টরন্টোর কৃষ্ণাঙ্গদের বৈষম্যের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা সব সময়ই ‘উল্লেখযোগ্যভাবে’ বেশি, গবেষণার তথ্য
প্রায় ৭৬% কৃষ্ণাঙ্গ নগরবাসী প্রতি মাসে অন্তত কয়েকবার বৈষম্যের শিকার হন: সমীক্ষা
টরন্টোর শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গ অধিবাসীদের নিয়মিতভাবে বৈষম্যের শিকার হবার সম্ভাবনা ‘উল্লেখযোগ্য’ পরিমাণে বেশি। টরন্টোর কৃষ্ণাঙ্গ জনগণের জন্য এটি প্রতিদিনের সাধারণ অভিজ্ঞতা ছবি: ইন্টারনেট
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক, ২১ মার্চ ২০২৩ : টরন্টোর শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গ অধিবাসীদের নিয়মিতভাবে বৈষম্যের শিকার হবার সম্ভাবনা ‘উল্লেখযোগ্য’ পরিমাণে বেশি। ছোট ছোট অবাঞ্ছিত আচরণ (microaggression) ও বৈষম্য নিয়ে টরন্টোবাসীর দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার উপর প্রণীত সাম্প্রতিক এক সবিস্তার প্রতিবেদনে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। খবর সারা জাবাখাঞ্জি – সিবিসি নিউজ।
সম্প্রতি প্রতিদিনের বর্ণবাদ
টরন্টোতে বৈষম্যের অভিজ্ঞতা শিরোনামে প্রকাশিত এক গবেষণার সারসংক্ষেপে গত নভেম্বরে প্রকাশিত টরন্টো সোশ্যাল ক্যাপিটাল স্টাডিতে উঠে আসা বৈষম্যের তথ্যগুলো গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে।
রিপোর্টটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান টরন্টো ফাউন্ডেশন এবং এনভায়রনিকস ইন্সটিটিউট ফর সার্ভে রিসার্চ প্রকাশিত এবং এটিই এ ধরণের প্রথম রিপোর্ট। এতে দেখা যায় যে, মোটামুটিভাবে টরন্টোর ৭৬ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ অধিবাসীই প্রতি মাসে অন্তত কয়েকবার করে হলেও জাতিগত বৈষম্যের শিকার হন।
ওয়েলেসলি ইন্সটিটিউটের সিইও এবং মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক কোয়ামে ম্যাকেঞ্জি বলেন, “আমি মোটেও বিস্মিত হইনি। যে ধরণের বৈষম্যকে মাইক্রোঅ্যাগ্রেশন বলে চিহ্ণিত করার চেষ্টা চলছে সেটি বর্ণবাদের প্রতিদিনের ঘটনা যা জনগণের উপলব্ধিতে আছে…কানাডার কৃষ্ণাঙ্গ জনগণের জন্য এটি প্রতিদিনের সাধারণ অভিজ্ঞতা।”
এই তথ্যের উৎস হলো গত গ্রীষ্মে সম্পাদিত একটি সমীক্ষার ফরাফল। ওই সমীক্ষায় অনলাইনে এবং টেলিফোনে ১৮ বছর ও বেশি বয়সের ৪,১৬৩ জন টরন্টোবাসীর বক্তব্য নেয়া হয়।
অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যারা কোনও না কোনও ধরণের বৈষম্যের শিকার হয়েছেন বলে জানান তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এই বৈষম্যের মূল কারণ কী বলে তারা মনে করেন। মোটামুটিভাবে ৪১ শতাংশ মানুষ বলেছেন, এটি ঘটে তাদের জাতিগত ও বর্ণগত কারণে, এর পরেই আছেন ৩৪ শতাংশ মানুষ যারা বলেন, বৈষম্য ঘটে শারীরীক বৈশিষ্ট্যের কারণে এবং ৩০ শতাংশের মতে লৈঙ্গিক কারণে।
কিন্তু, রিপোর্টে আরও বলা হয় যে, দৃশ্যমান সংখ্যালঘু বা অশে^তাঙ্গ মানুষের মধ্যে যারা বৈষম্যের শিকার হন তাদের ৬১ শতাংশই বলেন, তাদের সঙ্গে বৈষম্যের কারণ তাদের জাতিগত ও বর্ণগত পরিচয়।”
কৃষ্ণাঙ্গ টরন্টোবাসী বলেন, তারা চৌকস নন বলে মনে করা হয়
সমীক্ষার অংশ হিসাবে অংশগ্রহণকারীদের কাছে ১০ ধরণের বৈষম্যের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় যেগুলির মুখোমুখি তারা হয়েছেন। এটি করা হয় হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডেভিড আর উইলিয়ামস-এর উদ্ভাবিত দৈনন্দিন বৈষম্যের পরিমাপ (Everyday Discrimination scale) ব্যবহার করে।
উত্তরদাতারা প্রশ্নের জবাব দেন তাদের দৈনন্দিন জীবনে ঘটা অভিজ্ঞতার আলোকে, যেমন অপমান করা, হুমকি দেওয়া বা হয়রানি করা অথবা কোনও স্টোরের অশেপাশে অনুসরণ করা ইত্যাদি।
তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, অন্যদের চেয়ে কতটা ঘনঘন তাদের সঙ্গে কম সৌজন্যমূলক বা কম সম্মান দিয়ে আচরণ করা হয়, রেস্টুরেন্টে বা স্টোরে সেবা পাবার ক্ষেত্রে তাদের সাথে বৈষম্য করা হয় কিনা, অন্যরা তাদের সাথে এমন আচরণ করেন কিনা যাতে মনে হয় যে তাদেরকে যথেষ্ট চৌকস মনে করা হচ্ছে না অথবা অন্যরা তাদের ব্যাপারে ভীত বলে মনে হচ্ছে কিনা, লোকেরা নিজেদেরকে তাদের চেয়ে উত্তমর্ণ ভেবে আচরণ করছে কিনা।
যারা তাদেরকে যথেষ্ট চৌকস বলে মনে করা হচ্ছে না বলে অনুভব করেছেন এমন লোকেদের মধ্যে টরন্টোর কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যা অন্য যে কোনও বড় জাতিগোষ্ঠীর তুলনায় বেশি। ২৫ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ বলেছেন তারা নিয়মিতই এমন অনুভব করেন। আর শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে ১৭ জন একই ধরণের অনুভূতির কথা জানান।
কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে মোটামুটিভাবে ৪৬ শতাংশ বলেছেন, তাদের জাতিগত পরিচয়ের কারণে কেউ তাদেরকে ভয় পাচ্ছে এমনটা তারা কখনও অনুভব করেননি। এর বিপরীতে ৬৫ শতাংশ অধিবাসী বলেন, তারা কখনই এমন অভিজ্ঞতার মুখে পড়েননি।
সমীক্ষা প্রতিবেদনের সহযোগী লেখক এবং এনভায়রনিকস ইন্সটিটিউট ফর সার্ভে রিসার্চ-এর নির্বাহী পরিচালক এন্ড্রু পার্কিন বলেন, এসব তথ্য জাতিগত ও জাতিগোষ্ঠীর লোকেদের অভিজ্ঞতার সঙ্কলন উল্লেখযোগ্যভাবে তুলে ধরতে সহায়ক হয়।
পার্কিন বলেন, “জনগণ কীভাবে তাদের সমাজের সঙ্গে যুক্ত বলে মনে করে তার সাথে এই তথ্যগুলোর ফলাফল জড়িত। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, নগরের পরিষেবা, সিটি হল, পুলিশ, বিচার বিভাগ, শিক্ষালয়.. এগুলোর সবকিছুই জনগণের অভিজ্ঞতাকে প্রভাবিত করে।”
বৈষম্য হলো বেকারত্বের জোরালো উপাদান
রিপোর্ট অনুযায়ী, একই সাথে, জনগণের মঙ্গল ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং বৈষম্যের মধ্যে জোরালো সম্পর্ক রয়েছে।
রিপোর্ট বলা হয়, সবচেয়ে ঘন ঘন বৈষম্যের শিকার হন এমন টরন্টোবাসীর জীবনের তৃপ্তি যারা অপেক্ষাকৃত কম বৈষম্যের শিকার হন বা একেবারেই হন না তাদের চেয়ে কম, তেমনই তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাও দুর্বল।
তরুণ কৃষ্ণাঙ্গ পেশাজীবীদের কেন্দ্র সিইইর (CEE) নির্বাহী পরিচালক আগাপি গেসেসি বলেন, ঘন ঘন বর্ণবাদী বৈষম্যের শিকার হওয়া কৃষ্ণাঙ্গ টরন্টোবাসীর সংখ্যা তাদের গ্রুপে বেকারত্বের হারের অন্যতম প্রধান ফ্যাক্টর।
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার তথ্য অনুযায়ী, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ যুবকরা গত
মহামারিকালে উচ্চতর বেকারত্বের মুখে পড়েন। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে শ্রমশক্তির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ, আনুমানিক ৩০.৬
শতাংশ বেকার ছিল- এই হার নন-ভিজিবল মাইনরিটি গ্রুপের যুবকদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
গেসেসি বলেন, “এটি এমন এক চিত্র তুলে ধরে যা আমাদের বেকারত্বের হারের সঙ্গে সম্পর্কিত। যদিও আমাদের সমাজ সুশিক্ষিত, উদ্দীপিত … এমন যুবকরা আছে যারা কাজ করতে ইচ্ছুক, কিন্তু তবুও এটা কেন ঘটে যে, বেকারত্বের হার যেন কমতেই চায় না?”
“আমাদের মত সংস্থাগুলিকে ওইসব যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য কৌশলগতভাবে বাজারে শ্রমিক ঘাটতি খুঁজে বের করতে হবে যাতে তাদের চেহারা যেমনই হোক আপনি তাদের নিয়োগ করতে চাইবেন কারণ আপনার বিপুল শ্রমিক ঘাটতি রয়েছে আর এর সত্যিই কোনও বিকল্প নেই।”
দক্ষিণ এশীয়রা জানান তারা অন্যদের চেয়ে কম সম্মান পান
রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, টরন্টোর দক্ষিণ এশীয় বাসিন্দারাও নিয়মিতই, অন্তত মাসে কয়েকবার, বর্ণবাদী বৈষম্যের শিকার হন বলে জানান। এই গ্রুপের সদস্যদের রেস্টুরেন্ট ও স্টোরে অসঙ্গত পরিষেবা পাবার সম্ভাবনা শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।
সেই সঙ্গে, এই দক্ষিণ এশীয়দেরই জাতিগত পরিচয়ের দিক থেকে বৃহত্তম গোষ্ঠী যাদের অন্য যে কোনও গ্রুপের সদস্যদের চেয়ে নগরীতে কম সম্মানের চোখে দেখা হয়। এদের ২৫ শতাংশ জানান, তারা মাসে অন্তত কয়েকবার এ ধরণের অসম্মানজনক অভিজ্ঞতার মুখে পড়েন, শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে ১৪ শতাংশ এ ধরণের পরিস্থিতিতে পড়েন।
পার্কিন বলেন, টরন্টো ফাউন্ডেশন ও এনভায়রনিকস ইন্সটিটিউট ফর সার্ভে রিসার্চ ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর ওপর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে যারা তাদের বিশ্বাসের জন্য প্রায়শ বৈষম্যের শিকার হন। এ বিষয়ে অধিকতর আলোকপাত করে তথ্য প্রকাশ করা হবে।
পার্কিন বলেন, “আজ আমরা যে জাতিগত বৈষম্যের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছি এটি ছাড়াও টরন্টোতে দৃশ্যত ধর্মপ্রাণ লোকেদের প্রতি বৈষম্যসহ আরও অনেক ধরণের বৈষম্য রয়েছে।”