আইইএলটিএস (IELTS) পরীক্ষা দিচ্ছে সে দেশের নার্সসহ নানা শ্রেণীর কর্মীরা, যারা যুক্তরাজ্যে কাজের জন্য আবেদন করেছে। ২০১৯ সালের ছবি। (ইলোইসা লোপেজ/রয়টার্স)

ভাষা পরীক্ষার ফলাফল অনেক সময়ই প্রয়োজন হয়, যখন অভিবাসীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন বা ওয়ার্ক পারমিটের আবেদন করেন।

এই পরীক্ষা নিয়ে সম্ভাব্য বাসিন্দা ও তাদের পক্ষে ওকালতি করা ব্যক্তিরা যেসব সমস্যার কথা বলেন তার অন্যতম হলো পরীক্ষার জন্য দেয় অর্থের পরিমাণ, যা অনেক সময়ই একাধিকবার দিতে হয় এবং এর মেয়াদ। কেউ কেউ এটিকে কানাডায় বসবাসের জন্য কারও প্রার্থীতা মূল্যায়নের অপর্যাপ্ত উপায় বলে মনে করেন। 

ভাষা সক্ষমতার বিষয়টি ‘প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে’

এখন আলবার্টার বাসিন্দা মিস. উকওরি এজিবে নাইজেরিয়া থেকে কানাডায় আসেন ২০২০ সালে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আন্ডারগ্রাজুয়েট ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি দুটি বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েছেন-  একটি প্যারিস থেকে অন্যটি সিঙ্গাপুরে।

কিন্তু কানাডায় আসার আগে তিসি নাইজেরিয়ায় দুবার IELTS বসার চেষ্টা করেন। নাইজেরিয়ায় ইংরেজি দাপ্তরিক ভাষা।

ভাষার টেস্ট পাশ করা থাকলে তা অভিবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় পয়েন্ট যোগ করে। আবেদনকারীরা তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কাজের অভিজ্ঞতা থেকেও পয়েন্ট অর্জন করেন। একজন প্রার্থীর যত বেশি পয়েন্ট থাকবে, পারমানেন্ট রেসিডেন্ট হবার সম্ভাবনা তার তত বেশি।

এজিবে ২০১৬ সালের স্কোর পারমানেন্ট রেসিডেন্সি পাবার জন্য যথেষ্ট ছিল না। দ্বিতীয় চেষ্টার পর তাকে অভিবাসনের আমন্ত্রণ জানানো হয়।

তিনি বলেন, বিসিতে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির সময় তাকে তৃতীয়বার ভাষার টেস্ট দিতে বলা হলে তিনি ‘খুবই মন খারাপ’ করেন।

“কানাডায় আসা নিশ্চিতভাবেই খুব ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। আর এর একটি কারণ আইইএলটিএস অন্য সব প্রক্রিয়ার মত নয় যেগুলি আশা করা যায় একবার করলেই শেষ হবে।”

এজিবে তৃতীয়বার ভাষার টেস্ট দেবার সময় আগের মত ভালো প্রস্তুতি নেননি। তারপরও তিনি খুবই ভালো স্কোর করেন।

“অনুভূতিটা ছিল এমন যে, সব বাধা পেরিয়ে আসার পর আমার ইংরেজিতে দক্ষতার বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এটি করা হলো এমন একজনের সাথে যে যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষা গ্রহণ করেছে এবং নাইজেরিয়ায় ইংরেজিতে লেখাপড়া করেছে।”

মেয়াদকাল নিয়ে উদ্বেগ

সাঈদ হুসান মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স অ্যালায়েন্স ফর চেঞ্জ নামের একটি অধিকার গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, তারা যাদের নিয়ে কাজ করেন তাদের বেশিরভাগেরই প্রথম চেষ্টায় টেস্টে পাশ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি ইংরেজিই যাদের প্রথম ও একমাত্র ভাষা তাদেরও।

তিনি বলেন, “এটি টাকা-বানানোর এক বিরাট যন্ত্র।” তিনি উল্লেখ করেন যে, এই টেস্টে অর্জিত স্কোরের মেয়াদকাল তাকে দুই বছর যার পর তাদেরকে আবার সেই টেস্ট দিতে হবে, দৃশ্যত এই পরীক্ষা হলো টাকা ধরার কায়দা।

তিনি বলেন, “এতে স্পষ্টই দেখা যায় যে, এটি নিছকই মানুষের পকেট কেটে টাকা বের করে নেয়ার উপায় এবং লোকেদের কানাডায় কাজ করা বা বসবাসের সক্ষমতার মূল্যায়ন করা নয়।”

পারমানেন্ট রেসিডেন্সির জন্য আবেদন করতে দিতে হয় ১,৩৬৫ ডলার। এজিবে বলেন, কেবল টেস্ট দিতেই তাকে ব্যয় করতে হয়েছে ১,০০০ ডলারের মত। আর এটি হলো, এক ব্যয়বহুল প্রক্রিয়ার সংযোজনমাত্র।

অথচ যারা নাগরিত্বের জন্য আবেদন করেন তাদেরকে ভাষার টেস্টে একবার পাশ করলে আর দ্বিতীয়বার টেস্ট দিতে হয় না। ভাষার টেস্টের ফলাফলের মেয়াদ পেরিয়ে গেলেও তারা আবেদন করতে পারেন।

এর পেছনে কোন্ যুক্তি কাজ করছে সেটা নিয়ে এজিবে বিস্ময় প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, “নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে যদি এটি সম্ভব হয় তাহলে তা অভিবাসনের ক্ষেত্রেও বিবেচনা করা উচিৎ।”

অন্টারিওর অভিবাসন বিষয়ক আইনজীবী এলেনা অ্যাশফোর্ড বলেন, এসব ইংরেজি ভাষা টেস্টের স্কোর একজন ব্যক্তির কানাডায় আসতে পারার যোগ্যতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি মনে করেন, টেস্টের জন্য যে অর্থ ব্যয় করতে হয় সেদিক থেকে এটি আলোচনায় আসার মত বিষয়।

তিনি বলেন, “অনেক লোককে দ্বিতীয়বার টেস্টে বসতে হয়, সেটা বিরাট খরচের ব্যাপার। আমি বুঝি না কেন এর মেয়াদ দুই বছরে ফুরিয়ে যাবে।”

দক্ষতা ধরে রাখা ‘গুরুত্বপূর্ণ’: আইআরসিসি

আইইএলটিএস টেস্টের আয়োজক যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংগঠন ব্রিটিশ কাউন্সিলের সুপারিশ মত টেস্টের ফল দুই বছর কার্যকর থাকে। আইআরসিসি বলছে, তৃতীয় পক্ষের ভাষাদক্ষতার পরীক্ষা প্রথম যখন শুরু হয় তখন থেকেই তারা ওই সুপারিশ তাদের নীতিমালায় অনুসরণ করছে।

ই-মেল বার্তায় আইআরসিসি জানায়, দুই বছরের মেয়াদের পেছনে কিছু বিষয় বিবেচনায় নেয়া হয়েছে যেমন, যে ভাষায় তারা দক্ষ বলে আশা করা হচ্ছে সেই ভাষাটি তারা আসলে কত ঘনঘন ব্যবহার করেন, সাম্প্রতিক সময়ে কত দিনের মধ্যে তারা সেই ভাষায় নির্দেশনা পেয়েছেন অথবা তারা তাদের ভাষার দক্ষতা ধরে রাখতে পেরেছেন কিনা।

ই-মেলে বলা হয়, “এটা নিশ্চিত করা জরুরী যে, সময়ের সাথে সাথে এখানে আসার আগেই তাদের ভাষাগত দক্ষতার যেন অবনতি না হয়।”

আইআরসিসি তাদের ই-মেলে বলেছে, ভাষাগত দক্ষতা ব্যক্তির ইতিবাচক অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতার সঙ্গে জোরালোভাবে সম্পর্কিত এবং দেখা গেছে, উপযুক্ত কর্মসংস্থান খুঁজে পাওয়া ও যথেষ্ট আয় করতে পারার ওপর এর সরাসরি প্রভাব আছে।

কিন্তু এর পরও অনেকেই বলেন যে, একজন মানুষ কানাডায় আসার পর কতটা ভালো করবেন তা নিরূপণে ভাষার টেস্ট কোনও নির্ভরযোগ্য সূচক নয়।

সাঈদ হুসান বলেন, ২০২১ সালে যখন টেম্পোরারি রেসিডেন্টদের পারমানেন্ট রেসিডেন্সি দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হলো তখন ভাষা টেস্টের সাইটগুলোতে এত বেশি আবেদনের ঝড় ওঠে যে ওয়েবসাইটগুলো ক্রাশ করে।

তিনি বলেন, নতুন দেশে কোনও ব্যক্তির আত্ম-উন্নয়নের সক্ষমতার সূচক হিসাবে ভাষার পরীক্ষা ভিত্তিহীন। তিনি মনে করেন, এই মূল্যায়ন পদ্ধতির পুরোপুরি হালনাগাদ করাই হবে উত্তম। “আপনি যদি এরই মধ্যে কানাডায় কর্মরত থেকে থাকেন তাহলে সেটিই হওয়া উচিৎ যথেষ্ট প্রমাণ, আপনি যদি এখানে লেখাপড়ায় নিয়োজিত থেকে থাকেন, সেটাই হওয়া উচিৎ যথেষ্ট প্রমাণ।”