কানাডার বাইরে গিয়ে বিপদে পড়েছেন? সরকার আপনাকে উদ্ধারে বাধ্য নয়
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : সম্প্রতি সুদান থেকে কানাডীয়দের সরিয়ে আনার বিষয়টি বিদেশে বিপদে পড়া নাগরিকদের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বাধ্যবাধকতা ও তাদেরকে সহায়তা করার মত সক্ষমতার বিষয়ে কিছু তিক্ত প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।
সম্প্রতি কানাডা সুদান থেকে ২৫০ জন কানাডীয়কে সরিয়ে আনে। দেশটি এই মুহূর্তে নতুন করে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। অটোয়া জানায়, কিছু কানাডীয়কে সরিয়ে আনা হয় মিত্র দেশগুলোর ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত বিমানের ফ্লাইটে, আর ১১৭ জন কানাডীয়কে রয়েল কানাডিয়ান এয়ারফোর্সের পরিবহন বিমানে করে সরিয়ে আনা হয়। এই অপসারণের কাজ সম্পন্ন করতে সহায়তার জন্য কানাডার সেনা মোতায়েন করা হয়। খবর রিচার্ড রেক্রাফ্ট – সিবিসি নিউজ এর।
সুদানে অবস্থানরত কানাডীয় ও তাদের স্বজনদের কাছ থেকে কানাডা সরকার সহায়তার বহু অনুরোধ পেয়েছে।
কিন্তু সরকার যদিও এখন সুদান থেকে কানাডীয়দের সরিয়ে আনছে, কিন্তু অতীতে সরকার এমন যুক্তি দেখিয়েছে যে, আসলে এটা করার কোনও দরকার নেই।
অটোয়া ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক ইয়েভে লে বুথিলিয়ার কানাডার সিবিসি নিউজকে এক ই-মেল বার্তায় বলেন, “প্রথাগতভাবে, কানাডা সরকার এমন অবস্থান গ্রহণ করে যে, বিদেশ থেকে কানাডীয়দের ফিরিয়ে আনার কোনও দায় সরকারের নেই।”
স্বাধীনতা ও অধিকার সনদের ৬(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কানাডার যে কোনও নাগরিকের কানাডায় “প্রবেশ করার, অবস্থান করার এবং দেশত্যাগের অধিকার আছে।”
এই অধিকার কোনওভাবেই বলে না যে, বিশ্বের কোথাও বিপদে পড়লে সরকার কানাডীয়দের উদ্ধার করতে বাধ্য।
লে বুথিলিয়ার বলেন, “কানাডা সরকারের অন্তত এতটুকু আইনগত বাধ্যবাধকতা আছে যে, বিদেশ থেকে কোনও কানাডীয়র স্বদেশে প্রবেশে তারা বাধা দিতে পারবে না।”
কানাডীয়দের দেশে ফেরানোর ব্যাপারে সরকারের দায় আছে কিনা সেই প্রশ্ন এখন আদালতের বিবেচনায় রয়েছে।
চলতি বছরের আরও আগের দিকে কেন্দ্রীয় আদালত রুলিং জারি করে যে, কানাডাকে অবশ্যই সিরিয়া থেকে চারজন কানাডীয় নাগরিককে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারের অনীহা ছিল কারণ লোকগুলো সন্ত্রাসবাদী গ্রুপ আইএসআইএস-এ যোগ দিয়েছিল বলে সন্দেহ ছিল।
সরকার আদালতের সিদ্ধান্তের বিষয়ে আপিল করে। আপিলের নোটিশে সরকার বলেছে, “প্রত্যাবর্তনের অধিকার” সৃষ্টিতে ফেডারেল কোর্টের বিচারক “কার্যকর” ভুল করেছেন।
লে বুথিলিয়ার বলেন, ফেডারেল আপিল কোর্টের বিচারক কয়েক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।
অপসারণ কানাডার কূটনৈতিক, সামরিক সক্ষমতার পরীক্ষা
বিদেশে অবস্থানরত নাগরিকদের সরিয়ে আনার কোনও দায় আছে বলে কানাডা সরকার বিশ^াস না করলেও, বিশেষ করে কোনও দেশে যুদ্ধ, গুরুতর বেসামরিক উত্তেজনা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ পরিস্থিতিতে আটকে পড়া কানাডীয়দের জন্য সচরাচর তারা এটা করে থাকে।
তবে সরকার সাহায্য করতে চাইলেও এক্ষেত্রে কিছু বাস্তব সমস্যা সামনে চলে আসতে পারে।
পররাষ্ট্র বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতে, অপসারণ অভিযানের জন্য প্রায়শ কূটনৈতিক বিচক্ষণতা ও সামরিক সম্পৃক্ততার প্রয়োজন হয়। নাগরিকদের সরিয়ে আনার ব্যাপারে কানাডার সক্ষমতা নির্ভর করে অনেকগুলি ফ্যাক্টরের ওপর, যার মধ্যে আছে ভৌগোলিক অবস্থান, যে দেশে নাগরিকরা বিপদে পড়েছে সেটির সঙ্গে কানাডার কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং কানাডীয় অথবা মিত্র দেশের সামরিক সম্পদের প্রাপ্যতা।
কানাডিয়ান গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স ইন্সটিটিউটের ফেলো ও সাবেক কানাডীয় রাষ্ট্রদূত কলিন রবার্টসন বলেন, বিদেশে কানাডীয় দূতাবাসগুলি সম্ভাব্য বিপজ্জনক এলাকায় বাস করা কানাডীয় নাগরিকেদেরকে দূতাবাসে নাম তালিকাভুক্ত রাখতে বলে যাতে বিপদ এলে সাহায্য করা যায়।
রবার্টসন বলেন, মাত্র পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ নাগরিক এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন, আর যখন বিপর্যয় আসে তখন দেখা যায় তালিকাটি পুরোই তামাদি হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, সঙ্কটের সময় কূটনীতিকরা অপসারণ করার জন্য বিমান উড্ডয়নের অনুমতি পাওয়া, মিত্রদের সঙ্গে কাজ করা এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার ওপর গুরুত্ব দেন।
এসব কাজে সংশ্লিষ্ট দেশে জোরালো কূটনৈতিক উপস্থিতির প্রয়োজন হয়, রবার্টসন বলেন, এটি কানাডার পক্ষে সব সময় নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না।
তিনি বলেন, “প্রায় ২০ বছর ধরে আমরা আমাদের কূটনৈতিক সামর্থ্য বাড়ানোর প্রয়াস নিইনি। বস্তুত আমরা এটি সংকুচিত করেছি।”
রবার্টসন বলেন, বছরের পর বছর কানাডা কূটনৈতিক কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি করলেও কনসুলার সহায়তার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় এই সংখ্যা যথেষ্ট ছিল না। তিনি বলেন, এর কারণ কানাডার জনসংখ্যায় অনেক বেশি বৈচিত্র্য এসেছে এবং কানাডীয়রা আগের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় ভ্রমণ এবং বিদেশে বসবাস করছে।
রবার্টসন বলেন, “এটি কি যথেষ্ট পরিমাণে বেড়েছে? আমরা বিষয়টি সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে বিচার করে দেখতে পারি এবং আপনি সম্ভবত নেতিবাচক উপসংহারে পৌঁছবেন। আমাদেরকে আরও বেশি জোর দিতে হবে, আর এর অর্থ হলো আরও জনবল নিয়োগÑ চরম পরিস্থিতির জন্য সামরিক ভাষায় ময়দানে আরও বেশি সেনা নিয়োগ।”
কানাডীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর-জেনারেল ডেনিস থমসন বলেন, বিদেশে আটকে পড়া নাগরিকদের উদ্ধারের সময় সেনাবাহিনী নানা ধরণের সমস্যার মুখে পড়ে।
থমসন বলেন, “অন্টারিওর ট্রেনটনে আমাদের মূল বিমান ঘাঁটি থেকে সুদান ১১,০০০ কিলোমিটার দূরে। সুতরাং মনে রাখতে হবে, আমাদের কিছু মিত্র দেশের মত বিদেশের মাটিতে কানাডার কোনও স্থায়ী ঘাঁটি নেই।”
“হাইতিতে কোনও ঘটনা ঘটলে আমরা রাতারাতি সেখানে পৌঁছতে পারি। কিন্তু ঘটনা হাইতিতে নয়, ঘটছে সুদানে, আর সেটি এখান থেকে অনেক দূরে।”
থমসন বলেন, বিশ^জুড়ে সেনা নেটওয়ার্ক কৌশলগত চ্যালেঞ্জ সামলে নেয়া সহজতর করলেও এর ব্যয় কানাডার জনগণের জন্য হবে বিশাল। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মত ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেশের ওপর নির্ভর করা কানাডার জন্য যথার্থ। ওই দেশগুলো বিশ^জুড়ে ঘাঁটি আছে।
সরকার বলেছে, তারা সুদান থেকে অপসারণ কাজে কানাডিয়ান এয়ার ফোর্সের ২০০-র মত সেনা সদস্যকে নিযোগ করে। কিন্তু একজন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার এক ব্রিফিংয়ে বলেন, সরকারের হিসাবে অভিযানে নিযুক্ত বিমানের ক্রু, স্পেশাল ফোর্সের সদস্য অথবা নৌবাহিনীর কর্মীদের ধরা হয়নি।
এদিকে চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল ওয়েইন আয়ার সম্প্রতি সেনাবাহিনীর সার্বিক অপারেশনাল প্রস্তুতি বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও থমসন বলেন, এধরণের অপারেশনের ব্যাপারে সিএএফ ভালোভাবেই প্রস্তুত।
থমসন বলেন, “সেনাবাহিনী সংঘাতমুক্ত অপসারণ অভিযান পরিচালনায় প্রতি মুহূর্তের জন্য একটি কোম্পানি প্রস্তুত রাখে। এরা দুর্যোগ সহায়তা ত্রাণ দল হিসাবে কাজ করে। বিমান ব্যবহারের প্রয়োজন হলে আরসিএএফ একই ধরণের কাজ করে।”
তবে রবার্টসন বলেন, বিশেষ করে যখন দেশের জনসংখ্যার বৈচিত্র্য বাড়ছে এবং বিশ^ অধিকতর বিপজ্জনক হয়ে উঠছে সেই সময় বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সঙ্কটে সাড়া দেবার ক্ষেত্রে কানাডার সক্ষমতা নিয়ে তিনি চিন্তিত।
তিনি বলেন, “আমাদের সম্ভবত ময়দানে আরও বেশি জনবল দরকার।”
“দেশ হিসাবে আমাদের বিকাশ এবং ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ এই দুটোই সামলানোর সক্ষমতা আমাদের থাকা দরকার।”