স্বাস্থ্যসেবার প্রতি অসন্তুষ্ট বেশীরভাগ কানাডিয়ান
খুরশিদ আলম
কানাডায় স্বাস্থ্যসেবার যে চিত্র আমরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লক্ষ্য করে আসছি তার প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন বেশীর ভাগ নাগরিক। Ipsos নামের জরিপ প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক এক জরিপে এরকম তথ্যই উঠে এসেছে। আর এই স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার প্রতি ক্রমবর্ধমান অসন্তুষ্টি মহামারীর সময় বেশী করে স্পষ্ট হয়ে উঠে। অতিরিক্ত চাপের মুখে তখন হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সদের অবস্থা বেগতিক হয়ে উঠেছিল।
আসলে দক্ষ স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয়তা কানাডাকে গত কয়েক বছর ধরেই চাপের মুখে রেখেছে। অনেকেই বলছেন জরুরী বিভাগে অপেক্ষার দীর্ঘ সময় আগেও অসহনীয় ছিল এবং এখন তা সহ্যাতীত হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুঃসহ এক সময়ের মধ্য দিয়ে রোগীকে যেতে হয় কোন হাসপাতালের জরুরী বিভাগে গেলে।
কানাডায় সবচেয়ে বেশী সংখ্যাক মানুষ বাস করে যে অন্টারিওতে সেখানেও ভেঙ্গে পড়ছে স্বাস্থ্য-পরিচর্যা ব্যবস্থা। কয়েক মাস আগেও আমরা লক্ষ্য করেছি যে, প্রধানত নার্স এবং কোথাও কোথাও ডাক্তারের অভাবে সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কোন কোন হাসপাতালের জরুরী বিভাগ। ফলে রোগীরা চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছিলেন। এমনকি ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটেও পর্যাপ্ত নার্স পাওয়া যাচ্ছিল না সেবা অব্যাহত রাখার জন্য। ফলে কোন কোন হাসপাতালে বন্ধ রাখা হয়েছিল ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটও।
অন্যদিকে একজন ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান খুঁজে পাওয়াও আজকাল অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে কানাডায়। অদূর ভবিষ্যতে টরন্টোতে ডাক্তার ও নার্স সংকট আরো বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, টরন্টোর প্রায় ২০ ভাগ ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে প্র্যাকটিস বন্ধের কথা ভাবছেন। সিটিভি নিউজের এক খবরে এ কথা বলা হয়।
২০২১ সালের এক সমীক্ষার ভিত্তিতে ‘কানাডিয়ান ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান’ সাময়িকীতে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, “১৭.৫% (সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের) ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে তাদের প্র্যাকটিস বন্ধের পরিকল্পনা করছেন।” সমীক্ষার প্রধান লেখক ডা. তারা কিরণ বলেন, “কেউ যদি অবসরের সময় হবার এমনকি দুই বছর বা পাঁচ বছর আগেই অবসর নিতে চান তাহলে এটি স্বাস্থ্যসেবা খাতের শ্রমশক্তির ওপর ব্যাপকভিত্তিক বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে এবং এর ফলে জনগণের ওপরও প্রভাব ফেলবে যাদের সত্যিই ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান দরকার আছে।”
ডাক্তাররা কেন প্র্যাকটিস বন্ধের কথা ভাবছেন সে বিষয়ে সমীক্ষায় আলোকপাত করা হয়নি তবে অন্টারিও মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের আরেকটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে, মহামারি যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে এক্ষেত্রে সেটির ভূমিকা থাকতে পারে।
অন্টারিও মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ডা. রোজ জাচারিয়াস বলেন, ২০২১ সালের সমীক্ষায় “অন্টারিওর ৭৪ শতাংশেরও বেশি ডাক্তার বলেন, তারা ভষ্মস্তূপের মত অবস্থানে থেকে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।” জাচারিয়াস বলেন, মান্ধাতার আমলের বেতন ব্যবস্থা এবং প্রশাসনিক কাজ একটি বড় বাধা এবং ফ্যামিলি মেডিসিনে ডিগ্রি নেয়া খুব কম সংখ্যক চিকিৎসকই নিজের প্র্যাকটিস শুরু করতে চান তার কারণ সম্ভবত এটাই। তিনি বলেন, “প্রত্যেক ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানকে এক ঘণ্টা সরাসরি রোগী দেখার পর মেডিক্যাল চার্টে সেসব উপাত্ত ইনপুট দেয়ার জন্য দুই ঘণ্টা কমপিউটারে কাজ করতে হয়।”
অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, ডাক্তার ও নার্স সংকটের কারণে হাসপতালের জরুরী বিভাগে গেলে আজকাল চার থেকে আট বা আরো বেশী সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয় ডাক্তারের দেখা পাওয়ার জন্য। এরপর যদি হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তবে বেড পেতে হলে অপেক্ষা করতে হয় আরো দীর্ঘ সময় ধরে। ২০ ঘন্টা বা তার চেয়ে বেশী সময় ধরে চরম অসুস্থ্য শরীর নিয়ে অপেক্ষা করতে হয় কখন বেড পাওয়া যাবে তার আশায়। এ এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। ভুক্তভোগী ছাড়া এই অভিজ্ঞতার কি যে অসহনীয় যন্ত্রণা তা কেউ বুুঝবে না। আর শুধুই কি রোগীর যন্ত্রণা? রোগীর সাথে পরিবারের যে সদস্য উপস্থিত থাকেন তার ভোগান্তিরও কোন সীমা থাকে না।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা পেতে হলে বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই যে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয় তা যে কোন বিচারেই অগ্রহণযোগ্য এবং দুখঃজনক। বর্তমানে একজন ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান তার কোন রোগীকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রেফার করলে গড়ে ২৭.৪ সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয় তার দেখা পেতে। ২০২১ সালে এই অপেক্ষার সময় ছিল গড়ে ২৫.৬ সপ্তাহ। এটি একটি সাধারণ এবং গড় হিসাব। কারো কারো ক্ষেত্রে অপেক্ষার এই সময় আরো বেশী হতে পারে। অথবা কমও হতে পারে। সেটি নির্ভর করছে রোগটা কি এবং কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রোগীকে পাঠানো হয়েছে।
আমি টরন্টোতে মাঝ বয়সী এক বাঙ্গালী দম্পতির কথা জানি যারা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসা পেতে কানাডা থেকে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন গত ফেব্রুয়ারী মাসে! স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই দুরকম চিকিৎসার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। কিন্তু বিশেষজ্ঞের দেখা পাচ্ছিলেন না। কয়েক জায়গায় খোঁজ নিয়ে দেখেন ৫ থেকে ৬ মাস অপেক্ষা করতে হবে। শেষ পর্যন্ত উপায় না দেখে তারা বাংলাদেশে যান এবং সেখানে গিয়ে সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই বিশেষজ্ঞের দেখা পান এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করেন।
আমরা জানি, কানাডায় অল্প সময়ের মধ্যে বিশেষজ্ঞের দেখা না পেয়ে অনেকেই আমেরিকায় যান নিজ খরচে চিকিৎসা করানোর জন্য। সেটা অবশ্য অনেক ব্যয়বহুল। কিন্তু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা পেতে কানাডা থেকে কেউ বাংলাদেশে যাচ্ছেন এমনটা সচরাচর শুনা যায় না। কিন্তু পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে অনুন্নত দেশে গিয়ে হলেও চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন কেউ কেউ! কারণ আমেরিকায় গিয়ে চিকিৎসা করানোর মত আর্থিক সচ্ছলতা সবার নেই।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, কানাডায় চলতি বছর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা পেতে যে সময় ব্যয় করতে হচ্ছে তা গত প্রায় তিন দশকের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ১৯৯৩ সালে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা পেতে হলে গড়ে ৯.৩ সপ্তাহ সময় লাগতো। বর্তমানে সেই অপেক্ষার সময় বৃদ্ধি পেয়েছে ১৯৫%। Fraserinstitute এর এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে।
ঐ গবেষণায় আরো দেখা গেছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা পেতে যে সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়ে তা একেক প্রভিন্সে একেক রকম। অন্টারিওতে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা পেতে গড়ে ২০.৩ সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হচ্ছে। অপরদিকে প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ডে গড়ে ৬৪.৭ সপ্তাহ ধরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা পেতে। আবার অপেক্ষার সময়টা নির্ভর করছে কি ধরণের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রোগীকে রেফার করা হয়েছে। যদি কোন রোগীকে নিউরোসার্জিক্যাল চিকিৎসার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে পাঠানো হয় তবে তাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে ৫৮.৯ সপ্তাহ। অর্থাৎ এক বছরেরও বেশী সময়! তবে রেডিয়েশন ট্রিটমেন্টের জন্য একজন রোগীকে গড়ে ৩.৯ সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হচ্ছে বর্তমানে।
Fraserinstitute এর গবেষণায় বলা হয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা পেতে একজন রোগীকে যে সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয় তা শুধু অস্বস্তিকর তা নয়, সঠিক সময় চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে রোগীর অবস্থা আরো বেগতিক হয়ে দাঁড়াতে পারে। বৃদ্ধি পেতে পারে ব্যথা, যন্ত্রণা এবং মানসিক পীড়ন। এমনকি ততদিনে রোগীর অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যেতে পারে। চিকিৎসায় তখন আর কোন কাজ নাও হতে পারে। বরণ করে নিতে হতে পারে স্থায়ী পঙ্গুত্বকে অথবা হতে পারে অকাল মৃত্যু। পঙ্গু হলে রোগীকে বেকারত্বের খাতায় নাম লেখাতে হতে পারে। এতে করে অর্থনৈতিক চাপ বাড়ে রোগীর ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে। অন্যদিকে সরকারেরও চাপ বাড়ে অর্থনৈতিকভাবে।
এদিকে কানাডার চিকিৎসা ব্যবস্থার এই পরিস্থিতির সুযোগে কর্পোরেটওয়ালারা নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নাড়তে শুরু করেছেন। তারা সরকারকে চাপ দিচ্ছেন চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আরো বেশী মাত্রায় বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেয়ার জন্য। অন্টারিও প্রভিন্সের প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ডকে আমরা কর্পোরেট বান্ধব ব্যক্তি হিসাবে জানি। সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার কারণে তাঁর হাতে এখন প্রচুর ক্ষমতা। তাই তিনি অনেক কিছুই করে ফেলতে পারেন এই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে। এবং করছেনও তাই। তাঁর বিরুদ্ধে সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছে, প্রয়োজন নেই তবু তিনি কর্পোরেটওয়ালাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচ করে আরেকটি এক্সপ্রেসওয়ে (৪১৩) নির্মাণ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করতে গিয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হবে এমন অভিযোগও রয়েছে।
সেই ড্যাগ ফোর্ড এখন চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আরো অধিক মাত্রায় বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেওয়ার পিছনেও কাজ করছেন। এতে করে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নতি কতটা হবে বা আদৌও হবে কি না সেই বিতর্কও দেখা দিয়েছে নতুন করে।
বস্তুত চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিরাজমান সংকট মোকাবেলায় নতুন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন এ বিষয়ে সবাই একমত। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, সরকার ঘোষিত বেসরকারীকরণের সিদ্ধান্ত কোন সহজ সমাধান নয়।
আসলে স্বাস্থ্যখাতে এই সংকটময় পরিস্থিতি হঠাৎ সৃষ্টি হয়নি। এক কথা বলছেন পর্যবেক্ষক মহল। তাদের মতে, দীর্ঘদিন ধরেই একটু একটু করে সমস্যাগুলো পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর সেই পুঞ্জীভূত সমস্যাগুলো দ্রুত প্রকাশ পেতে থাকে সবার সামনে। এবং মহামারী শুরু হওয়ার পর দিন যতই পার হতে থাকে সমস্যাগুলোও ততই প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। আর এই সমস্যা মোকাবেলায় ড্যাগ ফোর্ড এর নেতৃত্বাধীন বর্তমান প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরো বেশী মাত্রায় বেসরকারীকরণ করা হবে স্বাস্থ্যখাতের সেবা। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, তাতে বর্তমান সংকটের সমাধান কতটুকু হবে? আর বেসরকারী খতের স্বাস্থ্য সেবা নিতে গেলে রোগীকে কি নিজের পকেট থেকে অর্থ যোগান দিতে হবে? পুরোটা না হোক আংশিকভাবে হলেও?
ইতিপূর্বে এক সংবাদ সম্মেলনে অন্টারিও’র স্বাস্থ্য মন্ত্রী সিলভিয়া জোন্স স্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করার জন্য একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। ঐ পরিকল্পনার মধ্যে আছে – বিদ্যমান বেসরকারী ক্লিনিকগুলোতে সরকারী খরচে রোগীদের অস্ত্রোপচার বা অপারেশন করানো, যাতে করে সরকারী হাসপাতালগুলোতে রোগীদের চাপ হ্রাস পায়। তবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি স্পষ্ট করে বলেননি কোন ধরণের ক্লিনিক এই পরিকল্পনার আওতার মধ্যে থাকবে বা কোন ধরণের অস্ত্রোপচার করা হবে।
উল্লেখ্য যে, করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর খুব জরুরী নয় এমন বহুসংখ্যক অস্ত্রোপচার বন্ধ রাখা হয়েছিল গত প্রায় আড়াই বছর ধরে।
বেসরকারী খাতের যারা সমর্থক তারা বলছেন এর মাধ্যমে সরকারী হাসপাতালগুলোতে চাপ কমবে এবং রোগীরা দ্রুত জরুরী সেবা পাবেন। কিন্তু যারা চিকিৎসা সেবা বেসরকারীকরণের সমর্থক নন তারা বলছেন, এর মাধ্যমে সরকারী কোষাগার থেকে অধিক অর্থ চলে যাবে এবং কানাডিয়ানদের মধ্যে চিকিৎসা বৈষম্য বাড়বে।
প্রকৃতপক্ষে অধিক মাত্রায় বেসরকারীকরণ কোন সমাধান নয়, বরং এটি মূল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। অন্টারিও নার্সেস এসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাথরিন হোয় সম্প্রতি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন, ‘চিকিৎসা সেবা আরো বেশী মাত্রায় বেসরকারীকরণ করা হলে তা শুধুমাত্র ব্যবসায়ীদের পকেট ভারী করবে। আর সেই অর্থের যোগান দিতে হবে কারদাতাদেরকে।’
কানাডিয়ান মেডিকেল এসোসিয়েশন এর সভাপতি ডাক্তার ক্যাথারিন সিবিসি নিউজকে বলেন, ‘এই মুহুর্তে আমরা নিজেদেরকে সত্যিই এক চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। কারণ আমাদের স্বাস্থ্যপরিচর্যা ব্যবস্থা ভালভাবে কাজ করছে না। এবং দিনে দিনে তা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে।’
কতটা খারাপের দিকে যাচ্ছে তার একটি উদাহরণ তুলে ধরেছে সিটিভি নিউজ। ঘটনাটি নভাস্কোশিয়ার। সেখানে লিজ লেক্লেয়ার নামের এক মহিলা রোগী দীর্ঘ ৩৬ ঘন্টা ধরে যন্ত্রণাদায়ক পেটের ব্যথায় ভুগেছেন সেই সাথে বমি। কিন্তু ৯১১ এ কল করে কোন এম্বুলেন্স পাচ্ছিলেন না।
এটি একটি মাত্র উদাহরণ যে কানাডায় স্বাস্থ্যসেবা কতটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কি পরিমাণ ডাক্তার, নার্স ও প্যারামেডিক্স এর অভাব বিরাজ করছে। লিজ লেক্লেয়ার প্রথমে ৯১১ এ কল করে অপেক্ষা করছিলেন এম্বুলেন্সের জন্য। দুই ঘন্টা পার হলেও কোন এম্বুলেন্স আসেনি তার বাড়িতে। শেষ পর্যন্ত এক অপারেটর তাকে জানান, জরুরী বিভাগে এসে ডাক্তারের দেখা পেতে হলে তাকে কমপক্ষে ১৬ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হতে পারে। তিনি ঐ প্রভিন্সের ভার্চুয়াল হেলথ লাইনেও ফোন দিয়েছিলেন। সেখান থেকে বলা হয়, একজন নার্সের সঙ্গে কথা বলার জন্য তাকে প্রায় ৯ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হতে পারে। তখন তার আর কোন উপায় ছিল না প্রার্থনা করা ছাড়া। প্রার্থনা করছিলেন যেন পেটের ব্যথা আপনা থেকেই কমে যায়।
অটোয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং স্বাস্থ্যআইন ও নীতির একজন গবেষক কলিন ফ্লাড বলেন বেসরকারী স্বাস্থ্য-পরিচর্যা কার্যক্রমের সেবা পাওয়াটা নিন্ম আয়ের মানুষের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বিশে^র বিভিন্ন দেশের বেসরকারী স্বাস্থ্য-পরিচর্যার উপর গবেষণা চালিয়ে অধ্যাপক কলিন এই মন্তব্য করেন। সিবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে তার এই বক্তব্য তুলে ধরা হয়। অধ্যাপক কলিন স্বাস্থ্যসেবাকে বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেয়ার পরিকল্পনাকে এক ধরণের হঠকারী সিদ্ধান্ত হিসাবে বর্ণনা করেন। এতে মূল সমস্যার সমাধান হবে না। তিনি আরো বলেন, এটি একটি সহজ সমাধান নয়। যে সব দেশে সরকারী ও বেসকারী উভয় খাতে চিকিৎসা-সেবার ব্যবস্থা রয়েছে সেসব দেশে বেসরকারী খাতকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তা বের করতে গিয়ে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়। নজর রাখতে হয় সরকারী জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকে বেসরকারী জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা যাতে সমস্ত রিসোর্স শোষণ করে না নেয়। তাছাড়া বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম সবসময় কম জটিল রোগীদেরকে চিকিৎসা সেবা দিতে চেষ্টা করে-যেমন হাঁটু বা নিতম্বের অস্ত্রোপচার। কিন্তু অধিকতর জটিল রোগী যেমন ক্যান্সার, হৃদরোগ ইত্যাদির জন্য সরকারী হাসপাতালের উপরই নির্ভর করতে হয়। তাছাড়া জরুরী চিকিৎসার জন্যও সরকারী হাসপাতালের জরুরী বিভাগের উপর নির্ভর করতে হয়।
তবে কুইবেক সিটির লাভাল ইউনিভার্সিটির হেলথ ইকনোমিকস এর অধ্যাপক মাড লাবার্গ এর মতে, স্বাস্থ্যসেবা খাত আরো অধিকতর মাত্রায় বেসরকারীকরণ করা হলেই যে তা খারাপ হবে সে কথাও জোর দিয়ে বলার উপায় নেই। কিন্তু সেটি নির্ভর করছে কি পরিমান খরচ হবে তার উপর এবং তার কোয়ালিটি বা মানের উপর। খরচের বিষয়টি শেষ পর্যন্ত টেক্সপেয়ারদেরকেই বহন করতে হয়। তিনি আরো বলেন, ‘যতক্ষণ একজন রোগীকে অর্থ দিতে হবে না, যদি একটি ক্লিনিক সত্যিই ভাল কিছু করতে পারে তবে এ ধরণের বেসরকারী স্বাস্থ্যখাত বা বিশেষায়িত ক্লিনিক থাকলে কোন সমস্যা নেই। আর যদি রোগীকে অর্থ প্রদান করতে হয় তবে সে ক্ষেত্রে সমতার প্রশ্ন উঠে।’
অন্যদিকে স্বাস্থ্যখাত বেসরকারীকরণের সমালোচকরা আরো বলছেন, ইতিমধ্যেই থাকা বেসরকারী ক্লিনিকগুলোর কারণে স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এমনটা বলার পক্ষে যথেষ্ঠ প্রমাণ নেই। তাছাড়া এই বেসরকারী ক্লিনিকগুলো কতটা মান সম্পন্ন সেবা দিতে পারছে সেই প্রশ্নও উঠছে। পরিদর্শনে দেখা গেছে অন্টারিওর ১৩ শতাংশ প্রাইভেট ক্লিনিক প্রাদেশিক মান পূরণ করে না। ইতিপূর্বে টরস্টার নিউজ সার্ভিসের এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কসমেটিক সার্জারি, কলোনোস্কোপি এবং ব্যথার ইনজেকশন দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে অন্টারিওর এমন ক্লিনিকগুলোর মধ্যে ২০১১ সালে সেবাদান শুরুর পর থেকে ১৩ শতাংশ ক্লিনিকেই প্রয়োজনীয় মান বজায় নেই। এই ১৩ শতাংশের মধ্যে এমন ৩.৬ শতাংশ ক্লিনিক রয়েছে যেগুলো জননিরাপত্তা বিষয়ক পরিদর্শনের মান রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, এই সংখ্যা খুবই বেশি এবং এতে করে এসব ক্লিনিকের সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। চিকিৎসায় অবহেলা বিষয়ক আইনজীবী আমানি ওয়াকলে অভিযোগ করে বলেন, ‘প্রতি সাতটি ক্লিনিকের মধ্যে একটি পরিদর্শনের মান রক্ষায় ব্যর্থ হলে বা শর্তাধীনে পাস করলে সেটা নিন্দনীয়। আপনি যেভবেই দেখেন না কেন এটি রীতিমত ব্যর্থতার পর্যায়ে পড়ে।’
উল্লেখ্য যে, কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস ইতিপূর্বে ৩৩০টি ক্লিনিক পরিদর্শন করেছে। এর মধ্যে ৪৪ টিতে মান পূরণ করার ক্ষেত্রে ঘাটতি পাওয়া যায়। পরিদর্শনে ১২টি ক্লিনিক অকৃতকার্য হয়েছে এবং ৩৩টিকে শর্তাধীনে পাসমার্ক দেয়া হয়েছে। এই ৩৩টির মধ্যে কয়েকটিকে দু’বার এমনকি তিনবারও শর্তসাপেক্ষে পাস করানো হয়েছে।
এদিকে অন্টারিওতে ড্যাগ ফোর্ড এর নেতৃত্বাধীন বর্তমান প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ সরকার স্বাস্থ্যখাতের সেবা আরো বেশী মাত্রায় বেসরকারীকরণ করা হবে বলে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার বিরুদ্ধে হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন ফেডারেল এনডিপি’র প্রধান জাগমিত সিং। শুধু ড্যাগ ফোর্ডের বিরুদ্ধেই নয়, অন্যান্য যে সকল প্রভিন্স এই একই রকম সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধেও তিনি একই হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন আমরা এ ধরণের পদক্ষেপ মেনে নিতে পারি না। সম্প্রতি টরন্টোতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, করদাতাদের অর্থ ব্যয় করতে হবে হাসপাতালে পরিষেবার মান উন্নয়নের জন্য এবং সরকারী হাসপাতালে কর্মরত ব্যক্তিদেরকে প্রতিযোগিতামূলক বেতন প্রদানের জন্য। এই অর্থ স্বাস্থ্যখাতের বেসরকারী ব্যবসায়ীদের পকেট ভারি করার জন্য নয়।
তিনি বলেন, ‘এটি এখন খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে আমরা স্বাস্থ্যখাত নিয়ে একটি খুব গুরুতর সংকটে রয়েছি। আর এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় কয়েকটি প্রভিন্সের প্রিমিয়ারগণ মিলে তাদের ভাষায় ‘সৃজনশীল সমাধান’ এর কথা বলছেন। তাদের সেই সৃজনশীল সমাধান হলো স্বাস্থ্য-পরিচর্যা ব্যবস্থাকে বেসরকারীকরণ করা। আমরা এটি হতে দিতে পারি না। কারণ এর মাধ্যমে জনগণের অর্থ আমাদের প্রিয়জনদের যত্নে ব্যয় না হয়ে যাবে ধনী করপোরেশনগুলোর পকেটে।
উল্লেখ্য যে, কর্পোরেট বান্ধব প্রিমিয়ার ড্যাগ টরন্টোর উত্তরে নতুন এক্সপ্রেসওয়ে (৪১৩) নির্মান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যানজট নিরসনের দোহাই দিয়ে। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই প্রকল্প মোটেও যানজট নিরসনে কোন সাহায্য করবে না। উল্টো যানজট আরো বৃদ্ধি করবে এবং একই সাথে পরিবেশেরও ক্ষতি করবে। কিন্তু তা সত্বেও ড্যাগ ফোর্ড তার এই পরিকল্পনা থেকে সড়ে আসেননি। আর এখন তিনি অন্টারিও’র স্বাস্থ্য খাতকে আরো বেশীমাত্রায় বেসরকারীকরণের জন্যও উঠে পড়ে লেগেছেন। এবং স্পষ্টতই সেটা কর্পোরেটওয়ালাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য, যেমনটা বলেছেন জাগমিত সিং। সমালোচকরা আরো বলছেন, ড্যাগ ফোর্ড অন্টারিওতে স্বাস্থ্যসেবা খাতকে আরো বেশী মাত্রায় বেসরকারীকরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো গোটা স্বাস্থ্য খাতকেই ক্রমান্বয়ে সম্পূর্ণভাবে বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেওয়া।
শেষপর্যন্ত যদি তাই হয় তবে লাভবান হবেন কর্পোরেটওয়ালারা। আর ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এই প্রভিন্সের স্বল্প আয়ের মানুষেরা। এই বিষয়ে অন্টারিও নার্সেস এসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাথরিন হোয় এর বক্তব্য আগেই উল্লেখ করেছি। তার মতে, চিকিৎসা সেবা আরো বেশী মাত্রায় বেসরকারীকরণ করা হলে তা শুধুমাত্র ব্যবসায়ীদের পকেট ভারী করবে। আর সেই অর্থের যোগান দিতে হবে কারদাতাদেরকে।
একই বিষয়ে অটোয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক কলিন ফ্লাড এর কথাও উল্লেখ করা হয়েছে আগে। তার মতে, বেসরকারী স্বাস্থ্য-পরিচর্যা কার্যক্রমের সেবা পাওয়াটা নিন্ম আয়ের মানুষের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আর স্বাস্থ্যসেবাকে বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেয়ার পরিকল্পনা এক ধরণের হঠকারী সিদ্ধান্ত এবং এতে মূল সমস্যার সমাধান হবে না।’
এখন এই পরিস্থিতিতে সরকার কর্পোরেটওয়ালাদের স্বার্থ রক্ষা করবে নাকি সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করবে সেটি-ই দেখার বিষয়।
খুরশিদ আলম
সম্পাদক ও প্রকাশক, প্রবাসী কণ্ঠ