টরন্টো বিশ্বের দ্বিতীয় নিরাপদ শহর
কতটা নিরাপদ এখানকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা?
খুরশিদ আলম
২০২১ সালের সালে বিশ্বে সবচেয়ে নিরাপদ শহরের তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল টরন্টো। আর প্রথম স্থান অধিকার করেছিল ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন। সবচেয়ে নিরাপদ শহর হিসাবে কোপেনহেগেন নির্বাচিত হওয়ার পিছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছিল সেখানকার কম মাত্রার অপরাধ। গত এক দশকেরও বেশী সময়ের মধ্যে এই শহরে অপরাধের মাত্রা সর্বনিম্ম পর্যায়ে নেমে এসেছিল। কোপেনহেগেন এর আরো একটি দারুণ বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে ধনী দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান তুলনামূলকভাবে কম। এখানে একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মীর সন্তান যে স্কুলে পড়তে যায় সেই একই স্কুলে পড়তে যায় বড় কোন প্রতিষ্ঠানের একজন প্রধান নির্বাহীর সন্তানও। স্থানীয় সুপার মার্কেটে বা অন্যকোন স্থানে এই দুই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ মেলামেশাও হয়।
শ্রেণী বৈষম্যে যারা বিশ্বাসী তারা হয়তো নাক সিটকাবেন এই কাহিনী শুনে। কারণ শৈশব থেকেই তাদেরকে শিখানো হয়েছে যারা গরীব তারা নিচু শ্রেণীর মানুষ। গরীব বা স্বল্প আয়ের মানুষকে ছোট করে দেখা, তাদেরকে ঘৃণার চোখে দেখা, তাদের সঙ্গে সামাজিকভাবে দূরত্ব বজায় রাখা তথাকথিত এই অভিজাত শ্রেণীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট। এই অমানবিক আচরণ থেকে মুক্ত নয় এই শ্রেণীর মানুষ। আর অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধির পিছনে ধনীদের এই আচরণ অন্যতম একটি কারণ।
টরন্টোর অবস্থাও অনেকটা কোপেনহেনের মতই। সাধারণভাবে সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে শ্রেণীবৈষম্য খুব একটা ভূমিকা রাখে না। এখানেও ধনী এবং দরিদ্র উভয় পরিবারের ছেলে মেয়েরা একই স্কুলে পড়তে যায়। অবশ্য ‘প্রাইভেট স্কুল’ নামে এখানে একটি সিষ্টেম চালু আছে যেখানে শুধুমাত্র ধনী পরিবারের সন্তানেরাই যেতে পারে। কিন্তু এই জাতীয় স্কুলের সংখ্যা খুব বেশী নেই এখানে।
তবে ধনী দরিদ্রের ব্যবধানটা টরন্টোতে অনেক বেশী। আসলে গোটা কানাডায়ই এই ব্যবধানটা অনেক বেশী। আমরা জানি কানাডা বিশ্বের ধনী দেশগুলোর একটি। কিন্তু এখানে যেমন আছেন ধনবান জনগোষ্ঠি তেমনি আছেন দরিদ্র জনগোষ্ঠিও। আবার এই ধনবানদের মধ্যে কয়েকজন আছেন যাদেরকে বলা হয় অতি ধনী। ২০১৭ সালে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফ্যামের এক গবেষণা পত্রের তথ্য থেকে জানা যায় এই অতি ধনীরা এতই ধনী যে তা রূপকথার গল্পকেও হার মানায়।
অক্সফ্যাম এর গবেষণা তথ্য থেকে আরো জানা যায় এই সুপার ধনীদের মধ্যে ঐ সময় যারা শীর্ষে ছিলেন এমন দুইজন ব্যক্তির হাতে যে পরিমাণ সম্পদ কুক্ষিগত অবস্থায় ছিল তার পরিমাণ দেশটির ১ কোটি ১০ লাখ দরিদ্র মানুষের হাতে যে সম্পদ রয়েছে তার সমান! ধনী এই দুই ব্যক্তি হলেন ডেভিড থমসন এবং গ্যালেন ওয়েস্টন সিনিয়র। ডেভিড থমসন ‘থমসন রয়টার্স’ এর চেয়ারম্যান এবং গ্যালেন ওয়েস্টন সিনিয়র লবলজ কোম্পানী লিমিটেড এর সাবেক প্রেসিডেন্ট। গ্যালেন মৃত্যুবরণ করেন ২০২১ সালে। থমসন রয়টার্সের ব্যবসা হলো মিডিয়া আর লবলজ এর ব্যবসা হলো গ্রোসারী ও ঔষধের দোকান।
এই দুই ব্যক্তির হাতে অক্সফামের রিপোর্ট প্রকাশে সময় কি পরিমাণ সম্পদ ছিল তা শুনলে আমাদের মত যারা নিতান্তই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ তাদের কথা বাদই দিলাম, যারা পর্যাপ্ত ধনী তারাও যারপর নাই বিস্ময়াভিভূত হবেন। এই দুই অতি ধনী মিলে সেই সময় কানাডার মাঝারি ধরনের একটি প্রভিন্সের সবকিছু কিনে ফেলতে পারতেন!
সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে একদিকে সম্পদের এই সীমাহীন বৈষম্য অন্যদিকে বেতনের আকাশপাতাল তফাৎ গোটা সমাজকেই একটি ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়। আর শুধু অক্সফ্যামের গবেষণা প্রতিবেদনেই যে এই বৈষম্যের চিত্র ফুটে উঠেছে তা নয়। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদন থেকেও প্রায় একই ধরণের চিত্র পাওয়া যায়। ইতিপূর্বে প্রকাশিত কানাডার সেন্টার ফর পলিসি অলটারনেটিভ নামের বাম ঘরাণার একটি সংগঠনের রিপোর্টে দেখা যায়, সবচেয়ে ধনী ৮৬ জন ব্যক্তি বা পরিবার অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার ০.০০২ শতাংশ লোক ক্রমশ আরও ধনী হয়ে উঠছেন এবং এই মুহূর্তে তাদের হাতে দেশের দরিদ্রতম এক কোটি ১৪ লাখ লোকের সম্পদের সমপরিমাণ সম্পদ পুঞ্জীভূত রয়েছে।
সম্পদের এরকম অসম বন্টন ব্যবস্থায় সমাজ বা রাষ্ট্রে অপরাধের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ কাজ নয়। কানাডায় মাত্র কয়েকজন লোকের হাতে পর্বতসমান উচ্চতার সম্পদ কুক্ষিগত হবে আর অন্যদিকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ দারিদ্রতার মধ্যে বাস করে অসুস্থ্য জীবনযাপন করবেন সেটা কোন সুস্থ্য সমাজব্যবস্থার প্রতিফলন নয়। আমরা দেখেছি, অক্সফ্যামও তাদের এক প্রতিবেদনে বিপজ্জনকভাবে সম্পদ কুক্ষিগত হওয়ার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। তারা বলেছে, যে সমাজে অধিক বৈষম্য থাকে সে সমাজে অপরাধের মাত্রাও অধিক থাকে। ঐ সমাজ হয় অস্বাস্থ্যকর। মানুষ একে অপরকে বিশ্বাস করেন না। মানুষজন মনে করতে থাকেন তারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন যখন দেখেন ঐ অতি ধনীরা নিজেদের সুবিধার্থে রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর প্রভাব খাটিয়ে আইন তৈরী করে নেন।
তবে এরপরও বলা যায় কানাডা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ একটি দেশ। অপরাধের মাত্রা অনেক কম অন্যান্য দেশের তুলনায়। এমনকি পাশ্ববর্তী ‘বিশ্ব নিয়ন্ত্রক’ দেশ যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায়ও। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এর এক হিসাব অনুযায়ী (২০১৭ – ২০২১) দেখা যায় সে দেশে বন্দুক হামলায় গড়ে প্রতিবছর ১ লাখ ১৭ হাজার লোক গুলিবিদ্ধ হন। গুলিবিদ্ধ এই ব্যক্তিদের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন প্রায় ৪২ হাজার ৬ শত লোক। সেই তুলনায় কানাডা অনেক বেশী নিরাপদ তা বলা যেতে পারে নির্দ্বিধায়।
এদিকে ২০২২ সালে প্রকাশিত worldpopulationreview.com এর এক গবেষণা তথ্যে দেখা যায় সেই সময় বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ দেশের তালিকায় ছিল আইসল্যান্ড এর নাম। অন্যদিকে কানাডার অবস্থান ছিল ১২তম। আর বিশ্বমোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান? ১২৯তম!! অপরাধের স্বর্গরাজ্য মেক্সিকো বা আফগানিস্তানের মত দেশগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্র খুব বেশী ভাল অবস্থানে ছিল না। অপরাধের সূচকে মেক্সিকোর অবস্থান ছিল ১৩৭তম এবং আফগানিস্তানের অবস্থান ১৬৩তম।
২০২২ সালে বিশ্বে সবচেয়ে নিরাপদ দেশের তালিকা কানাডার অবস্থান ১২তম হলেও নিরাপদ শহর হিসাবে টরন্টোর অবস্থান ছিল আরো উপরে। এই লেখার শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০২১ সালের সালে বিশ্বে সবচেয়ে নিরাপদ শহরের তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল টরন্টো।
অন্যদিকে দেখা গেছে শুধু কানাডার অভ্যন্তরে নিরাপদ শহরের তালিকায় টরন্টোর অবস্থান চতুর্থ। চলতি জুলাই মাসের ৭ তারিখে প্রকাশিত Rentola.ca এর এক গবেষণা পত্রে বলা হয়, নিরাপত্তার বিচারে টরন্টোর অবস্থান চতুর্থ। প্রথম অবস্থানে রয়েছে টরন্টোর উত্তরে লেক সিমকো’র কাছে অবস্থিত বেরি শহরটি। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে ব্রান্টফোর্ড ও গুয়েল্ফ শহর। টরন্টোসহ এই চারটি শহরই অন্টারিও প্রভিন্সে অবস্থিত।
বসবাসের জন্য একটি শহর কতটা নিরাপদ সেটি নির্ধারণ করা হয় ঐ শহরের মোট জনসংখ্যার অনুপাতে কতজন পুলিশ সদস্য রয়েছে এবং সহিংস ও অসহিংস অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সংখ্যা কত। আরো যে বিষয়টি আমলে নেয়া হয় সেটি হলো, অপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে বিচার কার্য সমাধানের হার কত।
উল্লেখ্য যে, ২০১৫ সালে প্রকাশিত স্ট্যাটিসটিকস কানাডার এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ‘কানাডায় গুরুতর অপরাধের মাত্রা গত ৪৬ বছরের মধ্যে সর্বনিন্ম পর্যায়ে পৌঁছেছে। আর সর্বাধিক নিরাপদ শহর এখন টরন্টো।’ টরন্টোতে অপরাধের যে মাত্রা বিদ্যমান সেটি তুলনা করে দেখা যায়, সেই সময় কানাডার অন্যান্য শহরের চেয়ে টরন্টো ভাল অবস্থানে ছিল এবং তা গত প্রায় একদশক ধরেই।
তবে কানাডায় অপরাধের এই মাত্রা কেন কমে এসেছে সে সম্পর্কে কোন সহজ উত্তর দিতে পারেনি কেউ। অপরাধ বিশেষজ্ঞ টরন্টো ইউনিভারসিটির অধ্যাপক এন্থনী ডুব বলেন, অপরাধ কমে আসার এই বিষয়টি জনগণ অনেকদিন ধরেই দেখে আসছে। কিন্তু কেন কমে আসছে সে সম্পর্কে যথাযথ কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।
স্ট্যাটিসটিকস কানাডার মতে দেশে বয়স্ক লোকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া, অপরাধ দমনে পুলিশের কৌশল পরিবর্তন ও অনুশীলন বৃদ্ধি, টেকনলজীর ব্যবহার বৃদ্ধি, বেকারত্ব হারের পরিবর্তন, অবৈধ ও ঝুঁকিপূূর্ণ আচরণের প্রতি মানুষের মনোভাব পরিবর্তন এবং অ্যালকোহল পানের অভ্যাসে পরিবর্তন আসায় আপরাধের মাত্রা অনেক কমে গেছে। স্ট্যাটিসটিকস কানাডা আরো জানায় দেশে সব ধরণের অপরাধের মাত্রা কমেছে।
তবে অপরাধের মাত্রা কমে আসার পিছনে বিগত তিন চার দশকে আসা ইমিগ্রেন্টদের বিরাট একটি ভূমিকা রয়েছে। ইতিপূর্বে পিউ রিসার্স সেন্টার এর এক অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি বা সন্ত্রাস বৃদ্ধির জন্য অভিবাসীদেরকে দায়ী করার প্রবনতা অন্যান্য দেশের নাগরিকদের তুলনায় কানাডিয়ান নাগরিকদের মধ্যে অনেক কম। পিউ রিসার্স সেন্টার এই তথ্য সংগ্রহের জন্য ১৮ দেশের উপর জরীপ চালায়। আর বিশ্বের প্রায় অর্ধেক অভিবাসী বাস করেন এই ১৮ দেশে। টরন্টো স্টার পত্রিকায় এই সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল।
অর্থাৎ কানাডায় অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধিতে অভিবাসীরা দায়ী নন, বরং অপরাধের মাত্রা হ্রাসে তাদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। ইতিপূর্বে স্যাটিসটিকস কানাডার এক জরীপে বলা হয়েছিল টরন্টো, মন্ট্রিয়ল প্রভৃতি বড় বড় শহরে সাম্প্রতিককালে আসা অভিবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ভয়ঙ্করসব অপরাধের মাত্রা হ্রাস পেয়েছে। এই অভিবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধি প্রকৃতপক্ষে একধরণের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করেছে অপরাধ কমানোর ক্ষেত্রে। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রন লেভি বলেন, অভিবাসীদের সম্পর্কে আগের দিনে যে একপেশে ভাবনা ছিল, অর্থাৎ অভিবাসীরাই সব নষ্টের মূলে, সে ভাবনা থেকে আজ আমরা মুক্তি পাবার পথ খুঁজে পেয়েছি। এটি সত্যি উৎসাহব্যঞ্জক একটি ব্যাপার।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এই অভিবাসীদের মধ্যে একটি অংশ আজ কানাডায় নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন। প্রথম সারির নিরাপদ শহরের তালিকায় স্থান পাওয়া কানাডার বিভিন্ন শহরে নির্দিষ্ট এই সম্প্রদায়ের অভিবাসীরা হত্যাকান্ডেরও শিকার হয়েছেন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। এরা হলেন কানাডার মুসলিম সম্প্রদায়।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, গত ২০২১ সালের ৬ জুন লন্ডন অন্টারিওতে এক সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণ হারান এক মুসলিম পরিবারের তিন প্রজন্মের চার সদস্য। আর অল্পের জন্য বেঁচে যায় ৯ বছরের এক শিশু। তবে আহত হয়ে তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। নিহতদের মধ্যে আছেন তালাত আফজাল (৭৪), তাঁর ছেলে সালমান আফজাল (৪৬), পুত্রবধু মাদিহা সালমান (৪৪) এবং নাতনী ইউমনা আফজাল (১৫)। আহত শিশুটির নাম ফয়েজ আফজাল। রাস্তা পারাপারের সময় অতর্কিতে তাঁদের উপর একটি পিকআপ ট্রাক উঠিয়ে দিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশের বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, পূর্বপরিকল্পিতভাবে এই হামলা ঘটনো হয়। হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে ন্যাথানিয়েল ভেল্টম্যান নামের ২০ বছর বয়সী এক শ্বেতাঙ্গ যুবককে আটক করে স্থানীয় পুলিশ। তার বিরুদ্ধে ৪ জনকে হত্যা ও আরেকজনে হত্যার চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছে।
ঘটনার দিন রাত পৌনে নয়টার দিকে পরিবারটি প্রতিদিনকার মত হাটতে রেরিয়েছিলেন। স্থানীয় হাইড পার্ক রাস্তা ধরে হাটার এক পর্যায়ে তাঁরা যখন রাস্তা পারাপারের জন্য গ্রীন লাইটের অপেক্ষা করছিলেন তখনই ঘটে হামলার ঘটনাটি। পুলিশ জানায় ইসলামবিদ্বেষ থেকেই পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে এই হামলা চালানো হয়।
হামলার দুদিন পর কানাডার পার্লামেন্টে বক্তৃতাকালে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছিলেন, ‘এটি সন্ত্রাসী হামলা। কোন সড়ক দুর্ঘটনা নয়। ইসলামবিদ্বেষ থেকে প্ররোচিত হয়ে এই হামলা চালানো হয়েছে।’ কানাডার শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী গোষ্ঠিগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই এগিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি।
উল্লেখ্য যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কানাডায় মুসলিমদের উপর ভয়াবহ হামলার এটি ছিল তৃতীয় ঘটনা। প্রথম ঘটনাটি ঘটে ২০১৭ সালের ২৯ জানুয়ারী। ঐ দিন ইসলামিক কালচারাল সেন্টার অব কুইবেকে মাগরিবের নামাজ আদায়কালে আলেকজান্ডার বিসোনেট নামের এক যুবক অতর্কিতে স্বয়ংক্রিয় বন্দুক হামলা চালায়। বন্দুক হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ৬ জন মুসল্লি। হামলার ঘটনায় আহত হন আরো ১৯ জন।
মুসলিম হত্যার দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে ইটোবিকোক এর ইন্টারন্যাশনাল মুসলিম অর্গানাইজেশন অব টরন্টো’র মসজিদের সামনে। ২০২০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ঘটে এই নৃশংস হত্যার ঘটনা। ঐ মসজিদের স্বেচ্ছাসেবক এক মুসল্লিকে নির্মমভাবে গলা কেটে হত্যা করেন শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের সমর্থক Guilherme ‘William’ Von Neutegem নামের এক যুবক। নিহত ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ আসলিম জাফিস। ৫৮ বছর বয়স্ক আসলিম জাফিস ঐ দিন সন্ধ্যায় রেক্সডেল এবং কিপলিং এ্যাভিনিউর (৬৫ রেক্সডেল) নিকটবর্তী ঐ মসজিদের সামনে একটি চেয়ারে বসেছিলেন। ভিডিওতে দেখা গেছে খুনী Von Neutegem চেয়ারে বসে থাকা আসলিম জাফিস এর পিছন দিক থেকে এসে সহসা আক্রমণ করেন। আসলিম জাফিস আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং সেই অবস্থায়ই তাঁর মৃত্যু হয়। Von Neutegem-কে পরবর্তীতে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং তাঁর বিরুদ্ধে ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার এর অভিযোগ আনা হয়। কানাডিয়ান এন্টি-হেট নেটওয়ার্কের তথ্য থেকে জানা যায়, Von Neutegem ব্রিটেনের একটি বিদ্বেষী গ্রুপের অনুসারী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে একটি শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী গ্রুপেরও অনুসারী সে।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, কুইবেকের ঘটনার পর কানাডায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে বেশ আতঙ্ক বিরাজ করছিল। সে সময় হ্যালিফেক্স সেন্টার ফর ইসলামিক ডেভলাপমেন্ট এর ইমাম জিয়া খান বলেছিলেন, ‘কমিউনিটির অনেকেই মনে করছেন কুইবেকের হত্যাযজ্ঞ বর্ধিত সহিংসতার শুরু মাত্র।’
জিয়া খান বলেছিলেন, ‘কুইবেকের ঘটনা এমন নয় যে তা শুধু মাত্র আমাদেরকে বিচলিত করছে, এটি এমন একটি ঘটনা যা রীতিমত আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে কানাডার মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে। তাঁরা এখন ভাবছেন এর পরের টার্গেট কোন মসজিদ? তিনি বলেছিলেন এ ধরণের ভাবনা বা অনুভূতির মধ্যে থেকে কেউ স্বস্তি অনুভব করতে পারেন না। কমিউনিটির কেউ কেউ ভীত হয়ে আছেন ভবিষ্যতে আরো আক্রমণ ঘটতে পারে এই আশংকায়।’
পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, কুইবেকের মসজিদে হামলার পর মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর আবারো হামলা হতে পারে বলে যে আশংকা দেখা দিয়েছিল তা একেবারেই অমূলক ছিল না। লন্ডন অন্টারিও’র ঘটনায় এবং তারো আগে ইটবিকোক এর মসজিদের সামনের ঘটনায় তা স্পষ্টতই প্রমাণিত হয়ে গেল।
উল্লেখ্য যে, হত্যাকান্ড ছাড়াও মুসলমানদের উপর ছোটখাট বিদ্বেষী হামলার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে কানাডায়। মসজিদে হামলা, হিজাব পরিহিতা মহিলাদের উপর হামলা ঘটেই চলেছে এবং দিনে দিনে এর মাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এগুলো ঘটাচ্ছে কানাডার উগ্র শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা। অনলাইনেও এই উগ্রবাদীরা বেশ সক্রিয়। সিটিভি নিউজে প্রকাশিত নতুন এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বেশ কিছু প্লাটফর্মে ৬৬০০-র বেশি অনলাইন চ্যানেল, পেজ, দল এবং ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে রক্ষণশীল কানাডীয়রা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ এবং এ ধরণের অন্যান্য চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে দিচ্ছে। যুক্তরাজ্যের ইন্সটিটিউট ফর স্ট্রাটেজিক ডায়লগ (ISD)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত ইতিপূর্বের এক গবেষণা তথ্যে দেখা যায়, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, আয়রন মার্চ, ফেসিস্ট ফোর্জ, ফোরচ্যান ও গ্যাব (4chan and Gab) এর মত বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মে কানাডার বিভিন্ন শ্বেতাঙ্গবাদী উগ্র সম্প্রদায় সক্রিয়।
ইতিপূর্বে গ্লোবাল নিউজের জন্য পরিচালিত এক বিশেষ জরিপে দেখা গেছে, কানাডায় বর্ণবাদ বা জাতিবিদ্বেষকে এখন তেমন একটা বড়ো সমস্যা হিসাবে দেখা হচ্ছে না যদিও কানাডায় ঘৃণাপ্রসূত অপরাধ বা হেট ক্রাইম বেড়েই চলেছে। গ্লোবাল নিউজের জন্য পরিচালিত ইপসস-এর বিশেষ ঐ জরিপে এই বলা হয়, এক-চতুর্থাংশেরও বেশি কানাডীয় মনে করেন, গত পাঁচ বছরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার বিষয়টি ‘অধিকতর গ্রহণযোগ্য’ হয়ে উঠেছে।
অন্টারিও ইউনিভার্সিটির টেকনোলজি ইন্সটিটিউটের হেট ক্রাইম বিশেষজ্ঞ বারবারা পেরি বলেন, কানাডায় ইসলামভীতি সব সময়ই ছিলো কিন্তু গত কয়েক বছরে তা বহুগুণ বেড়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, এর পেছনে অনেক উপাদান সক্রিয় তবে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘ট্রাম্পের প্রভাব।’
উল্লেখ্য যে, শুধু মুসলিম নয়, কানাডায় বসবাসকারী পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয় জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধেও বিদ্বেষমূলক অপরাধ বা হেট ক্রাইমের (hate crime) মাত্রা বৃদ্ধি আগের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। গত ১৭ মার্চ,২০২২ সালে প্রকাশিত স্ট্যাটিসটিকস কানাডা’র নতুন এক রিপোর্টে এ তথ্য প্রকাশিত হয়। স্ট্যাটিসটিকস কানাডা জানায়, কভিড-১৯ মহামারীর প্রথম বছরে (২০২০) পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয় কানাডিয়ানাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক অপরাধের মাত্রা তার আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে ৩০১%। এটি পুলিশের খাতায় নিবন্ধিত হিসাব। ২০২০ সালে পুলিশের কাছে মোট ২৬৬৯টি বিদ্বেষমূলক অপরাধের অভিযোগ করা হয়। হিসাবে দেখা যায়, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে কানাডায় সার্বিকভাবে বিদ্বেষমূলক অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৮%। আর এশিয়ানদের বিরুদ্ধে বৃদ্ধি পেয়েছে ৩০১%।
স্যাটিসটিসক কানাডা এই হিসাব রাখতে শুরু করে ২০০৯ সাল থেকে। তখন থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত হিসাব তুলনা করে দেখা গেছে ২০২০ সালে বিদ্বেষমূলক অপরাধের মাত্রা সবচেয়ে বেশী ছিল পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়দের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে যা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
এখন এই পরিস্থিতিতে নিরাপদ দেশের তালিকায় কানাডার অবস্থান যত উপরেই থাকুক, এখানে বসবাসকারী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছে তার মূল্য কতটুকু সে প্রশ্ন থেকেই যায়। বিশেষ করে মুসলিম ও করোনাকালীন সময়ে চীনসহ দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠির কাছে। কারণ তারা হামলার শিকার হচ্ছেন, বিদ্বেষের শিকার হচ্ছেন, বর্ণবাদের শিকার হচ্ছেন। বর্ণবাদ ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এখানকার কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠিও। বাদ নেই আদিবাসী জনগোষ্ঠিও। কানাডার মতো একটি গণতান্ত্রিক ও সহিষ্ণু দেশে এক শ্রেণির মানুষের এরকম আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো অবশ্য এশিয়দের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ইতিপূর্বে। তিনি এর নিন্দাও জানিয়েছেন। এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রুডো বলেছিলেন, “ঘৃণা, সহিংসতা ও বৈষম্যের কোনও জায়গা কানাডায় নেই। কানাডীয় হিসাবে আমরা যেরকম, এরা (ঘৃণা, সহিংসতা ও বৈষম্যকারীরা) সেরকম নয়।”
তিনি কুইবেকে মুসলিমদের উপর হামলার পরও পার্লামেন্টে দাড়িয়ে বলেছিলেন, “কুইবেক সিটির ইসলামিক সেন্টারে পরিচালিত হামলায় যে ৬ জনের মৃত্যু ঘটেছে তা সন্ত্রাসী ঘটনা। এই সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটানো হয়েছে কানাডার বিরুদ্ধে, কানাডিয়ানদের বিরুদ্ধে।” তিনি কানাডায় বসবাসরত ১০ লাখ মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। কানাডার ৩৬ মিলিয়ন হৃদয় আপনাদের সঙ্গে সহমর্মী।” প্রধানমন্ত্রী কানাডিয়ানদেরকে ভীত না হওয়ার আহ্বানও জানিয়েছিলেন।
লন্ডন অন্টারিও’র ঘটনার পরও জাস্টিন ট্রুডো বলেছিলেন, এটি সন্ত্রাসী হামলা। কোন সড়ক দুর্ঘটনা নয়। ইসলামবিদ্বেষ থেকে প্ররোচিত হয়ে এই হামলা চালানো হয়েছে। কানাডার শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী গোষ্ঠিগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই এগিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি সেই সময়।
কিন্তু বার বার এই প্রতিশ্রুতির পরও পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়েছে কি উল্লেখ করার মত? এইতো গত বছর মার্চ মাসে মিসিসাগায় দার আল-তাওহিদ ইসলামিক সেন্টারে আবারও এক সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়। মুসল্লিরা যখন ফজরের নামাজ আদায় করছিলেন তখন হামলাকারী পিছন থেকে কুড়াল ও বেয়ার স্প্রে (Bear spray) নিয়ে তাদের উপর আক্রমণ করে। কিন্তু সৌভাগ্যবশত, মুসল্লিদের কয়েকজন সাহসিকতার সঙ্গে হামলাকারীর মোকাবেলা করে তাকে পরাস্ত করতে সক্ষম হন এবং পুলিশের হাতে তুলে দেন। হামলাকারীর নাকি পরিকল্পনা ছিল বড় ধরণের ক্ষয়ক্ষতি করার। কিন্তু আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করতে পারেনি বলে সেটি সম্ভব হয়নি। কৌতুহলের বিষয় হলো, এই হামলাকারীর নাম মোহাম্মদ মইজ ওমর। মুসলিম পরিবারেই তার জন্ম। তবে ধর্মে বিশ্বাস নেই তার। সে যেটা বিশ্বাস করে সেটা হলো, ‘ইসলাম একটি অসহিষ্ণু ও সহিংস ধর্ম’। কয়েকদিন আগে আদালতে তার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে বলা হয়, মসজিদে মুসল্লিদের উপর হামলার জন্য তাকে আট বছরের জেল খাটতে হবে।
বিশ্বের অন্যতম একটি নিরাপদ দেশে এভাবে বার বার সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হামলার শিকার হচ্ছে তা মেনে নেয়া কঠিন। আমাদের মনে হয়, শুধু মৌখিক প্রতিশ্রুতি বা ভরসা না দিয়ে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী হয়ে দাড়িয়েছে এখন সন্ত্রাস, বিদ্বেষ ও হিংসার বিরুদ্ধে। নয়তো কেবল ‘নিরাপদ দেশ’ বা ‘নিরাপদ শহর’ এই জাতীয় তকমা দিয়ে কানাডায় বসবাসকারী সংখ্যালঘুদের মন ভোলানো যাবে না।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ