মানবাধিকার কমিশন নিজেই তার কৃষ্ণাঙ্গ কর্মচারীদের প্রতি বৈষম্য করেছে !

কানাডা সরকারের মানবসম্পদ বিষয়ক দপ্তর দ্য ট্রেজারি বোর্ড অব কানাডা সেক্রেটারিয়েট (TBCS) এমনই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। মানবাধিকার কমিশনের নয়জন কর্মচারী তাদের ইউনিয়নের মাধ্যমে ২০২০ সালের অক্টোবরে নীতিগত বিষয়ে অভিযোগ জানানোর পর ট্রেজারি বোর্ড ওই মন্তব্য করে। কর্মচারীদের ক্ষুব্ধ অভিযোগে বলা হয়, কানাডিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনে (CHRC) কৃষ্ণাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গ কর্মীরা কৃষ্ণাঙ্গ-বিরোধী প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ, যৌন হয়রানি ও প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের শিকার হন।

ট্রেজারি বোর্ডের অ্যাসোসিয়েট অ্যাসিস্ট্যান্ট ডেপুটি মিনিস্টার ক্যারোল বাইডাল অভিযোগ সম্পর্কে তার আনুষ্ঠানিক রুলিংয়ে বলেন, “আমি ঘোষণা করছি যে, মানবাধিকার কমিশন আইনের চর্চাকারীদের যৌথভাবে সম্মত ‘বৈষম্যহীনতার’ ধারা লংঘন করেছে।”

কেন্দ্রীয় সরকারি খাতের আরও তিনটি প্রধান ইউনিয়ন -দ্য অ্যাসোসিয়েশন অব জাস্টিস কাউন্সেল, দ্য পাবলিক সার্ভিস অ্যালায়েন্স অব কানাডা এবং দ্য কানাডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব প্রফেশনাল অ্যামপ্লয়িজÑ একই রকম অভিযোগ দায়ের করে এবং তারাও একই সিদ্ধান্ত পেয়েছে। সবগুলো অভিযোগেই মূলত মানবাধিকার কমিশনে কৃষ্ণাঙ্গবিরোধী বর্ণবাদের বিষয় তুলে ধরা হয়।

ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের সময় প্রতিবাদকারীরা অটোয়ায় পার্লামেন্ট ভবনের কাছে স্লোগান দেয়। ছবি: এড্রিয়ান ওয়াইল্ড/দি কানাডিয়ান প্রেস

কমিশন নিজেকে কানাডায় মানবাধিকারের পাহারাদার বলে দাবি করে। কমিশন ফেডারেল সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থা, রাজকীয় করপোরেশন এবং ব্যাংক, বিমান সংস্থা ও টেলিকমিউনিকেশন্স-এর মত বহু সংখ্যক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে আসা অভিযোগ গ্রহণ ও তদন্ত করে। কমিশনই সিদ্ধান্ত দেয় কোন ঘটনাগুলি কানাডার মানবাধিকার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হবে।

সিবিসি নিউজ গত মার্চে দেয়া উল্লেখিত রুলিংয়ের কপি পেয়েছে, সেগুলি পর্যালোচনা করেছে এবং মানবাধিকার কমিশনে কর্মরত ও প্রাক্তন কর্মচারীদের বিভিন্ন দলের সঙ্গে কথা বলেছে।

তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, মানবাধিকার কমিশন এমন একটি কর্মস্থল যেটিকে তারা বলেন, বৈরী এবং জাতিগত বর্ণবাদে নিমজ্জিত এবং কৃষ্ণাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গ কর্মচারীদের ক্যারিয়ার ও প্রশিক্ষণের সুযোগ থেকে বাদ দেয়া হয়, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সমস্ত নেটওয়ার্ক থেকে তাদেরকে বাইরে রাখা হয়। তারা দাবি করেন যে, কৃষ্ণাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গ কর্মচারীদের ক্যারিয়ার স্থবির হয়ে থাকে কিন্তু শ্বেতাঙ্গ সহকর্মীদের কর্মজীবনে আগেভাগেই উন্নতি হয়। তারা বলেন, ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উচ্চতর পদগুলি প্রধানত শ্বেতাঙ্গদের জন্য রাখা হয়।

সিবিসির সঙ্গে কথা বলেছেন যেসব কর্মরত ও প্রাক্তন কর্মচারী তারা বলেন, তাদেরকে স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও ভুগতে হয়েছে।

কমিশনে নীতিগত বিষয়ের উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেছেন বারনাডেথ বেচি। পরে তিনি সরকারের আরেকটি দপ্তরের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি হিসাবে কমিশন ছেড়ে যান। তিনি বলেন, “আমি বলবো, কানাডার মানবাধিকার কমিশনের পরিবেশ, কর্মস্থল হিসাবে এটি দূষিত ও বিষাক্ত।”

“এটি আমার মানসিক ও শারীরীক স্বাস্থ্য ও কল্যাণের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। আর আমি একাই ভুক্তভোগী ছিলাম না।”

কমিশনের চাকরিতে যোগ দেবার আগে বেচি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে রাজনীতি বিষয়ক কর্মকর্তা হিসাবে কাজ করেন।

তিনি বলেন, মাসের পর মাস তাকে উদ্বেগের মধ্যে এবং নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়েছে, যেজন্যে তাকে অসুস্থতাজনিত ছুটি এবং চিকিৎসা নিতে হয়েছে। বর্তমান ও সাবেক কর্মীরা ভয় পাচ্ছিলেন যে কর্মস্থলে তাদেরকে প্রতিশোধপরায়ণতা, ক্যারিয়ার নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং বাড়তি বৈরিতার মুখে পড়তে হতে পারে। তাই সিবিসি নিউজ তাদের পরিচয় প্রকাশ না করতে সম্মত হয়।

এসব কর্মচারী বলেন, কমিশনের কর্মচারীরা কৃষ্ণাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গ কর্মচারীদের প্রায়ই অবমাননা ও অপমান করে। তারা জানায়, তারা জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ ব্যাপক হারে নাকচ করে দেয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, এ ধরণের অভিযোগ তদন্তের জন্য কমিশন অনেক সময় এমন তদন্তকারীদের দায়িত্ব দিতো যাদের বর্ণবাদ বিষয়ক অভিযোগ তদন্তের প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাব ছিল।

সিবিসির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একজন কর্মচারী বলেন, “বোধগম্য কারণেই কমিশন জনগণের কাছ থেকে আসা যৌন হয়রানি এবং লৈঙ্গিক বৈষম্যের অভিযোগ তদন্তে কখনই শুধু পুরুষদের নিয়ে কোনও তদন্ত দল গঠন করে না।”

“অথচ তার পরও, বেশ কয়েক বছর ধরে কানাডার জনগণের পক্ষ থেকে আসা জাতিগত সমস্ত অভিযোগ তদন্তের জন্য একচেটিয়াভাবে কেবল শ্বেতাঙ্গ কর্মচারী এবং ম্যানেজারদের নিয়োগ করেছে।”

বর্তমান ও সাবেক কর্মচারীরা বলেন, অশ্বেতাঙ্গ কর্মচারীরা কোনও পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করলে তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হতো এবং তাদের পরামর্শ উপেক্ষা করা হতো।

তারা স্মরণ করেন সেইসব ঘটনার কথাও যখন বর্ণবাদবিষয়ক অভিযোগ নিয়ে আলোচনার মিটিং থেকে হঠাৎ তাদের বের করে দেয়া হয়েছে অথবা আমন্ত্রণই জানানো হয়নি।

সিবিসির পক্ষ থেকে মানবাধিকার কমিশনের নির্বাহী পরিচালক ইয়ান ফাইন এবং অন্তর্বর্তী চিফ কমিশনার শার্লটি-অ্যান ম্যালিশেভস্কির সাক্ষাৎকার চাওয়া হয়েছিল। কমিশন সাক্ষাৎকার দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

এক বিবিৃতিতে ম্যালিশেভস্কি বলেন, আমরা (ট্রেজারি বোর্ডের) উদঘাটিত তথ্যাবলি ও সুপারিশমালা মেনে নিয়েছি এবং একটি অর্থবহ ও সম্মানজনক সমাধানে পৌঁছার জন্য অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে উদার থাকি।”

বিবৃতিতে বলা হয়, “এটি এখনও চলমান বিষয় বলে এবং দর কষাকষিকারী এজেন্ট এবং তাদের সদস্যদের সম্মানের দিকে তাকিয়ে আমরা এই মুহূর্তে ট্রেজারি বোর্ডের ওই সিদ্ধান্তের বিস্তারিত নিয়ে মন্তব্য করতে পারি না। আমরা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি এবং বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ও এক্ষেত্রে অর্থবহ পদ্ধতিগত

পরিবর্তন আনার ব্যাপারে গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছি।”

বিচার বিভাগের মন্ত্রী ডেভিড লামেত্তি বলেন, চলতি সপ্তাহের আরও আগের দিকে পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয় নিয়ে ভারপ্রাপ্ত কমিশনারের সঙ্গে তার “খোলামেলা আলোচনা” হয়েছে।

এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, মানবাধিকার কমিশনের দায়িত্বের প্রেক্ষিতে ট্রেজারি বোর্ডের রায় “একইসঙ্গে উদ্বেগজনক ও হতাশাব্যঞ্জক।”

সিবিসিকে দেয়া বিবৃতিতে লামেত্তি বলেন, “চিফ কমিশনারের পদ শূন্য তাই আমরা কমিশনে নতুন নেতৃত্ব নিয়োগের জন্য কাজ করছি।” তিনি বলেন, নতুন নেতৃত্বের দায়িত্বের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে ট্রেজারি বোর্ডের রায় নিয়ে কাজ করা। 

কৃষ্ণাঙ্গ সরকারি কর্মচারীদের প্রতিনিধিত্বকারী গ্রুপ ফেডারেল ব্ল্যাক অ্যামপ্লয়ী ককাস বিবৃতি দিয়ে বলেছে, তারা আশা করে যে, এরপর “প্রয়োজনীয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন” আনার পদক্ষেপ নেয়া হবে।”

সংশ্লিষ্ট একটি কর্মচারী ইউনিয়ন বলেছে, ট্রেজারি বোর্ডের রায় কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা খর্ব করেছে।

জাস্টিস কাউন্সিল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যাকনেয়ার্ন বলেন, “আশঙ্কা করি যে, কানাডীয়রা কমিশনের ওপর বিশ্বাস ও আস্থা হারিয়ে ফেলবে। সত্যি যদি কমিশন নিজেই বৈষম্যমূলক আচরণ করে তাহলে বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে কমিশন তাদের রক্ষা করবে কানাডীয়দের পক্ষে এমন ভরসা রাখার সম্ভাবনা কোথায়?”

কমিশনের সাবেক ও বর্তমান যেসব কর্মচারী সিবিসির সঙ্গে কথা বলেছেন, তারা কৃষ্ণাঙ্গবিরোধী বর্ণবাদের বিষয়টি সামনে রেখে স্বাধীনভাবে কমিশনের কর্মপরিবেশ পর্যালোচনার দাবি জানান।

তারা বলেন, ওই পর্যালোচনায় কৃষ্ণাঙ্গ কর্মচারীদের ক্ষেত্রে কমিশনের নিয়োগ, পদোন্নতি, এখানে চাকরির মেয়াদ ইত্যাদি পরীক্ষা করতে হবে এবং চূড়ান্ত রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। তারা বলেন, পর্যালোচনা হতে হবে কৃষ্ণাঙ্গবিরোধী বর্ণবাদ বিষয়ে দক্ষতা আছে এমন একজন স্বনামধন্য তদন্তকারীকে দিয়ে।

তারা মানবাধিকার কমিশনের মধ্যস্থতার ভূমিকা বাতিল করে কানাডার নাগরিকদেরকে সরাসরি মানবাধিকার ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়েরের সুযোগ দেয়ারও দাবি জানান।

কর্মচারীরা বলেন, মানবাধিকার কমিশন বন্ধ করে দেয়া উচিৎ

তারা একথাও বলেন যে, এসব পদক্ষেপ নেয়া না হলে অশ্বেতাঙ্গ কানাডীয় এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার কমিশনের মাধ্যমে ন্যায়বিচার চাওয়ার ব্যাপারটা ভুলে যেতে হবে।

বেচি বলেন, “আমি কোনও কৃষ্ণাঙ্গ, অশ্বেতাঙ্গ অথবা ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনও সদস্যকে মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ পেশ করার সুপারিশ করি না। সংস্থাটিকে আমি কতটা বিষাক্ত মনে করি এটা তার নমুনা।”

কতিপয় কৃষ্ণাঙ্গ সরকারী কর্মচারী কেন্দ্রীয় সরকারকে আদালতে অভিযুক্ত করার পর এই তদন্তের ফল প্রকাশ পায়।

ওই কর্মচারীরা কর্মক্ষেত্রে পদ্ধতিগত বর্ণবাদ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাবজনিত মানসিক ও অর্থনৈতিক ভোগান্তির জন্য কৃষ্ণাঙ্গ ফেডারেল কর্মচারীদের ক্ষতিপূরণ দেবার জন্য ক্লাস অ্যাকশন মামলা রুজুর বিষয়ে বিচারকের অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছিলেন।

প্রস্তাবিত ক্লাস অ্যাকশন মামলায় বেচিও একটি পক্ষ।

অভিযোগকারীরা কেন্দ্রীয় সরকারের জনশক্তিতে বৈচিত্র্য আনার একটি পরিকল্পনা এবং কর্মসংস্থানে সাম্য রক্ষার আইন যেসব বাধা দূর করতে পারেনি সেগুলি অপসারণেরও দাবি জানান।

কেন্দ্রীয় সরকার দাবিটি খারিজ করার জন্য আদালতকে বলেছিল। সরকারের যুক্তি ছিল, কৃষ্ণাঙ্গ কর্মচারীরা তাদের ইউনিয়ন অথবা মানবাধিকার কমিশনের মত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিকার চাইতে পারে।