টরেটক্কা টরন্টো
চীন-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক -১৫
কাজী সাব্বির আহমেদ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সামার ভ্যাকেশনের পর ‘বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব পোস্টস এন্ড টেলিকম্যুনিকেশনস’-এ আমাদের সেকেন্ড ইয়ারের ফার্স্ট সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হলো সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে। সামার শেষ হয়ে তখন অটাম মাত্র শুরু হয়েছে। দিনের দৈর্ঘ্য পাল্লা দিয়ে কমতে শুরু করে এ সময়। সামারে যেখানে সন্ধ্যা হয় রাত ন’টার দিকে, উইন্টারে সেই সন্ধ্যা নামে বিকেল পাঁচটারও আগে। সামার আর উইন্টারের মাঝে যে ঋতুতে দিনের দৈর্ঘ্য ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে সেই ঋতুটা হচ্ছে অটাম, বাংলায় যাকে আমরা হেমন্তকাল বলে থাকি। চাইনিজে সামারকে শিয়া-থিয়েন, উইন্টারকে তোং-থিয়েন আর অটামকে বলে ছিউ-থিয়েন। চারটি ঋতুর দেশ চীনে এই তিনটি ঋতুর বাইরে যে ঋতুটি রয়েছে সেটি হলো ‘স্প্রিং’ বা ‘ঠ্রুন-থিয়েন’। শীত এবং গ্রীষ্মের মাঝামাঝি এই ঋতুটি হচ্ছে বেইজিং-এর জন্য সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ঋতু। তাই অনেকের নাম রাখা হয় ‘ঠ্রাং ঠ্রুন’ বা ‘লং স্প্রিং’ যা কিনা সবারই কাম্য। আমাদের দেশে বসন্তকালের মতন হেমেন্তকাল হচ্ছে একটি আরামদায়ক ঋতু। কিন্তু অন্যান্য শীত প্রধান দেশগুলির মতন চীনের জন্য এই হেমন্তকাল হচ্ছে কঠিন শীতের আগমনী বার্তাবাহক একটি কাল। এই সময় মানুষকে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে হয় শীতকে মোকাবেলা করার জন্য। এই সময় সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আসা কনকনে ঠান্ডা বাতাস বেইজিং-এর উপর দিয়ে হু হু করে বয়ে যায়। সেই বাতাসে ঝরতে শুরু করে গাছের পাতা। প্রকৃতির মাঝে যেন নেমে আসে বিষণ্ণতার এক ছায়া। প্রকৃতি থেকে সেই বিষণ্ণতা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মাঝেও। এই বিষণ্ণতা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য চাই দৃঢ় মনোবল এবং সেই সাথে শারীরিক পরিশ্রম। এই শারীরিক পরিশ্রমের অংশ হিসেবে খেলা শুরু করলাম টেবিল টেনিস যাকে চাইনিজে বলে ‘পিংপং ছিউ’। আমাদের ফরেন স্টুডেন্ট ডরমেটরির চারতলাতে ছিল টেবিল টেনিস খেলার রুম। রাতে যদি কোন ক্লাস না থাকত তবে সন্ধ্যে সাড়ে পাঁচটার দিকে ডিনার সেরে সোজা চলে যেতাম সেই টেবিল টেনিস রুমে।
টেবিল টেনিস খেলাতে আমার হাতে খড়ি হয়েছিল যখন আমি ক্লাস টু কিংবা থ্রী-তে পড়ি। আমাদের লালমাটিয়ার বাসার ঠিক উল্টোদিকের বাসায় ছিল টেবিল টেনিস খেলার আয়োজন। সেখানে ছুটির দিনে সকাল-বিকাল আর অন্যান্য দিনে বিকেলে বসত খেলার জমজমাট আসর। সেই আসরে তখন আমাদের পাড়ার সব বাঘা বাঘা খেলোয়াড়রা খেলতে আসতেন যাদের মধ্যে দুইএকজন তখন জাতীয় পর্যায়ে খেলতেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতন আমরা ছোটরা তখন তাদের সেই খেলা দেখতাম আর দুপুরবেলাতে যখন টেবিলটি ফাঁকা পড়ে থাকত তখন আমরা ছোটরা খেলতাম। বড়দের খেলা দেখে দেখে আমরা তাদের ট্রিক্সগুলি আয়ত্তে আনার চেষ্টা করতাম। তাদের খেলা থেকেই কিভাবে চপ, টপ স্পিন কিংবা স্ম্যাশ করতে হয় তা শিখি। বিভিন্ন ধরনের সার্ভিস করাটা যে খেলা জেতার একটি অন্যতম স্ট্র্যাটেজি সেটাও তাদের খেলা থেকে জেনে ফেলি। প্রতিপক্ষকে সহজেই ঘায়েল করার জন্য আমি প্রায় পাঁচ রকমের সার্ভিস করার কৌশল আয়ত্ত করি। তারপর যখন ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হই, সেখানেও নিয়মিত টেবিল টেনিস খেলতাম আমি। বেশ কিছু মেডেলও পেয়েছি ক্যাডেট কলেজের আন্তঃ হাউজ টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায়। ক্যাডেট কলেজের শেষ বছরে অর্থাৎ আমি যখন ক্লাস টুয়েলভ-এ তখন আমি সিঙ্গেলস-এ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করি। সেই আমি যখন চীনের ছাত্রজীবনের অবসর সময় কাটানোর জন্য টেবিল টেনিসের দেখা পেলাম তখন আমাকে আর পায় কে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতাম এই টেবিল টেনিস খেলার রুমে। লক্ষ্য করে দেখলাম এশিয়ান স্টুডেন্টরাই বেশী ভীড় জমায় টেবিল টেনিস রুমে। আফ্রিকান স্টুডেন্টদের এই খেলার প্রতি তেমন কোন আগ্রহ দেখিনি। নেপাল আর শ্রীলংকান স্টুডেন্টদের পাশাপাশি নর্থ কোরিয়ান স্টুডেন্টদের সাথেও প্রচুর খেলতাম। খেলার ব্যাপারে নর্থ কোরিয়ানরা বেশ সিরিয়াস এবং সাধারণত তারা সব সময় নিজেরা নিজেরা খেলতে পছন্দ করত। আমাকে নিয়মিত খেলতে দেখে তারাও এক সময় আমার সাথে খেলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করা শুরু করে। আমি এই সুযোগে নর্থ কোরিয়ানদেরকে ঘনিষ্ঠভাবে জানার এবং সেই সাথে তাদের কাছ থেকে খেলার বিভিন্ন স্কিল রপ্ত করার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেই স্কিলকে কাজে লাগিয়ে বেশ কয়েকজন নর্থ কোরিয়ান স্টুডেন্টকে হারিয়ে ১৯৯০ সালে আমি ফরেন স্টুডেন্টদের ভেতর টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিলাম।
আমি আমার চীনের শিক্ষাজীবন থেকে একাডেমিক জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি অনেক ধরনের বিচিত্র এবং বিরল অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছি যা কিনা অন্য কোন ভাবে অর্জন করা সম্ভব ছিল না। সেই রকম একটি অভিজ্ঞতা হচ্ছে নর্থ কোরিয়ান স্টুডেন্টদের তথা নর্থ কোরিয়ান মানুষদেরকে কাছ থেকে দেখার কিংবা পর্যবেক্ষণ করার। আজকের পৃথিবীতে সম্ভবত এই দেশটিই একমাত্র দেশ যেখানকার নাগরিকদের বঞ্চিত করা হচ্ছে মনুষ্যত্বের ন্যূনতম অধিকার থেকে। নর্থ কোরিয়া যেন জর্জ ওরওয়েল-এর ‘নাইনটিন এইটিফোর’ উপন্যাসে বর্ণিত সেই টোটালিটারিয়ান স্টেট ‘ওসানিয়া’-এর বাস্তব চিত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে জাপান যখন কোরিয়া ছেড়ে চলে যায় তখন সোভিয়েত বাহিনীর সহায়তায় ‘কিম ইল সুন’ উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতা গ্রহণ করে। ১৯৪৮ সালে তিনি ‘ডেমোক্রাটিক পিপলস রিপাবলিক অব কোরিয়া’ বা ‘ডিপিআরকে’-এর প্রিমিয়ার পদে নিযুক্ত হন। ‘ডিপিআরকে’ পরবর্তীতে নর্থ কোরিয়া নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৪৯ সালে কিম ইল সুন ‘ওয়ার্কার পার্টি অব কোরিয়া’ নামের একটি কম্যুনিস্ট পার্টি তৈরি করে সেই পার্টিকে দিয়ে নর্থ কোরিয়াতে সোভিয়েত ইউনিয়নের মতন কম্যুনিস্ট সরকার গঠন করেন। তিনি পার্টির ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই দল থেকে তার প্রতিপক্ষদের একে একে বহিষ্কার করেন এবং পরবর্তীতে তাদেরকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেন। সোভিয়েত রাশিয়ার স্ট্যালিন-এর মতন তিনি শক্তহাতে দেশ চালাতে শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় কিম ইল সুন এক সময় নিজেকে নর্থ কোরিয়ার জনগণের কাছে ঈশ্বরসম ব্যক্তিত্বে পরিণত করেন। তার প্রতিফলন আমি দেখেছিলাম নর্থ কোরিয়ান স্টুডেন্টদের জীবনযাত্রায়। চীন সরকার অবশ্য অন্যান্য দেশের ফরেন স্টুডেন্টদের থেকে নর্থ কোরিয়ার স্টুডেন্টদেরকে অন্যভাবে ট্রিট করত যাতে তারা তাদের দেশের প্রটোকল মেনে চলতে পারে। যেমন রুম বন্টনের সময় নর্থ কোরিয়ার স্টুডেন্টদের রুমমেট অবশ্যই নর্থ কোরিয়ার হত। আবার কোন ইউনিভার্সিটিতে বেজোড় সংখ্যক নর্থ কোরিয়ার স্টুডেন্ট থাকত না। ফলে কোন নর্থ কোরিয়ান ছাত্রকে একা কিংবা অন্য কোন দেশের ছাত্রের সাথে রুম শেয়ার করতে হত না। নর্থ কোরিয়ার স্টুডেন্টদের রুমের দেয়ালে টাঙ্গানো থাকত কিম ইল সুনের ছবি। শুনেছিলাম যে প্রতিদিন সকালে তাদেরকে নাকি সেই ছবিকে বাউ করে সম্মান প্রদর্শন করতে হতো। এ ক্ষেত্রে এক রুমমেট আরেক রুমমেটের উপর নজরদারি করত। কোন রকম বিচ্যুতি হলে সেটা নাকি এ্যাম্বাসিতে রিপোর্ট করতে হতো। আবার তারা সবাই ক্লাসে যেত কোট বা ব্লেজার পরে যেখানে লাগানো থাকত কিম ইল সুনের ছবিসহ কোটপিন। কোনদিন এর অন্যথা আমার চোখে পড়েনি। তাদেরকে কখনই আমাদের ফরেন স্টুডেন্টদের জন্য নির্ধারিত ক্যান্টিনে খেতে দেখিনি। শুনেছিলাম তারা নাকি তাদের এ্যাম্বাসি থেকে শুকনো খাবার নিয়ে আসত এবং সেটা খেয়েই তাদেরকে নাকি জীবনধারণ করতে হত। তাদেরকে কখনো কোথাও কোন টাকা খরচ করতে দেখিনি। ক্লাসের বাইরে তাদেরকে একমাত্র টেবিল টেনিস রুমেই দেখা যেত। সেখানেই তাদের সাথে আমার কিছুটা হলেও সখ্যতা গড়ে উঠেছিল।
কানাডার মন্টিয়ালে জন্ম এবং বেড়ে উঠা তৃতীয় প্রজন্মের চাইনিজ-কানাডিয়ান সাংবাদিক জেন ওং মাত্র উনিশ বছর বয়সে মাও সেতুং-এর হাতে গড়া ‘রেড চায়না’-এর কম্যুনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ১৯৭২ সালে এক সংক্ষিপ্ত সফরে বেইজিং যান। সেই সফরে থাকাকালীন তিনি তখন প্রেস্ট্রিজিয়াস বেইজিং ইউনিভার্সিটিতে পড়ার জন্য আবেদন করেন যা তিনি ধরেই নিয়েছিলেন যে নাকচ হয়ে যাবে। কিন্তু তাকে আশ্চর্য করে দিয়ে চীনা কম্যুনিস্ট পার্টি তাকে পড়ার জন্য সুযোগ দেয়। তিনি পরে জানতে পারেন যে তার এ্যাপ্লিকেশনটি চীনের প্রিমিয়ার ট্রৌ এন-লাই পর্যন্ত পৌঁছায় এবং তিনি তা একসেপ্ট করেন। তাকে স্টুডেন্টশীপ দেয়ার ব্যাপারে কম্যুনিস্ট পার্টির দুইটি উদ্দেশ্য ছিল – এক, সেই বছরের ফেব্রুয়ারী মাসে নিক্সন পিকিং সফর করে চীন এবং আমেরিকার মধ্যকার ছিন্ন কূটনৈতিক সম্পর্ককে পুনরায় জোড়া লাগান। সেই সম্পর্ককে আরো দৃঢ় করার উদ্দেশ্যে চীনের কম্যুনিস্ট পার্টি একজন চাইনিজ-আমেরিকানকে বেইজিং ইউনিভার্সিটিতে স্টুডেন্টশীপ দিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ঠিক সেই সময়ে জেন ওং পড়ার জন্য এ্যাপ্লিকেশন করাতে কম্যুনিস্ট পার্টির লীডাররা মনে করল যে জেন ওং-কে পড়ার সুযোগ দিলে সেই চাইনিজ-আমেরিকান স্টুডেন্টটি একজন পশ্চিমা সঙ্গী পাবে। দুই, এই সুযোগে কানাডার সাথে চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কও ঝালাই হবে। ফলে জেন ওং কম্যুনিস্ট চায়নার প্রথম ব্যাচের দ্বিতীয় ফরেন স্টুডেন্ট হওয়ার বিরল সুযোগ লাভ করেন। ঠিক তার পনেরো বছর পর আমি ১৯৮৭ সালে আমিও কম্যুনিস্ট চায়নার ফরেন স্টুডেন্ট হিসেবে বেইজিং-এ গমন করি। জেন ওং-এর সঙ্গী চাইনিজ-আমেরিকান স্টুডেন্টটি ছিল আমেরিকার বিখ্যাত ইয়েল ইউনিভার্সিটির ম্যাথ গ্রাজুয়েট এরিকা চেন। জেন ওং এক সময় টের পেলেন যে তাদের সাথে আরও নয়জন নর্থ কোরিয়ান ফরেন স্টুডেন্ট আছে। সাতজন ছেলে এবং দুইজন মেয়ে। তাদের বয়স কুড়ি থেকে বাইশের মধ্যে। তাদের জন্য হোস্টেলে রুম বরাদ্দ থাকলেও তারা থাকত তাদের এ্যাম্বাসীতে। দিনের বেলায় শুধু ক্লাসের বিরতির সময় অর্থাৎ দুপুরে লাঞ্চের পর রেস্ট নেয়ার জন্য তারা সেই রুমগুলিকে ব্যবহার করত। প্রতিদিন একটি কালো মার্সিডিস-বেঞ্জ লিমোজিনে করে তারা আসা যাওয়া করত। তাদের জন্য আলাদা উন্নত খাবারের ব্যবস্থা থাকত যা কিনা তারা কিছুটা খেত আর বেশীর ভাগই অবজ্ঞাভরে ফেলে দিত। কালচারাল রেভ্যুলেশনের সেই সময়ে যখন চীনে হাতে গোনা কিছু বই পড়ার অনুমতি ছিল তখন লাইব্রেরিতে ‘সিলেক্টেড ওয়ার্কস অব কার্ল মার্কস’-এর পাশাপাশি ‘সিলেক্টেড ওয়ার্কস অব কিম ইল সুন’-ও শোভা পেত। কারণ সেই সময় নর্থ কোরিয়া ছিল চীনের মেন্টর। সেই ক্ষমতাবান নর্থ কোরিয়ার ক্ষমতাবান নেতাদের ছেলেমেয়ে ছিল সেই নয়জন ছাত্রছাত্রী। জেন ওং-এর অভিজ্ঞতায় নর্থ কোরিয়ার স্টুডেন্টরা ছিল একই সাথে উদ্ধত এবং আনটাচেবল। তাদের রূঢ় আচরণের জন্য তাদেরকে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হতো না। চীন তাদের বেলায় নিয়েছিল ‘সাত খুন মাপ’-এর নীতি। ‘রেড চায়না ব্লুজ, মাই লং মার্চ ফ্রম মাও টু নাও’ বইতে জেন ওং নর্থ কোরিয়ান স্টুডেন্ট সম্পর্কে তার এইসব অভিজ্ঞতার কথা ‘পিয়ংইয়ং প্যান্টি থিফ’ নামক চ্যাপ্টারে বিস্তারিত লিখেছেন। আমি যখন বেইজিং-এ নর্থ কোরিয়ার স্টুডেন্টদেরকে পাই তখন অবস্থা অনেকখানিই পাল্টে গেছে। চীন তখন দেং শিয়াওপিং-এর নেতৃত্বে ‘ওপেন ডোর’ পলিসি নিয়ে অর্থনৈতিকভাবে অনেকটাই চাঙ্গা, অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে সাথে সারা পৃথিবীতে কম্যুনিজম পতনোন্মুখ হওয়ার কারণে নর্থ কোরিয়া তখন অর্থনৈতিকভাবে পুরোপুরি পঙ্গু এবং চীনের উপর নানাভাবে নির্ভরশীল। চীন তখন ধীরে ধীরে উল্টো নর্থ কোরিয়ার অভিভাবকে রূপান্তরিত হচ্ছিল। স্বাভাবিকভাবেই নর্থ কোরিয়ান ফরেন স্টুডেন্টদের জন্য উন্নত খাবারের ব্যবস্থা করার সেই অদৃশ্য দায়বদ্ধতা আর ছিল না। ফলে নর্থ কোরিয়ান ফরেন স্টুডেন্টদেরকে এ্যাম্বাসী থেকে দেয়া শুকনো খাবার খেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছিল। তাদের একমাত্র এন্টারটেইনমেন্ট ছিল টেবিল টেনিস যেটা গড়পড়তা তারা সবাই খেলতে পারত এবং বেশ ভালোই খেলতে পারত।
বাংলাদেশে আমরা টেবিল টেনিস খেলার বলকে ‘পিংপং’ বল বলে থাকি। শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এই টেবিল টেনিস খেলাকে ‘পিংপং’ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নিক্সন কম্যুনিস্ট চীনের সাথে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন সেটার সূচনা হয়েছিল এই টেবিল টেনিস খেলার মাধ্যমেই। এই জন্য চীনের সাথে নিক্সনের এই কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ঘটনাকে ‘পিংপং ডিপ্লোম্যাসি’ বলেও উল্লেখ করা হয়ে থাকে। চীন বিভিন্ন দেশের সাথে তার কূটনৈতিক সম্পর্ককে উন্নত এবং দৃঢ় করার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রমের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক খেলাধূলার আসরের সুযোগকেও কাজে লাগিয়েছে পুরোপুরি। ১৯৮৯ সালের থিয়েনআনমেন ম্যাসাকারের পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীনকে একটি ফ্যাসিবাদী দেশ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছিল। সেটার প্রতিরোধে চীন ১৯৯০ সালে বেইজিং-এ অনুষ্ঠিতব্য ‘একাদশ এশিয়ান গেমস’-এর প্রস্তুতির দিকে মনযোগ দেয় এবং সেই সাথে এর ব্যাপক প্রচারণা শুরু করে। এই আসরের ‘মোটো’ নির্বাচন করা হয় তিনটি শব্দ দিয়ে – ‘ইউনিটি’ (থুয়ান-চিয়ে), ‘ফ্রেন্ডশীপ’ (ইয়ো-ই) এবং ‘প্রগ্রেস’ (চিন-পু)। এই শব্দ তিনটি দ্বারা চীন বহির্বিশ্বের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ককে কিভাবে পুনরদ্ধার করতে আগ্রহী সেটাই ব্যক্ত করেছে। এবং এই এশিয়ান গেমসের মাধ্যমে চীন এশিয়ার দুইটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ সৌদি আরব এবং সিঙ্গাপুরের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ককে জোরদার করে। পরবর্তী বছরগুলিতে এই দুই দেশের সাথে বিশেষ করে সিঙ্গাপুরের সাথে শিক্ষা, অভিবাসন এবং বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে চীনের বিভিন্ন ধরনের মিথষ্ক্রিয়া শুরু হয়ে যায়।
একাদশ এশিয়ান গেমসের সফল আয়োজনকে কাজে লাগিয়ে চীন ২০০০ সালের সামার অলিম্পিকের হোস্ট বা আয়োজক হওয়ার জন্য ব্যাপক লবিং শুরু করে। ১৯৮৩ সাল থেকেই চীনের লক্ষ্য ছিল ২০০০ সালের অলিম্পিকের আয়োজক হওয়ার। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে চীন সরকার ১৯৯০ সালের এশিয়ান গেমসের জন্য প্রায় এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে। সেই টাকা দিয়ে তারা প্রায় ৮০টির মতন আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম প্রস্তুত করে যার মধ্যে কিছু রয়েছে একেবারে আনকোরা নতুন আর বাকীগুলি পুরোন কাঠামোকে ভেঙে নতুন করে পুনঃনির্মাণ করা। বিদেশী খেলোয়াড় এবং সাংবাদিকদের থাকার জন্য তৈরি করা হয় সুবিশাল এশিয়ান গেমস ভিলেজ যেখানে রয়েছে বসবাসের জন্য সকল প্রকার আধুনিক সুযোগ সুবিধা। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে তৈরি করা হয় মিডিয়া সেন্টার যাতে করে খেলার সর্বশেষ সংবাদ ন্যূনতম সময়ের মধ্যে বিশ্বের যে কোন প্রান্তে পৌঁছাতে পারে। এই সব আয়োজন মূলত এশিয়ান গেমসের জন্য হলেও চীন এই সব অবকাঠামো দ্বারা পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করতে চাচ্ছিল যে তারা ২০০০ সালে অলিম্পিক আয়োজনের জন্য পুরোপুরি সক্ষম। এত কিছু করার পরেও ১৯৯৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি বেইজিং-কে বাদ দিয়ে সিডনি-কে ২০০০ সালের আয়োজক হিসেবে মনোনীত করে। চারটি রাউন্ডের প্রথম তিনটি রাউন্ডে জিতলেও চতুর্থ বা ফাইনাল রাউন্ডে বেইজিং হেরে যায় সিডনির কাছে। ছুতা হিসেবে দেখানো হয় যে বেইজিং-এর বায়ুদূষণের মাত্রা, জনবহুল রাস্তাঘাট এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। তবে বেইজিং-কে মনোনীত না করার পিছনে থিয়েনআনমেন ম্যাসাকারের আবছায়া যে রয়েছে সেটা সহজেই অনুমেয়। বিশেষ করে যখন দেখা গেছে আমেরিকার পলিটিশিয়ান টমাস লেন্টস এবং উইলিয়াম ব্র্যাডলি-কে প্রকাশ্যে বেইজিং-এর বিরুদ্ধে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির কাছে লবিং করতে।
এই সময় অর্থাৎ ১৯৯০ সালে চীনের প্রাক্তন জিমন্যাস্ট ‘লি নিং’ তার নিজের নাম দিয়ে একটি খেলার পোশাক ও খেলার সামগ্রীর একটি কোম্পানী খুলে। চীনে লি নিং-কে ‘প্রিন্স অব জিমন্যাস্টিক’ নামে ডাকা হত কারণ তিনি ১৯৮২ সালে সিক্সথ ওয়ার্ল্ড কাপ জিমন্যাস্টিক কম্পিটিশনের সাতটি ইভেন্টের ভিতর ছয়টিতেই সোনা জিতেন। এরপর আমেরিকার লস এঞ্জেলেসে অনুষ্ঠিত ১৯৮৪ সালের সামার অলিম্পকে তিনটি সোনা, দুইটি সিলভার এবং একটি ব্রোঞ্জ জিতেন। কিংবদন্তি এই জিমন্যাস্ট চীনের প্রথম এক্স অলিম্পিয়ান যিনি কিনা তার ক্যারিয়ার শেষে উদ্যোক্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। তার এই উদ্যোক্তা হওয়াটা দেং শিয়াওপিং-এর অর্থনৈতিক সংস্কারের কারণেই সম্ভব হয়েছিল। কালের পরিক্রমায় ‘লি নিং’ আজ একটি আন্তর্জাতিক মানের স্পোর্টস ওয়্যার এবং স্পোর্ট ইকুপমেন্টের বিশ্বস্ত ব্যান্ড হিসেবে পুরো পৃথিবীতে জায়গা করে নিয়েছে। ‘লি নিং’ কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাতা ‘প্রিন্স অব জিমন্যাস্টিক’ লি নিং বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত ২০০৮ সালের সামার অলিম্পিকের মশাল প্রজ্বলন করার বিরল সম্মান অর্জন করেন। চীন ২০০৮ সালের সামার অলিম্পিকে এক মনোমুগ্ধকর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপহার দেয়। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব সেই অনুষ্ঠানের কোন ক্রুটি ধরতে না পেরে পরিশেষে অভিযোগ করে যে স্টেজে যে নয় বছরের বালিকাটি উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করে সেটা আসলে গেয়েছে অন্য এক বালিকা, সে শুধু ঠোঁট মিলিয়েছে। এই অভিযোগের আড়ালে তারা আসলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি আলোচনায় আনতে চেয়েছিল। কিন্তু চীন সাফ জানিয়ে দিয়েছিল এটা শুধুমাত্র তাদের পরিবেশনাকে আকর্ষণীয় করার জন্য এক ধরনের টিম ওয়ার্ক ভিন্ন অন্য কিছু নয়। অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ২০১০ সালে ভ্যানকুভারে অনুষ্ঠিত উইন্টার অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কানাডা সেই টিম ওয়ার্ক দেখাতে ব্যর্থ হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী স্টেজে চারটি পিলার ছোট ছোট মশাল নিয়ে ধীরে ধীরে উঠে এসে একটি বড় পিলারে রক্ষিত বিশাল একটি মশালের সাথে মিলিত হবে। কিন্তু যান্ত্রিক ক্রুটির কারণে চারটির ভেতর একটি পিলার আর উঠে আসতে পারেনি। এছাড়াও উদ্বোধনীর ঘণ্টা কয়েক আগে জর্জিয়ার একজন লু’জ এথলেট মহড়ার সময় তার শ্লেড থেকে ছিটকে পড়ে প্রাণ হারান। এই দূর্ঘটনার জন্য কানাডার অলিম্পিক আয়োজকদের কড়া সমালোচনা করা হয় কারণ তারা যথোপযুক্ত সেফটি রেগুলেশন মেনে অনুশীলনের জন্য জায়গা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। ঘটনাক্রমে সেই বছরই চীনের ‘লি নিং’ কোম্পানী একটি বড়সড় মাইলফলক অতিক্রম করে। নতুন লোগো নিয়ে তারা আমেরিকার ওরিগন স্টেটের পোর্টল্যান্ড সিটিতে হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে নাইকি, এডিডাস এইসব কোম্পানীর কাতারে তারা তাদেরকে তুলে আনে। সেই সাথে যুক্ত হয় তাদের নতুন স্লোগান – ‘লেট দ্য চেইঞ্জ অকার’।
লি নিং-এর মতন চীনের আরেক কিংবদন্তি অলিম্পিয়ান হচ্ছেন কাও মিন যিনি কিনা ১৯৮৮ এবং ১৯৯২ সালের অলিম্পিকে থ্রী-মিটার স্প্রিংবোর্ডে দুইবার গোল্ড মেডেল জিতে ‘ডাইভিং কুইন’ নামে পরিচিত হন। তিনি তার অলিম্পিক ক্যারিয়ার শেষে কানাডাতে ইমিগ্র্যান্ট হয়ে আসেন এবং এলবার্টার এডমনটন শহরের এক ডাইভিং ক্লাবে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। তার প্রশিক্ষণে কানাডা বেশ কিছু ন্যাশনাল লেভেলের ডাইভার পেয়েছে। ২০০৫ সালে কাও মিন চীনে ফেরত চলে যান এবং সেখানেই আবার থিতু হন। ২০২২ সালে চীনে অনুষ্ঠিত উইন্টার অলিম্পিকের জন্য তিনি পাঁচটি মাছ দিয়ে একটি প্রতিকী ছবি আঁকেন যা দিয়ে তিনি পাঁচটি মহাদেশকে বুঝিয়েছেন। তিনি নিজেকে এখন সমাজসেবামূলক কাজে ব্যস্ত রেখেছেন। ২০২২ সালের বেইজিং উইন্টার অলিম্পিকে চাইনিজ বংশোদ্ভূত আমেরিকার নাগরিক পনেরো বছরের কিশোরী ‘আইলিন কু’ চীনের পক্ষে ফ্রি স্টাইল স্কী-তে অংশগ্রহণ করে দুইটি গোল্ড এবং একটি সিলভার মেডেল জিতে বেশ আলোড়নের সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি কি আমেরিকান না চাইনিজ সেটা নিয়ে মিডিয়াতে শুরু হয়ে যায় তুমুল বিতর্ক। আমেরিকার ফক্স নিউজের এনালিস্ট তাকে ‘আনগ্রেটফুল’ বলে অভিহিত করেন। আবার ওয়াশিংটন পোস্টের কলাম লেখিকা ফ্রাংকি হুয়াং তাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন চীনের পক্ষে অংশগ্রহণ করার জন্য। তবে এ কথা সত্য যে অনেক প্রবাসী চাইনিজ এখন শেকড়ের টানে চীনে ফেরত যেতে আগ্রহী। ‘ইয়ে লোয়ো কুই কেন’ – চীনের একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ যার অর্থ হচ্ছে ‘ফলিং লিভস সেটল অন দেয়ার রুটস’। (চলবে)
কাজী সাব্বির আহমেদ
কলাম লেখক । টরন্টো