মাসের পর মাস বাড়ি ভাড়া দিচ্ছেন না এক শ্রেণির ভাড়াটিয়া

দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ছোট বাড়িওয়ালাদের অনেকে

খুরশিদ আলম

অন্টারিওতে এক শ্রেণির ভাড়াটিয়া আছেন যারা মাসের পর মাস বাড়ি ভাড়া দিচ্ছেন না আবার বাড়িও ছাড়ছেন না। এভাবে প্রায় বছর গড়িয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তারপরও তাদের উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। উল্টো বাড়িওয়ালাকে হুমকি-ধামকিও দিচ্ছেন এই ভাড়াটিয়াদের কেউ কেউ। নাজেহাল করছেন নানা ভাবে। এমনকি বাড়িতে ঢুকতেও দিচ্ছেন না বাড়িওয়ালাকে। 

এরকম পরিস্থিতির শিকার হয়ে ঋণে জর্জরিত হয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন ক্ষুদ্র বাড়িওয়ালাদের অনেকে। তাদের ঋণের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলছে। কেউ কেউ ক্রেডিট কার্ড বা লাইন অব ক্রেডিট ব্যবহার করছেন মর্টগেজ পেমেন্ট করার জন্য। যারা ভাড়ার টাকার উপর সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নির্ভরশীল, তাদের অবস্থা বেশী খারাপ হয়ে উঠেছে।

অন্টারিওতে এখন এরকম প্রায় ৩৪ হাজার মামলা ঝুলে আছে ল্যান্ডলর্ড এ্যান্ড টেনেন্ট বোর্ডের কাছে। মামলার এই পাহাড় জমার কারণে হিয়ারিং বা শুনানির ডেট পেতেই লাগছে আট থেকে দশ মাস সময়। আবার নির্ধারিত দিনে ভাড়াটিয়া আদালতে হাজির না হলে অথবা উচ্ছেদ নোটিশের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে সময় লেগে যাচ্ছে আরো কয়েক মাস। এই বাড়তি সময়ে বাড়িওয়ালার অবস্থা আরো বেগতিক হয়ে উঠে।

মামলার এই পাহাড় গড়ে উঠার পিছনে করোনা মহামারীরও ভূমিকাও রয়েছে। কারণ, ঐ সময় ভাড়াটিয়াদের উচ্ছেদের উপর বেশ কয়েক মাসের অস্থায়ী স্থগিতাদেশ জারি করা হয়েছিল। তবে বাস্তবতা হলো, মামলার স্তুপ আগে থেকেই জমে ছিল। মহামারী সেই স্তুপটি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। যার কারণে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন সেই সব বাড়িওয়ালা যাদের ভাগ্যে জুটেছে মন্দ ভাড়াটিয়া।

হয়রানির শিকার হয়ে ছোট বাড়িওয়ালাদের কেউ কেউ মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকির মুখে পড়েন। ছবি : সংগৃহীত

এই পরিস্থিতিতে গত ৪ মে অন্টারিও’র ওমবাডসম্যান বা ন্যায়পাল Paul Dubé দীর্ঘ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন যেখানে পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য ৬১টি সুপারিশ করা হয়েছে। তিনি স্পষ্টই বলেন, অন্টারিওর ল্যান্ডলর্ড এ্যান্ড টেনেন্ট বোর্ড মৌলিকভাবেই ব্যর্থ হয়েছে তাদের কার্যক্রম পরিচালনায়। আগে যেখানে মাত্র দিন কয়েক লাগতো শুনানির ডেট পেতে সেখানে এখন লাগছে গড়ে সাত থেকে আট মাস সময়। সর্বশেষ প্রাপ্ত (ফেব্রুয়ারি ২০২৩) হিসাব অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে ভাড়াটিয়ার বিরুদ্ধে ল্যান্ডলর্ড এ্যান্ড টেনেন্ট বোর্ড বরাবর অভিযোগ দায়ের করে শুনানির তারিখ পেতে বাড়ির মালিকদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে ৬ থেকে ৯ মাস সময়। অন্যদিকে বাড়ির মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে শুনানির তারিখ পেতে ভাড়াটিয়াদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে গড়ে ২ বছর পর্যন্ত সময়। ন্যায়পাল তার প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরেন। দি কানাডিয়ান প্রেস গত ৪ মে এই খবর প্রকাশ করে।

বাড়িওয়ালা এবং ভাড়াটিয়া উভয় পক্ষের অভিযোগগুলো নিষ্পত্তিতে ল্যান্ডলর্ড এ্যান্ড টেনেন্ট বোর্ড প্রচুর সময় নিচ্ছে, এরকম অভিযোগের পাহাড় জমে গেলে ন্যায়পাল বিষয়টি খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেন। ন্যায়পালের তদন্তে যা বেরিয়ে আসে তাতে দেখা যায়, বাড়িওয়ালারাই শুধু হয়রানির শিকার হচ্ছেন তা নয়। অনেক ভাড়াটিয়াও বাড়িওয়ালা কর্তৃক হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তাদেরকে সহ্য করতে হচ্ছে অনিরাপদ বাসস্থানের পরিবেশ। এমনকি জোর করে বাড়ি থেকে অবৈধভাবে উচ্ছেদের প্রচেষ্টাও করা হচ্ছে।

ন্যায়পালের তদন্তে আরো দেখা যায়, ২০১৯ সালে মহামারী শুরু হওয়ার আগে থেকেই এই অন্টারিও’র ল্যান্ডলর্ড এ্যান্ড টেনেন্ট বোর্ড এর কার্যক্রম মরণোন্মুখ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। ২০ হাজারেরও বেশী মামলা জমে গিয়েছিল বোর্ড এর সামনে নিষ্পত্তির জন্য। এর জন্য দায়ী করা হয় বোর্ড এর একাধিক অদক্ষতাকে যার মধ্যে আছে-

* যোগ্য বিচারকদের অভাব। এর পাশাপাশি বোর্ডে দীর্ঘ নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং প্রশিক্ষণের অভাব পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করে দেয়।

* জটিল আবেদন প্রক্রিয়া যেখানে সামান্য ভুলের কারণে জটিলতা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে।

* পুরানো সিস্টেম যা জরুরী মামলার বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছে।

* দ্বিভাষিক বিচারকদের অভাব।

ন্যায়পাল তার উপসংহারে বলেন, গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় বলা যায় ল্যান্ডলর্ড এ্যান্ড টেনেন্ট বোর্ড তাদের কাছে জমা হওয়া মামলা গুলোর নিষ্পত্তিতে নিজেদের অযোগ্যতা প্রমাণ করেছে। আর এই কারণে অন্টারিও’র হাজার হাজার মামলাকারী কষ্টভোগ করছেন। একটি প্রশাসনিক ট্রাইবুনাল হিসাবে অন্টারিও ল্যান্ডলর্ড এ্যান্ড টেনেন্ট বোর্ড মামলাগুলোর বিচার কাজ দ্রুত নিষ্পত্তি করতে মৌলিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আর এর মধ্য দিয়ে এই বোর্ড উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অন্টারিও বাসীকে ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত করেছে এবং করছে। 

উল্লেখ্য যে, অন্টারিও সরকার এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় আরো ৪০ জন নতুন বিচারক নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ন্যায়পাল আহ্বান জানিয়েছেন এই নিয়োগের কাজটি যাতে দ্রুত সম্পন্ন করা হয়।

দি কানাডিয়ান প্রেস আরো জানায়, ‘ট্রাইবুনালস অন্টারিও’ যারা ল্যান্ডলর্ড এ্যান্ড টেনেন্ট বোর্ড এর তত্বাবধান করে থাকে সেই প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী চেয়ারম্যান এবং নির্বাহী পরিচালক এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘বোর্ড ইতিমধ্যেই মামলা নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রিতা কমিয়ে আনার জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যার মধ্যে আছে আনলাইনে আবেদন করার ব্যবস্থা। আর ন্যায়পাল যে সব সুপারিশ করেছেন তার অনেকগুলোই ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত করা হয়েছে। তবে এখনো আরও কাজ করতে হবে পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য। আমরা নিশ্চিত যে চলতি অর্থবছরের মধ্যেই জমে যাওয়া কাজের সমাধান হবে উল্লেখযোগ্য হারে।’

এদিকে ন্যায়পালের রিপোর্ট প্রকাশের পর অন্টারিও নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে নির্বাচিত এমপিপি জেসিকা বেল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা জানি বহু বছর ধরেই ল্যান্ডলর্ড এ্যান্ড টেনেন্ট বোর্ড তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ পার্টি পাঁচ বছর সময় পেয়েও এর কোন উন্নয়ন সাধন করতে পারেনি। বরং ন্যায়পালের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘কোন ভাড়াটিয়া বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করলে দ্বিগুণ সময় লাগছে শুনানির ডেট পেতে। এটি এক ধরণের বৈষম্য। আমরা ক্ষমতাশীল দলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি অবিলম্বে এই অবিচারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া হোক।’

ন্যায়পালের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ল্যান্ডলর্ড এ্যান্ড টেনেন্ট বোর্ডে যারা মামলার আবেদন করছেন তাদের মধ্যে বাড়ির মালিকের সংখ্যা ৯০%।

এই বাড়ির মালিকদের মধ্যে কিছু সংখ্যক বাংলাদেশীও আছেন যারা বাড়ির বেজমেন্ট ভাড়া দিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন। আমার নিকট প্রতিবেশী এক বাংলাদেশী পরিবার সম্প্রতি এই ঝামেলার মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করছেন। আজকে প্রায় এক বছর হয়ে গেল ভাড়াটিয়া বাড়ি ভাড়া দিচ্ছেন না এবং বাড়িও ছাড়ছেন না। অন্টারিও ল্যান্ডলর্ড এ্যান্ড টেনেন্ট বোর্ড এর কাছে নালিশ করে প্রায় আট মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে হিয়ারিং এর ডেট পেতে। গতমাসে হিয়ারিং এর ডেট ছিল। কিন্তু ভাড়াটিয়া সেদিন বোর্ডে উপস্থিত হননি। বৈধ কারণ ছাড়া উপস্থিত না হলে মামলার রায় ল্যান্ডলর্ড এর পক্ষেই যাবার কথা। কিন্তু সেই পরিবারটি এখনও আদালত থেকে ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদের নোটিশ হাতে পান নি। অর্থাৎ এই ল্যান্ডলর্ড এ্যান্ড টেনেন্ট বোর্ড এতটাই অকার্যকর হয়ে আছে যে উচ্ছেদের নোটিশটা পর্যন্ত ঠিক সময়মত পাঠাতে পারছে না।

তারা বাড়ির বেজমেন্টটি ভাড়া দিয়েছিলেন কিছু বাড়তি আয়ের জন্য। সবাই তাই করে থাকেন। কেউ কেউ অবশ্য নির্ভর করে থাকেন এই ভাড়ার উপর। সঠিক সময়ে ভাড়া না পেলে বাড়ির মর্টগেজ পেমেন্ট বা সংসারের অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ করা কঠিন হয়ে দাড়ায়। এমনই এক মহিলা হলেন তোজেগ রোশঙ্কর। তিনি একজন সিঙ্গেল মাদার। তাকে তার মেয়ে ও বৃদ্ধা মাকে আর্থিক সহায়তা দিতে হয়। এ কারণে তিনি তার মিসিসাগাস্থ একটি কন্ডো এপার্টমেন্ট ভাড়া দিয়েছিলেন। তিনি নিজে থাকেন অন্য একটি কন্ডোতে।

সম্প্রতি সিবিসি নিউজকে তিনি বলেন, ভাড়া নেয়ার জন্য যে মহিলা আবেদন করেছিলেন, তাকেই দৃশ্যত উপযুক্ত প্রার্থী বলে মনে হয়েছিল। কারণ তার ক্রেডিট স্কোর ছিল চমৎকার। তিনি চাকরির প্রমাণপত্র, সাম্প্রতিক সময়ের তিন মাসের বেতনের রশিদ এবং আগের বাড়িওয়ালার রেফারেন্স ইত্যাদি সবই দিয়েছিলেন এজেন্টের মাধ্যমে। ভাড়া নেওয়ার জন্য যে মহিলা আবেদন করেছিলেন তিনিও একজন সিঙ্গেল মাদার। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তার প্রতি বাড়িওয়ালা তোজেগ রোশঙ্করের একটি সহানুভূতি তৈরী হয়েছিল। তিনি তার সঙ্গে কথা বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এই বলে যে, ‘সিঙ্গেল মাদারের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে আমি ভালো রকমের সতর্ক। তাই আমি আপনাকে সাহায্য করবো।’

তবে বাড়ি ভাড়ার অর্থ নিয়মিত পরিশোধ করা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা তিনি ভাড়াটে মহিলাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন। ঐ কন্ডো এপার্টমেন্টটির ভাড়া ছিল ২,৪৫০ ডলার। কিন্তু বাড়িওয়ালা রোশঙ্কর বুঝতে পারেননি ভাড়াটিয়ার মনে কি উদ্দেশ্য ছিল। তিনি বলেন, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সঠিক ব্যক্তির কাছে তিনি এপার্টমেন্টটি ভাড়া দেননি। তার দাবি অনুযায়ী, ভাড়াটে মহিলা প্রথম মাসের ভাড়া দেরিতে দিয়েছেন এবং পরের দুই মাসের ভাড়ার চেক বাউন্স করেছে। রোশঙ্কর বলেন ‘ এই পরিস্থিতিতে আমি সত্যিই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি।’

রোশঙ্কর বলেন, ‘আবেগের দিক থেকে এটি আমার কাছে ছিলো এক বিরাট আঘাত।’ তিনি আরও যোগ করেন, বকেয়া ভাড়া ও ইউটিলিটির বিল বাবদ তিনি এখন ওই ভাড়াটের কাছে ১৩,০০০ ডলার পাবেন।

গত বছর আগস্টে তিনি অন্টারিওর ল্যান্ডলর্ড অ্যান্ড টেনান্ট বোর্ডের কাছে ভাড়াটে উচ্ছেদের আবেদন করেন। কিন্তু প্রায় ৫ মাস পার হয়ে গেলেও শুনানীর কোনও তারিখ পাননি। তাকে ঐ সময় বলা হয়েছে, শুনানির তারিখ পেতে আরও ৩ থেকে ৪ মাস অপেক্ষা করতে হবে।

উপরে যে বাংলাদেশী পরিবারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তারা বেশ সরল বিশ্বাসেই ভাড়া দিয়েছিলেন বেজমেন্টটি। এক শ্বেতাঙ্গীনি সিঙ্গেল মাদার বেজমেন্টটি ভাড়া নেন। সঙ্গে আবার একটি বড় সাইজের কুকুরও আছে সেই মহিলার। ভাড়া দেওয়ার সময় ভাড়াটিয়ার ক্রেডিট হিস্টোরী চেক করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি বাংলাদেশী পরিবারটি। অথবা বিষয়টি তাদের জানা ছিল না। আর ক্রেডিট হিস্টোরী ভাল থাকলেও পরবর্তীতে সেই ব্যক্তি যে প্রতারণার আশ্রয় নিবেন না তার কোন গ্যারান্টি নেই। রোশঙ্করের ভাড়াটিয়ার  ক্ষেত্রে সেরকমটাই দেখা গেছে। ভাড়া দেওয়ার আগে রোশঙ্করের এজেন্ট সম্ভাব্য ঐ ভাড়াটিয়ার ক্রেডিট স্কোর চেক করে দেখেছিলেন যা ছিল চমৎকার। তিনি চাকরির প্রমাণপত্র, সাম্প্রতিক সময়ের তিন মাসের বেতনের রশিদ এবং আগের বাড়িওয়ালার রেফারেন্স ইত্যাদি সবই দিয়েছিলেন ঐ এজেন্টের মাধ্যমে। কিন্তু তারপরেও সেই ভাড়াটিয়া সমস্যা তৈরী করেছেন। ভাড়া দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। বাড়িও ছাড়ছেন না। অন্যদিকে অযোগ্য ও ব্যর্থতার পরিচয় দেয়া ল্যান্ডলর্ড এ্যান্ড টেনেন্ট বোর্ড চলছে গরুর গাড়ির গতিতে যেখানে দরকার ছিল দ্রুতগামী এক্সপ্রেস ট্রেনের গতি।

উল্লেখিত বাংলাদেশী পরিবারের বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডটিও দখল করে রেখেছেন ভাড়াটিয়া। সেখানে যখন-তখন বড় সাইজের কুকুটিকে ছেড়ে দেয়া হয় গলায় দড়ি না বেধে। ব্যাকইয়ার্ড থেকে কুকুরের বিষ্ঠাও পরিষ্কার করেন না ভাড়াটিয়া। ফলে বাড়িওয়ালা নিজের ব্যাকইয়ার্ডও ব্যবহার করতে পারছেন না। টেলিফোনে বা ইমেইলে যোগাযোগ করা হলে সেই ভাড়াটিয়া উল্টো হুমকী দেন এই বলে যে, তাকে হয়রানী করা হচ্ছে। টেলিফোন বা ইমেইলের প্রতিউত্তরে ভাড়াটিয়া যে ভাষা ব্যবহার করেন তা বেশ অপ্রীতিকর এবং অশোভন। একবার পুলিশও ডেকেছিলেন বাড়িওয়ালা। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। পুলিশ এসেছিল তাদের ডাকে সারা দিয়ে। কিন্তু আদালতের নির্দেশ ছাড়া ভাড়াটিয়ার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নিতে পারবে না বলে জানায় তারা। 

বর্তমানে অন্টারিওর ল্যান্ডলর্ড এ্যান্ড টেনেন্ট বোর্ডে ৩৮ হাজারেরও বেশী মামলা জমা পড়ে আছে নিষ্পত্তির জন্য। এই মামলাগুলোর শতকরা ৯০ ভাগই করেছেন বাড়ির মালিকেরা। অর্থাৎ প্রায় ৩৪ হাজারেরও বেশী বাড়িতে বাড়ির মালিকেরা জিম্মি হয়ে আছেন ভাড়াটিয়ার কাছে। সংখ্যাটি নিশ্চিতভাইে আতংকজনক। এটি একটি স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়। হাইরাইজ বা বড় বড় এপার্টমেন্টের মালিকেরা হয়তো তাদের আর্থিক ক্ষতি সামলে নিতে পারবেন। কিন্তু  ক্ষুদ্র বাড়িওয়ালাদের অবস্থা কি হবে? লক্ষ্য করা গেছে এই শ্রেণীর ভাড়াটিয়ারা বাড়ি ভাড়াতো দেনই না, উল্টো আরো বাড়ির ক্ষতি করে যান। সেগুলো মেরামত করতে মালিকের খরচ আরো অনেক বেড়ে যায়। আর আইনী প্রক্রিয়ায় ভাড়াটিয়াকে এক পর্যায়ে উচ্ছেদ করা গেলেও বকেয়া ভাড়া আর উদ্ধার হয় না সাধারণত।

একজন ভাড়াটিয়া নানান কারণে বিপদে পড়তেই পারেন। সে ক্ষেত্রে বাড়ির ভাড়া দেওয়া তার পক্ষে কঠিন হতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, তার দায়ভার বাড়িওয়ালা কেন নিবেন? ক্ষুদ্র বাড়িওয়ালারাতো সাধারণ আয়েরই মানুষ। সাধ্য থাকলে ছোট বাড়িওয়ালাদের কেউ তো আর বাড়ি ভাড়া দেন না। মর্টগেজ পেমেন্ট, সাংসারিক খরচসহ অন্যান্য কিছু খরচ মেটানোর জন্যই বাড়ির বেজমেন্ট ভাড়া দিয়ে থাকেন তারা। অথবা যারা কন্ডো কিনে রাখেন ইনভেস্টমেন্ট হিসাবে তারা সেটি ভাড়া দিয়ে রাখেন মর্টগেজ পেমেন্টটা যাতে ঐ ভাড়ার অর্থ থেকে পুরাটা না হলেও বেশীরভাগটা উঠে আসে। এই পরিস্থিতিতে যখন একজন ভাড়াটিয়া বাড়ি ভাড়া দেওয়া বন্ধ করে দেন নানান অজুহাত তুলে, তখন তার বাড়িওয়ালাকে পড়তে হয় বড় রকমের বিপদে। কারণ ব্যাংক এর ঋণ পরিশোধ করা তখন ভয়াবহ রকমের কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এমনিতেই ঋণ করে বাড়ি কেনা, তার উপর সেই ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে যদি মাসে মাসে আবার আরেকজনর কাছে ঋণ করতে হয় তখন কারো মাথা ঠিক থাকার কথা নয়। অথচ এমন এক অদ্ভূত আইন এখানে করে রাখা হয়েছে যে, মাসের পর মাস বাড়ি ভাড়া না দিলেও আদালতের অনুমতি ছাড়া সেই ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে না। আবার সেই আদালতও এখন হয়ে আছে এক অর্থে পঙ্গু। চরমভাবেই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে অন্টারিওর ল্যান্ডলর্ড এ্যান্ড টেনেন্ট বোর্ড। আর এর প্রধান ভুক্তভোগি হচ্ছেন ক্ষুদ্র বাড়িওয়ালারা। অল্প সংখ্যাক ভাড়াটিয়াও আছেন যারা বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বসে আছেন শুনানির তারিখ পাওয়ার জন্য।

পরিস্থিতি বর্তমানে এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ভুক্তভোগীরাতো বটেই, বাকিদের মধ্যেও কেউ কেউ এখন ভাবতে শুরু করেছেন যে তাদের বর্তমান ভাড়াটিয়া চলে গেলে নতুন করে আর বাড়ি ভাড়া দিবেন না। দরকার হয় কিছুটা আর্থিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে থাকবেন। কিন্তু এরকম বিপদ নিজের ঘরে ডেকে আনবেন না। এ কথার সমর্থন পাওয়া যায় টরন্টোর একজন প্যারালিগ্যাল ক্যাথলিন লোভেট এর এক বক্তব্যে। তিনি সিবিসি নিউজকে বলেন, ‘মামলা নিষ্পত্তিতে ল্যান্ডলর্ড এ্যান্ড টেনেন্ট বোর্ডের বিলম্বের একটি প্রতিক্রিয়া হলো, কিছু বাড়িওয়ালা তাদের বাড়ি বিক্রি করে দিতে অথবা ভাড়া দেয়ার ব্যবসা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চাচ্ছেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘গত কয়েক বছরে আমি অনেক, অনেক ক্লায়েন্টকে সব বন্ধ করে দিতে দেখেছি, এবং সেটাই চূড়ান্ত। আর আমাদের গোটা সমাজের ওপর এর একটা নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যই পড়ছে, কারণ, আমাদের বাড়ি ভাড়ার বাজার ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসছে।’

এদিকে এই অবস্থা পরিবর্তনের জন্য ল্যান্ডলর্ডদের সংগঠন অন্টারিওর রেন্টাল-হাউজিং প্রোভাইডার্স ফেডারেশন কাজ করে যাচ্ছে বলে জানা যায়। ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট টনি ইরউইন সিবিসি নিউজকে বলেন, “সম্প্রতি আমরা আমাদের সদস্যদের বক্তব্য শুনেছি। তারা নিয়মিতভাবেই তাদের হাতাশার কথা আমাদের কাছে বলে আসছেন। আমরা তা অব্যাহতভাবে সরকারের কাছে তুলে ধরছি।

ইরউইন বলেন, ‘ড্যাগ ফোর্ডের সরকার ল্যান্ডলর্ড এ্যান্ড টেনেন্ট বোর্ডে আরও বেশি সংখ্যক বিচারক নিয়োগ এবং আরও তহবিল বরাদ্দের মাধ্যমে কিছুটা অগ্রগতির সূচনা করেছে, তবে এ নিয়ে এখনও অনেক কিছু করার রয়েছে।’

ইরউইন বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই একটি অধিকতর যৌক্তিক সময়সীমার মধ্যে শুনানি শেষ করতে সক্ষম হওয়ার দরকার আছে।’ তিনি আরও বলেন, এটা কেবল বাড়িওয়ালাদের জন্য নয়, ভাড়াটেদের জন্যও দরকারি।

এ সমস্যা যে শুধু অন্টারিওতেই চলছে তা নয়। কানাডার অন্যান্য প্রভিন্সেও কমবেশী একই অবস্থা বিরাজ করছে। এমনকি জাল কাগজ পত্র দেখিয়ে বাড়ি ভাড়া নেয়ার ঘটনাও ঘটছে। অর্থাৎ এই শ্রেণির লোকেরা ভাড়া দিবে না এই রকম উদ্দেশ্য নিয়েই একজনের বাড়িতে উঠেন ভাড়াটিয়া হিসাবে। তারপর এক দুই মাস হয়তো ভাড়াটা দেন ঠিকমত। অনেক বাড়িওয়ালা আবার দুই মাসের (ফার্স্ট এ্যান্ড লাস্ট মান্থ) ভাড়া আগ্রীম নিয়ে থাকেন। অন্টারিওতে এই রীতি চালু আছে। এই দুই মাস পার হয়ে গেলে ভাড়াটিয়া ভাড়া দেয়া বন্ধ করে দেন নানান অজুহাত তুলে। এর মধ্যে অন্যতম অজুহাত হলো, চাকরী নেই তাই ভাড়া দিতে পারবেন না।

চাকরী না থাকলে ভাড়া দিবে কোথা থেকে এটা একটা যৌক্তিক কারণ অবশ্যই। কিন্তু এর দায়ভার বাড়িওয়ালা কেন নিবে? তাছাড়া চাকরী না থাকলে এম্প্লয়মেন্ট ইন্সুরেন্স বেনিফিট আছে। সেটি না থাকলেও সরকারী ভাতা আছে। টরন্টো ভিত্তিক ‘Maytree’ নামের একটি সামাজিক সংগঠন তাদের ওয়েবসাইটে সরকারী ভাতা সম্পর্কে যে তথ্য দিয়েছে তাতে দেখা যায়, এখানে ৪ সদস্যের একটি পরিবার বেসিক সোস্যাল এসিস্টেন্স পান মাসে ১২৫০ ডলার। ফেডারেল চাইল্ড বেনিফিট দুই বাচ্চর জন্য মাসে ৯২৩.৫৮ ডলার। অন্টরিও চাইল্ড বেনিফিট দুই বাচ্চার জন্য মাসে ২৩৬.৪১ ডলার। জিএসটি/এইচএসটি ক্রেডিট মাসে ৭৩ ডলার। প্রভিন্সিয়াল টেক্স ক্রেডিট/বেনিফিট মাসে ১৪০.৭৫ ডলার। সব মিলিয়ে মাসে ভাতার পরিমাণ দাঁড়ায় ২,৬২৩.৭৪ ডলার। তাহলে চাকরী নেই এই অজুহাতে ভাড়া দেয়া কেন বন্ধ করবে একজন ভাড়াটিয়া? টরন্টোতে একটি বাড়ির ওয়ান বেডরুম বেজমেন্ট এপার্টমেন্ট বর্তমানে ৮ শ থেকে শুরু করে ১ হাজার ডলারের মধ্যেই পাওয়া যায়। দুই বেডরুম হলে হয়তো ১২ শ বা খুব বেশী হলে ১৫ শ ডলারের মধ্যেই পাওয়া যায়। তাহলে আপদকালীন সময়ে তো একজন ব্যক্তি পরিবারসহ বেজমেন্ট ভাড়া নিয়ে থাকতে পারেন। অথবা যারা আগে থেকেই বেজমেন্টে আছেন তারা তাদের ভাড়া দেয়া অব্যাহত রাখতে পারেন। কিন্তু তারা সেটা করছেন না। কারণ এই শ্রেণির ভাড়াটিয়াদের উদ্দেশ্যই থাকে বাড়ি ভাড়া না দেয়ার। একটা সময়ে গিয়ে তাদেরকে বাড়ি ছাড়তেই হয়। কিন্তু এর মধ্য যদি ছয় থেকে আট মাস বা পুরো বছর ভাড়া না দিয়ে থাকা যায় তবে অনেক অর্থই তারা সঞ্চয় করতে পারেন। এবং উচ্ছেদের নোটিশ পাওয়ার পর তারা আবার সুযোগ খুঁজেন অন্য কোন বাড়িওয়ালার ঘাড়ে চেপে বসার। এভাবেই চলতে থাকে তাদের কার্যক্রম। আর ভুক্তভোগী হন ছোট বাড়িওয়ালারা। এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার জরুরী ভিত্তিতে। বর্তমানে অন্টারিওতে প্রায় ৩৪ হাজার ভাড়াটিয়ার বিরুদ্ধে ল্যান্ডলর্ড এ্যান্ড টেনেন্ট বোর্ডে মামলা ঝুঁলে আছে। সংখ্যাটা যে কোন বিচারেই অতঙ্কজনক।

এদিকে মামলাকারীদের মধ্যে কত ভাগ ক্ষুদ্র বাড়িয়ালা আর কতভাগ বৃহৎ প্রপার্টির মালিক আছেন তা অবশ্য জানা যায়নি। তবে সিংহভাগই ক্ষুদ্র বাড়িওয়ালা হওয়ার কথা। কারণ প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে অর্থাৎ জাল ডকুমেন্ট উপস্থাপন করে যারা ভাড়ি ভাড়া নেন বা অসৎ উদ্দেশ্যে বাড়ি ভাড়া নেন তারা সাধারণত ক্ষুদ্র বাড়িওয়ালাকে টার্গেট করে অগ্রসর হন। কারণ তারা জানেন এই ক্ষুদ্র বাড়িওয়ালারা সহজবশ্য। বড় বাড়িওয়ালা, বিশেষ করে হাইরাইজ বিল্ডিং এর মালিকদের প্রচুর ক্ষমতা বা প্রতিপত্তি থাকে। তাদের সঙ্গে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সুবিধা করা যায় না।

তবে ব্যতিক্রমও আছে। আমার প্রতিবেশী আরেক বাংলাদেশী ভদ্রলোক জানান তার বেজমেন্টের ভাড়াটিয়া এতটাই ভদ্র যে, বাড়িতে কোন মেহমান আসতে চাইলে আগে থেকেই তিনি তাকে জানিয়ে রাখেন বা অনুমতি চান। বাড়ির বাইরে গেলে সবসময় ঘরের সব বাতি নিভিয়ে যান। 

আমরা জানি বর্তমানে গ্রেটার টরন্টোতে তীব্র আবাসিক সংকট বিরাজ করছে। যার ফলে বাড়ির দাম এবং একই সাথে বাড়ি ভাড়াও আকাশ ছোঁয়া হয়ে উঠেছে। নতুন বাড়ি নির্মানও খুব ধীর গতিতে চলছে। আর এফোর্ডএ্যাবল বাড়ি নির্মানের কথা ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরা বলে আসলেও গত কয়েক বছরে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এই পরিস্থিতিতে এই ক্ষুদ্র বাড়িওয়ালারা আবাসিক সংকট নিরসনে কিছুটা হলেও উল্লেখযোগ্য একটা ভূমিকা পালন করে আসছেন। তারা তাদের বেজমেন্ট বা উপর তলায় একটি দুটি রুম ভাড়া দিয়ে নিজেদের আর্থিক সংকট কিছুটা লাঘবের পাশাপাশি আবাসিক সংকটও কিছুটা নিরসনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছেন। এমতাবস্থায় এক শ্রেণীর অসৎ ভাড়াটিয়ার কারণে যদি তাদের বাড়িওয়ালাকে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয় তবে চলমান তীব্র আবাসিক সংকট আরো তীব্র হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই। কারণ খাল কেটে বাড়িতে কেউ কুমিড় আনতে চাইবেন না নিশ্চই।  

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক, প্রবাসী কণ্ঠ