কানাডার নতুন রাজার সামনে চ্যালেঞ্জ

ক্যারিবিয় দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপ রাষ্ট্র বার্বাডোস ২০২১ সালের নভেম্বরে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের কবল থেকে বের হয়ে আসছিল, তখন সেখানে রাজকীয় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন প্রিন্স চার্লস। ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতার ৫৫ বছর পর সেই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশটি সংসদীয় প্রজাতন্ত্র হিসেবে নতুন পথচলা শুরু করেছিল। সেই সময়ে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের পরিবর্তে বার্বাডোস নতুন রাষ্ট্রপ্রধান নিযুক্ত করে। ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে চার্লস সেদিন তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘অতীতের অন্ধকারতম দিন এবং দাসত্বের ভয়ঙ্কর নৃশংসতার পরও এই দ্বীপের মানুষ অসাধারণ দৃঢ়তার সঙ্গে তাদের পথ তৈরি করেছে। মুক্তি, স্বশাসন এবং স্বাধীনতা আপনাদের পথ। স্বাধীনচেতা, ন্যায়বিচার এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ আপনাদের পথপ্রদর্শক।’

তাঁর বক্তব্যে সেদিন দর্শকরা মুগ্ধ হয়েছিলেন। সেই প্রিন্স চার্লস এখন বৃটেনের রাজা। তার মা রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর তিনি দেশটির রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। একই সাথে তিনি কানাডারও রাজা। সম্প্রতি বাকিংহাম প্রাসাদে সাত দশকের মধ্যে প্রথম রাজ্যাভিষেকে নম্র স্বভাবের নতুন রাজা বলেছেন: ‘সেবা নিতে আসিনি; সেবা করতে এসেছি।’

ব্রিটেনের রাজা হিসেবে অভিষেক হয় তৃতীয় চার্লসের । ছবি: এএফপি

কিন্তু সেই চার্লস এখন এমন একটি কমনওয়েলথের প্রধান হিসেবে ভূমিকা রাখতে যাচ্ছেন, যার প্রাসঙ্গিকতাও দ্রুত ম্লান হয়ে যাচ্ছে। বছর দেড়েক আগে দ্বীপরাষ্ট্র বার্বাডোস নিজেদেরকে প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত করে নিয়েছে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মানুষও রাজতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করছে।

গত মাসে পরিচালিত Angus Reid Institute এর এক জরিপে দেখা গেছে বেশীরভাগ কানাডিয়ান (৬০%) রাজা হিসাবে চার্লসকে পছন্দ করছেন না। অন্যদিকে রাজতন্ত্রকেই সমর্থন করছেন না অনেক কানাডিয়ান। দিনে দিনে রাজতন্ত্রের প্রতি কানাডিয়ানদের সমর্থন ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে। এই হ্রাসের হার কুইবেক প্রভিন্সে সবচেয়ে বেশী। জরিপে দেখা গেছে সার্বিকভাবে কানাডায় ৫২% কানাডিয়ান বৃটিশ রাজতন্ত্রের সঙ্গে থাকতে চাচ্ছেন না।

উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এর মৃত্যুর পর কানাডায় রাজতন্ত্রের পক্ষে ও বিপক্ষে আলোচনা আবারো চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। অতীতে যাঁরা ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের শিকার হয়ে নানানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে রাজন্ত্রের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার সংখ্যা বেশী। এদের মধ্যে আছেন কানাডার আদিবাসীদের বিভিন্ন গ্রুপ, এশিয়ান ও আফ্রিকান ইমিগ্রেন্টদের একটি অংশ।

আমরা দেখেছি, বৃটিশ রাজতন্ত্রের অপকর্মগুলো সাম্প্রতিক সময়ে জোরালোভাবে সামনে আসছে। সম্প্রতি গার্ডিয়ানে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ব্রিটিশ রাজপরিবার ১৭ শতকে ক্রীতদাস বিক্রি থেকে সরাসরি লাভবান হয়েছিল।

এই রাজপরিবার কানাডায় আদিবাসীদের উপর নির্যাতনের সঙ্গেও জড়িত। ক্যাপিলানো ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ভেঙ্কুভার এর Bosa Centre for Film and Animation পরিচালক ডরিন ম্যানুয়েল বলেন, ‘সেই ব্রিটিশ রাজতন্ত্র এবং সেই সময়কার কানাডিয়ান সরকার আদিবাসীদের উপর গণহত্যা চালানোর অনুমোদন দিয়েছে, তাঁরা শিশুদের ধর্ষণ ও হত্যার অনুমোদন দিয়েছে। সেই সব দিনগুলোতে আমি ও আমার মত যারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে তাঁদের কাছে রাজতন্ত্রের চিত্রটি সুুখকর নয়। রাজতন্ত্র ধনী হয়েছে আমাদের জমি দখল করে আর আমরা জীবন কাটিয়েছি দারিদ্রতার মধ্যে। আমাদের অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে অনাহারে।’

আরও স্মরণ করা যেতে পারে যে, ১৯৪৩ সালে বৃটিশরা ভারতে উৎপাদিত লক্ষ লক্ষ টন গম ব্রিটেনে পাচার করে দিয়েছিল। ফলে ভারতবর্ষের ইতিহাসে ভয়াবহ এক দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়। সেই দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়ে ভারতের ১ কোটি ২০ লাখ থেকে ২ কোটি ৯০ লাখ মানুষ শুধু না খেতে পেয়েই মারা যায়। এর মধ্যে কেবল বাঙ্গালী অধ্যুষিত অঞ্চলেই চল্লিশ লক্ষ মানুষ অনাহারে মারা যায়।

এখন ব্রিটিশ সেই রাজতন্ত্রের প্রতি কানাডা সরকারের আনুগত্য আগামী দিনগুলোতে অব্যাহত থাকবে, না থাকবে না তা সময়ই বলে দিবে। তবে সাধারণ কানাডিয়ানদের মধ্যে রাজতন্ত্রের প্রতি সমর্থন ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। বিষয়টি কানাডিয়ান রাজনীতিকদের ভেবে দেখা উচিত।