কলমবাজি

সাইদুল হোসেন

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

HAPPY MOTHER’S DAY!

আজ ক্যানাডার সর্বত্র মা ও তাদের সন্তানদের মাঝে উষ্ণ আনন্দময় মিলনের স্রোত বয়ে চলেছে। মায়ের প্রতি ভালোবাসার প্রতীক নানাবর্ণের ফুলের তোড়া এবং কিছু উপহারসামগ্রী (gifts), তৎসহ Happy Mother’s Day greeting card হাতে নিয়ে হাসিমুখে তাদের সন্তানেরা ভালোবাসা প্রকাশ করতে এবং মায়ের সাদর আলিংগণে তাদের আশীর্বাদ নিতে ছুটে চলেছে। মধুর মিলনদৃশ্য অভিনীত হচ্ছে দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে। Old Age Home, Long Term Care Home, Seniors’ Residences এমনকি হসপিটালে চিকিৎসাধীন মায়েরাও বাদ যাচ্ছে না। অপূর্ব প্রকাশ স্নেহের, ভালোবাসার। দেখতে যেমন ভালো লাগে, ভাবতেও মনে আলোড়ন জাগায়। মায়ের প্রতি ভালোবাসার জয় হোক!

মাদা’র্স ডে উপলক্ষে ফুল একটা বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে থাকে- সর্বত্র, সর্বদেশে। তাই বিভিন্ন স্টোরে, এমনকি শহরের রাস্তার মোড়েমোড়েও অগুনতি temporary flower-sellers-এর দেখা পাওয়া যায়। সবাই ফুল বিক্রি করে বেশ লাভবান হয় এই দিনে। ক্রেতা-বিক্রেতা দু’পক্ষই খুশী। আর কি চাই?

দুপুর বেলা। বাসার কাছের ফুড বেসিকস্ স্টোরে গেলাম ফুল কিনতে। তবে মায়ের জন্য নয়, তিনি তো এজগতের মায়া কাটিয়ে আমাদের ছেড়ে অন্য জগতে পাড়ি জমিয়েছেন ৫৩ বছর আগে- ১৯৭০ সনে। ফুল দেবো আমার সন্তানের মা-কে।

স্টোরের শেলফে রাখা ফুলগুলোর মাঝে উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের Daffodil-গুলোই সবার আগে চিত্তাকর্ষণ করে। ওখানেই ক্রেতাদের জটলা অধিক। প্রত্যেকেই তার পছন্দমত সৌন্দর্যময় অধিকসংখ্যক ফুলের pot-এর সন্ধানে ব্যস্ত। আমার পাশে দাঁড়ানো পঞ্চাশোর্ধ এক সাদা ক্যানাডিয়ান মহিলাকে উদ্দেশ করে বললাম, “Happy Mother’s Day!”

মলিন মুখে বললেন, “I’m not a mother. God has not given me any child. But I don’t complain, it’s His wish. But He has given me plenty of nephews and nieces to compensate. I’m happy with them. Thanks for wishing me Happy Mother’s Day!” শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল।

মায়ের প্রতি ভালোবাসার জয় হোক! ছবি : সংগৃহীত

এমন সময় এসে উপস্থিত এক চাইনীজ মহিলা, সংগে তার ১৪-১৫ বছরের একটি ফুটফুটে সুন্দরী মেয়ে। মহিলাকে বললাম, “Happy Mother’s Day!” তিনি হেসে বললেন, “Thank you. This is my daughter, God’s only gift to me.” বললাম, “God bless you, God bless her.”

ফুল কিনে ঘরে ফিরে এসে ঘটনা দু’টির বর্ণনা দিলাম ওয়াইফকে। আমার কথা শেষ হলে তিনি একটা ঘটনার বর্ণনা দিলেন। আমাদের বড় ছেলের মুখ থেকে শোনা। ওর বয়স এখন ৬৩ বছর। ঘটনাটা এরকম :

ওর স্কুল এবং কলেজ জীবনের এক সহপাঠিনী- বয়স ৬৩ বছর- ঢাকায় থাকে। একাকী জীবন, স্বামীর সংগে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে বহুদিন আগেই। ওদের একমাত্র সন্তান এক ছেলে। উচ্চশিক্ষিত, আমেরিকায় থাকে, বড় চাকরি, বড় বাড়ি, বড় গাড়ি। সবই ঠিক আছে তবে দুঃখজনক ঘটনা হলো এই যে ছেলেটা ওর মাকে দু’চোখে দেখতে পারে না। সে একবার আমেরিকায় গিয়েছিল ছেলের সংগে দেখা করতে। ছেলে তাকে বাসায় ঢুকতে দেয়নি, পুলিশ ডেকে বের করে দেয়। পুলিশ অফিসার তাকে বলেছিলেন, “Mum, it’s honorable that you leave your son alone because he doesn’t want to meet you. We can’t force him.”

মে ১৪, ২০২৩

ডারিয়া নামের বাংলাপ্রেমী শিশুটি

ডারিয়া (DARYA), মেয়ে। বয়স সাড়ে তিন বছর। নিউ ইয়র্ক সিটিতে নিজেদের বাড়িতে বাবা-মায়ের সংগে বাস করে। ডে-কেয়ার স্কুলে নিয়মিত যাতায়াত করে। মায়ের ফার্স্ট হাজব্যান্ডের পক্ষের এক বড় বোন আছে। বয়স আট বছর। দুই বোনে খুব মাখামাখি।

মা বাংলাদেশী। মুসলিম। ইন্জিনিয়ার। চাকরি করেন। বাবা রাশ্যান। ইন্জিনিয়ার। চাকরি করেন। ডারিয়ার মায়ের প্রতি ভালোবাসার টানে তিনি বিয়ের আগেই তার ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। একজন মুসলিম হিসেবে জীবনযাপন করছেন। তার ভাষা রাশ্যান এবং ইংলিশ।

ডারিয়ার নানা-নানী বাংলাদেশী। পেশাতে তাঁরা ডাক্তার। ধনবান। নিউ ইয়র্কে নিজেদের বাড়িতেই বসবাস করেন। দু’বাড়ি পাশাপাশি। সর্বক্ষণ এবাড়ি-ওবাড়ি যাওয়া-আসা চলে, খানাপিনা চলে- একই পরিবারের মত। ডারিয়া নানানানীর চোখের মণি- তাদের আদরের চাদরে ঢাকা।

ডারিয়া একটা রাশ্যান নাম যার অর্থ the sea (সাগর); kingly (রাজকীয়)। ডারিয়া খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে কারণ সে এই বয়সেই তিনটা ভাষায় স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারে।

বাবার সংগে রাশ্যান, স্কুলে গেলে ইংলিশ। মা-বোন ও নানানানীর সংগে বাংলা। বাংলা ভাষার প্রতি তার আকর্ষণ খুব প্রবল। ঘরের কেউ বা বাসায় ভিজিটরদের কেউ তার সংগে ইংলিশে কথা বলতে গেলে সে বাধা দেয়। বলে, “বাংলা বল!”

ভিজিটররা অবাক হয়। অবাক হয় ডারিয়ার মা এবং নানানানীও।

ওর নানীর মুখে ঘটনাটা শোনার পর অবাক হলাম আমরাও।

Black Angel

ব্ল্যাক এন্জেল? জী হ্যাঁ, ব্ল্যাক এন্জেল। গতরাতে ১০টার পর আকষ্মিকভাবেই তার দেখা পেয়েছিলাম। কি ঘটেছিলো? শুনুন তাহলে।

আমার দুই হাঁটু ও কোমরে arthritis-এর তীব্র ব্যথা কমাতে ডাক্তারের পরামর্শে প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় আমার walker-এ ভর দিয়ে ১০-১৫ মিনিট আমাদের কমিউনিটি রেসিডেনশিয়াল বিল্ডিংয়ের লম্বা corridor ধরে দুবেলা হাঁটার অভ্যাস করেছি। স্বামী-স্ত্রী আমরা দু’জন চারতলাতে বাস করি। সেই করিডোর ধরেই সচরাচর হাঁটি। কখনো কখনো নীচে একতলায় Lobby-তেও নামি সেখানে bulletin board-এ পিন দিয়ে আটকে রাখা নানা ধরনের ইনফরমেশনসহ বুলেটিনগুলো পড়ার উদ্দেশ্যে। অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে পারি সেগুলো পড়ে, নিজেকে updated রাখতে পারি। গতরাতেও লবীতে গিয়েছিলাম তবে রাতের বেলা, ঘুমাবার আগে।

লক্ষ্য করলাম, দু’টি বুলেটিন বোর্ডের একটাতে হলুদ রংয়ের একটা পৃষ্ঠাব্যাপী লেখা পিন দিয়ে আটকানো। গেলাম সেটার কাছে। সেটা পড়ে আমি খুবই মুগ্ধ হলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম যে এর একটা কপি করে ভবিষ্যতে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে নিজের কাছে রাখবো। কিন্তু কাগজ কলম তো চাই সেটা লেখার জন্য। তাই বাসায় ফিরে এসে একটা কলম ও বড় একটা সাদা কাগজ হাতে নিয়ে ফিরে এলাম। তারপর আমার walker-এর seat-এ বসে বুলেটিন বোর্ডে সাদা কাগজটা চেপে ধরে সেই বুলেটিনটা কপি করতে শুরু করলাম।

খুব অসুবিধাজনক পরিস্থিতি, তাই লেখার অগ্রগতিও মন্থর। লিখে যাচ্ছি। লবীটা জনশূন্য। রাত তখন সাড়ে ১০টা। খুব মনোযোগ দিয়ে লিখে যাচ্ছি। এমন সময় কানে এলো কোমল এক নারী কণ্ঠ। সে পেছন থেকে আমাকে জিজ্ঞাসা করছে, “What are you trying to copy at this hour of the night, Papa?”

চমকে উঠলাম। পেছন ফিরে তাকালাম। দেখলাম আমাদের এই বিল্ডিংয়ে বসবাসকারী শারীরিকভাবে পংগু ও অসহায় tenant-দের সাহায্যকারিণী PSW (Personal Support Worker) এক ইয়াং লেডি দাঁড়িয়ে আছে, ইউনিফর্ম গায়ে, facemask-এ সম্পূর্ণ মুখটা ঢাকা, a very black skin African girl. ওর রাতের ডিউটি শেষ করে সে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।

ওকে আমি চিনি যদিও চেহারা দেখিনি কোনদিন COVID-19 Pandemic-এর facemask-এর কারণে। নামও জানি না। জানি না কোন দেশের মেয়ে সে।

বললাম, “I am trying to copy this bulletin.”

আমার কথা শেষ হলে সে বোর্ডের কাছে গিয়ে বুলেটিনটা একবার পড়ে নিলো। বললো, “Very nice indeed! But please don’t try to copy it. It’s very painful for you. I’ll get you photocopies from our office photocopier. Wait for me.” একথা বলেই সে সেই বুলেটিনটার পিনগুলো টেনে বের করে সেটা হাতে নিয়ে ওদের PSW office-এর দিকে হাঁটা দিলো।

কয়েক মিনিট পর ফিরে এলো। বুলেটিনটা পিন দিয়ে যথাস্থানে আটকে দিয়ে আমার দিকে ফিরে বললো, “Here are five copies for you. I have taken a copy for myself. It’s late in the night already. Go home now and take rest. But would you please tell me what you gonna do with this?”

বললাম, “This bulletin carries a very positive, powerful, and encouragaing message. I’ll distribute copies of it among our children, relations, and others for their enlightment.”

মেয়েটি তখন বললো, “I’ll do so too. Thank you. Good night, Papa.”

আমাকে সাহায্য করার জন্য ওকে “Many thanks” জানানোর পর জিজ্ঞাসা করলাম,  “May I ask for your name, young lady?”

বললো, “Very simple and easy- MAUREEN.” এই গভীর রাতে নির্জন স্থানে এত বড় একটা সাহায্য পাবো সেটা ছিলো কল্পনারও অতীত। তাই কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললাম, “God sent you at the right moment to help me. You have made my task so easy without my asking. I am so grateful to you. You are an angel, Maureen. God bless you.”

মাথাটা একটু নীচু করে একটা bow করে Maureen বিনীত কণ্ঠে বললো, “No angel, just an ordinary human, sir.”

তারপর আমাকে আবার Good night জানিয়ে ধীর পায়ে বিল্ডিংয়ের main entrance দিয়ে বের হয়ে গেল।

আমাদের এই কথোপকথনের মাধ্যমে আমার বুঝতে কোন কষ্ট হলো না যে ঘোর কালো আফ্রিকান চামড়ার নীচে আলোকিত একটা হৃদয় নিয়ে বাস করে সে। এবং সে যথেষ্ট শিক্ষা, উদারতা এবং সৌজন্যের অধিকারিণীও বটে। পরোপকারিতা গুণটা ওর স্বভাবজাত।

বাসায় ফিরে বুকশেলফ থেকে A Dictionary of Christian Names বইটা খুলে দেখলাম যে অতি পরিচিত MARY নামটারই Irish variant হচ্ছে MAUREEN. ভবিষ্যতে দেখা হলে জানতে চেষ্টা করবো মূলতঃ সে কোন দেশের মেয়ে।

এখন যেটাকে কেন্দ্র করে আমার এই লেখা সেই বুলেটিনটার বা বর্ণনাটার একটা কপি নীচে ছেপে দিলাম। পাঠক, এবার আপনিই বিবেচনা করুন, আপনার জন্য এখানে কোন message আছে কি?

Life is …
Life is a gift accept it
Life is a mystery unfold it
Life is a puzzle solve it
Life is a song sing it
Life is a beauty praise it
Life is a game play it
Life is a promise fulfill it
Life is a goal achieve it
Life is an opportunity take it
Life is an adventure dare it
Life is a duty perform it
Life is a challenge meet it
Life is a struggle fight it
Life is a sorrow overcome it
Life is a tragedy face it
Life is a journey complete it

দাদীর জন্য ফুল

মা-বাবা পরিত্যক্ত হতভাগা একটি শিশুর করুণ কাহিনী।

ঘটনাস্থল : একটি ক্রিশ্চান চার্চ

বর্ণনাকারী : একজন পাদ্রী (Pastor John R. Ramsey)

স্বয়ং পাদ্রীর মুখ থেকেই শুনুন-

প্রতি বরিবার চার্চে sermon দিতে যাওয়ার আগে আমাকে একব্যক্তি নিয়মিত আমার coat-এর lapel-এ গুঁজার জন্য ছোট্ট একটা গোলাপ ফুল দিতো। নিয়মিত পেতে পেতে এমনি অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিলাম যে এতে কোন বৈশিষ্ঠ্য অথবা বৈচিত্র্য অনুভব করতাম না। Just routine. কিন্তু এক রবিবার সেই ছোট্ট গোলাপ ফুলটাই বিশেষ তাৎপর্যময় (special) হয় উঠলো।

রবিবার। Sermon শেষ করে চার্চ থেকে বের হতে যাচ্ছি এমন সময় বছর দশেক (কিছু কমও হতে পারে) বয়সের একটি ছেলে আমার কাছে এসে বিনীত স্বরে বললো, “স্যার, আপনার কোটে লাগানো গোলাপ ফুলটা তো আপনি ফেলেই দেবেন?”

ওর প্রশ্ন শুনে আমি হেসে দিলাম। বললাম, “চাইলে তুমি এটা পেতে পারো, কিন্তু কি করবে তুমি এটা দিয়ে?”

আশান্বিত দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছেলেটি জবাব দিলো,

“স্যার, ফুলটা আমি আমার দাদীকে (grandma-কে) দেবো। এক বছর আগে বাবা-মা divorce হওয়ার পর আমি মায়ের সংগে থাকতাম। কিন্তু মা আবার বিয়ে করার পর মায়ের নতুন সংসারে আমার আর স্থান হলো না। মা বললো, “তুই এখন তোর বাবার কাছে যা।” গেলাম বাবার কাছে। কিছুদিন পর বাবা বললো, “আমার সংগে আর তোর থাকা হবে না, তুই তোর grandma’র ওখানে গিয়ে থাক।”

“কি আর করি? গেলাম দাদীর কাছে। দাদী খুব ভালো, কত যে আদর করে আমাকে! আমাকে রান্না করে খাওয়ায়, আমার যত্ন করে। আমি দাদীকে খুব ভালোবাসি। ফুলটা পেলে সেটা আমি আমার দাদীকে দেবো।”

বাচ্চাটার কাহিনী শুনতে শুনতে আমি বেদনাহত হয়ে কাঁদতে লাগলাম, কষ্টে আমার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়তে লাগলো।

আমি আমার কোট থেকে খুলে ফুলটা বাচ্চাটার হাতে দিতে দিতে বললাম, “Son, that is the nicest thing I have ever heard, but you can’t have this flower because it’s not enough.”

তারপর তাকে বললাম, আমি যেখানে দাঁড়িয়ে sermon দিচ্ছিলাম সেখানে যাও। দেখবে অনেকগুলো তাজা ফুল দিয়ে সাজানো ফুলের একটা বড় তোড়া (bouquet). সেখান থেকে সেই তোড়াটা নিয়ে যাও, তোমার দাদীকে দাও because she deserves the very best.

আমার বক্তব্য শেষ হলে উৎফুল্ল স্বরে ছেলেটি বলে উঠলো, ”What a wonderful day! I asked for one flower but got a beautiful bouquet.”

Note: Collected and translated from pages 32-33 of ÒA 2nd Helping of Chicken Soup for the Soul” authored by Jack Canfield and Mark Victor Hansen (1993) USA.

এপ্রিল ১৬, ২০২৩

সমাপ্ত

সাইদুল হোসেন। মিসিসাগা