প্রবাসে ‘উচ্চারণের’ বাধা কাটিয়ে ওঠা

আয়োডেলে ওডেয়েমি

ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল এমন একটি ইংরেজি বলা দেশ থেকে এসেও আমার কথা অন্যদের বুঝাতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। কানাডায় আসার সময় আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে, প্রত্যেকেই আমার কথা খুব সহজে বুঝতে পারবে, আমাকে বারবার ব্যাখ্যা করে বুঝাতে হবে না। দুর্ভাগ্য যে, ঘটনা ঘটে পুরো উল্টো।
একজন অভিবাসী হিসাবে কিছু বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছে যেমন, একই জিনিসের জন্য ভিন্ন পরিভাষার ব্যবহারÑ আমার দেশে গাড়ির “বুট” থাকে আর মানুষ প্যান্ট নয়, “ট্রাউজার” পরে। তবে আমি এর চেয়েও বেশি জটিল হয়ে ওঠে যখন আমাকে নিজের “উচ্চারণ” ঠিকঠাক করে নিতে হয়।
আমার ধারণা, আমাদের সবারই নিজস্ব উচ্চারণের ব্যাপারে পক্ষপাতিত্ব আছে অথবা আমাদের মতো করে উচ্চারণ করে এমন লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি বদ্ধমূল পছন্দ আছে। দুর্ভাগ্যজনক যে, কানাডার মত বহুসংস্কৃতির দেশে সেটি কাজ করে না। উচ্চারণের ধরণ পাল্টানো কঠিন, কারণ আমরা যেটা বুঝতে পারি না তা শুনতে আমাদের মস্তিষ্কই আমাদেরকে বাধা দেয়, আর নতুন উচ্চারণভঙ্গি না শেখা পর্যন্ত অবস্থার পরিবর্তন হয় না। অথচ নিজের দেশে কেউ আমার উচ্চারণ নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি।
কানাডায় আমার প্রথম দিককার সময়ে অনেক সময় আমাকে কোনও রিসেপশন ডেস্কে দাঁড়িয়ে পড়তে হতো, ভেবে নিতে হতো, কথোপকথনের সময় কীভাবে বললে আমার কথা অন্যকে বোঝাতে পারবো। আমাকে আলোচনার মুখ্য শব্দগুলি মহড়া দিয়ে নিতে হতো এবং ইচ্ছা করে ওই শব্দগুলোর ওপর জোর দিতাম। অনেক সময় আমি যোগাযোগের জন্য কলম দিয়ে লিখে দিতাম। যতই দিন যেতে থাকলো আমি যোগাযোগের অন্য উপায় খুঁজতে গিয়ে উপলব্ধি করলাম, আমার উচ্চারণের উন্নতি করা দরকার।
কানাডায় অনেক অভিবাসীর দেখা মেলে যারা কথা বুঝাতে হিমশিম খায়। আমি জানতে পারলাম, ফিলিপিনো, ভারতীয় এবং অন্যান্য অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীসহ বেশিরভাগ অভিবাসীর জন্য তাদের উচ্চারণই সমস্যার কারণ। কানাডার সৌন্দর্য হলো এর বৈচিত্র্য এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতি এর উদারতা; তা স্বত্তেও ভাষা ও উচ্চারণের ওপর আরও বোঝাপড়ার দরকার আছে। আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, কারো ভাষা ও সংস্কৃতির অভিবাসন ও বুঝে ওঠা হতে পারে অতি দুরূহ প্রয়াস।
ইংরেজিটা বেশ চ্যালেঞ্জিং: প্রথমে এর নিয়ম-বিধি অধ্যয়ন করতে হবে, তারপর শিখে নিতে হবে ওইসব বিধির ব্যতিক্রমগুলি। এমনকি পুরো শব্দভাণ্ডার মুখস্ত করা ও বুঝে নেবার পরও কানাডার মত কোনও দেশে এলে আপনার উচ্চারণ নিয়ে কেউ কথা বলতেই পারে।
উচ্চারণের কারণে যখন কেউ আপনার কথা বুঝতে পারবে তখন সেটি নিরুৎসাহজনক, ধ্বংসাত্মক ও নৈরাশ্যকর হতে পারে। এতে করে আমাদের বন্ধুত্ব, পেশাজীবী এমনকি সহকর্মীর সঙ্গেও দূরত্ব ঘটাতে পারে।

ক্লাসে উচ্চারণ শিখানো হচ্ছে। ছবি : ডালহৌসি ইউনিভার্সিটি

সামঞ্জস্য বিধান করতে হবে, বর্জন নয়

আমার এক বন্ধু আছেন যিনি তার কাস্টমার সার্ভিসের চাকরি হারিয়েছিলেন। কাস্টমাররা একজন সুপারভাইজারের কাছে অভিযোগ করেন যে, তারা এমন ব্যক্তির সঙ্গে কাজ করতে চান “যিনি ইংরেজি বলতে পারেন”। কার্যকর সম্পর্ক, আস্থা ও আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার জন্য যোগাযোগ এবং তথ্য হলো মুখ্য বিষয়। আমাদের কানাডীয় বন্ধুদেরকে বুঝতে হবে যে, আমাদের সহাবস্থান এবং কানাডার সমাজের পুরোপুরি অংশ হবার দিকে এগুনোর ক্ষেত্রে অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে অভিবাসীদেরকে সহায়তা করার ও তাদের বুঝে ওঠার দরকার আছে।
আমি কানাডীয়দের উৎসাহ দিই আমাদের অবস্থানে নিজেদের কল্পনা করতেÑ কানাডীয়রা অন্য কোনও দেশে অভিবাসী হয়ে গেলে তা কেমন হবে? তারা কীভাবে সেদেশের ভাষা ও উচ্চারণ সম্পর্কিত বাধার সঙ্গে মানিয়ে নেবেন? আপনি কি মনে করেন না যে, যে কোনও ধরণের বাধা ও অনুরূপ বিষয়গুলি প্রশমনে তাদের সাহায্য করা ও বুঝে নেয়ার প্রয়োজন আছে?
আমি ইংরেজি উচ্চারণের সমস্যা কমাতে সক্ষম হয়েছি কারণ নিজের পরিচয়ের যত বড় ভক্তই হই না কেন আমি এখানে আত্তীকৃত হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমাদেরকে এই দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আমরা নিজের পরিবেশ এবং অবস্থান সম্পর্কে শিখতে এবং এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারলে ভালো অনুভব করি, তাই আমাদের জন্য তাদের কাজের ধরণের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার প্রয়োজন আছে। অভিবাসী বন্ধুদের বলি, প্রতিদিনের যোগাযোগের জন্য স্পষ্টতা ও শুদ্ধ উচ্চারণ খুবই জরুরী।
অভিবাসীদের উচিৎ তাদের উচ্চারণ নিয়ে বাঁচতে শেখা। বর্জন নয়, সামঞ্জস্য বিধানের ওপর জোর দিন। আপনার উচ্চারণ খারাপ নয়, বরং তা আপনার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে, আর এটিই হলো জীবনযাত্রার একটি উপায়। আপনি একটির বেশি ভাষা বলতে পারেন এটি এক দারুণ একটি ব্যাপার; তদুপরি, স্থানীয় ইংরেজিভাষীদের মধ্যেও উচ্চারণের অগণিত ভিন্নতা আছে। আমাদের সহকর্মী ও বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডের ব্যক্তিরা যাতে আমাদের কথা বুঝতে পারে সেটি নিশ্চিত করা আমাদেরই দায়িত্ব।
আমি যখন কানাডায় প্রথম আসি তখন এক সহকর্মী আমাকে বলেছিলেন, আমি খুব দ্রুত কথা বলি। তিনি আমাকে ধীরে বলার পরামর্শ দেন। খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার সময় অথবা উত্তেজিত অবস্থায় আমরা দ্রুত কথা বলতে অভ্যস্ত, কিন্তু তাড়াহুড়া করে কথা বললে আমাদের উচ্চারণের উপর জোর এসে যায় এবং আমরা কী বলতে চাইছি সেটা বুঝে ওঠা অন্যদের জন্য কঠিন হয়ে যায়। আমার পরামর্শ হলো, ধীরে ধীরে কথা বলুন, প্রতিটি শব্দ এমনভাবে প্রকাশ করুন যেন আপনার চমৎকার ভাবনাগুলো অন্যদের পক্ষে বোঝা সহজ হয়।
শেষ কথা হলো, আপনার উচ্চারণ আপনারই অংশ, আর এটি সেভাবেই নেয়া উচিৎ। একজন অভিবাসীর উচ্চারণ পাল্টে ফেলা প্রায় অসম্ভব এক কাজ, যেহেতু এটি তার পরিচয়ের অংশ।

  • সূত্র : দি নিউকানাডিয়ানমিডিয়া.কম