টরন্টোর নবনির্বাচিত মেয়র অলিভিয়া চাওকে অভিনন্দন

মোয়াজ্জেম খান মনসুর

Olivia Chow টরন্টোর নবনির্বাচিত একজন প্রগ্রেসিভ মেয়র। গত ১২ ই জুলাই,২০২৩ তিনি মেগা সিটি টরন্টোর মেয়রের দায়িত্ব বুঝে নেন।

গত ২৬জুন/২৩ ওলিভিয়া চাও Ana Bailao (ডেপুটি মেয়র)-কে ৩০,০০০ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে মেগা সিটি টরন্টোর মেয়র নির্বাচিত হন। ওলিভিয়া চাও হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি ভিজিবল মাইনোরিটি গ্রুপ থেকে টরন্টোর মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন এবং মহিলা মেয়রদের মধ্যে তৃতীয়। বৃটিশ হংকং এ জন্ম নেয়া অলিভিয়া তের বছর বয়সে ১৯৭০ সালে বাবা মার সাথে কানাডার টরন্টো শহরে আভিবাসী হন। ওলিভিয়া চাও’র বাবা এবং মা দুজনেই শিক্ষক ছিলেন। নতুন দেশ নতুন শহর টরন্টো এসে তারা কেউ তাদের প্রফেশনে ফিরে যেতে পারেনি। তার মা হোটেলের লন্ড্রিতে চাকুরি নেন আর তার বাবা টেক্সি ড্রাইভারের কাজ নেন এবং একই সাথে চাইনীজ রেস্তোরায় ডেলিভারীর কাজও করতেন। বাবা একজন প্রফেশনাল শিক্ষক হওয়া সত্বেও তার পেশায় ফিরে যেতে না পেরে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন এবং ধীরে ধীরে তার মানসিক বৈকল্য দেখা দেয়। আর এর প্রভাবে অলিভিয়ার বাবার এক পর্যায়ে তার মায়ের উপর শারীরিক নির্যাতন শুরু করে। এর ফলে অলিভিয়ার মা অলিভিয়াকে  নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। একজন সিংগেল মাদারের ঘরে বাবার আদর ভালবাসাহীন যত্নহীন কৈশোরে  কঠিন অর্থনৈতিক সংগ্রামের ভিতর বেড়ে উঠে আজকের অলিভিয়া চাও। পড়াশুনার পাশাপাশি দুটো পার্টটাইম কাজ করে সংসারের হাল ধরেছিলেন মায়ের সাথে।

টরন্টোর নবনির্বাচিত মেয়র অলিভিয়া চাও। ছবি : টুইটার

টরন্টো বিশ্ব^বিদ্যালয় থেকে ফাইন আর্টস এ স্নাতক ডিগ্রীধারী অলিভিয়া। রাজনীতিতে সুদীর্ঘ ৩৮ বছরের বর্ণাঢ্য অভিজ্ঞতায় ভরপুর তার জীবন। বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জীবনের এই অপরাহ্ন বেলায় ৬৬ বছর বয়সে  আবার রাজনীতির মঞ্চে ফিরে এসেছেন তিনি বিজয়ীর বেশে। রাজনীতির জগতে অলিভিয়ার হাতেখড়ি ঘটে (১৯৮৫-১৯৯১) সালের মিউনিসিপাল ইলেকশনে স্কুল ট্রাস্টি হিসেবে জয়ী হয়ে। তারপর সিটি কাউন্সিলার পদে একাধিকবার নির্বাচিত হন (১৯৯২-২০০৫) সাল পর্যন্ত। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, কানাডার ফেডারেল দল এন ডি পি প্রধান জেক লেইটনের (প্রয়াত) রাজনৈতিক সহযোদ্ধা এবং জীবন সঙ্গিনী হওয়াতে তার বাড়তি পরিচিতির সুযোগ ঘটে যেটা তার রাজনৈতিক জীবনে বাড়তি পাওনা। বাম ঘরনার New Democratic Party’র (NDP) রাজনীতিক Jack Layton ছিলেন রাজনীতির এক যুবরাজ। সিটি কাউন্সিলার (মিউনিসিপাল রাজনীতি) পদে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে  ফেডারেল NDP দলের প্রধান নির্বাচিত হন। দলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন (২০০৩-২০১১) পর্যন্ত। জেক লেইটন-ই প্রথম এন ডিপি প্রধান যার হাত ধরে ২রা মে,২০১১ সালের নির্বাচনে কানাডা ব্যাপী অরেঞ্জ (এন ডি পি’র দলীয় রং) ক্রাসের ঝড় উঠেছিল। ফেডারেল নির্বাচনে ৩০৮টি আসনের মধ্যে ১০৩টি আসনে জয়ী হয়ে দলটি প্রথম বারের মত বিরোধী দলীয় স্টেটাস অর্জন করেছিল। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, জেক লেইটন তার রাজনীতির অনন্য কিংবদন্তি ভূমিকার সুফল তার জীবনে দেখে যেতে পারেননি। প্রস্টেট ক্যন্সারে আক্রান্ত হয়ে মাত্র চার মসের মধ্যেই না ফেরার দেশে চলে যান ২২আগস্ট, ২০১১ সালে।

অলিভিয়া চাও

টরন্টো শহরের ট্রিনিটি-স্পাডাইনা (চীনা অধ্যুষিত)  এলাকা থেকে ফেডারেল দল NDP থেকে MP নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০০৬-২০১৪ সালে। ২০১৪ সালে টরন্টোর মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দি¦তা করার জন্য MP পদ থেকে ইস্তফা দেন। সেবার মেয়র নির্বাচনে সিটি কাউন্সিলর Rob Ford মেয়র পদে নির্বাচিত হন এবং John Tory দ্বিতীয় ও Olivia Chow তৃতীয় স্থান  অধিকার করেন।  তারপর প্রকাশ্য রাজনীতিতে আর সরব ছিলেন না অলিভিয়া।

John Tory টরন্টোর প্রাক্তন মেয়র। অন্টারিও  Progressive Conservative (PC) দলের নির্বাচিত প্রধান ছিলেন। একজন আইনজীবী রজার্স কম্পানীর CEO (প্রাক্তন) এবং রাজনীতিবিদ (২০০৪-২০০৯)  জীবনের শেষ প্রান্তে এসে রাজনীতির সোনার হরিনটির খোঁজ পেয়েছিলেন। জন টরি ২০১৪ সালে তৃতীয় বার মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দি¦তা করে মেগা সিটি টরন্টোর ৬৫তম মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি আবার ২০১৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতন মেয়র নির্বাচিত হন। এবং গত ২৪শে অক্টোবর,২০২২ সালে তৃতীয় বারের মতন মেয়র পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। নির্বাচিত হবার মাত্র চার মাসের মধ্যই গত ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ সালে জন টরী তার মেয়র পদ থেকে পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন। করোনা মহামারীর সময় (২০১৯-২০২১) তার অধীনস্ত এক কর্মচারীর সাথে পরকীয়া সর্ম্পকের কথা স্বীকার  করে তার পদ থেকে সরে দাঁড়ান। যদিও জরীপে জানা গেছে এতে করে তার জনপ্রিয়তার কোন কমতি হয়নি। জন টরীই মেয়র পদে বহাল থাকুক তার পক্ষে ছিল শহরের অধিকাংশ নাগরিকের মতামত। তিনি ইচ্ছে করলেই তার পদে বহাল থাকতে পারতেন সিটির আইন তার বিপক্ষে যেতনা। কিন্তু মেয়র টরী সম্ভবত নগরপিতার আসনটির সম্মান ক্ষুন্ন করতে  নারাজ ছিলেন। টরন্টো স্টার পত্রিকায় অলিভিয়া চাওকে একজন প্রগ্রেসিভ লিডার বলে অখ্যায়িত করে খবর ছাপা হয়। বাম ঘরনার এই নেত্রী টরন্টো শহরের বর্তমান মেয়র। তার নির্বাচনী এজেন্ডায় প্রথম প্রাইয়োরিটির মধ্যে আছে হাউজিং সমস্যা, টরন্টো শহরের ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যাম এর সমস্যা, ডাউন টাউনের কেন্দ্রস্থলের উপর দিয়ে শতাব্দী পুরানো গার্ডেনার এক্সপ্রেস ওয়ের সমস্যা এবং গান ভাইয়োলেন্স এর সমস্যা। এই সমস্যাগুলোর সমাধানসহ আরো অনেক কাজ দ্রুত গতিতে সারতে হবে। টরন্টো শহরের প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের বাজেট ঘাটতির কথা তিনি ইতিমধ্যেই সাংবাদিকদের জানিয়ে রেখেছেন এবং সেই সাথে শহরের  বাড়ীর টেক্স বাড়বে সেটাও বলেছন। বিশাল অর্থনৈতিক  বাজেট ঘাটতি কাঁধে নিয়ে বাম ঘরনার মেয়র অলিভিয়া চাও কতগুলো শিল্প প্রতিষ্ঠান, শিল্পপতি এবং কাউন্সিলরকে পাশে পাবেন সেটাও দেখার বিষয়। ওন্টারিও প্রিমিয়ার Doug Ford অলিভিয়া চাওকে কতটুকু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিবেন সেটাও অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। যদিও প্রিমিয়ার বলেছেন তার সাহায্য সহযোগিতার দরজা খোলা থাকবে মেয়রের জন্য। কিন্তু মেয়র এবং প্রিমিয়ার অন্টারিও সাইন্স সেন্টার ইস্ট ইয়র্ক থেকে ডাউন টাউনে স্থানন্তর নিয়ে মতবিরোধে জড়িয়ে পরেছেন। সুদীর্ঘ চল্লিশ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় পুষ্ট Olivia Chow একজন সফল মেয়র হয়ে আগামী দিনে আমাদের হৃদয়ে স্থান করে নিবেন সেটাই কামনা। Congratulations and best wishes Mayor Chow.