মায়ের যত স্মৃতি

জসিম মল্লিক

সেপ্টেম্বর মাসটা আমার জন্য বেদনার। এই মাসে আমার মা মারা যান। মায়ের মৃত্যু আমাকে অনেক খানি নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে। মা-বাবার মৃত্যু সবসময় বেদনার। যার মা-বাবা নাই তারাই কেবল সেটা জানে। মায়েরা সন্তানের জন্য অনন্ত ত্যাগ স্বীকার করেন। নিজের পাতের খাবার কেবল মায়েরাই সন্তানের জন্য তুলে রাখেন, অসুস্থ্যতায় রাত জেগে বসে থাকেন কেবল মা। সেটা আমি আমার মাকে দেখে জেনেছি, আমার স্ত্রীকে দেখে জেনেছি, আমার মেয়ে বন্ধুদের দেখে জেনেছি। মায়ের সাথে আমার টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলোর কথা অনেকই লিখেছি, তারপরও কত কথা মনে ভেসে আসে। এসব মনে হলেই আমার শরীরের ভিতর একটা আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। জীবনের প্রয়োজনে মানুষকে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যেতে হয়। এটা হাজার বছর ধরে চলে আসছে। আমাকেও যেতে হয়েছে। আমি মায়ের সবচেয়ে ছোট সন্তান। আমার বাবা ছিল না। কিন্তু আমার অন্য ভাই বোনরা শেষ দিন পযর্ন্ত মায়ের পাশেই ছিল।

আমার দুই বোনের ছোটো যে বোন সাজু সে মারা গেছে মায়েরও আগে। মা তার সন্তান হারানোর শোক বহন করেছেন অনেকদিন। সন্তানের লাশের বোঝা বহন করা অনেক কঠিন। কোনো বাবা মা এটা সহ্য করতে পারে না। মা সবসময় বরিশালে ছিলেন। কখনও আমার ঢাকার বাসায় এসে থাকতে চাননি। দু’একবার যাও এসেছেন মন পড়ে থাকত বাড়িতে। ঢাকার বন্দী জীবনে মায়ের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতো। চলে যেতে চাইতেন। বলতেন জসিম আমারে দিয়া আয়। বাড়িতে মায়ের অবাধ চলফেরার সুযোগ আছে ঢাকায় তা নেই। নিজের সংসার ছেড়েও মা থাকতে চাইতেন না। আমি সেটা বুঝতে পারতাম, তাও চাইতাম মা আমার সাথে থাকুন। বিদেশে দেখেছি অনেকে মা বাবাকে নিয়ে এসেছেন কিন্তু তারা থাকতে পারেন নি। সবাই যখন বাইরে কাজ নিয়ে ব্যস্ত তখন একা ঘরে বাড়ির কথা মনে করে চোখের জল ফেলেন। অনেকে মা বাবাকে দিয়ে ঘরের কাজ করান, অনেকে সন্তান লালল পালনের দ্বায়িত্ব দেন। উপায়ও থাকে না। আবার অনেকে মা বাবা নিয়ে সুখেই আছেন।

মায়েরা সন্তানের জন্য অনন্ত ত্যাগ স্বীকার করেন। ছবি : ইউটিউব

মা যখনই আমাকে একা পেতেন অনেক কথা বলতেন। অনেক কিছু ছিল পারষ্পর্যহীন তাও আমি মন দিয়ে শুনতাম। কখনও যুক্তিহীন কথাও বলতেন মা, মাঝে মাঝে আমি রেগে যেতাম। আবার একটু পর ঘুরে ফিরে মায়ের কাছে আসতাম। বয়স হয়ে গেলে মানুষ শিশুর মতো হয়ে যায়। আমার মাও তেমন ছিলেন। রাগ করে কোনো লাভ হতো না। নিজেরই খারাপ লাগত। তাই মা যা বলতেন আমি মেনে নিতাম। মা আমার কেনো কথায় কষ্ট পাক তা চাইনি। মা কি অতো কিছু বোঝে! জীবন যে কত ঝঞ্ঝা মুখর সবকথা কি মাকে বলা যায়! আমার মাও তো আমাদের নিয়ে কত কষ্ট করেছেন সে কথা মা কোনোদিন ঘুণাক্ষরেও উচ্চারণ করেননি। আমি কখনও মাকে আমার কষ্টের কথা, জীবন সংগ্রামের কথা, আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন আমার যে একটা দুটোর বেশি শার্ট ছিল না, কতদিন না খেয়ে রাত পার করেছি সে কথা আমি মাকে কোনোদিন বলিনি, এসব কি বলা উচিত! মা কেঁদে কেটে বুক ভাসাবেন। ওসব ছিল জীবনেরই অংশ। জীবনে সুখ দুঃখ কিছুই নিরবচ্ছিন্ন না।

সেটা ১৯৮৮ সালের কথা। সেবার খুব বন্যা হলো দেশে। ঢাকা শহর পানির নিচে। একই সময় আমাকে হল ছাড়তে হলো। থাকার কোনো জায়গা নাই। নিরুপায় হয়ে বাড়িতে চলে গেলাম। ভাবলাম কিছুদিন কাটিয়ে আসা যাক। বরিশালের দিনগুলো ভালই কাটছিল। অনিশ্চিত ঢাকায় আর কি ফেরা হবে! একজন আমার জন্য অপেক্ষা করবে। কিন্তু ওসব আমি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাই। একদিন রাতে মায়ের বিছানার পাশে গিয়ে বসলাম। মা বললেন, পড়াতো শেষ হইছে, আর যাওয়ার দরকার নাই ঢাকায়। ওখানে কে দেখবে! কত কষ্ট করতে হয়।

আমি বললাম, বরিশালে থেকে কি করব!

চাকরি করবা, সুন্দর একটা মেয়ে দেখে বিয়ে দেবো।

আমি হাসি মায়ের কথা শুনে। মা ভড়কে যায় আমার হাসি দেখে।

আমি দুষ্টুমি করে বললাম, আমাকে কেউ বিয়ে করবে না। বেকারদের কেউ বিয়ে করে না। আমি ঢাকায় থাকতে চাই, আমি লেখক হতে চাই মা।

মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোমার কলেজের বন্ধুরা এখনও আসে বাড়িতে। আমার সাথে দেখা করে। একজন খুব সুন্দর দেখতে…।

মাকে এই প্রসঙ্গ আর বাড়াতে দেই না। তাই প্রসঙ্গ ঘুরানোর জন্য বললাম, মা আপনার বিয়ের দিনের কথা মনে আছে! কেমন শাড়ি পড়েছিলেন! ছবি নাই কেনো আপনার!

মা যেনো মুহূর্তে তার কিশোরী জীবনে ফিরে গেলেন! একটু স্মৃতিকাতর হলেন। সেই কবে থেকে মা বৈধব্যের বেশে আছেন। স্বামীহারা এক নারী!

আমি আকস্মিক বললাম, মা আমি একটা মেয়েকে পছন্দ করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে!

মার মুখ খুশীতে ঝলমল করে উঠল! মা হয়ত ভাবছে সত্যি তার ছেলেকে কোনো মেয়ে পছন্দ করে! সত্যি বাস্তবে এমনটা ঘটবে! যার ঢাকা শহরে কিছু নাই তাকে কেউ পছন্দ করতে পারে!

কেমন সে দেখতে!

আপনার মতো সুন্দর মা। পছন্দ হবে। একদিন বউ করে নিয়ে আসব।

মা অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে থাকে। মায়ের চোখে পানি টল টল করে ওঠে।

আর ছিল মায়ের হাতের স্পর্শ

মিষ্টি জাতীয় খাবার আমার বেশি পছন্দ না। ঝাল জাতীয় খাবার পছন্দ। আমার পছন্দগুলো একটু সেকেলে ধরনের। যেখানেই যাই আমার চোখ খুঁজে ফেরে গতানুগতিক ধরনের খাবার। আমার খাদ্যাভ্যাস যারা জানেন তারা আমার জন্য কিছু আলাদা আইটমে করেন দাওয়াত দিলে। আমি খাবার নিয়ে বেশি এক্সপেরিমেন্ট করতে পারি না। জীবনে আমি যতবার রেষ্টুরেন্ট যেয়ে খাবার অর্ডার করেছি ততবারই তা খাবার অযোগ্য হয়েছে। এমনকি ফাষ্টফুডের দোকানে গিয়েও আমি ঠিকমতো খাবার অর্ডার করতে পারি না। হয়ত লাইনে দাড়িঁয়ে আছি, বেশি চিন্তা করার সময় নাই, মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে সেলস পারসন। আমি কি অর্ডার করব তা গুলিয়ে ফেলেছি। আমি একটু নার্ভাস! যা মনে মনে ভেবেছিলাম তা না করে এমন একটা অর্ডার দিলাম যা নিজেই খেতে পারছি না। টীম হর্টনসের ড্রাইভ থ্রুতেও এটা হয় আমার। হয়ত খিদা পেয়েছে কিন্তু গাড়ি থেকে নামার সময় নাই। চা বা কফির সাথে কিছু একটা নিতে চাই যা ড্রাইভ করতে করতে খেতে সুবিধা হবে। কি নেবো! বেগেল না মাফিন! বেগেল কি হোল হুইটের নেবো, সিসিমি বেগেল, এভরিথিং বেগেল না জাষ্ট প্লেন বেগেল নেবো! ডাবল টোষ্টেড এবং সাথে সামান্য বাটার বা ক্রিম চীজ কি থাকবে! মাফিনেরও নানা জাত পাত আছে। কম মিষ্টি বেশি মিষ্টি। আমার তো আবার ডায়াবেটিস। বাছ বিচার করতে হয়। চা হবে স্মল সাইজ। কফি আমি খুব কম খাই। চা তাও স্টিপ টী, সাথে হাফ সুইটনার।

খবার নিয়ে আমি বেশ কষ্টে থাকি। যথেষ্ট বিরক্তিকরও আমি। বিদেশে প্রতিদিন নতুন নতুন আইটেম বা ফ্রেশ খাবার তৈরী করা এতো সহজ না! তাইতো এদেশের মানুষ প্রচুর রেষ্টেুরেন্ট খায়। শুক্র শনিবার সব ধরনের খাবার দোকান রমরমা। ডেলিভারিম্যানরা ভাল টিপস পায়। কিন্তু আমি সেই মান্ধাতা আমলেই পড়ে আছি। আলু ভর্তা, ঘন ডাল, ডিম ভাজা, করল্লা ভাজি, ঢেরস, পটল, ঝিঙ্গা, ডাটা, শিম বা পুঁইশাক এইসব আমার পছন্দ। গুলশা, কাজরি, ইলিশ, বাইলা, মেনি, শোল বা পাবদা মাছ সবসময় পছন্দের তালিকায়। কৈ এবং শিং মাছও পছন্দ। তবে কাঁটার ভয়ে কৈ মাছ খাই না। বড় মাছ একদম খেতে পারি না। দেশ থেকে মাছের যে ব্লকগুলো আসে তা থেকে কেমন বোটকা গন্ধ পাই। কানাডিয়ান মাছ খুবই সুস্বাদু কারণ কানাডার পানি খুবই সুপেয়। এখানে বোতলের পানির চেয়েও ট্যাপের পানি পানের জন্য রিকমন্ডেড। কিন্তু হলে কি হবে এদেশীয় মাছ আমার মুখে রোচে না সহসা। আমি দেশের মাছই খেতে চাই। জেসমিন আমার খাওয়া নিয়ে চরম বিরক্ত..

– তোমারে কে কানাডা আসতে বলছে!

– কেনো কি করছি আমি!

– যে দেশে থাকো সেই দেশের খাবার খেতে অভ্যস্ত হও। প্রতিদিন তোমারে কে দেশি খাবার রান্না করে দেবে!

– প্রতিদিন কই। মাঝে মাঝে করলেই হবে।

– নিজেরটা নিজেই রান্না করে খাও। অনেক ছেলেরাই করে। আমরা মাছ খাই না। আমাদের সমস্যা নাই।

– নিজেই করব দেইখো।

– পনোরো বছর ধরে তাই শুনতেছি, একদিনও দেখলাম না। আর খালি খুঁত ধরতে পার। কিছু মানুষ আছে খুঁত ধরনের ওস্তাদ..।

মায়ের হাতের পিঠা!

প্রসঙ্গ পিঠা। মায়ের হাতের পিঠা। মা লেখাপড়া জনতেন না বলে সিদ্দীকা কবিরের ’রান্না খাদ্য পুষ্টি’ গ্রন্থে কি কি রেসেপি আছে তাতে মায়ের জানা নাই। ইউটিউব দেখেও রান্না শেখার প্রশ্ন নেই। তখন গুগলের জন্মই হয়নি। মা যা কিছুই করেছেন সবই ম্যানুয়াল। নিজের ক্রিয়েশন। তখন ওভেন ছিল না, টোষ্টার ছিল না, রাইস কুকার ছিল না, একসাথে চার/ পাঁচটা বার্নারের গ্যাসের বা ইলেকট্রিক চুলা ছিল না। মাটির চুলায় লাকরি দিয়ে প্রচুর ধোঁয়ায় চোখের জলে একাকার হয়ে রান্না করতেন মা। তখন তো আর একজষ্ট ফ্যান ছিল না! তবুও এখন পর্যন্ত আমার কাছে সেই সব রান্নাই শ্রেষ্ঠ। জীবনে অনেক দামী রেষ্টুরেন্ট খেয়েছি। দেশে বিদেশে, লন্ডন, নিউইয়র্ক, টোকিও, প্যারিস, টরন্টো, লসএঞ্জেলেস কিন্তু মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ সব কিছুর চেয়ে আলাদা ছিল। মা ছিলেন পৃথিবীর সেরা শেফ। নিউজার্সি থেকে মনা কিছু পিঠার ছবি ফেসবুকে পোষ্ট করেছেন। বরিশালের মেয়ে বলেই হয়ত। আমাদের অঞ্চলে এই পিঠা খুব জনপ্রিয়।

পিঠাটার নাম পাকওয়ান পিঠা। আমরা বলতাম পাক্কান পিঠা। এই পিঠাটা মা বানাতেন। খুব স্বাদ ছিল। মা মারা যাওয়ার পর এই পিঠা আর খাওয়া হয়নি। এখন অনেক নতুন নতুন খাবার সম্পর্কে জানছি আমরা। বিজ্ঞান অনেক কিছু বদলে দিয়েছে। ইনগ্রিডেন্স বদলে গেছে। সবই প্যাকেটে পাওয়া যায়। শান, রাধুঁনি বা প্রানের মসলা জীবনকে সহজ করে দিয়েছে। কিন্তু মা কোনোদিন সেই সুবিধা পাননি। মসলা পাটা পুতায় বাটতেন। হলুদ, মরিচ, ধনিয়া, আদা, রসুন এই সব। জিনজার বা গারলিক পেষ্ট কি মা জানতেন না। এতো মসলার ব্যবহারই জানা ছিল না তার। প্রয়োজনও বোধ হয়নি। সামান্য লবন, তেল, মরিচ, হলুদ আর পেয়াঁজ দিলেই খাবার হয়ে উঠত অতি সুস্বাদু। একস্ট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল, কর্ন অয়েল,ভেজিটেবল অয়েল কি মা জানতেন না। সরিষার বা সোয়াবিন তেল ছিল যথেষ্ট। কত ধরনের গরম মসলা এখন। তখনও হয়ত ছিল। মা জানতেন না। দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ, পেস্তা, জিরা, তেজপাতা, জয়ফল এসবের ব্যবহার ছিল কদাচিৎ। ডীপ ফ্রীজ কাকে বলে মা জানতেন না। যেদিনের খাওয়া সেদিনই শেষ করতাম আমরা। শীতের দিনে হয়ত দু’একদিন বেশি রাখা যেতো গরম করে করে।

ব্রেকফাষ্ট নিয়েও কোনো মাথা ব্যাথা ছিল না। চায়ের সাথে মুড়ি বা গরম ভাত খেতাম। গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতে একটু ঘি হলে ফাইভস্টার হোটেল ফেল। পান্তা ভাতও খেতাম। কনকনে ঠান্ডার দিনে পান্তার সাথে জিওল মাছের তরকারি বা কাঁচা মরিচের সাথে পিঁয়াজ দিয়ে ডলে খেয়ে নিতাম। এখন যেমন নানা পদের খাবার খাই আমরা। ডায়াবেটিস আছে বলে কত বাছ বিচার করি। তখনও মানুষের ডায়াবেটিস ছিল। হোল হুইটের ব্রেড, টুয়েলভ গ্রেন, মাল্টি গ্রেন, প্লেন কত ব্রান্ডের ব্রেড। বিভিন্ন টাইপের সিরিয়াল, ওটমীল, ওমেগা থ্রি ডিম, এক, দুই বা তিন পার্সেন্ট বা স্কিম মিল্ক, অর্গানিক কলা, মা এসব কিছুই জানতেন না। গরুর দুধ খেতাম আমরা। দুধের সর খেতাম। কি সুন্দর ঘ্রান ছিল সেই হলুদ রঙের সরের। এখনও নাকে লেগে আছে। মা প্রায়ই ছিটাপিঠা বা চিতই পিঠা ভাজতেন মাটির সাজে। খুদের ভাত করতেন। কখনও কখনও চাপটি। একটু হলুদ, পিয়াঁজ আর কাচা মরিচ দিলেই রংটা ফুটত। এপিটাইজার, মূলকোর্স বা ডেজার্ট সার্ভ করার কথা মা জানতেন না। চা, কফি, ওয়াইন এসবও জানা ছিল না।

মুড়ি ভাজতেন নিজেই। আট দশ টিন মুড়ি বা খই ভেজে ফেলতেন। কোনো সার দিতে হতো না। জানতেনও না। বছরব্যাপী সেই মুড়ি খই খেতাম আমরা। সব্জিতো সবই মায়ের হাতের লাগানো। মাচানে মাচানে লাউ, ঝিঙ্গা, ধুঁধল, শিম, বিন ধরত। আলু দিয়ে শিমের লাবড়া ছিল তুলনাহীন। শিমের বিচি খুঁটে খুঁটে খেতাম। কাঠালের বিচির ভর্তা করে দিতেন পোড়া মরিচ দিয়ে। হলুদ কুঞ্জলতায় ছেয়ে থাকত কাঁটাঝোপের বেড়া। কলইর শাক খেতাম। আরো কত এলেবেলে খাবার খেতাম। ঢেঁকির শাক জিনিসটা কি দেশে এখন পাওয়া যায়! খোঁজ নিতে হবে। লবঙ্গ লতা মেয়ের মতো মোলায়েম ছিল সেই শাক। বনে জঙ্গলে হতো।

খাওয়া দাওয়া নিয়ে আমার মধ্যে একটা গ্রাম্যতা রয়ে গেছে আজও। আমি কি একটু আনস্মার্ট! এখন যেমন আমরা অর্গানিক খুঁজি, তখন সবই ছিল অর্গানিক। হেলথি খাবার। ফরমালিন কি জিনিস কেউ জানতে না। খাদ্যে ভেজাল ছিল না। মা সবই করেছেন রেসিপি ছাড়া কিন্তু সবকিছুতে ছিল মায়ের হাতের স্পর্শ আর কষ্টের ঘাম..।

ইশ্ মা যদি থাকতেন!!

মা বলতেন আমার নাকি চোখের খিদা। শিশু বয়স থেকেই খাবার নিয়ে আমার মধ্যে একটা সঙ্কট ছিল। এখনও সেটা আছে। আমার যেদিন ডায়াবেটিস ধরা পরল সেদিন থেকে আমার খাওয়া বিষয়ে ঘরে মার্শাল ’ল জারি হলো। এমন রান্না শুরু হলো যা কেউ খেতে পারে না। খেতে বসলে বলে এতো হাসপাতালের খাবার! আমি নিজেও খেতে পারি না। কিন্তু চোখ কান বন্ধ করে খাই। ব্রাউন রাইসের ভাত খাওয়া যে কত কষ্টের বা প্রায় প্রতিদিন সবুজ রঙের করল্লা ভাজি খাওয়া! ভয়তে বলতেও পারি না যে এতো নিয়ম মেনে আমি চলতে পারি না। বলতে পারিনা যে আমি সকালে ঘুম থেকে উঠে ওটমিল, সিরিয়াল বা টুয়েলভ গ্রেইন ব্রেড খেতে পারি না। এসব বললে জেসমিন এমন কড়া কথা শোনাবে যে কষ্টে আমার বুক ভেঙ্গে যাবে। অথচ ঘরের অন্য সবাই এসব খাবার রপ্ত করে ফেলেছে। কিন্তু আমিই পারিনি। ডায়াবেটিসের চেয়েও জেসমিনকে আমার বড় শত্রু মনে হয়। আমাকে কত যে খাওয়ার কষ্ট দেয়। আমি এলেবেলে টাইপ খাবার বেশি পছন্দ করি। সে হয়ত বলবে চাপটি, ছিটাপিঠা খেতে হবে না। আমি বলি মানুষ ডায়াবেটিস নিয়েও হরদম খাচ্ছে। তাহলে আমি কেনো পারব না।

দেশে আসার পর জেসমিনের সাথে বেশি কথা বলছি না। ইগনোর করছি। কথা বললেই খাবারের প্রসঙ্গ উঠবে। সুগার চেক করি না কিনা সেসব কথা উঠবে। সত্য ঘটনা হচ্ছে দেশে আসার পর একদিনও সুগার মাপিনি। আমার ডাক্তার বলেছে ঘন ঘন সুগার মেপে পেনিক না হতে। টের পাচ্ছি ভুড়িটা বড় হচ্ছে, শাটগুলো পেটের কাছে কেমন টাইট টাইট লাগছে। ভুড়ি জিনিসটা আমার তেমন পছন্দ না। স্লিম পছন্দ। টরন্টো গেলেই জেসমিন প্রথম বলবে তোমাকে দেখতে আগলি লাগছে। হাঁটার জন্য সেদিন বসুন্ধরা সিটিতে এপেক্স থেকে নাইকির কেডস কিনে এনেছি। কিন্তু একদিনও হাঁটতে যাইনি। আমার মহাখালীর বাসার কাছে সবচেয়ে কাছের পার্ক হচ্ছে নিকেতন। সেখানে লোকজন হাঁটার চেয়ে গল্প আর খাওয়া দাওয়াই করে বেশি। একটা পিকনিক পিকনিক ভাব।

ঢাকার রাস্তায় ওয়াকওয়ে বলে কিছু নাই। সব চা ওয়ালাদের দখলে। সেখানে আবার পুলিশের ভাগ আছে। সেদিন একজন বলল, স্যার পুলিশ দুই টাকাও খায়। এখন পুলিশই সব। রাষ্ট্রের বাপ মা। ওয়াকওয়ে যাওবা আছে তাও বছর ধরে খানা খন্দ করে রাখা। সুতরাং রাস্তায় হাঁটার কোনো সুযোগ নাই। আমি যে খুব খাওনেঅলা তাও না। ইদানীং আমার খাবারের মাত্রা আরো কমে গেছে। বয়স বাড়লে মনে হয় এমন হয়। খাওয়া নিয়ে আমার সমস্যার কোনো শেষ নাই।

যখন ছোট ছিলাম তখন যা পেয়েছি তাই খেয়েছি। তখনতো আর খাবারের এতো ভ্যারাইটি ছিল না। মা যা রাঁধতেন তাই হাপুস হুপুস খেয়ে ফেলতাম। হয়ত একটা দুইটার বেশি আইটেম থাকত না। হয়ত কখনো পেটও ভরত না ঠিকমতো। কতটুকু খেলে সঠিক হবে তা বুঝতে পারি না। কখনো কখনো খাওয়ার একটু পরেই খিদা পায় আবার কখনো কখনো নিঃশ্বাস নিতে পারি না। ছোট সময় খাওয়া নিয়ে নাকি কান্না করেছি নিশ্চয়ই। হয়ত খাওয়া নষ্টও করেছি বা মা হয়ত পর্যাপ্ত খাবার সাপ্লাই দিতে পারতেন না। এসব কারণেই মা বলতেন আমার নাকি চোখের খিদা। এখনও কি ঘরে, কি রেষ্টুরেন্ট বা কারো বাড়িতে দাওয়াতে গেলে টেবিল ভরা খাবার দেখতে খুব ভাল লাগে। কিন্তু খেতে বসে দেখা গেলো অনেক আইটেম টাচ করিনি। আমার স্টমাকের স্পেস অনেক কমে গেছে। একটু খাওয়ার পরই আমার পেট ভরে যায়। অরিত্রি বলে বাবা অনেক অপচয় করে..।

সেবার যখন হায়দারাবাদ গেলাম, দ্বিতীয় রাতে একটা ঘটনা ঘটল। টরন্টোতে আমি বহুরাত খিদা নিয়ে পেটে বালিশ চাপা দিয়ে ঘুমিয়েছি। আমি একটু রাত জাগি বটে তবে দুটার পর আর জাগি না। কিন্তু বারোটা বাজলেই আমার খিদা পেয়ে যায়। জেসমিনই বলবে একটু পরেই বলবা খিদা লাগছে। বেশি রাতে খাওয়া ঠিক না। তাড়াতড়ি শুতে পারনা! লেখার কথা বলে চ্যাটিং করো। তাই খিদা লাগলেও খাই না। খিদার কষ্ট নিয়ে ঘুমাই মাঝে মাঝে। খাওয়া নিয়ে জেসমিন কেনো যে এতো নির্মম বুঝি না। আমি যখন যেখানে হোটেলে থাকি কিছু খাবার রিজাভ রাখি। চকোলেট বা কুকি বা ফল। ইমারজেন্সি যাতে কাজে লাগে। এই যে এবার কলকাতা, হায়দারাবাদ বা বরিশালে হোটেলে থাকলাম, সবসময় পর্যাপ্ত খাবার মজুত ছিল। কিন্তু একদিনও খিদে পায়নি। খাওয়া থাকলে খিদা পায় না। না থাকলে পায়।

সেদিন রাতে ডিনার খেয়ে আসার ঘন্টাখানেক পরই ’বাবুর খিদার উদ্রেক হইলো’। আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম যে রুম সাভিস চালু আছে। কিন্তু হায়দারাবাদের হোটেলে যে রাত সাড়ে ন’টার পর রুম সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায় তা আমার জানা ছিল না। তখন রাত এগারোটা। সেদিন ছিল আবার রবিবার। বাইরের দোকানপাট, রেষ্টুরেন্ট সব বন্ধ হয়ে গেছে। হোটেলের লাগোয়া যে জুসের দোকানটা দেখেছি সেটাও বন্ধ। রুমেও আজ কিছু নাই। আকস্মিক খিদায় প্রায় মারা যাচ্ছি। যেহেতু কোথাও কিছু নাই সুতরাং ভয় আর আতঙ্কে আমার মারা যাওয়ার অবস্থা। সারারাত আমার কিভাবে কাটবে! অর্ক’র শশুরকে তো আর বলতে পারি না ভাইসাব আমার খিদা পাইছে! আমি বারবার ফ্রন্ট অফিসে ফোন করছি। ছেলেটা বলছে স্যার দেখছি ব্যাবস্থা করতে পারি কিনা কিছু। কিছুক্ষণ পরে জামাল নামে এক রুম বয় আসল। সে আবার ইংরেজি ভাল বোঝে না। কোনো রকম বোঝাতে সক্ষম হলাম যে আমার এখনই কিছু খাবার চাই। সে রাতে জামাল আমাকে বাঁচিয়েছিল। সে হোাটেলের রেষ্টুরেন্ট থেকে ব্রেড এবং জেলি টোষ্ট করে দিয়েছিল। জামিল তোমাকে ভুলব না ভাই..।

জসিম মল্লিক, লেখক ও সাংবাদিক