বইমেলা প্রাণের মেলা

জসিম মল্লিক

এবারের বইমেলা নানা কারণে গুরুত্বপূর্ন ছিল।  সম্ভবত এবারই সবচেয়ে বেশি প্রবাসে বসবাসরত লেখকরা একুশের গ্রন্থমেলায় অংশ নিয়েছেন। এবারই সবচেয়ে বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে তাদের। বিশেষকরে কানাডা আমেরিকার লেখকদের ছিল জয়জয়কার। বাংলা ভাষার চর্চাও বেশি হয় এই দুই দেশে। তারাই বিদেশে বাংলাভাষাকে টিকিয়ে রেখেছেন। এরপরই ইউকে, অষ্ট্রেলিয়ারর নাম করা যায়। এবারের মেলা এই কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটা হচ্ছে দীর্ঘ পেন্ডামিকের অবরুদ্ধ সময়কে পিছনে ফেলে এবারই প্রথম নির্ভয়ে লেখক, প্রকাশক আর পাঠকদের সম্মিলন ঘটেছে। যারা গত কয়েকবছর মেলায় আসতে পারেননি এবার তাদের অনেকেই এসেছেন। আমি নিজেও প্রায় বাইশ বছর ধরে কানাডা প্রবাসী হলেও প্রতিবছরই মেলায় এসেছি। ব্যাতিক্রম ছিল ২০২১। সেই বছর আসতে পারিনি। মেলাও পরিপূর্ণভাবে হয়নি। গত বছর এসেছিলাম। কিন্তু এ বছরই আনন্দের মাত্রাটা বেশি।

তবে এ বছর অন্যান্য বছরের তুলনায় বই প্রকাশ এবং বই বিক্রী কম হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে প্রকাশনার সাথে যুক্ত সবকিছুর মূল্যবৃদ্ধি। বিশেষকরে কাগজের দাম। ইউক্রেন যুদ্ধ, কোভিডের ধাক্কা সবমিলিয়ে পুরো পৃথিবী জুড়ে অর্থনীতির যে ধাক্কা তা থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। মধ্যবিত্তরাই বইয়ের প্রধান ক্রেতা। কিন্তু তারা বই কেনার মতো বিলাসিতা করতে কয়েকবার চিন্তা করছেন। যিনি দুইটা বই কিনতেন তিনি একটা বই কিনেছেন। অনেকে একবারও মেলায় আসেননি। অনেকে এসেও বই না কিনেই ফিরে গেছেন। পথের খরচও এর সাথে যুক্ত। বাচ্চাদের আনন্দ উল্লাসটা একটু কম ছিল। যারা ধানঢ্য তারা বই কেনেন খুবই কম। মেলায় আসেন না বললেই চলে। তারপরও বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা। ছুটির দিনগুলোতে উপচেপড়া ভীড় ছিল। বই প্রকাশও নেহায়েত কম হয়নি। স্টলের সংখ্যাও আগের বছরের চেয়ে বেশি ছিল। এবারের মেলায় স্টল বিন্যাস একটু খাপছাড়া মনে হয়েছে। লেখক পাঠকের মিলনটা ঠিকমতো ঘটতে পারেনি। কেমন একটা বিচ্ছিন্ন ভাব মনে হয়েছে। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে বইমেলা সফল হয়েছে পাঠক, লেখক আর প্রকাশকের কল কাকলিতে।

যারা গত কয়েকবছর মেলায় আসতে পারেননি এবার তাদের অনেকেই এসেছেন। ছবি : সংগৃহীত

মাঝে মাঝে মনে হয় লেখালেখির পিছনে এতো সময় না দিয়ে, এতো ত্যাগ স্বীকার না করে অন্য কিছু করলে ভাল হতো। সেই তরুণ বয়স থেকেই শুরু হয়েছে এক লড়াই। লেখক হওয়ার লড়াই। শুধু লেখালেখি করতে চাই বলেই ঘর ছেড়েছি, মা, ভাই ,বোন ছেড়েছি। না খেয়ে, একটা দুইটা কাপড় পড়ে দিন পার করেছি কতদিন। দেশ ছেড়েও রেহাই নাই। সেখানেও লেখালেখির ভুত আমার পিছু ছাড়েনি। ফি বছর বইমেলা শুরু হলেই ছুটে আসি। শুধুই কি ঢাকা, যেখানে বইমেলা সেখানেই ছুটে যাই। কখনও নিউইয়র্ক, কখনো কোলকাতা, কখনও লন্ডন। লেখকের আসলে কোনো তৃপ্তি নাই। অতৃপ্তি নিয়ে বেঁচে থাকাই লেখকের নিয়তি। কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকা। বিচিত্র সেই কষ্ট। একমাত্র লেখকই সেই কষ্ট বহন করে বেড়ায়। আপাতঃ বাইরের সাফল্য, খ্যাতি এসব লেখককে সাময়িক তৃপ্তি দিলেও দিনশেষে লেখক খুবই একা, খুবই দুঃখী। লেখকের মন কেউ বোঝে না। না বুঝে কষ্ট দেয়। লেখককে সবাই কষ্ট দেয়। মা কষ্ট দেয়, বাবা কষ্ট দেয়, ভাই-বোন কষ্ট দেয়, ছেলে-মেয়ে কষ্ট দেয়, বন্ধু-আত্মীয় কষ্ট দেয়, সাংবাদিক কষ্ট দেয়, পুলিশ কষ্ট দেয়, উকিল কষ্ট দেয়, রিক্সাওয়ালা কষ্ট দেয়, সম্পাদক কষ্ট দেয়, পাবলিশার কষ্ট দেয়, দোকানদার কষ্ট দেয়, শিক্ষক কষ্ট দেয়, লেখকও লেখককে কষ্ট দেয়। অনেক অপমান, অবহেলা আর উপেক্ষা সহ্য করে লেখক। শুধু পাঠকই লেখককে কষ্ট দেয় না। পাঠকের মুখের দিকে তাকিয়েই লেখক বেঁচে থাকে।

একটি স্বপ্নের ইতিবৃত্ত

দেশে আসলে আমি মোটামুটি ভাল থাকি। শারীরিক, মানসিক উভয় দিক থেকেই আমি ভাল থাকি। যতই অসুখ বিসুখ আর নির্জনতায় আক্রান্ত হই না কেনো দেশের মাটিতেই আমি অভ্যস্ত। এই মাটি আমাকে আপন করে নেয়, কোলে টেনে নেয়। শেঁকড়ের টান একেই বলে বা এ্যাট হোম ফিলিং। এই মাটি আমাকে পেলেই খুশীতে খলবলিয়ে ওঠে। বিদেশে যতই নাগরিক উপভোগ থাক, যতই ডিসিপ্লিন থাক, নিয়মের শৃঙ্খলে বন্দী থাক, যতই নাগরিক অধিকার থাক জন্মস্থান আমাকে তাঁর নিজের সন্তান মনে করে। দেশে যখন ছিলাম তখনও কী সমস্যা ছিল না! ছিল। অসুখ বিসুখ হয়নি! হয়েছে। বিদেশে কী অসুখ বিসুখ হয় না! হয়। অসুখ বিসুখ আর মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই নেই কারো। কিন্তু সেটা কখন, কিভাবে, কোথায় হবে জানা নাই। জানা থাকলে ভাল হতো। আমি সবসময় চাই আমার মৃত্যু যেনো দেশের মাটিতে হয়। আমার কবর যেনো আমার বাবার কবরের পাশে হয়। কিছুতেই আমি পিকারিংয়ের বরফ ঢাকা নির্জন কবরস্থানে শেষ আশ্রয় নিতে চাইনা। আল্লাহ নিশ্চয়ই আমার আবেদনে সারা দেবেন। তিনি কাউকেই বঞ্চিত করেন না। আমি আমার সন্তানদের বলে রেখেছি কষ্ট হলেও যেনো আমার মরদেহটা দেশে পাঠায়। তাঁরা আমার কথা রাখবে বলেই আমি বিশ্বাস করি। ঢাকায় যদি আমার মৃত্যু হয় আমার ঢাকার আত্মীয়রা আমার অনুরোধ রাখবেন।

আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে বরশিালে। সেই জীবন ছিল সবচেয়ে আনন্দমুখর। সবচেয়ে আবেগের। স্মৃতির মনিকোঠায় সবসময় ভেসে উঠে বরিশালের দিনগুলো। সেখানে আমার মা ছিল, বাবা ছিল, ভাই বোন ছিল, বন্ধুরা ছিল, আত্মীয় আর খেলার সাথীরা ছিল। আমি সবসময় স্মৃতির সরোবরে ভাসতে থাকি। সেটা হচ্ছে বরিশালের দিনগুলোর স্মৃতি। আমি এ পর্য্যন্ত আটটি স্মৃতিকথার বই লিখেছি যার অধিকাংশই বরিশালের দিনগুলোর স্মৃতি। বরিশালের স্কুল, কলেজের স্মৃতি, সহপাঠিদের স্মৃতি। দুরন্তপনার স্মৃতি। কষ্ট আর অবহেলা সত্ত্বেও সেই জীবনে ছিল মায়ের মমতা, ভাই বোনের স্নেহ। অনেক না পাওয়া ছিল, অপ্রাপ্তি ছিল কিন্তু তারপরও সেইসব দিনগুলোর আনন্দ হৃদয় তন্ত্রিতে কুলকুল করে বয়ে যায় আজও। এখন অনেককিছু দরকার হয় বেঁচে থাকা জীবনে। জীবন যাপনের জন্য অনেক উপকরন যুক্ত হয়েছে। গাড়ি লাগে, বাড়ি লাগে, বাথটাব লাগে, হট ওয়াটার লাগে, ব্রান্ডনেম লাগে, সেভিং ক্রীম লাগে, লোশন লাগে, পারফিউম লাগে, দামী কাপড় লাগে, স্যুট টাই লাগে, টুথপেষ্ট লাগে, ব্রাশ লাগে, ডাক্তার লাগে, স্পেশালিষ্ট লাগে, পলিউশনমুক্ত পরিবেশ লাগে, অর্গানিক লাগে, বেড়ানো লাগে, বিজনেস ক্লাস লাগে, ফাইভস্টার লাগে, লিমুজিন লাগে, ক্লাবের মেম্বারশীপ লাগে, স্মার্ট ফোন লাগে, টিভি লাগে, রিমোট লাগে, ল্যাপটপ লাগে, কম্পিউটার লাগে, নেট লাগে, জুম লাগে, সোশ্যাল মিডিয়া লাগে।

কিন্তু শৈশবের দিনগুলোতে ওসব কিছুই লাগত না। তখন এসবের অনেক কিছুই ছিল না। তখন অন্যকে ল্যাং মারা ছিল না। হিংসা, ঈর্ষা ছিল না। প্রতিযোগিতা ছিল, ঝগড়া ছিল, আড়িকাটা ছিল। কিন্তু দিনশেষে আবার মিল মিস হয়ে যাওয়া ছিল। এখনকার জীবন অনেক বেশি সংঘাতময়, স্বার্থের, ঘৃণার, প্রতিহিংসার। বন্ধুর প্রতি বন্ধুর ঘৃণা, কেউ কারো ভাল দেখতে পারে না। সবকিছু কৃত্রিম, লোক দেখানো। ভালবাসায় কোনো সুবাস নাই। চাওয়া পাওয়া শুধু। পাওয়া শেষ হলেই ভালবাসার সমাপ্তি। আস্থাকুড়ে নিক্ষিপ্ত করে দেই। তখন একটা দুটোর বেশি জামা প্যান্ট ছিল না আমার। জুতা ছিল না। স্যান্ডেল পড়ে স্কুলে চলে যেতাম। বৃষ্টিতে ভিজতাম, রোদে পুড়তাম। একবার স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আমাকে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিল। তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। সেদিন আমার প্রোপার ড্রেস ছিলনা। আগের দিন বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিল স্কুলের ড্রেস। আমি কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে গেলাম।

মা বললেন, কি হইছে, এতো তাড়াতাড়ি আইছ ক্যান! মা কষ্ট পাবেন তাই বললাম, আমার পেটে ব্যথা। তখন আমি মাঝে মাঝেই পেটের সমস্যায় ভুগতাম। মা কাঁচা হলুদ বাটা খাইয়ে দিতেন। ডাক্তার বা ওষুধের কথা মনে থাকত না মায়ের। টুথপেষ্ট ব্যবহার জানতাম না, ব্রাশ ছিল না, আমপাতা দিয়ে দাঁত মাজতাম, শ্যাম্পু ছিল না, বডি লোশন ছিল না, ফেসওয়াশ ছিল না।

অনেক কিছু ছাড়াই জীবন চলে যায়। অনেকের অনেক কিছু নাই তাতে কি! একজীবনে সব থাকে না। জীবনের অনুসঙ্গ যত কম হবে জীবন তত সহজ হবে। আমারও অনেক কিছু নাই। সেজন্য আমার কোনো দুঃখবোধ নাই। আমার চেয়ে কম আছে, কম পেয়েছে এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি। সেজন্য তাদের জীবন বৃথা হয়ে যায়নি। যা পাই তাতেই আমি সুখী। বাকি জীবন এভাবেই কেটে যাক, ভালবাসায়, মায়ায়, কাছে থাকায়, পাশে থাকায়। ভালবাসা বেঁচে থাকুক।

ঢাকা ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

আজ সকালে

আচ্ছা অর্ক অরিত্রি এমন কেনো! এতো কম কথা বলে কেনো! বাবার সাথে এতো হিসাব করে কথা বলতে হবে! একটু বেশি বললে কি হয়! আমি তো আরো কিছু শুনতে চাই! আসলে আমিও যে ওদের মতোই। ওরা পেয়েছে আমার স্বভাব। আমি নিজেই অল্প কথা বলেই শেষ করি। ওরা কী মনে করে বাবার সাথে এরচেয়ে বেশি বলা যাবে না! আজ সকালে ঘুম ভেঙ্গেই হোয়াটসএপে অর্ক’র ম্যাসেজ! অর্ক অরিত্রি ফেসবুক করে না বলে হোয়াটসএপে ম্যাসেজ করে। আর ইন্সটাগ্রামে আমি যে ছবিই পোষ্ট করি অর্ক আর খাতিজা লাইক দেবেই।

অর্ক লিখেছে baba how is boimela going!

মাত্র এই টুকুই। আমি লিখলাম, খুবই ভাল। আমার বই ভাল সেল হয়েছে। আজকে মেলা শেষ।

সকালে চা খাচ্ছি এমন সময় অরিত্রির ফোন। ছুটে গিয়ে ফোন ধরলাম। লাইনটা কেটে গেলো। আবার ফোন। এমন ছুট দিলাম চা চলকে পড়ে গেলো।

-আম্মু কেমন আছ! ফোন করো না তো।

অরিত্রি হেসে বলল, তিন দিন আগেই তো করলাম। অফিসের কাজে একটু বিজি ছিলাম বাবা। তোমার মেলা কেমন হচ্ছে। শেষ কবে!

-আজকেই শেষ। আমি বললাম, দুই তিন দিনের জন্য চলে আসতা। সারপ্রাইজ হতো। আজকে বিশেষদিন আমার জন্য।

-তিন দিনের জন্য ঢাকায় আসা যায়!

-এমনি মজা করলাম।

-তোমার ফ্লাইট ডেট পেয়েছি। ওই দিন আমি লাসভেগাস যাব বাবা।

অরিত্রির হাজবেন্ড অফিসের কাজে গত জানুয়ারী থেকে লাসভেগাস। তাই উইকেন্ডে হয় সাদ টরন্টো আসে না হয় অরিত্রি যায়।

-ওহ দেখা হবে না তোমার সাথে!

-চলে আসব তিন দিন পরই। ভাইয়া তোমাকে এয়ারপোর্ট থেকে পিক করবে।

-কি খেলা আজকে! রান্না করো!

-হ্যা করি।

-পাস্তা নিশ্চয়!

অরিত্রি হেসে বলে, হ্যাঁ। ইজি তাই।

-ওকে আম্মু টেক কেয়ার। সি ইউ সুন।

ঢাকা ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

ফেরা

বোর্ডিং শুরু হয়েছে। টিভির পর্দায় দেখতে পাচ্ছি গেট ওপেন। আমি তখনও লাউঞ্জে বসে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বই ঘাঁটাঘাঁটি করছি আর দ্বিতীয় দফা চায়ে চুমুক দিচ্ছি। এর আগেও আমি স্কাইলাউঞ্জে এসেছি কিন্তু এই লাইব্রেরিটি চোখে পড়েনি কেনো! লাউঞ্জের ছেলেটি বলল, স্যার এবার আস্তে আস্তে যেতে পারেন। ৮ নম্বর গেটে এসে দেখি বিরাট লাইন। আমাকে অবশ্য লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়নি। যাত্রী সবাই প্রায় বাঙালি। বিমানের ঢাকা-টরন্টো ডিরেক্ট ফ্লাইট। বেশ কয়েকজন চেনা মানুষের সাথে দেখা হলো। আমার পিছনেই দাঁড়ানো সিনথিয়া বলল, আঙ্কেল আপনার লেখা খুউব ভাল লাগে। আমার হাজবেন্ডও আপনার লেখার ভক্ত। অরিত্রিকে নিয়ে আপনি এতো লেখেন! আজকাল সবাই প্রায় আঙ্কেল বলে সম্বোধন করে। ব্যাপারটা ভেবে বিষন্নবোধ করি। 

আমার পাশেই আরো দু‘তিনজন অপেক্ষাকৃত তরুণ যাত্রী। একজন বলল, আপনি যে অরিত্রিকে নিয়ে এতো লেখেন অর্ক মাইন্ড করে না! আমি জোরে হেসে বলি, না, অর্ক খুশী হয়। পাশের একজন বলল, অর্ককে নিয়েওতো লেখেন জসিম ভাই। আমার এবারের যাত্রা ভাল ছিল। একজন সুশ্রী কেবিন ক্রু আমাকে কিভাবে যে চিনেছে কে জানে! যথেষ্ঠ আতিথেয়তা দিয়েছেন। ঠিকঠাকমতোই টরন্টো পৌঁছেছি। এয়ারপোর্টে কেউ আসবে না আগেই জানি। তাই লিমো ভাড়া করে এসেছি। অরিত্রি লাসভেগাস যাবে। একটু পরেই ফ্লাইট। অর্কর অফিসে মিটিং। হোম অফিস। কাউকেই বলিনি এয়ারপোর্টে আসতে। আমি খুবই সেলফ ইন্ডিপেনডেন্ট। অন্যে করে দেবে এই আশায় বসে থাকি না।

হায়দ্রাবাদী ড্রাইভারের সাথে গল্প করতে করতে ঘরের সামনে গাড়ি এসে থামে। দেখি জেসমিন দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ খুউব বিষন্ন লাগে আমার। কয়েকদিন জেটল্যাগ থাকবে, পড়ে পড়ে ঘুমাবো আর দেশের কথা মনে করে মন খারাপ লাগবে। তারপর আবার একঘেয়ে জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ব। অরিত্রি এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করে। অর্ক বাসা থেকে। ইশ্ কারো সাথেই দেখা হলো না!

টরন্টো ৯ মার্চ, ২০২৩

উজান

মানুষের জীবনে ভাল বন্ধু বা ভাল সঙ্গী দরকার আছে। মানুষ একলা বাঁচতে পারে না। আমি প্রায়ই লিখি যে আমি একলা হতে চাই, একলা বাঁচতে চাই, নিজের কাছে নিজের ছায়া হতে চাই। যতই এসব বলি না কেনো, প্রকৃতপক্ষে সঙ্গী ছাড়া বাঁচা খুব কঠিন। এই প্রথমবারের মতো আমি যে ক’মাস দেশে ছিলাম একলা ছিলাম। নির্জন একটি বাড়িতে একলা। এটা ঠিক যে আমি ফ্রিডম উপভোগ করেছি। একলা বাজার করেছি, একলা রেঁধেছি, একলা খেয়েছি, একলা বেঁচেছি। আবার পাশাপাশি কখনও কখনও নিজেকে খুব অসহায় লেগেছে। মনে হয়েছে আমার কেউ নাই। কেউ একজন পাশে থাকলে ভাল হতো। কথা বলার একজন মানুষ থাকলে ভাল হতো। কিন্তু কেউ নাই আমার। আমি তখনই জেনেছি মানুষ আসলে একা। মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষন একা। রাত যত বাড়ত, তত নিঃসঙ্গতা আমাকে ঘিরে ধরত। প্রতিদিন ঘরে ফিরেই এই অনুভূতি হতো। আমি আসলে কোনো একটা বিষয় নিয়ে বাঁচতে পারি না। আমার মধ্যে একটা অস্থিরতা আছে। কি চাই, কিভাবে চাই, কাকে চাই নিজেই ভাল বুঝতে পারি না। তখনই আমার এই বোধটা কাজ করে। নির্জনতা আকড়ে ধরে। আমার আত্মসম্মানবোধ অনেক তীব্র। তাই আমি সহজে কারো দরজায় হুট হাট হাজির হতে পারি না। ফোনালাপেও আমি তত পটু না। দীর্ঘক্ষণ ফোনালাপ চালিয়ে যাওয়া আমার জন্য কঠিন। আমার কথার স্টক অনেক কম। অল্প কয়েকজন মানুষের সাথে আমার ফোনে কথা হতো। আমি বেশি কোথাও যেতামও না। কয়েকজন মানুষের কাছে যেতাম যারা আমার স্বভাব চেনে। যারা কেউ আমাকে অগ্রাহ্য করে না। কোনো স্বার্থ নাই তাদের। তাদের সঙ্গ আমি উপভোগ করতাম।

কিন্তু একাকীত্ব আমাকে কুড়ে কুড়ে খেতো। এখনও খায়। এই যে ফিরে আসা তাতেও কিছু পরিবর্তন চোখে পড়ছে না। সবই এক। কোথাও নতুন কিছু নেই। একই মানুষ, একই রাস্তাঘাট, একই আইনকানুন, একই ঘরবাড়ি, একই লুকোচুরি, একই স্বার্থপরতা। কোথাও কোনো নতুনত্ব খুঁজে পাই না। কোথায় যে সুখ লুকিয়ে আছে জানি না। সুখ দুঃখ নিয়ে আমার অবশ্য কোনো আদিখ্যেতা নাই। এই যে আমি একটা উন্নত দেশে থাকি, অনেক নাগরিক উপভোগ, সুদৃশ্য রাস্তাঘাট, শপিং মল, দালানকোঠা, যখন যেখানে ইচ্ছা যেতে পারি, যা ইচ্ছা কিনতে পারি এসব ভেবে আমার কোনো ভিন্ন অনুভূতি কাজ করে না। রোবটিক জীবনে আমি ক্লান্ত। আমি যে বরিশাল থেকে ঢাকা এসেছিলাম, ঢাকা থেকে টরন্টো বা পৃথিবীর বড় বড় শহরের যেখানে যখন পা রাখি তখন আমার এক ধরণের ভিন্ন অনুভূতি হয় বটে কিন্তু আমার সমস্ত সত্তা, সমস্ত আবেগ জাড়িয়ে থাকে বরিশালের রাস্তায়, ঢাকার রাস্তায়। ঢাকা শহর দিয়ে যখন আমি চলি গন্তব্যে পৌঁছে আমার অদ্ভুত ভাললাগার অনুভূতি হয়। তীব্র ট্রাফিক, পলিউশিন, বিকট গাড়ির হর্ন, কোটি কোটি মানুষ এসব আমি তোয়াক্কা করি না। আমি অনেক সাধারণভাবে বেড়ে উঠেছি, অনেক অপ্রাপ্তি ছিল আমার জীবনে। সবারই থাকে। ওসব ভেবে আমার মোটেও মন খারাপ হয় না। ওসব জীবনেরই অংশ। তাই আমি যেখানেই যাই, যেখানেই থাকি, যেভাবেই থাকি আমার মনের কোনো পরিবর্তন হয় না। আমি সবসময় দুঃখী মানুষের পাশে থাকতে চেষ্টা করি। আমিও অনেক কষ্টে সৃষ্টে বড় হয়েছি। আমি সহজে কাউকে না বলি না। ফিরিয়ে দেই না। আমার মা আমাকে না ফেরাতে শিখিয়েছেন।

আমার সবচেয়ে অপছন্দ স্বার্থপর মানুষ। অবিশ্বাসী মানুষ। কিন্তু পৃথিবীতে বেশিরভাগ মানুষই স্বার্থপর। আত্মকেন্দ্রিক মানুষ। শুধু নিজেরটা বোঝে। নিজের ষোল আনা চাই। আমার চারপাশে এমন মানুষ যে নাই তা না। অনেক আছে। আমি নিজে কখনও অবিশ্বাসী কাজ করিনা। কথা দিয়ে কথার বরখেলাপ করিনা। নিজের ক্ষতি জেনেও যখন যাকে কথা দেই তা পালন করি। জীবনে বড় বড় ঝুঁকি নিয়েছি আমি। সেই ঝুঁকিগুলো হচ্ছে মানুষকে বিশ্বাসের ঝুঁকি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমি ঠকিনি। আমি জুয়া খেলতে পছন্দ করি। হারলে হারব। জেনে বুঝেই মানুষকে আমি বিশ্বাস করি এবং হারতে হারতে জিতে যাই। আমার এমন কিছু চেনা মানুষ আছে যারা আমার সাথে লুকোচুরি করে, পুরোপুরি আস্থায় আনতে পারে না। কিন্তু আমার হেল্প চায়। আমি এসব টের পাই। কিন্তু কিছু বলি না। তাদেরকে আমি আস্থায় নিয়ে চমকে দেই। ভাবতে বাধ্য করি, দেখো আমি নির্ভরশীল মানুষ। আমাকে বিশ্বাস করা যায়। আমার কারো কাছ থেকে কিছু চাওয়ার নাই। আমি জানি আমাকে লড়াই করে বাঁচতে হবে। লড়াই করে বাঁচতে আমি অভ্যস্ত। আমি এভাবেই বেড়ে উঠেছি। অনেক উজান ঠেলে বেড়ে উঠেছি। কেউ আমাকে টেনে নামাতে পারেনি। যারা চেষ্টা করেছে তারাই ধপাস হয়েছে। যারা কষ্ট দিয়েছে তারা সেটা ফেরত পেয়েছে। প্রকৃতি সবসময় আমাকে রক্ষা করে। আমার মায়ের দোয়া আমার সঙ্গী। আমার কিছু ভাল বন্ধু আছে বলেই পৃথিবী আজও সুন্দর। বেঁচে থাকা আনন্দের। নির্জনতার মধ্যেও এক ধরনের কোলাহল টের পাই।

টরন্টো ১২ মার্চ ২০২৩

বৃষ্টির ঘ্রাণ

আবার পুরনো জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। পুরনো নিয়মে বন্দী হয়ে গেছে জীবন। বেশ অনেকটা দিন বাংলাদেশে কাটিয়ে এসে আগের নিয়মে অভ্যস্ত হতে একটু সমস্যা হচ্ছে বটে কিন্তু সময় সবকিছু স্বাভাবিক করে দেয়। এখনও ঘুম ভাঙলে মনে হয় আমি মহাখালীর বাসায় শুয়ে আছি। নিজের চেনা বিছানাটা অচেনা লাগে। আরে মশাড়ি গেলো কই! এসির শব্দ পাচ্ছি না যে! বাইরে এতো শুনশান কেনো! মহাখালীতে সকাল হলেই লোকজনের কোলাহল, ফেরওিয়ালাদের হাক ডাক, ফজরের নামাজের সময় অবিরাম কুকরের ঘেউ ঘেউ, কর্পোরেশনের নারীদের রাস্তা ঝাট দেওয়ার ছরাত ছরাত শব্দ পাচ্ছি না তো! একটা আড় আড় ভাব এখনও আছে। একটা পিছুটান। কি যেনো ফেলে এসেছি। চোখ বন্ধ করলেই দৃশ্যের পর দৃশ্য ভেসে উঠে। বইমেলা, বাংলা একাডেমি, প্রেসক্লাব, রাস্তার জানজট, পদ্মাসেতু দিয়ে বরিশাল যাওয়া, বরিশাল ক্লাবের চেনা কক্ষ, মল্লিক বাড়ির গাছ গাছালি, মা বাবার কবর এইসব দৃশ্য। একেই হয়ত বলে এ্যাট হোম ফিলিং।

দেশ কেবলই টানে। আসার পর থেকেই মনে হচ্ছে কি যেনো নেই এখানে। কি যেনো থাকার কথা ছিল। এতো সুন্দর সাজানো গোছানো সবকিছু তারমধ্যেও একটা শূন্যতা বাদুরের মতো ঝুলে থাকে সারাক্ষণ। স্মৃতিরা কিলবিল করে মাথার মধ্যে। ঘোর ঘোর লাগে। দেশে গিয়ে দুই দফায় অন্ততঃ বিশ দিন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলাম। দুই তিনবার ডাক্তারের কাছে গিয়েছি। প্রতিবারই এমন হয়। এটা এমন কিছু না অবশ্য। রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকেছি, ধুলা বালি আর গাড়ির বিকট হর্ন মেনে নিয়েছি। এগুলোর মধ্যেই আমি বেড়ে উঠেছি তাই এসব আমার জন্য স্বাভাবিক ঘটনা। দেশে অনেকটা সময় নিঃসঙ্গ কাটিয়েছি বটে আবার অনেক আনন্দের মুহূর্তও ছিল। বন্ধুদের সান্নিধ্য আমাকে সবসময় সতেজ রেখেছে। কয়েকজন অতি প্রিয় বন্ধু আমার নিঃসঙ্গ সময়কে ভরিয়ে তোলার সবটুকু চেষ্টাই করেছে। তাদের কথা কখনো ভুলব না।

জানি বিদেশের এই শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। সংসারের মায়া এতোটাই দূর্নিবার যে এ মায়া ছিন্ন করা করা অসম্ভব প্রায়। এমন না যে সন্তানরা কাছে থাকে, এমন না যে মন চাইলেই তাদের সাথে দুটো কথা বলতে পারি, এমন না যে যখন তখন অরিত্রি বলবে বাবা চা বানাও আগে যেমন বলত, এমন না যে অর্ককে বলবে বাবা ঢাকার টোষ্ট দিয়ে চা খেতে ভাল লাগে, এমন না জেসমিন যখন তখন পাশে এসে বসে গল্পে মেতে উঠবে। ওসব এখন হয় কদাচিৎ। পুরো পরিবার একসাথে হওয়াটাই একটা লটারির মতো। সময় মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। একলা করে দেয়। এখানে এখনও শীতের প্রকোপ রয়ে গেছে। এটা একটা ডিপ্রেসিং ব্যাপার। আজকাল এমন হয়েছে কোন জীবনটা ভাল বুঝতে পারি না। প্রতিবার ছুটে যাই দেশে, আবার ফিরে আসি। দেশেও অনেক বিচ্ছ্ন্নিতা আছে। লোনলিনেস আছে। মানুষ অনেক একলা হয়ে গেছে। তারপরও আমার কাছে দেশের টানটা প্রবল। এই দেশকেও আমি ভালবাসি। এই দেশ অনেক দিয়েছে। এই বৈপরীত্য কিছুতেই ঘোচে না। এসব সত্ত্বেও দেশের মাটি আর বৃষ্টির একটা আলাদা ঘ্রাণ আছে। ওটাই টানে, শুধু টানে..

টরন্টো ২৪ মাচ ২০২৩

জসিম মল্লিক, লেখক ও সাংবাদিক, টরন্টো, কানাডা।