শপলিফটিং প্রতিরোধে ওয়ালমার্ট ও লবলসের অবমাননাকর পলিসি
টার্গেট হয়ে উঠতে পারেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা
খুরশিদ আলম
অন্টারিওতে Walmart, Loblaws এবং Zehrs এর মালিক পক্ষ তাদের স্টোরে চুরি ঠেকানোর জন্য সম্প্রতি বেশ তৎপর হয়ে উঠেছেন। আর এ কারণে কয়েকটি লবলস এবং জেহর্স এর প্রবেশ মুখে একটি নোটিশ ঝুলিয়ে দেয়া হয় যাতে লেখা আছে ‘Please be prepared to show your receipt upon exiting to validate and maintain inventory accuracy’। আর কয়েকটি ওয়ালমার্টের প্রবেশ মুখেও টানানো নোটিশে লেখা আছে ‘Please have Receipt ready for Proof of Purchase.’ অর্থাৎ এই স্টোরগুলো থেকে কেনাকাটা শেষে বের হওয়ার সময় ক্রেতাকে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি তার সাথে থাকা পণ্য সামগ্রীর মূল্য পরিশোধ করেছেন ঠিকমত। আরও সহজ ভাষায় বলতে গেলে বলা যায়, ক্রেতা কোন কিছু চুরি করে নিয়ে যাচ্ছেন না সেটি প্রমাণ করতে হবে।
কিন্তু Walmart এবং Loblaw এর মালিকানাধীন Loblaws ও Zehrs এর এই উদ্যোগকে সহজভাবে নেননি অনেক ক্রেতা। রীতিমত ক্ষেপে উঠেছেন তাঁরা। জেইন ইসমাইল নামের এক ক্রেতা সিবিসি নিউজের কাছে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, স্টোর মালিকদের এই আচরণের কারণে মনে হচ্ছে তাঁরা আমাদেরকে অপরাধী বা চোর হিসাবে বিবেচনা করছে। আর হঠাৎ করে তাঁরা কেন এই উদ্যোগ নিয়েছে তাও আমার বোধগম্য নয়। ইসমাইল Zehrs এর একজন নিয়মিত ক্রেতা।
লবলস কেন হঠাৎ করে এই ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সিবিসি তা জানতে চাইলে এক ইমেইল বার্তায় কোম্পানীর পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, দোকানের পলিসিতে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে এবং এটি ক্রেতাদেরকে জানানোর জন্য কয়েকটি দোকানে এই নোটিশ টানানো হয়।
তবে ক্রেতাদের রোষানলে মুখে পড়ে লবলস কর্তৃপক্ষ পরে নোটিশটি সরিয়ে নেয়। কিন্তু লবলস কর্তৃপক্ষ বলেনি যে তাঁরা ক্রেতাদের রিসিট চেকের পলিসি বাতিল করেছে। আর বাস্তবতা হলো, রিসিট চেকের প্রক্রিয়াটি ক্রেতাদের কাছে খুবই বিরক্তকর এবং এই পলিসি প্রয়োগ করাও কঠিন।
ধারণা করা যেতে পারে যে, নোটিশের বিষয়টি আসলে ছিল এক ধরণের সতর্কীকরণ প্রক্রিয়া। সাম্প্রতিক সময়ে দোকানের মালামাল বেশী মাত্রায় চুরি হচ্ছে এই বিষয়টি সবাইকে জানান দেয়া। বিশেষ করে যারা চুরি করছেন তাদেরকে টার্গেট করে এই নোটিশ।
কিন্তু উদ্দেশ্য যাই হোক, বিষয়টি ক্রেতাসাধারণ সহজভাবে নেননি। প্রতিদিন দোকানে আসা হাজার হাজার ক্রেতাদের মধ্যে দুই চারজন অসাধু ক্রেতা থাকতে পারেন। এবং আছেনও। কিন্তু তাই বলে সব ক্রেতাকে সন্দেহের চোখে দেখা বা চোর ভাবার কোন যুক্তি নেই। এটি নিঃসন্দেহে একটি অপমানজনক আচরণ। আর এই পলিসির প্রধান টার্গেট হয়ে উঠতে পারেন অশে^তাঙ্গ জনগোষ্ঠি। ভেঙ্গুভারে বসবাসকারী ক্রিমিনাল লইয়ার Kyla Lee- ও এই বিষয়ে একমত। তিনি সিবিসি নিউজকে বলেন, ক্যাশ কাউন্টারে খরিদ করা পণ্যের মূল্য পরিশোধ করে প্রধান ফটকের সামনে আসার পর পণ্যসামগ্রী ও রিসিট চেক করার প্রক্রিয়াটি সমস্যা মুক্ত নয়। কারণ, এখানে বর্ণবাদী বা বৈষম্যমূলক আচরণের সম্ভাবনা রয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি। তিনি বলেন সচেতন ভাবে হোক বা অবচেতন ভাবে হোক, কিছু মানুষ একধরণের পক্ষপাতিত্বে ভুগেন যাদের কাছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠতে পারেন।
উল্লেখ্য যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওতে মার্শা জ্যাকসন নামের এক মহিলা ওয়ালমার্টের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন সম্প্রতি। তাঁর অভিযোগ, ২০২১ সালে রিসিট চেক করার সময় তাঁর বিরুদ্ধে অন্যায় ভাবে চুরির অভিযোগ আনা হয়। কারণ তিনি একজন কৃষ্ণাঙ্গ। ওয়ালমার্টের এন্টি-থেফ্ট পলিসি অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে তাঁর প্রতি এবং অন্যান্য আফ্রিকান-আমেরিকানদের প্রতি প্রয়োগ করা হয়েছে। এ বিষেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ালমার্টের কোন মন্তব্য আছে কি না তা জানতে চেয়েছিল সিবিসি। ওয়ালমার্ট কোন মন্তব্য করেনি।
কানাডায় ক্রেতাদের রিসিট বা ক্রয়কৃত দ্রব্যাদি চেক করার বিষয়ে একটি বড় ধরণের আইনী জটিলতাও রয়েছে। সেটি হলো, কোন অনিয়ম বা চুরির সুষ্পষ্ট প্রমাণ না থাকলে দোকান মালিক বা তাঁর কোন কর্মী কোন ক্রেতাকে বাধ্য করতে পারেন না তাঁর ক্রয়কৃত মালামাল বা রিসিট দেখানোর জন্য। অবশ্য Costco’র বিষয়টি ভিন্ন। তাঁরা ক্রেতাকে রিসিট প্রদর্শনে বাধ্য করতে পারে। কারণ Costco’র মেম্বারশীপ ফর্মে স্বাক্ষর করার সময় ক্রেতারা সম্মতি দিয়ে থাকেন এই বলে যে, দোকান থেকে বের হওয়ার সময় তাদের রিসিট ও ক্রয়কৃত মালামাল চেক করা যেতে পারে।
লবলজ এর পাশাপাশি কানাডার ওয়ালমার্টও সম্প্রতি ক্রেতাদের রিসিট ও ক্রয়কৃত মালামাল চেক করার পলিসি গ্রহণ করে। তাদের ঐ পলিসির বিরুদ্ধেও ক্রেতাসাধারণ ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছেন। ওয়ালমার্ট ক্রেতাদেরকে ক্রিমিনাল হিসাবে গণ্য করছে এমন অভিযোগ অনেকেই করছেন। ক্রেতাদের অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে এমন অভিযোগও উঠেছে। সিবিসি নিউজের এক খবরেও বলা হয়, ওয়ালমার্ট কর্তৃক রিসিট ও ব্যাগ চেক করার যে পলিসি গ্রহণ করা হয়েছে সেটি ক্রেতাদের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এই পলিসির বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন অনেকেই। এমনকি ক্রেতাদের অধিকার সম্পর্কে উদ্বেগও বাড়িয়েছে ওয়ালমার্টের এই পলিসি।
টরন্টোর উত্তরে অবস্থিত ভন অঞ্চলের বাসিন্দা পেনি রিন্টুল অভিযোগ করে বলেন, এটা ওয়ালমার্টের কোন অনুরোধ নয়, দাবী। তিনি নিজেও এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। কেনাকাটা শেষ করে ওয়ালমার্ট থেকে বের হওয়ার সময় তাঁর কাছে রিসিট দেখতে চাওয়া হয়েছিল।
ক্রেতাদের দাবী, এই ধরণের পলিসি খুবই বিরক্তিকর এবং একই সাথে অবমাননাকর। দি কানাডিয়ান সিভিল লিবার্টিজ এসোসিয়েশন এর পক্ষ থেকে বলা হয়, স্টোর কর্তৃপক্ষ যে ভাবে রিসিট চেক করছে তা ক্রেতাদের অধিকারকে বিপন্ন করতে পারে। এসোসিয়েশনের নির্বাহী পরিচালক এবং জেনারেল কাউন্সিলর মাইকেল ব্রায়ান্ট বলেন, ক্রেতাদের রিসিট বা ব্যাগ চেক করার আগে তাদের সম্মতি নেওয়া উচিত। এই পরিস্থিতিতে কোন ক্রেতা যদি সম্মতি প্রদান না করেন তবে তিনি আইন ভঙ্গকারী হিসাবে বিবেচিত হবেন না। এবং তিনি দোকান থেকে বের হয়ে আসতে পারেন রিসিট বা ব্যাগ চেক করতে না দিয়ে।
সিবিসি নিউজ জানায়, ২০১৬ সালে অন্টারিও সুপরিয়র কোর্ট এর এক বিচারক সন্দেহভাজন এক শপলিফটারের বিষয়ে এক রায়ে বলেন, যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকলে দোকান মালিক সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে আটক করতে পারেন। কিন্তু তারপরও ব্যাগ বা রিসিট চেক করতে হলে উক্ত ব্যক্তির সম্মতি পেতে হবে।
রিসিট বা ব্যাগ চেক করার পলিসি গ্রহণ করায় ক্রেতাদের অধিকার লংঘিত হচ্ছে কি না এ বিষয়ে সিবিসি নিউজের এক প্রশ্নের উত্তরে ওয়ালমার্ট সরাসরি কিছু বলেনি। তবে প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র অ্যাডাম গ্র্যাচনিক এক ইমেইল বার্তায় বলেন, প্রতিদিনের খরচ পরিচালনা এবং কম দামে পণ্যসামগ্রী বিক্রি করার স্বার্থে ক্রেতাদের ব্যাগ বা রিসিট চেক করার পলিসি গ্রহণ করা হয়েছে এবং একই সাথে ক্যাশ কাউন্টারের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হচ্ছে কি না সেটিও দেখা হচ্ছে এই প্রক্রিয়ায়।
তবে সিবিসি নিউজের কাছে বেশ কিছু ক্রেতা অভিযোগ করে বলেন, রিসিট বা ব্যাগ চেক করার জন্য কোন অনুমতি চাওয়া হচ্ছে না, বরং চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে তাদের পলিসি মানার জন্য। পলা ফ্লেচার নামের এক ক্রেতা বলেন, তিনি যখন সেল্ফ চেকআউটে দাঁড়িয়ে পণ্যসামগ্রী স্ক্যান করছিলেন তখন ওয়ালমার্টের একজন কর্মী তার উপর নজর রাখছিলেন। স্ক্যান শেষে তিনি যখন বের হয়ে আসছিলেন তখন ঐ কর্মী তার ব্যাগ ও রিসিট চেক করার দাবী জানান। সেই কর্মী পলা ফ্লেচারকে কোন অপশনের সুযোগ দেননি। পলা বলেন, আমি তাদের এই পলিসি পছন্দ করছি না। অপরাধ না করলেও তাঁরা আমাকে একজন অপরাধী হিসাবে বিবেচনা করবে তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাঁরা যদি আমাদের বিশ্বাস নাই করে তবে এই সেল্ফ চেকআউট এর ব্যবস্থা বাতিল করে দিক।
ধারণা করা হচ্ছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ওয়ালমার্টসহ আরো কয়েকটি বৃহৎ গ্রোসারীতে সেল্ফ চেকআউটের ব্যবস্থা প্রবর্তন করার ফলে ক্রেতাদের ব্যাগ বা রিসিট চেক করার প্রবনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্রেতারা এর বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করলে ওয়ালমার্ট বারবার এর ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে আসছে। তাদের ব্যাখ্যাটা হলো, সব আইটেম ঠিক মত স্ক্যান করা হচ্ছে কি না এবং এই সেল্ফ চেকআউট সিস্টেম ঠিক মত কাজ করছে কিনা তা দেখার জন্যই ক্রেতাদের ব্যাগ বা রিসিট চেক করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
তবে গবেষণা বলছে, বড়মাপের বিভিন্ন স্টোরগুলোতে সেল্ফ চেকআউটের ব্যবস্থা প্রবর্তন করায় মালামাল চুরি যাওয়ার সম্ভাবনা আগের তুলনায় আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ, যারা অসাধু ক্রেতা, তাদের ধারণা- সেল্ফ চেকআউট কাউন্টারে কোন পণ্য স্ক্যান করা না হলেও ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে, কোন ক্রেতা যদি স্টোর পলিসির সঙ্গে একমত না হয়ে ব্যাগ বা রিসিট চেক করতে না দেন তবে স্টোর মালিক কি পুলিশের সাহায্য চাইতে পারে? হ্যা, পুলিশের সাহায্য তাঁরা চাইতেই পারে। সবারই অধিকার আছে পুলিশের সাহায্য চাইবার। কিন্তু পুলিশ আসবে কি না তা নির্ভর করছে পরিস্থিতির উপর। টরন্টো সিকিউরিটি কনসালটেন্ট সিবিসিকে বলেন, পুলিশ ডাকার আগে স্টোর মালিকের হাতে প্রমাণ থাকতে হবে যে নির্দিষ্ট কোন ক্রেতা শপলিফটিং করেছেন। প্রমাণ না থাকলে পুলিশ কোন পদক্ষেপ নিতে যাবে না।
অন্যদিকে দোকানের মালিক যদি কোন ক্রেতাকে চোর হিসাবে অভিযুক্ত করে আটক করেন এবং পরবর্তীতে প্রমানিত হয় সেই ক্রেতা চুরি করেননি তবে তার দায়ভার বহন করতে হবে দোকান মালিককে।
Walmart, Loblaws, Zehrs এমন একটা সময় ক্রেতাদের ব্যাগ ও রিসিট চেক করার পলিসি গ্রহণ করেছে যখন খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে তারা ক্রমাগত সমালোচনার মুখোমুখি হচ্ছে এবং একই সাথে কেউ কেউ যখন রেকর্ড পরিমাণে মুনাফাও করছে। তাদের এই রেকর্ড পরিমাণ মুনাফার পাশাপাশি আমরা লক্ষ্য করছি প্রায় ৬০ শতাংশ কানাডিয়ানকে তাদের পরিবারের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ খাবার যোগাতে কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে। গত জানুয়ারীতে প্রকাশিত এঙ্গুস রেইডের জরিপে দেখা যায়, ৫৭ শতাংশ কানাডিয়ান জানিয়েছেন, সম্প্রতি তাঁরা তাদের পরিবারের জন্য খাবার জোটাতে কঠিন সময় পার করছেন। ২০১৯ সালে সর্বশেষ যখন তাদেরকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো তখনকার চেয়ে এই সংখ্যা ৩৬ শতাংশ বেশি।
এখন একদিকে যখন গ্রোসারী মালিকরা রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা অর্জন করছেন এবং অন্যদিকে অধিকাংশ কানাডিয়ানকে যখন যথেষ্ট পরিমাণ খাবার যোগাতে কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে তখন ক্রেতাদের ব্যাগ বা রিসিট চেক করার পলিসিটাকে সহজ ভাবে নিচ্ছেন না শিল্প এবং আইন বিশেষজ্ঞরাও। তাঁরা বলছেন এটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত।
হাম্বার কলেজের আইনজীবী ও ব্যবসায়িক আইনের অধ্যাপক অ্যালেক্স কোলাঞ্জেলো টরন্টো স্টারকে বলেছেন, ক্রেতাদের জন্য এটি জানা গুরুত্বপূর্ণ যে আইনের দোহাই দিয়ে কোন ক্রেতার রিসিট চেক করা যায় না। এবং কেউ তাদের রিসিট দেখতে চাইলে সেই দাবী প্রত্যাখ্যান করে তাঁরা দোকান থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন। তিনি আরো বলেন, কাউকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা পুলিশ কর্মকর্তাদের আছে। কিন্তু গ্রোসারীর কোন নিরাপত্তা কর্মী বা লস প্রিভেনশন অফিসারগণ সাধারণ মানুষের মতনই। ক্রিমিনাল বা ফৌজদারী আইনের অধিনে কাউকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা অনেক সীমিত তাদের বেলায়। তাঁরা একজন ক্রেতাকে তাঁর রিসিট প্রদর্শনের জন্য বলতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ক্রেতা সম্মতি দিলে তাঁর রিসিট চেক করা যেতে পারে। তবে নিরাপত্তা কর্মী বা লস প্রিভেনশন অফিসারদের কোন ক্ষমতা নেই একজন ক্রেতাকে আটক করার যদি তিনি রিসিট দেখাতে অস্বীকৃতি জানান। তারপরও যদি এমন কাউকে আটক করা হয় যিনি কোন অপরাধ করেননি, তখন দোকান মালিকের বিরুদ্ধে সেই ব্যক্তি আইনী ব্যবস্থা নিতে পারেন।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, রিসিট চেকের সময় অশে^তাঙ্গ জনগোষ্ঠি প্রধান টার্গেট হয়ে উঠতে পারেন। এই বিষয়ে একমত প্রকাশ করেছেন ডালহৌসির এগ্রি-ফুড ল্যাব এর পরিচালক সিলভাইন শার্লেবোইস-ও।
কানাডায় শিল্প বিশেষজ্ঞরা এবং গ্রোসারী মালিকগণ দাবী করছেন সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দোকানে চুরির ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে পণ্যসামগ্রীর দামবৃদ্ধি এবং একই সাথে বড় বড় গ্রোসারীগুলোতে সেল্ফ চেকআউট ব্যবস্থার প্রবর্তন। কিন্তু কানাডার বৃহৎ গ্রোসারীগুলো এ কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনটা মনে হচ্ছে না। কারণ তাঁরা রেকর্ড মুনাফার ঘোষণা দিয়ে আসছে দুই তিন বছর ধরে।
সন্দেহ নেই লবলস, ওয়ালমার্টসহ অন্যান্য সুবৃহৎ স্টোরগুলোতে চুরি হয়। কিন্তু এই চুরি ঠেকানোর নামে সাধারণ ক্রেতাদের সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখা খুবই দুঃখজনক। ক্রেতাদের জন্য এটা খুবই বিব্রতকর ও অপমানজনকও। সুবৃহৎ এই স্টোর মালিকদের মনে রাখতে হবে – কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্রেতা হলো লক্ষী। সেই লক্ষী ক্রেতা যদি কোন কারণে বিব্রত হন বা অপমানিত হন তবে ব্যবসায়ীদের ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশী। কারণ, ক্রেতাদের হাতে বিকল্প আছে। তাঁরা অন্য স্টোরে যেতে পারেন। কিন্তু মালিকদের কোন বিকল্প নেই। মালিকদের নির্ভর করতে হয় এই ক্রেতাদের উপরই। তাই চুরি ঠেকাতে সাধারণ ক্রেতাদের ব্যাগ বা রিসিট চেকের বিকল্প কিছু ভাবা জরুরী।
বাঙ্গালী মালিকানাধিন গ্রোসারীতেও শপলিফটিং!
শপলিফটিং বা সোজা বাংলায় আমরা যাকে দোকান থেকে চুরি বলি, সেটা ঘটছে টরন্টোর বাংলাদেশী গ্রোসারী গুলোতেও! আর দীর্ঘদিন ধরেই ঘটছে এই ঘটনা। অবাক হওয়ার বিষয় হলো, এই শপলিফটারদের মধ্যে বাঙ্গালীও আছেন। হাতেনাতে ধরা পরার পরও এই বাঙ্গালী শপলিফটারের কারো কারো হুস হয়নি। এদের কেউ কেউ দ্বিতীয়বার ধরা পরেছেন এমন ঘটনাও ঘটেছে। শুধু একা নয়, পরিবারের সদস্যরা দল বেধে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছেন এমন ঘটনার ভিডিও রেকর্ডও আছে। কয়েক বছর আগের ঘটনা এই দলবদ্ধ চুরির বিষয়টি।
আগে ধারণা করা হতো শপলিফটিং শুধু কানাডার বড় বড় দোকানগুলোতেই হয়। কিন্তু খোদ বাঙ্গালী পাড়ায় বাঙ্গালী দোকানে এবং বাঙ্গালী কর্তৃক শপলিফটিং হচ্ছে এমন ধারণা গ্রোসারীর মালিকরাও করেননি আগে। তবে গত কয়েকবছর ধরে কয়েকটি গ্রোসারীতে সিসিটিভি বসানোর পর শপলিফটিং এর ঘটনা ধরা পড়ছে। রেকর্ডকৃত একটি ভিডিওতে দেখা গেছে এক পরিবারের চার সদস্য মিলে খুব ধীরে-সুস্থে ড্যানফোর্থের একটি বাঙ্গালী গ্রোসারী থেকে মালামাল সরিয়ে নিচ্ছেন। ভিডিওতে দেখা গেছে তাঁরা ৪০ পাউন্ডের বেশ কয়েক বস্তা চাল পিছনের দরজা দিয়ে পাচার করে গাড়িতে তুলেন। তাঁরা প্রথমে ক্রেতা হিসেবেই দোকানে প্রবেশ করেন। টুক-টাক কিছু কেনাকাটাও করেন যাতে কেউ সন্দেহ না করে। আর এরই ফাকে ফাঁকে চলে তাদের চৌর্যবৃত্তি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গ্রোসারীর মালিক জানান, আমরা ধারণাই করতে পারিনি কোন বাঙ্গালী এরকম অপকর্ম করতে পারেন। কানাডায় যে সকল বাঙ্গালী এসেছেন তাঁরা প্রায় সকলেই উচ্চ শিক্ষিত এবং মোটামুুটি অবস্থাপন্ন ঘরের সদস্য। কিন্তু তাদের মধ্যেও যে দু একজন পথভ্রষ্ট লোক থাকতে পারেন তা ভিডিওতে ধরা না পরলে আমরা বিশ্বাসই করতাম না। এখন দেখছি, এরকম একটি দুটি ঘটনা নয়, বেশ কিছু ঘটনাই ধরা পরছে ভিডিওতে। আমরা ঝামেলা এড়াতে অনেক সময় পুলিশ ডাকি না। কারণ এই শপলিফটারদেরকে পুলিশের হাতে তুলে দিলে তাদের নানারকম সমস্যা হতে পারে। ক্রেডিট হিস্ট্রি থেকে শুরু করে অনেক কিছুতেই তাঁরা লাইফ লং চিহ্নিত হয়ে থাকবেন। কিন্তু তারপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে আমাদেরকে পুলিশ ডাকতে হয়।
উল্লেখ্য যে, কানাডায় বাংলাদেশী গ্রোসারীগুলোর অধিকাংশই মার্জিন লাভে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। তাদের অনেক আইটেমই থাকে পেরিসএবল। অর্থাৎ দ্রুত পচে যেতে পারে এরকম আইটেম থাকে অনেক। শাক-সবজি, ফল-মূল এমনকি প্যাকেটজাত পন্যও সময়মত বিক্রি না হলে লোকশানের মধ্যে পড়তে হয়। এখন এর সঙ্গে যদি চুড়ির ঘটনাও ঘটে তবে অল্প-স্বল্প লাভ যা হয় তাও আর তেমন থাকবে না। ফলে কমিউনিতে গ্রোসারীগুলো যে সেবা দিয়ে আসছে সেটিও যথাযথভাবে দেওয়া সম্ভব হবে না বলে জানালেন এক গ্রোসারীর মালিক।
চুরির ঘটনায় গ্রোসারীগুলোকে কি পরিমাণ ক্ষতির সন্মুখিন হতে হচ্ছে তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি সঠিক ভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে অনুমান করা যায় যে, লাভের ২/৩ পার্সেন্ট চলে যায় এই চুরির ঘটনায়। বা আরো বেশীও হতে পারে।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক
প্রবাসী কণ্ঠ