মনের আয়নাতে

সাইদুল হোসেন

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

Gift of time

প্রতি সপ্তাহে একদিন দেড়ঘন্টার জন্য ফিজিওথেরাপি নেয়ার উদ্দেশ্যে এক বৃদ্ধাকে তাঁর স্বামী হুইলচেয়ারে বসিয়ে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে আসেন। মহিলাকে ক্লিনিকের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে ভদ্রলোক আমার কাছে আসেন গল্প করতে। চমৎকার ব্যবহার, নানা বিষয়ে জ্ঞান রাখেন, যথেষ্ট উদার মনোবৃত্তির লোক। নাম তাঁর রোনাল্ড কেইন। আমাকে তাঁর খুব পছন্দ। তাঁর স্ত্রীও আমাকে হাসিমুখে হাই-হ্যালো করেন। এঁদের সঙ্গে একধরনের বন্ধুত্বই গড়ে উঠেছে। তাঁদের পরিবারের বিষয়ও আলোচনা করেন কখনো। একদিন বললেন যে তাঁদের মেয়েটি ডিভোর্স মামলায় জড়িয়ে পড়েছে, বড় মানসিক যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছে। শুনে সহানুভূতি জানালাম এবং আমার সংগ্রহ থেকে Spiritual upliftment and confidence building এর সহায়ক কিছু কাগজপত্র ওর মা-বাবার হাতে দিয়ে বললাম : আপনাদের মেয়েটিকে দিবেন। বলবেন ও যেন এগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ে, তাতে মনের যন্ত্রণার তীব্রতা কমবে, মনে সাহস আসবে, জীবনটাকে অর্থহীন মনে হবে না, গডের নৈকট্য অনুভব করবে সে। মাস দুই পর সেই ভদ্রলোক এসে আমার হাতে একটা এনভেলাপ তুলে দিয়ে বললেন, আমার মেয়ে আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে এবং এই চিঠিটা আপনাকে দিতে বলেছে। আমার মেয়েটিকে সান্ত্বনাসূচক কিছু পড়াশোনার কাগজ দেবার জন্য আমরাও কৃতজ্ঞ আপনার কাছে। থ্যাঙ্ক ইউ।

চিঠিখানা একটু অবসর পেতেই খুলে পড়লাম। মেয়েটি লিখেছে –

Thank you for taking time to write down your beliefs for me. The following beliefs are not mine but I do believe in them.

  1. Take time to think; it is the source of power.
  2. Take time to read; it is the foundation of wisdom.
  3. Take time to play; it is the secret of staying young.
  4. Take time to be quiet; it is the opportunity to seek God.
  5. Take time to be ware; it is the opportunity to help others.
  6. Take time to love and be loved; it is God’s greatest gift.
  7. Take time to laugh; it is the music of the soul.
  8. Take time to be friendly; it is the road of happiness.
  9. Take time to dream; it is what the future is made of.
  10. Take time to play; it is the greatest power of earth.
    It is also very important to forgive or else it will eat you up inside.

Your New Found Friend,
Debbie

নাতিদের জন্য টুপি

২০০৬ সনের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহ। খুব গরম সেদিন। দুপুর বেলা এক হালাল ফুড স্টোরে কিছু একটা কিনতে গেলাম। কোন ভীড় নেই, অল্প বয়েসী এক হিজাবী কেশিয়ারের সামনে একজন মাত্র কাস্টমার এক সাদা সিনিয়র মহিলা দাঁড়িয়ে। মহিলার মাথায় হ্যাট, গায়ে টি-সার্ট, পরনে হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট, পায়ে স্লিপার্স। তার হাতে চারটি হাতে-বোনা সুতি টুপি। তিনি কেশিয়ার মেয়েটিকে বললেন : তোমাদের স্টোরে জিনিসের দাম বড় বেশী। তোমরা চাচ্ছ ২.৯৯ ডলার ক’রে অথচ আমি অন্য একটা ডলার স্টোরে দেখেছি ওরা মাত্র এক ডলার ক’রে বিক্রি করছে। যাহোক, এই চারটা টুপি আমি নিচ্ছি আমার নাতিদের জন্য, এক্ষুনি দরকার।

তার কথা শুনে আমার একটু অবাক লাগলো। তাই তাকে বললাম, এক্সিউজ মি, ম্যাডাম। আপনার নাতিরা কি মুসলিম?

হেসে দিয়ে তিনি বললেন : শিউর, এবং আমি নিজেও মুসলিম। আলহামদুলিল্লাহ! আমার ড্রেস, মাথায় হিজাব নেই দেখে অবাক হচ্ছেন? মুসলিম বলে চিনতে অসুবিধা হচ্ছে? বাট দ্যাট্স ওকে, আই অ্যাম এ মুসলিম!

ফাগুয়া উৎসব

গিয়েছিলাম এক গায়ানীজ হালাল মীট স্টোরে। স্টোরের মালিক একজন পাকিস্তানী মুসলিম যুবক, আমার সঙ্গে ওর পরিচয় ৬-৭ বছরের, আমাকে কখনো আঙ্কেল, কখনো চাচাজী বলে ডাকে। প্রায় প্রতি শুক্রবারেই মসজিদে জুমার নামাজের আগে বা পরে দেখা হয়। আমি ওর সঙ্গে কথা বলছি এমন সময়ে মুখে-মাথায়-গায়ে লাল-নীল-হলুদ-গোলাপী রং মাখানো ৩৫-৩৬ বছরের সালোয়ার-কামীজ পরিহিতা এক মহিলা কাস্টমার এসে ঢুকলো হালাল বীফ কিনতে। মহিলার কাছে আমি জানতে চাইলাম এটা কি হিন্দুদের হোলি পরবের দিন?

ভারতে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় এই ফাগুয়া তথা হোলি উৎসব। ছবি : দি হ্যানস্ ইন্ডিয়া

মহিলা বেশ একটু অবাক হয়েই বলল : কেন, আপনি কি জানেন না এটা ফাগুয়া উৎসবের দিন?

বললাম : না, জানি না, কারণ আমি একজন মুসলিম, আমরা কখনো ফাগুয়া বা হোলি পরব পালন করি না।

জবাবে মহিলা বলল : আমিও তো মুসলিম তবে আমার হাজব্যান্ড একজন হিন্দু। তাই আমিও তার ধর্মের সব উৎসবই পালন ক’রে থাকি।

এবার আমার অবাক হওয়ার পালা! একজন মুসলিম মহিলা হিন্দুদের সব পরব পালন করে?

মহিলা তার হালাল বীফের দাম মিটিয়ে দিয়ে চলে গেলে আমার সেই পাকিস্তানী ভাতিজা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো : চাচাজী, এই মহিলা কি-ধরনের মুসলিম?

বললাম : আমার মনেও তো সেই প্রশ্ন।

পীসমেকার

হাসপাতালে কখনো কখনো বেশ মজার ঘটনাও ঘটে।

একদিন বৃদ্ধা মা’কে সঙ্গে নিয়ে বেশ বয়স্কা এক মহিলা এলেন। জানতে চাইলেন পেশেন্ট ভর্তি করতে হলে কোথায় যেতে হবে, তার মায়ের হার্টের চিকিৎসার জন্য একটা পীসমেকার লাগাতে হবে। পীসমেকার কথাটা আমাকে বোঝানোর উদ্দেশ্যে তিনি দু’তিনবার বললেন। বললাম : আপনাদের এক্সরে ডিপার্টমেন্টে যেতে হবে হবে, এবং তারপর সেখানে যাবার এলিভেটরটা দেখিয়ে দিলাম।

তার বলা কথাটা আসলে pacemaker, পীসমেকার নয়। এর আগেও একদিন এক পেশেন্ট এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো তার বুকে একটা spacemaker লাগাতে লাগাতে হবে, সেটার জন্য কোথায় যেতে হবে!

লটারী জেতার বিড়ম্বনা

একদিন দুপুরে গ্রোসারি হাতে স্টোর থেকে বের হয়েছি এমন সময় এক যুবক এসে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে বললো সে ব্রাজিলের লোক, পর্তুগীজ হচ্ছে ও মাতৃভাষা। সে পর্তুগীজ জানে এমন এজন ল’ইয়ারের সন্ধান করছে। আমি কি সে রকম কাউকে জানি? বড় উপকার হতো তাহলে।

বললাম : না, সেরকম কাউকে তো চিনি না, দুঃখিত। কিন্তু ইংলিশ জানা ল’ইয়ারের কাছে যাচ্ছ না কেন?

আমার প্রশ্ন শুনে সে তার ওয়ালেট খুলে 6/49 একটা লটারী টিকেট দেখিয়ে বলল : এটা দু’ডলার দিয়ে কিনেছিলাম, ড্র’তে আমি আড়াই মিলিয়ন ডলার জিতেছি। কিন্তু লটারী অফিসে গিয়ে ক্লেম করতে সাহস পাচ্ছি না কারণ আমি কানাডাতে একজন ইল্লিগ্যাল ইমিগ্রেন্ট, আমার কোন কাগজপত্র নেই। চোরাপথে এজেন্টদের মাধ্যমে এ দেশে ঢুকেছি দু’মাস আগে। জানাশোনা কেউ নেই। তাই ভয়, যদি লটারী অফিস পুলিশ ডেকে আমাকে ধরিয়ে দেয়? আমার জেল হয়ে যায়? ইংলিশ তো বলতে গেলে জানিই না, সেজন্যই আমার মাতৃভাষা পর্তুগীজ জানা ল’ইয়ারের দেখা পেলে তাকে সব কথা বুঝিয়ে বলতে পারতাম, হয়ত তিনি আমার লটারীর টাকা পাওয়া এবং জেলে না যাওয়ার কোন রাস্তা বাৎলাতে পারতেন।

লোকটার কি বিড়ম্বনা লটারী জিতে! ভাগ্যের পরিহাস অথবা ভগবানের উপহাস, কোনটা বলবো?

শাশুড়ি – বৌ সংবাদ

সচরাচর শাশুড়ি-বৌয়ের সম্পর্কটা মধুর হয় না, তিক্ততাই বেশী চোখে পড়ে। তবে ব্যতিক্রমও আছে বৈকি!

হাসপাতালের সার্জারি ইনফরমেশন ডেস্কে কাজ করছি এমন সময় একটি ইন্ডিয়ান যুবতী এসে জানতে চাইল দময়ন্তী জাভেরী কখন সার্জারি সেরে বাইরে আসবে। রিকভারি রুমে ফোন করে জানা গেল যে দময়ন্তীর সার্জারি শেষ হয়েছে, সে সুস্থ আছে, দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। তবে তার জন্য একটি বেড না পাওয়া পর্যন্ত সে রিকভারি রুমেই থাকবে। কখন সেই বেড পাওয়া যাবে তার কোন নিশ্চয়তা দেয়া যাচ্ছে না, খোঁজাখুঁজি চলছে। ভিজিটরকে ধৈর্য ধরতে হবে।

খবরটা যুবতীকে দিলাম। শুনে সে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল যে সেই সকাল ছ’টায় সে রোগিনীকে ভর্তি করার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছে আর এখন বাজে ১২টা। আরো অপেক্ষা করতে হবে? ইট্স্ এ লং ওয়েট! থামলো সে।

জানতে চাইলাম পেশেন্ট তার কে হয়। বলল : তিনি আমার শাশুড়ি। তিনি আমার জন্য ভগবানের দেয়া আশীর্বাদ। তিনি না থাকলে এদেশে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই চাকরী করে দু’টি সন্তান মানুষ করা যে কি কষ্টকর হতো আমার জন্য সেটা আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারবো না। তিনি আমার শাশুড়ি এবং মা দুইই।

আমি তার নাম জানতে চাইলে সে জানালো যে ওর নাম আর্তি (বাংলায় যাকে আমরা আরতি বলে থাকি), এবং ওরা ইন্ডিয়ার পশ্চিম সীমান্তের কাথিয়াওয়াড়ের লোক।

আর্তির শেষ হলে আমি বললাম : আর্তি, তোমার শাশুড়িকে বলছ তিনি তোমার জন্য ভগবানের আশির্বাদ, তোমাকে প্রশংসা জানাচ্ছি তোমার উদার মনোভাবের জন্য। অথচ দেখ, মাত্র গতকাল অন্য এক অফিসে ভলান্টারি সার্ভিস দেয়ার সময় সম্পূর্ন ভিন্ন এক চিত্র দেখেছি। শোন –

(এক)

পঁচাত্তর বছরের এক বৃদ্ধ তার ৭০ বছর বয়স্কা স্ত্রীকে নিয়ে আমার ডেস্কে এসে কেঁদে ফেলল, বলল : এক সপ্তাহের ভিতরে ৩০০-৪০০ ডলার মাসিক ভাড়ায় আমাদের দু’জনের জন্য একটা বাসা খুঁজে দিতে পারেন? ছেলের সঙ্গে থাকি, আমরা স্পন্সরড্ ইমিগ্রেন্টস, কানাডিয়ান সিটিজেন হয়েছি কিন্তু ১০ বছর কানাডাবাস পূর্ণ হতে আরো ৪ বছর বাকি। তাই ওয়েলফেয়ার বা পেনশন কোনটাই দাবী করতে পারছি না। স্ত্রী বেকার, আমিও বেকারই বলা চলে যদিও Crossing Guard – এর একটা কাজ করি, সামান্য কিছু রোজগার হয় তাতে। কোন ধরনের সেভিংস নেই আমাদের। বড় অসহায়।

জিজ্ঞাসা করলাম : এত তাড়া কেন?

বুড়ো দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললো : কপালের ফের। দেশে থাকলে কোনরকমে চলে যেত জীবন। ছেলেই বলেকয়ে এদেশে নিয়ে এল। ওর বৌটা এখন আমাদের একটুও সহ্য করতে পারে না। ছেলের বৌ নোটিশ দিয়েছে, ১৫ দিনের ভেতর বাড়ি ছাড়, নিজেদের ঠিকানা খুঁজে নাও।

আপনার ছেলে কি বলে? জানতে চাইলাম।

বুড়ো বলল : ছেলে আমার মেরুদন্ডহীন, স্ত্রীর দাস (জরুকা গুলাম)। সে বলে : আমি কিচ্ছু জানি না।

 (দুই)

বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে এক বৃদ্ধাকে নিয়ে এক যুবতী নিয়মিতভাবে ফ্র্যকচার ক্লিনিকে আসা-যাওয়া করছিল। তাই একটু মুখ পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। যুবতীটি খুব সুন্দর ইংরেজী কথা বলতে পারে। শুনতে ভাল লাগে। কথা প্রসঙ্গে জেনে নিয়েছিলাম যে ওরা মধ্যপ্রাচ্যের ওমান এর লোক, বর্তমানে কানাডায় ইমিগ্রেন্ট। বৃদ্ধা ওর শাশুড়ি, ওরই সঙ্গে থাকে, স্বামী টেকনিক্যাল কোন একটা কাজ করে। মেয়েটির নাম ফাতিমা।

যুবতীটি বেশ সহজ-সরল, আসলেই আমার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে। সে তখন প্রেগন্যান্ট। একদিন জিজ্ঞাসা করলাম : ছেলে না মেয়ে হবে? হেসে বলল : জানার ইচ্ছা নেই, তাই জানতে চেষ্টা করিনি। তবে মনে হয় ছেলেই হবে, বড় উপদ্রব করে, বলেই হেসে দিল।

অন্যদিন জিজ্ঞাসা করলাম : আচ্ছা ফাতিমা, এই যে তোমার ভারী শরীর নিয়েও তোমার শাশুড়িকে নিয়ে বারবার হাসপাতালে আসো-যাও তাতে তোমার কষ্ট হয় না?

ফাতিমা বলল : অসুখটা আমার নিজের মায়ের হলে কি করতাম? না আসার বাহানা খুঁজতাম? কক্ষনো নয়। এখানেও ঠিক তাই। আমার শাশুড়ি তো আমার মা, মায়ে যত্ন করবো না? আমি তাকে অবহেলা করলে আমি তার স্নেহ পাব কি করে? আমিও তো একদিন মা হব, শাশুড়ি হব, তখন অসুখবিসুখ হলে আমার ছেলের বৌ আমার দেখ্ভাল্ করুক সেটাই তো চাইব। শাশুড়ির মেয়ে বিয়ে হয়ে অন্য পরিবারে চলে গেছে, সেই স্থান পূর্ণ করেছি আমি। তাঁর দেখাশুনা করা, যত্ন নেয়া তো আমার জন্য ফরজ্ – অবশ্য কর্তব্য।

ফাতিমার কথাগুলো শুনে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। বললাম : আল্লাহ তোমাকে আজীবন রহমত করুন।

শুনে সে বলল : শোকরান (ধন্যবাদ)।

কথা প্রসঙ্গে একদিন সে বলেছিল যে ওরা মূলত : আফ্রিকার লোক, ওদের পারিবারিক ভাষা ‘সোয়াহিলি’। সেই ভাষাটা একবার শেখার চেষ্টা করেছিলাম, যার দু-চারটি কথা আজো মনে আছে। আমি তাকে বললাম : নাকুপেণডা (আই লাইক ইউ)। খুশী হয়ে ফাতিমা বলল : আসান্তে, আসান্তে সানা, অর্থাৎ থ্যাঙ্কস, মেনি থ্যাঙ্কস।

এরপর থেকে ফাতিমার প্রতি আমার মনটা খুবই প্রসন্ন হয়ে গেছে। শপিং মলে কখনো দেখা হলে ও খোঁজখবর নেই। একদিন তো ওর মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। মেয়ের প্রথম সন্তান হবে, তার যত্ন নেয়ার জন্য ওমান থেকে ওর মা এসেছেন কিছু দিনের জন্য।

(তিন)

এটাও সার্জারি ইনফরমেশন ডেস্কেরই ঘটনা।

ডেস্কে বসে যথারীতি কাজ করে যাচ্ছি এমন সময় এক ৩০-৩৫ বছর বয়সের সাদা কানাডিয়ান মহিলা আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন : আমার শাশুড়ির জন্য অপেক্ষা করছি, আজ তাঁর একটা day surgery আছে। কিন্তু আমার অবাক লাগছে যে তিনি লেট, যা তিনি কখনো হন না কাজে। She is always early. That’s her style.

অপর দিকে আমি সর্বদা সব কাজে লেট, তিনি আমাকে তাড়া দেন। অথচ আমিই আজ আগে পৌঁছে গেছি আর তিনি লেট। ব্যাপারটা সহজভাবে নিতে কষ্ট হচ্ছে। শাশুড়ি আবার রাস্তায় কোন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েননি তো?

মহিলার উতলা অবস্থা দেখে তাঁকে অভয় দিয়ে বললাম : আপনার মুখে আপনার শাশুড়ির পাংচুয়ালিটির যে বর্ণনা শুনলাম তাতে তো মনে হচ্ছে তিনি অচিরেই এখানে পৌঁছে যাবেন। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করুন।

থ্যাঙ্কস, তাই যেন হয়, বলে ব্যস্তভাবে এলিভেটরের দিকে এগিয়ে গেলেন মহিলা।

(চার)

বেশ কয়েক বছর আগে (১৯৯৭-৯৮ হতে পারে) এই টরন্টো শহরেই এক ভদ্রলোকের মুখে এই ঘটনাটি শুনেছিলাম।

পথে কুড়িয়ে পাওয়া মা

তিনি এক অপরিচিত, পরিত্যক্ত বৃদ্ধাকে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন নিতান্ত অসহায় অবস্থায় উদভ্রান্তের মত রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে দেখে। হিন্দি ছাড়া অন্য কোন ভাষা বৃদ্ধা জানেন না। দয়া পরবশ হয়ে নিজের বাসায় তাঁকে নিয়ে যান এবং স্ত্রীকে তাঁর সেবাযত্ন করে সুস্থ করে তুলতে বলেন। তিনি কার কি হন, কোথায় থাকেন সে-খবর পরে নেয়া যাবে। পুলিশকে খবর দিয়ে বৃদ্ধার নাম পরিচয় যথা সময়ে তাদের জানাবেন এই শর্তে মহিলাকে রাখতে লাগলেন। হেলথ কার্ড নেই, তাই নিজের নিকটাত্মীয় পরিচয় দিয়ে নিজের পয়সা খরচ করে সব চিকিৎসা করাতে থাকেন। ডাক্তার তাঁকে দেখে পরীক্ষা করে জানালেন যে বৃদ্ধা দারুণ malnutrition-এ এবং রক্তহীনতায় ভুগছেন, তাঁর পুষ্টিকর সব খাদ্যপানীয় দরকার, সঙ্গে কিছু ওষুধপত্র। ভদ্রলোক সব ব্যবস্থা করলেন। স্বামী-স্ত্রীর সেবাযত্নে ও আদরে বৃদ্ধা ক্রমে সুস্থ হয়ে উঠলেন। তারপর শোনালেন তাঁর দুঃখের কাহিনী যার সারসংক্ষেপ হলো এই –

তিনি থাকতেন ছেলের বাসায়, ছেলে তার স্ত্রীকে নিয়ে বাস করে। কিন্তু ছেলের বৌ তার শাশুড়িকে দু’চোখে দেখতে পারে না, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, সময়মত খেতে দেয় না, পেট ভরে খেতে দেয় না। কিচেনে যাওয়া বারণ, ফ্রিজে হাত দেয়া বারণ। ক্ষুধায় কাতর হয়ে কিছু খাবারের জন্য কাকুতি-মিনতি করলেও বৌমার মন গলে না। বলে, দিনে দু’বার খানা পাবেন-সকালে ও সন্ধ্যায়, তার বেশী না।

পর্যাপ্ত খাদ্যপানীয়ের অভাবে বৃদ্ধা ক্রমে অপুষ্টিতে ভুগে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ছেলেকে বললে সে গা করে না, বরং উপদেশ দেয় বৌয়ের মন জয় করে ওর সঙ্গে মিলেমিশে চলতে। কিন্তু বৌমা তো তার সাজাগোজা ও আনন্দ-ফুর্তি নিয়েই ব্যস্ত, শাশুড়ির কথা শোনার মত ধৈর্য কোথায়? অবশেষে একদিন ক্ষুধার জ¦ালা সহ্য করতে না পেরে বৃদ্ধা ডাইনিং টেবিলে রাখা খাবার মুখে তুলে খেতে লাগলেন। সেটা চোখে পড়তেই অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে করতে বৃদ্ধাকে ঘরের বাইরে ঠেলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। হতভম্ভ বৃদ্ধা রাস্তায় নেমে হাঁটতে লাগলেন, উত্তর-দক্ষিণ জ্ঞান নেই। হাঁটছেন তো হাঁটছেনই। এমন যখন অবস্থা তখন সেই ভদ্রলোকের নজরে পড়েন। অসুস্থ বৃদ্ধাকে নানা প্রশ্ন করে কোনই জবাব পেলেন না, শুধু কান্না, শুধুই কান্না, আমাকে তোমার ঘরে নিয়ে চল বাবা, আমাকে কিছু খেতে দাও। ভদ্রলোক তাঁকে ঘরে নিয়ে এলেন। সেই বৃদ্ধাই এখন তাঁর মা, তিনি জানালেন।

(চলবে)

সাইদুল হোসেন। মিসিসাগা