সোনাঝরা শৈশবসোনাঝরা শৈশব
জসিম মল্লিক
আমাদের বাড়িটা বরিশালের দক্ষিণে অবস্থিত। সাগরদি নাম। বিরাট বড় পরিবার আমাদের। মল্লিক বাড়ির কোনো এক নিভৃত সকালে সম্ভবত আতুর ঘরে আমার জন্ম হয়েছিল। তখন টিনের চালের দোচলা ঘর ছিল আমাদের। তখনতো আর সিজারিয়ান ছিল না। ডাক্তার কবিরাজ নার্সও কেউ ডাকত না সহজে। হয়ত দাইর হাতেই আমি এই পৃথিবীর আলো দেখেছি। কেমন ছিল সেই মুহূর্তটি কে জানে! যখন আমার বাবা মারা যান তখন নাকি আমার মাত্র দুবছর বয়স। মানুষ কি দুই বছরের স্মৃতি মনে করতে পারে! আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমি আমার বাবার কথা মনে করতে পারি। চোখ বন্ধ করলে তাঁকে অস্পস্ট দেখতে পাই। জানিনা এটা কল্পনা কিনা নাকি সত্যি তিনি আসেন স্মৃতিেেত। অবাক কান্ড তাঁর একটা ছবি পর্যন্ত নাই। আমি কোনোদিন জানতে পাবনা আমার বাবা দেখতে কেমন ছিলেন! কোনো মানে হয় না।
আমার শৈশব, কৈশোরকালটা যতই সাদামাটা থাকনা কেনো সেখানে ভালবাসার কোনো কমতি ছিল না। সাধারণ এক কিশোর ছিলাম আমি কিন্তু সেটাই ছিল বিরাট আনন্দের। তখন আমার মা ছিল, ভাই বোনরা ছিল, খেলার সাথীরা ছিল। মনের মধ্যে সবসময় একটা আনন্দের শিহরন কুল কুল করে বয়ে যেতো। মা ছিল বলে নিজেকে কখনও অসহায় মনে হয়নি। মনে হতো আমি কখনও একলা না। মনে হতো আমার মা পাশে আছে। সবার ছোট ছিলাম বলে মা চোখে চোখে রাখত। মা ছিল আমার শক্তির জায়গা। মা যতদিন বেঁচে ছিল যত দূরেই ছিলাম কোনো শূণ্যতা অনুভব করিনি। বড় হয়ে সংসার শুরু করার পরও মায়ের কাছে সবসময় বুদ্ধি পরামর্শ নিতাম। এখন যেমন অর্ক অরিত্রির কাছ থেকে পরামর্শ নেই। ওরা ঠান্ডা মাথার মানুষ। সঠিক পরামর্শ দিতে পারে। ওদের কাছে গেলে মনে হয় যেনো আবার ছোট হয়ে গেছি। শৈশবে ফিরে গেছি। সোনাঝড়া শৈশব। আবার শিশু হয়ে কোলে ফিরে গেছি যেনো। খেলার সাথীদের যেনো দেখতে পাই চোখ বন্ধ করলেই।
মাঝখানে এক লম্বা পথ পরিক্রমা। বরিশালের নিস্তরঙ্গ কিন্তু সবুজে, মায়ায়, ছায়ায়, ভালবাসায় চমৎকার জীবন ছেড়ে বেড়িয়ে পরলাম একদিন। অনিশ্চিত সেই জীবন ছিল আমার। তারপর কত কি ঘটল জীবনে। এতো কিছু ঘটার কথা ছিল না। এক জীবনে সবারই অনেক অভিজ্ঞতা হয়। আমার একটু বেশিই হয়েছে। আমার সববয়সী অনেকেই বরিশালের সেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। তাদের তো কোনো সমস্যা হয়নি! কোনো কিছু থেকে তারা বঞ্চিত হয়নি! আমি কি এক নেশায় বরিশাল ছেড়ে আজ এখানে কাল সেখানে ছুটে বেড়ালাম। বরিশাল থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে কানাডার অটোয়া। তারপর একসময় টরন্টো শহরে থিতু হলাম। আরো কত দেশ বিদেশ ঘুরলাম। কত মানুষ দেখলাম। শহর, নগর, বন্দর দেখলাম। অভাব অনটন যেমন দেখেছি, এক পয়সা দুই পয়সার হিসাব সহজে মিলত না, আবার তথাকথিত বিলাসী জীবনও দেখেছি। নৌকায় চড়ে যেমন মায়ের সাথে মামা বাড়ি যেতাম তেমনি প্লেনের হাজার মাইল পারি দিয়েছি, কখনও ইকোনমি, কখনো বিজনেস ক্লাস, কখনও ভিআইপি লাউঞ্জ দেখেছি। শিশুকালে কাঠের চৌকিতে ঘুমাতাম, জাজিম কি জিনিস জানতাম না। দেশ বিদেশে নামি দামী হোটেল দেখেছি, থেকেছি। পার্থক্য খুব একটা খুঁজে পাইনি। নিশ্চিন্ত ঘুম হওয়াটাই বড় ব্যাপার। সুস্থ্যভাবে বেঁচে থাকাটাই আসল।
শৈশবে আমি খুউব দুরন্ত প্রকৃতির ছিলাম। হেনো কোনো দুষ্টুমি নাই যা আমি করি নাই। কখনও একা, কখনও দলবেঁধে এসব করতাম। পুরো পাড়া মাতিয়ে রাখতাম। আমার দুরন্তপনা এতোটাই প্রবল ছিল যে বাড়ির দুই একজন মুরুব্বি তাদের সন্তানদের আমার সাথে মিশতে দিত না, ওরা নষ্ট হয়ে যাবে এই ভয়ে। আমার মাকে এজন্য কম গঞ্জনা সহ্য করতে হইনি। মা শুধু চোখের পানি ফেলতেন। ভাবতেন আমার ছেলেটা কেনো যে এমন হলো! অনেক শাসনে করতেন। চোখে চোখে রাখতেন। কখন কি করে বসি তার ঠিক নাই। সারাদিন পাড়া, মহল্লা দাপরিয়ে বেড়াই। সেই বয়সেই স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখা শুরু করি। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে টিয়াখালি রাস্তা বলে, সেটা দিয়ে সুন্দর সুন্দর মেয়েরা স্কুলে যেতো। সেইসব রুপসী কন্যাদের দেখতাম লুকিয়ে লুকিয়ে। তখন থেকেই ঘুড়ি উড়াতাম, সুতায় মাঞ্জা দিতাম, কাঁটা ঘুড়ির পিছনে দৌড়াতাম। ক্যাপস্টান, ব্রিস্টল, স্টার সিাগারেটের কাগজ দিয়ে চারা খেলতাম, মার্বেল খেলতাম। সে সময় মার্বেল খেলত রাস্তার ছেলেরা। সাত চারা খেলতাম, সাইকেলের রিং চালাতাম সিএন্ডিবি রোডে। বেয়ারিং দিয়ে তিন চাকার গাড়ি বানিয়ে চালাতাম। একজনকে পিছন থেকে ধাক্কা দিতে হতো। তারপর ঘর ঘর করে চলত।
অনেক পরে দেখেছি আমাদের বাড়ির সেইসব ছেলে আমার মায়ের কাছে তাদের আচরনের জন্য পরোক্ষভাবে লজ্জা প্রকাশ করেছে। আমাকে তুই’র জায়গায় তুমি বলতে শুরু করেছে। আমি কিন্তু কখনও কাউকে কোনো অভিযোগ করিনি বা তাদেরকে তুইয়ে’র বদলে তুমি করেও বলিনি। একবার আমার এক ভাই আমাকে বলেছিল, জসিম তুমি এভাবে বদলে যাবে বুঝিনি। আমি হেসে বললা, আমি তো বদলাইনি, তোরা বদলেছিস। পরে বলল, আামাদের মসজিদের জন্য তুমি অনেক করেছো, অনেক ফান্ড এনে দিয়েছো। এজন্য আমারা কৃতজ্ঞ। তোমার কথা অনেকেই জানতে চায়। তুমি লিখালিখি করো তাই। আমি হাসি। তাদের সাথে আমার তেমন দেখা সাক্ষাৎ হয়না। আমি বহু বছর বাইরে বাইরে। তাদের এসব কথা আমাকে বিচলিত করে। আমি কখনও নিজেকে বদলাতে চাই না।
খেলাধুলা করতাম আমরা খুউব। আমাদের মল্লিক বাড়ির নিজস্ব মাঠে নানা ধরণের খেলাধুলার প্রচলন ছিল। আমি নিজেই আয়োজকদের একজন ছিলাম। ফুটবল, হাডুডু, হকি, ক্রিকেট খেলতাম। শীতের সময় রাতে লাইট জ্বালিয়ে ভলিবল, ব্যাডমিন্টন খেলা হতো। পাড়ার ছেলেদের নিয়ে বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা করতাম। হাইজাম্প, লং জাম্প, দৌড় প্রতিযোগিতা হতো। বড়রা করত নাটক। সবকিছুতেই আমার অংশগ্রহন থাকত। ব্যাডমিন্টন আমার খুব প্রিয় খেলা ছিল। বাড়ির পুকুরে বা খালে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কাটতাম। গায়ের চামরা সাদা হয়ে যেতো তাও পানি থেকে উঠতাম না। মা এসে টেনে তুলে নিয়ে যেতো, আর আচ্ছামতো পিটুনি দিত। সাঁতার শিখেছিও একা একা। নৌকা বাইতাম মামা বাড়ি গেলে, ডোঙ্গা উল্টে কতবার পানিতে পড়ে হাবুডুবু খেয়েছি। কলা গাছের ভেলায় ভেসে বেড়াতাম। মামাত ভাইদের সাথে বিড়ি ফুঁকতাম। শীতের দিনে পানিতে ডুব দিয়ে শিং, কৈ ধরেছি। শিং মাছের কাঁটায় কতবার রক্ত বের হয়েছে। চিনে জোকে রক্ত চুষে নিত। সহজে ছাড়ানো যেতো না। শীতের দিনে ধান মাড়াই হতো। গরুর পিছন পিছন ছুটতাম, রাতে সিদ্ধ ধানের নাড়ার মধ্যে ঘুমাতাম। দারুণ ওম ছিল।
একটু বড় হয়ে লাইব্রেরিতেও যাওয়া শুরু করলাম। তখন সেভেন এইটে পড়ি সম্ভবত। আমাদের বাড়িতেই একটা পাঠাগার ছিল। নাম ছিল ইকবাল পাঠাগার এন্ড ক্লাব। সেখানে কিছু বই ছিল, কেরামবোর্ড ছিল, দাবা ছিল, টেবিল টেনিস ছিল। সেসব খেলতাম। দাবা খেলাটা যে কে আবিস্কার করে! বড্ড জটিল। তাসও তেমনি। কখনও শেখা হলো না। মাঝে মাঝে বই নাড়া চাড়া করতাম। দু’একটা সংবাদপত্র রাখা হতো। বই পড়তে গিয়েই আমার ক্ষতিটা হয়ে গেলো। পাড়ার লাইব্রেরির পরিবর্তে আমি বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরির খোঁজ পেলাম। বারো তেরো বছর বয়স পর্যন্ত আমার দুরন্তপনার স্থায়ীত্বকাল ছিল। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের ফটিকের মতো ছিল আমার স্বভাব। তারপর হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলাম, আমি আর সেই আমি নাই। আমি বদলে যাচ্ছি। নির্জণতা আমার পছন্দ। আমার খেলাম সাথীরা খুবই অবাক হতো। মা চিন্তিত হয়ে পরলেন। মা মনে করতেন আমার মাথার সমস্যা হয়েছে। তার ছিঁড়ে গেছে। মাথায় ঘু ঘু ডাকছে। হ্যাঁ তাই। মাঝে মাঝে আমার মাথায় ঘুঘু ডাকত। এখনও ডাকে। আমি একা হয়ে যেতাম। একা একা ঘুরতাম, নিজের সাথে নিজে কথা বলতাম। কারো সাথে মিশতে ইচ্ছে করত না। শুধু বইয়ের সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠল। কলেজ উঠেও তাই। পড়াশুনাও মন দিয়ে করিনি। তাও রেজাল্ট ভাল হতো। অবাক কান্ড! পেনপলস করতাম। আমার একশর বেশি পত্রবন্ধু হয়েছিল কলেজ জীবন থেকেই। তাদের নিয়মিত চিঠি লিখতাম। নিজের কথা শেয়ার করতাম।
সেই যে কৈশোরে আমি একা হয়ে গিয়েছিলাম, সেই একাকীত্ব আজও ঘোচেনি। কখনও ঘুচবেও না। চারিদিকের এতো আয়োজন, কোলাহল, পরিবার, সন্তান, বন্ধু, আত্মীয়, সমাজ, দলাদলি, ঈর্ষা, নোংরামি, অপমান, এতো কিছু ঘটনার মধ্যে আমি একাকী একজন। এই যে এতো কিছু করি, জীবন ফেনানো যাকে বলে। লেখালেখি, বন্ধুত্ব, আতিথেয়তা, সংসার, বেড়ানো, দাওয়াত খাওয়া, মনে হয় আমি এসবের অংশ না। অন্য কেউ করছে। অন্য এক আমি এসব করছে। আমি নিজেকে নিজে প্রায়ই প্রশ্ন করি, আচ্ছা আমি কি কখনও কারো ছিলাম! কেউ কি কখনও আমার হতে পারে! পৃথিবীতে আসলে কেউ কারো না। সবকিছু মিথ্যে, মরীচিকা। মিছে মায়া। সবাই একা। স্বার্থপর দুনিয়ায় সবাই নিজেরটা বুঝে। প্রতিহিংসা পরায়ন মানুষ, হিংস্র মানুষ চারিদিকে। তাই আমি সবসময় একা। জাগতিক যা কিছু করি তার সাথে আত্মার কোনো সম্পর্ক নাই। যেনো আমি করি না। অন্য কেউ করে।
সবারই নিজের সাথে নিজের কিছু বোঝাপড়া থাকে। আমারও আছে। কনফেশন। বাইরের নিষ্ঠুর পৃথিবীতে মানুষ কেমন করে বেঁচে থাকে! যেখানে এতো স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা, হিংসা, অন্যের ক্ষতি করার চেষ্টা সারাক্ষণ, সেখানে মানুষ কিভাবে টিকে থাকে! টিকে থাকে কারণ প্রকৃতি মানুষকে অষ্ঠে পৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে। মানুষকে আগলে রাখে। বিপদ থেকে মুক্ত রাখে। তেমনি প্রকৃতির মতো কিছু উদার মানুষ আছে পৃথিবীতে। তাদের ভালবাসাই বাঁচিয়ে রাখে। আমার ক্ষেত্রেও তাই। এক জীবনে আমি মানুষের অনেক ভালবাসা পেয়েছি, আনুকল্য পেয়েছি যা পাওয়ার যোগ্য আমি না। যা পাওয়ার কথা ছিল না। প্রকৃতি যেমন আমাকে আগলে রাখে তেমনি মানুষের ভালবাসাও আমাকে সতেজ রাখে, অনুপ্রানিত করে। আমি হারতে হারতে জিতে যাই। আমি কি ভুল করি না! অনেক ভুল করি। আমিও কি ঈর্ষান্বিত হই না! হই। আমি কখনও কারো ক্ষতির চিন্তা করিনি। আমি কখনও প্রতিশোধ পরায়ন হইনি! অনেক ক্ষতি মেনে নিয়েছি। আমার কিছু দুর্বল দিক আছে। অনেকে সেটা ব্যবহার করে।
তখন ক্লাস ফোরে বা ফাইভে পড়ি। রাস্তায় মার্বেল খেলতে গিয়ে এক বন্ধুর সাথে ঝগড়া লেগে গেলো। বন্ধুটি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল রাস্তায়। কিল ঘুষি দিল। সে ছিল ষন্ডা মার্কা। আমি ছিলাম হালকা, পটকা। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি আসলাম। মা বললেন, তুমি কিছু বলো নাই তো! আমি বললাম, না বলি নাই। মা বললেন, ঠিক করেছো। মা সবসময় আমাকে অহিংস হতে শিখিয়েছেন। ভালবাসতে শিখিয়েছেন। কাউকে অপছন্দ হলে এভোয়েড করতে বলেছেন। কিন্তু প্রতিশোধ পরায়ন হতে বলেন নি। কিন্তু আমার মনে হয় মায়ের এই ধারণা ঠিক না। শিখদের একটা প্রবাদ আছে, কেউ যদি অন্যায়ভাবে তোমার এক গালে একটা চর মারে, তুমি তার অন্য গালে চারটা চর মেরো।
সংবাদপত্র, সাংবাদিকতা, লেখালেখি, বই প্রকাশ, পাঠক, প্রকাশক, পুরস্কার, ভক্ত এসব কোনোদিন মাথায় ছিল না। জানতামও না এসব কি। কেমন করে সব ঘটে যায় জীবনে। অবাক কান্ড। কত মানুষের প্রশংসা, পাশাপাশি নিন্দাও আছে। প্রেম, প্রতারণা, বন্ধুত্ব, শত্রুতা, হিংসা, ঈর্ষা সব যেনো হাত ধরাধরি করে চলছে। এক জীবনে সব থাকে। দুঃখ থাকে, অভাব থাকে আবার সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য থাকে। আজকাল খুউব পৃথিবীর যাবতীয় কুটিলতা থেকে মুক্তি পেতে ইচ্ছে করে। কূটিল মানুষদের কাছ থেকে দূরে থাকতে ইচ্ছে করে। আবার কি পিছনে ফেরা যায়? একটা দুইটা প্যান্ট শার্ট, একজোরা জুতা বা স্যান্ডেল, শীতের সকালে জিয়ল মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়া! ডাইনিং টেবিল, কাটা চামচ, বুফে, স্মার্টফোন, ফেসবুক, টুইটার, টিকটক এসব না হলেও জীবন চলে যাবে। আধুনিক জীবন, সুশৃঙ্খল শহর, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, ব্যাংক ব্যালেন্স, সুদ আসলের হিসাব আর মুখোশধারী মানুষ কতইতো দেখা হলো। তাই আবার ফিরেও যেতে ইচ্ছে করে সেই সারল্যমাখা দিনগুলোতে। বরিশালের সেই মায়ময় পরিবেশে ফিরতে ইচ্ছে করে যে পরিবেশ আমি ফেলে এসেছি। মাঝখানে যা ঘটেছে সবই এক অলীক স্বপ মনে হয়্ন। সব মরিচিকা। আবার কি ফেরা যায়! যদি ফিরতে পারতাম খুবই ভাল হতো। কিন্তু ফেরা সত্যি কঠিন। কোথায় ফিরব! ফেরা বলে কিছু নেই আসলে।
কৈশোর থেকেই আমার মধ্যে অদ্ভুৎ অদ্ভুৎ সব কল্পনা কাজ করতো। কিন্তু কোনো একটা কল্পনা বা ইচ্ছাই বেশীক্ষন স্থায়ী হতে পারতোনা। এখনও যেমন আমার মনটা ঠিক কৈশোরের মতোই চঞ্চল রয়ে গেছে। মন মুহুর্তে একটা জায়গা থেকে লাফ দিয়ে অন্যত্র্য চলে যায়। কিছুতেই এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে না। আমি আমার এই মনোজাগতিক সমস্যা নিয়ে অনেক ভেবেছি। কিন্তু কোনো সমাধান খুঁজে পাইনি। যদিওবা কেউ কোনো সমাধানের পথ বাতলে দিয়েছে কিন্তু তা আমি অনুসরন করতে পারিনি। আচ্ছা আমি কী কখনও নিজেকে শুধরাতে পারবো? নিজেকে প্রায়ই এই প্রশ্ন আমি করি। আমি কখনও কারো অধীন নই। যতদিন মায়ের ছায়াতলে ছিলাম ততদিন একটা নিয়মের ঘেরাটোপে মা আমাকে বন্দী করে রেখেছিল। আমি যতটুকু শেখার তখনই মায়ের কাছ থেকে শিখে নিয়েছি। এরচেয়ে বেশী কিছু শেখার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়নি। আমি যখন আমার উনিশ বছর বয়সে মায়ের ছায়াতল থেকে বেরিয়ে পড়লাম তখন থেকে আমি পুরোপুরি স্বাধীন হয়ে গেলাম। কেউ আর আমাকে বাঁধতে পারেনি। এমনকি আমি আমার দীর্ঘ সংসার জীবনেও একই রকম রয়ে গেছি। আমাকে ঠিক নিয়ন্ত্রণ করা যাকে বলে সেটা কেউ করে উঠতে পারেনি। সেই চেষ্টা কেউ করলে হিতে বিপরীত হয়েছে। অথচ আমি কী কখনও চাইনি আমাকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করুক? আমি চেয়েছিলাম। কিন্তু সবাই তার নিজের মতো করে সব করতে চায়। তখনই আমার মন বিদ্রোহি হয়ে ওঠে। পালাই পালাই করে। আমার এই চঞ্চল মনকে কেউ কখনও সঠিকভাবে বাগে আনতে পারেনি বা পারলেও আমি বুঝতে পারিনি।
আমার শৈশব কৈশোর ছিল খুউবই সাদামাটা। হেলা ফেলা টাইপ ছিল। কোনো মূল্য ছিল না। কেউ তেমন খেয়াল করতো না আমাকে। আমি নীরবে বেড়ে উঠা এক মানুষ। অন্যদের কাছে ছিলাম অবহেলার পাত্র। আমার বয়সী যারা ছিল তারা অনেক কিছু করতো, অনেক কিছু পেতো, আমি পেতাম না। আমি কিছু চাইতামও না। চাওয়ার সাহসও আমার ছিলনা। একমাত্র আমার মা সব বুঝতেন। কিন্তু আমার চাহিদা পূরনের সামর্থ্য তার ছিল না। আমার তেমন বড় কোনো চাহিদা ছিল না। আমি খুবই কল্পনাবিলাসী। কল্পনার ভেলা ভাসাতে আমার জুড়ি নাই। এখনও প্রায়ই আমি গাড়ি চালাতে চালাতে কল্পনার জগতে হারিয়ে যাই। ভুলে যাই কোথায় যাবো। আমার কল্পনাগুলো সব সময় লাগাম ছাড়া। আমার জীবনের সাথে যা অসামাঞ্জস্যপূর্ণ। আমি যে রকম একটা গন্ডীবদ্ধ জীবনে বড় হচ্ছিলাম তাতে আমার যথেষ্ঠ ভীত হওয়ার কারণ ছিল। আমি ভাবতাম এই জীবন থেকে কখনও বের হয়ে আসতে পারবো না। আমি যে কখনও কারো অধীন হবোনা বা কারো আজ্ঞাবহ হবো না এটা তখনও আমি জানতাম না। এতটা স্বাধীনচেতা মনোভাব তখনও আমার গড়ে উঠেনি। একটা অনিশ্চয়তার আতংক সবসময় আমাকে ঘিরে ছিল। আমাকে সাহস যোগানোর কেউ ছিল না। তাই আজও এতটা বয়সেও আমার মধ্যে এক ধরনের ইনসিকিউরিটি আছে। ওসব আমি কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
ছোটবেলা থেকে কিছু জিনিস নিয়ে আমার মধ্যে অবসেশন ছিল। আমি যখন কলেজে পড়ি তখন আমার একজন পত্রবন্ধু ছিল। তখন আমি একটু একটু লিখি। তার নাম ছিল জব্বার। জব্বার মল্লিক। সেও মল্লিক বলেই কি বন্ধুত্ব হয়েছিল! পটুয়াখলীর ছেলে। বরিশালে পড়তে এসেছে। চকবাজার থাকতো। একটা গলির ভিতরে ওদের একটা পুরনো বাড়ি ছিল। আমার সাথে পরিচয় হলো। বন্ধুত্ব হলো। সে আমাকে একদিন বলল, তোমার ঘড়ি নাই কেনো! ওই বয়সে যে ঘড়ি থাকতে হবে এটা আমার মনে হয়নি। আমাকে কে ঘড়ি কিনে দেবে! আমি বললাম, তাতো জানি না। সে বলল, আমি তোমাকে একটা ঘড়ি কিনে দেই! আমি রাজী হয়ে গেলেমা। সে আমাকে সদও রোডের একটা দোকান থেকে সিলভার রঙের একটা ঘড়ি কিনে দিয়েছিল। সেই ঘড়ি পরে আমি বীরের মতো হাঁটতাম। ঘড়ি পরা বিরাট বড় কিছু আমার মনে হতো। এরপর লন্ডন, জাপান থেকে আমার বস মুন্নু সাহেব আমাকে বেশ কয়েকটা ব্রান্ড নেমের ঘড়ি গিফট দিয়েছেন। যেগুলো আজও আমি ব্যবহার করি এবং পরম যত্নে রেখে দিয়েছি। আমি নিজের টাকায় জীবনে একটাই ঘড়ি কিনেছি। ঢাকার বায়তুল মোকাররম থেকে সিকো ঘরি কিনেছিলাম একটা। তখন সেটার দাম ছিল তিন হাজার টাকা। আজও সেটা আছে চমৎকারভাবে। আমার বন্ধু জব্বারের সাথে পরবর্তীতে অনেকবারই দেখা হয়েছে কিন্তু সেই আগেরমতো যোগযোগটা থাকেনি। তিনিই যোগযোগ রাখতে চাননি এমন মনে হয়েছে আমার।
স্কুলে যখন পড়ি তখন আমার খুউব কাপড় চোপরের অভাব ছিল আমার। সবারই থাকে। তখনকার মধ্যবিত্ত পরিবার এমনই ছিল। সেই অভাব কলেজ, ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত ছিল। একটা দুইটার বেশী আমার কাপড় ছিল না। পাজামা পড়ে স্কুলে যেতাম। জাইঙ্গা থাকত না। একবার আমার ক্লাসের বন্ধু আমাকে লজ্জা দিয়েছিল কেনো জাইঙ্গা পড়ে আসি নাই। আর একবারের ঘটনা, সেটা খুউব গ্লানির বিষয় ছিল। আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি সম্ভবত। একদিন হঠাৎ স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান আসলেন ক্লাশ ভিজিটে। তার নাম আনুজ তালুকতার। অত্র অঞ্চলে খুউব দাপট লোকটার। মুক্তিযুদ্ধের সময় লুটপাট করে তখন বেশ পয়সাওয়ালা হয়েছে। ছিল ছনের ঘর। রাতারাতি বিল্ডিং উঠে গেছে বাড়িতে। লোকটা আমাকে ক্লাস থেকে বের করে দিলো। আমার অপরাধ আমি সেদিন প্রোপার ড্রেস পরে আসিনি। সেদিন আমি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে গেছি। মা জিজ্ঞেস করলেন আমি ক্লাস ফাঁকি দিয়েছি কেনো! মাকে সেদিন আমি আসল ঘটনা বলিনি। এটা বললে মা অনেক কষ্ট পেতেন। কলেজে উঠার পরও আমার কাপড়ের অভাব ঘোচেনি। আমার এক আত্মীয় ছিল। বাড়িতে আমরা দুজন এক রূমে থাকতাম। হিরু মল্লিকের বাড়ির তিন তলায়। তার নাম রিমন। রিমন ছিল ষ্টাইলিষ্ট ছেলে। ওর বাবা ছিল আমতলির চেয়্যারম্যান। রিমন একমাত্র ছেলে। ওর কাপড় চোপড়ের অভাব ছিলনা। আমি মাঝে মাঝে ওর কাপড় পরতাম। সুন্দর সুন্দর টী শার্ট ছিল ওর। সে সব পড়ে কলেজে যেতাম। লক্ষ্য করতাম কোনো মেয়ে আমাকে দেখছে কিনা। কোনো মেয়ে আমার দিকে তাকালেই আমি কেমন উদাস হয়ে যেতাম। বয়সটাই যে ওইরকম। রিমন পরে আওয়ামী লীগ থেকে এমপি হয়েছিল। ভোটে হয়েছিল কিনা ঠিক জানিনা। বরিশাল বিএম কলেজে পড়ার সময় নজরুল নামে আমার একটা বন্ধু হয়েছিল। খুউবই মাখামাখি টাইপ বন্ধুত্ব। বেশ কয়েকবছর সেই বন্ধুত্ব টিকে ছিল। নজরুল একটু দাপুটে ছিল। পলিটিক্স করতো। বিএনপির হোমরা চোমরা ছিল। আমি একটা প্যান্ট পড়ে প্রতিদিন কলেজে যেতাম। ভাল কাপড় চোপর আর পয়সার দাপটে রোজির সাথে সখ্যতা হয়ে গেলো এবং বিয়ে করেছিল। রোজির প্রতি আমার প্রগাঢ় একটা ভাললাগা তৈরী হয়েছিল। তবে সেটা প্রেম ছিল না কিছুতেই। ওদের বিয়েটা শেষ পর্যন্ত টেকেনি।
ছোটো বেলায় আমি মায়ের সাথে মামা বাড়ি ঢাপরকাঠি গিয়ে থাকতাম বছরে দু’তিন মাস। সেটা থাকতো শীতের সময়। এমনই শীত যে মায়ের বুকের মধ্যে গুটিশটি মেরে ঘুমাতাম। মায়ের শরীরের ওম আমাকে উষ্ণতা দিত। টিনের চালের ঘরে ফাঁক ফোঁকর দিয়ে ঠান্ডা ঢুকে পড়তো। মনে হতো কাথা কম্বলের উপর কে যেনো বরফ ঢেলে রেখেছে। সকালে রোদ উঠতো অনেক দেরী করে। কুয়াশায় ছেয়ে থাকতো দিগন্ত। রোদটা উঠতে না উঠতেই আবার সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতো। শীতের বিকেলে আমরা দল বেধে ধানের খেতে নেমে পড়তাম। ঘুড়ি উড়াতাম পাতা দিয়ে। নাড়া কাটতাম (ধান কেটে নেওয়ার পর অবশিষ্টাংশ) ধারোলো কাঁচি দিয়ে (এক ধরনের খাঁজকাটা)। মামী আখের গুর দিয়ে নাড়ু আর মোয়া বানাতেন সেসব খেতাম মজা করে। আমার বয়সী মামাতো বোনদের সাথে মন দেওয়া নেওয়া করতাম।
সকালে নাস্তা হিসাবে আমরা পান্তা ভাত খেতাম। বরফের মতো ঠান্ডা ভাত, সাথে জমে যাওয়া জিওল মাছের তরকারি। কই শিং মাগুর শোল সরপুঠি। আহ্্ কী স্বাদ ছিল সেসবের। তরকারি গরম করে খাওয়ার প্রচলন বা একটা ম্যাচের কাঠি খরচ করে চুলো জ্বালানোর মতো বিলাসিতা ছিল না। আমার জন্য ছিল একটা সেগুন কাঠের পিঁড়ি। বেশ বড়সড় পিঁড়ি। দেখতে সুন্দর। আমি আসন পেতে বসতে পারতাম। আর ছিল ঝকঝকে কাসার একটা থালা। সারা বছর এই দুটো জিনিস তোলা থাকতো। আমি গেলেই শুধু বের করা হতো। তখনও ডাইনিং টেবিল কী জিনিস আমি জানতাম না। অনেক পরে যখন আমার বয়স তেরো চৌদ্দ হবে তখন আমি প্রথম ডাইনিং টেবিল দেখি। আমাদের বারিশালের বাড়িতেও আমরা চৌকির উপর বসে সবাই মিলে খেতাম। আমার মা রান্না করে থালে ভাত বেড়ে দিতেন। আমরা হালুম হুলুম করে খেতাম। মা যাই রান্না করতেন তাই ছিল অমৃত। তখনও সিদ্দীকা কবিরের বই বাজারে আসেনি। আসলেও লাভ ছিল না। আমার মা লেখা পড়া জানতেন না। কিন্তু আমার মায়ের মতো জ্ঞানি সক্রেটিসও না।
শীতের সময় ছোট্ট ছোট্ট ডোবার মধ্যে কী করে এতো মাছ থাকে! অবাক কান্ড। ভরা বর্ষার সময় ডালপালা ফেলে রাখা হতো। যখন শীত আসতো, পানি কমে যেতো তখন পানি সেচে থকথকে কাদার মধ্যে থেকে জিওল মাছ মেরে কলশী ভরে রেখে দিত। ছয়মাস প্রায় সেই মাছ খাওয়া হতো। মামা বাড়িতে কয়েকটা পুকুর ছিল। বছরান্তে পুকুর সেচে ফেলতো। তখন তো আর সেচযন্ত্র ছিল না। পুকুর পাড়ে মাচা বানিয়ে সেখানে মুড়ির টিন কেটে দড়ি বেধে পানি সেচা হতো। ম্যানুয়ালি। কয়েকদিন লেগে যেতো। তারপর সবাই মিলে মহা উৎসবে মাছ ধরা চলতো। খুউব মিস করছি আমার সেই পিঁড়ি আর কাসার থালাকে। পিছনে ফেলে আসা আমার শৈশব আমার কৈশোর আমাকে টানে। খুউব টানে। স্মৃতি ছাড়া মানুষের কিছুই থাকে না। আমার নানা নানী, মামারা, মা বাবা আজ কেউ নাই। কিন্তু স্মৃতিগুলো পড়ে আছে। আমার সেই পিঁড়ি আর কাসার থালাটা কী আছে! কে জানে!
জসিম মল্লিক, লেখক ও সাংবাদিক