আমার ছোট বেলা
তাসরীনা শিখা
এই লেখাগুলো অনেক আগেই আমার শেষ করে ফেলা উচিৎ ছিলো। যখন যেটা মনে আসে সেটা যদি তখনই লিখে ফেলতে পারতাম তাহলে হয়তো অনেক দূর এগুতে পারতাম। কিন্তু সে সুযোগ কোথায়? যখন লেখার কথা মনে হয় তখন দেখা যায় আমি অন্য একটি কাজে মহা ব্যস্ত আর যখন ব্যস্ততা কমে তখন লেখাগুলো আমার মন থেকে হারিয়ে যায়। সে কারণে মনের যন্ত্রণাতে ভুগছি। যদি সব ছেড়ে ছুড়ে কোন জায়গাতে বসে নিজের মনে- নিজের মনের কথাগুলো লিখতে পারতাম। কিন্তু সেটা সম্ভব না আমার ,কারণ আমাকে চলতে হয় মা দুর্গার মতো দশটি হাত সাথে নিয়ে। আমার সময় কোথায় লেখা লেখির দিকে মন দেবার। আমিতো খুব ক্ষুদ্র একজন নারী। আমার জ্ঞানের আয়তন পিঁপড়ের চাইতেও ছোট। কিন্তু যারা বড় বড় কাজ করছেন, অনেক সন্মানিত অবস্থানে অবস্থান করছেন তারাও কি পারছেন সুস্থ মাথায় সংসার করতে? নাহ পারছে না। সম্ভব না। নারীদের উপরে উঠতে হলে পেছনের সিঁড়িগুলো নড়বড়ে হয়ে পরে আবার কখনো ভেঙ্গেও পরে। আর সে ভাঙ্গা সিঁড়ি বেয়েই তাদের উপরে উঠতে হয়। যাকগে এসব কথা। আসলে আজকে আমি এসব কথা লিখতে বসিনি। রাত অনেক হয়েছে একদম ঘুম আসছে না। এই ঘুম ব্যাপারটা বেশ ঘন ঘন আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে যাচ্ছে। ঘুম না আসার কারণে ভাবলাম আবোলতাবোল যা মনে আসে কিছু লিখি।
ছোটবেলা নিয়ে আমি খুব বেশী আপ্লুত কখনো হতাম না পৃথিবীর অন্যান্য মানুষের মতো। কিন্তু আজকাল স্মৃতি কেনো যেন আমাকে টেনে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয় আমার ছোট বেলায়। ছোট বেলার অনেক কথা মনে পরে যায়। সেটা নিয়ে কখনো নিজের মনে হাসি আবার কখনো বিষণ্ণ হয়ে পড়ি।
বৃষ্টি অনেকই ভালো লাগে যদি বাইরে যাবার তাগিদ না থাকে। ঘরে বসে বৃষ্টি দেখা বৃষ্টি উপভোগ করার আনন্দই আলাদা। ছোট বেলার ঝড় বৃষ্টির আনন্দই ছিলো অন্যরকম। ঝড়ে বা প্রবল বৃষ্টিতে বিদ্যুৎ চলে যাবে। অন্ধকার হয়ে যাবে সারাবাড়ী। আহা কি আনন্দ, পড়তে হবে না এখন আর। আন্ধকার ঘরে ভুতুরে একটা পরিবেশ সৃষ্টি করে বিছানাতে লাফিয়ে পরে ভাই বোনদের গল্প শুরু হয়ে যেতো। লাইট নেই মানে হারিকেন জ্বালিয়ে দেয়া ঘরে ঘরে। আমাদের ছোট বেলাতে হারিকেনের প্রচলন খুব ছিলো। আবশ্য আমার মা সারা বছরই সন্ধ্যা হওয়ার আগেই একটা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে ঘরের এককোণে রেখে দেওয়াতেন। সাবধানের মার নেই সে বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে। এখন আমাদের বিদেশী অনেক বাঙালীর ঘরেই দেখা যায় এন্টিক পিস হিসাবে হ্যারিকেন সাজিয়ে রাখতে।
হ্যারিকেনের কথা লিখতে বসে ছোট বেলার একটা ঘটনা মনে পরে গেলো। আমি ছোট বেলা থেকেই একটু ভাবুক ধরনের ছিলাম। কি যে ভাবতাম নিজেও জানিনা। আমার মাঝে বেশ কিছু অদ্ভুত আচরণ ছিলো যা কিনা ভাই বোনদের মাঝে হাস্য রসের সৃষ্টি করতো। বিশেষ করে আমার ভাইদের।
একদিন ঝড় বৃষ্টির রাতে বিদ্যুৎ চলে গিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেলো। কয়েকটি হ্যারিকেন জ্বালিয়ে দেবার প্রস্তুতি চলতে লাগলো। আম্মা আমাকে বললেন, শিখু ওই ঘরের হ্যারিকেনটা এই ঘরে এনে দেতো মা। আমি টর্চ জ্বালিয়ে জলন্ত হ্যারিকেন খুঁজতে গেলাম পাশের ঘরে। এটা নিয়ে বেশ কিছুদিন আমার উপর মজাকরার কাটা বর্ষিত হয়েছিলো।
আরেকদিন আম্মা আমাকে বললেন, পানির জগে তিন গ্লাস পানি ঢেলে রাখতে। মায়ের বাধ্য কন্যা আমি। তিন গ্লাস পানি ঢালতে বলা হয়েছে আমার সেটাই করতে হবে। দুই গ্লাস পানি দেয়াতেই জগটা ভরে গেলো। তাতে আমার কি? আমাকেতো তিন গ্লাস পানিই ঢালতে হবে। আমি পানি ঢেলে দিলাম। সারা টেবিল পানিতে ভেসে গেলো। আম্মা হায় হায় করে ছুটে এলেন। আমি নির্বিকার। আমি কি করবো? আমাকেতো তিন গ্লাস পানি ঢালতে বলা হয়েছে, আমি তাই করেছি। টেবিল ভিজে গেলে আমি কি করবো? তখনো হয়তো আমি ছোটবেলার কোন গভীর চিন্তাতে মগ্ন ছিলাম। পানিতে টেবিল ভেসে গেছে তাতে আমার কোন খেয়ালই নেই। এখন মাঝে মাঝে মনে হয় আমি কেনো এত বোকা ছিলাম। এসব ভেবে এখনো লজ্জা পাই।
তাসরীনা শিখা
টরোন্ট ,ক্যানাডা