আমার লেখক হয়ে উঠার নেপথ্য গল্প

জসিম মল্লিক

আমার লেখক হয়ে ওঠার পিছনে বরিশালের কয়েকজন মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিরাট ভূমিকা আছে। সেই মানুষগুলোর কথা আমার কখনও বলা হয়নি। আমি তখন বরিশাল বিএম কলেজে পড়ি। পত্রপত্রিকায় চিঠিপত্র লিখি। বিচিত্রায় ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন দেই। পত্রমিতালী করি। প্রতিদিন ডজন ডজন চিঠি আসে আমার কাছে। আমি সেই চিঠির উত্তর দেই। বেশিরভাগ চিঠি মেয়েদের। বিএম কলেজে আমার অনেক মেয়ে বন্ধু। আমার ডিপার্টমেন্টের যেমন তেমনি অন্য ডিপার্টমেন্টের  মেয়েদের সাথেও আমার সখ্যতা। বিএম কলেজ দেশের খ্যাতিমান কলেজ। মেধাবী শিক্ষার্থীরা পড়ে এখানে। মেধাবী শিক্ষকগন শিক্ষা দেন। লেখালেখির প্রতি আমার আগ্রহ দেখে কয়েকজন শিক্ষক আমাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। উৎসাহ দিতেন। কলেজের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে আমি অংশগ্রহন করি। কলেজ ম্যাগাজিনে লিখি।

বিচিত্রা ফোরাম ক্লাব তখন দেশজুড়ে খুবই আলোচিত। বিচিত্রায় সামান্য এক লাইন দুলাইন লেখা ছাপা হলে আলোচনার ঢেউ ওঠে। বরিশালে বিচিত্রা ফোরাম ক্লাব গড়ে উঠে পঞ্চপান্ডবের নেতৃত্বে। পঞ্চপান্ডবের একজন ছিলেন বরিশালের সাংস্কৃতিক ও নাট্য ব্যাক্তিত্ব সৈয়দ দুলাল। পঞ্চপান্ডব তখন ব্যাক্তিগত বিজ্ঞাপনে খুবই আলোচিত নাম। সে সময় তসলিমা নাসরিন, রফিকউল্লাহ এমরান ইমু, সিউ সুবর্ণগ্রাম, রজনী, মাসুদ এমকো, মরবিড, জিয়া খন্দকার প্রমুখরা ব্যাক্তিগত বিজ্ঞাপনে বেশ সরব। ব্যাক্তিগত বিজ্ঞাপন ছাড়াও পাঠকের পাতায় চিঠি লিখি আমি। সেই চিঠি ছাপা হয় নিয়মিত। এছাড়া চিত্রালী, পূর্বানী, রোববার, ইত্তেফাক, বেগম, সন্ধানী এসব পত্রিকায় চিঠি লিখি। সৈয়দ দুলালের সাথে তখন থেকেই আমার সখ্যতা গড়ে উঠে। তিনি লেখালেখির জন্য আমাকে খুবই অনুপ্রাণিত করতেন। যেকোনো সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে আমাকে ডেকে নিতেন। আমি একটা নুতন জগতের সন্ধান পাই। আমার ভিতর যে অন্য একটা আমি আছে সেটা টের পেতেন দুলাল ভাই। তিনি আমাকে সাহসী করে তুলেছিলেন। যুদ্ধ করে কিভাবে টিকতে হয় শিখিয়েছিলেন।

বরিশালের খ্যাতিমান বইয়ের দোকান বুকভিলার রূপক আমার স্কুলের বন্ধু। ক্লাস টু থেকে মাস্টার্স পর্য্যন্ত আমরা একসাথে পড়াশুনা করেছি। রূপক আর আমি মিলে বিচিত্রা ফোরাম ক্লাব বিএম কলেজ শাখা করেছিলাম। দুলাল ভাই আমাদের সহযোগিতা করেছিলেন। মূলতঃ তার পরামর্শেই আমরা ফোরাম ক্লাব করেছিলাম। রূপক সবসময় আমাকে লেখালেখির জন্য অনুপ্রেরণা দিয়েছে। রূপক তখনও বুকভিলার দ্বায়িত্ব নেয়নি। ফারুক ভাই ছিলেন দ্বায়িত্বে। তা সত্বেও ভাল কোনো বই এলে রূপক আমাকে পড়তে দিত। আমাকে কখনও বই কিনে পড়তে হয়নি। এখনও আমি বরিশাল গেলে বুকভিলায় যাই। রূপক আজও আমার লেখালেখির অনুপ্রেরণার নাম। বই পড়েই আমার গল্প উপন্যাস লেখার প্রতি আগ্রহ জাগে, অনুপ্রাণিত হই।

বিএম কলেজে পড়ার সময় আমার বন্ধু পান্না এবং শামীম আরা আমার লেখালেখির ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রেখেছিল। পান্নাও টুকিটাকি লিখত। আমরা লেখা নিয়ে কথা বলতাম। আমি নুতন কিছু লিখলে হোক সেটা চিঠি বা ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন পান্নাকে আগে পড়তে দিতাম। মেয়েরা যে আমাকে এতো এতো চিঠি লিখত সেই চিঠিও ওকে পড়ে শোনাতাম। আমি কি রিপ্লাই দিয়েছি তাও পান্নাকে পড়তে দিতাম। পান্নার কাছে আমার গোপন কিছু ছিল না। শামীম এবং পান্না দু’জনই আমার ক্লাসের ছিল। আমি লিখি বলে আমার প্রতি শামীমের একটা পক্ষপাত ছিল। আমাকে সবসময় ভাল কিছু লেখার জন্য অনুপ্রেরণা দিত। ভাল ভাল বই এনে দিত, দৈনিকবাংলা থেকে উপসম্পাদকীয়র কাটিং এনে দিত। সবসময় বলত তোমাকে চিঠিপত্রের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, বড় কিছু লিখতে হবে। দৈনিকবাংলা এবং বিচিত্রা এই দুই পত্রিকা ছিল সাহিত্যের প্রতি আমার হাতেখড়ি। সেই পথচলা আজও থামেনি। আজও চেষ্টা করি যাচ্ছি। আমার জগতটা অনেক ছোট আর লেখালেখি আমার আনন্দের উৎস। বেঁচে থাকার অবলম্বন। লেখালেখির এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আমার এই বন্ধুদের কথা আমি সবসময় কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি।

ঢাকা ২৭ নভেম্বর ২০২২

এই দেশে জন্মেছি, এই দেশেই মরতে চাই

কালকে গুলশান দুই থেকে পিসি কালচার হাউজিং সোসাইটি যেতে লেগেছে প্রায় দুই ঘন্টা। বাম্পার টু বাম্পার ট্রাফিক ছিল ঢাকার রাস্তায়। কালকে উবার পেঁছাতেই লেগেছে প্রায় এক ঘন্টা। এখানকার বেশিরভাগ উবার চালকরা ঠিকমতো লোকেশন চেনে না। প্রায় সবাই প্রথমেই জানতে চায় কোথায় যাব। কারণ তার ফোনে গন্তব্য শো করে না। এটা জানতে চাওয়ার কোনো নিয়ম নাই। এর কারণ হচ্ছে লোকেশন পছন্দ হলে যাবে, না হলে বলবে যামুনা ক্যান্সেল করেন বা নিজেই অন্যকে ডাইভার্ট করে দেবে। আমি ছিলাম ল্যান্ডমার্কের সামনে। উবার চালক আসছিল গুলশান ক্লাব এড়িয়া থেকে কামাল আতাতুর্ক রোড দিয়ে। তার হাতের বাঁ দিকেই কিন্তু ল্যান্ডমার্ক। বিশাল বড় বিল্ডিং। খুবই ইজি লোকেশন। কিন্তু সে সিগনাল পার হয়ে ওপার চলে গছে। তারপর ফোন দিয়ে উল্টো আমার সাথেই হট টক করল। ঢাকার সিগনাল সব ম্যানুয়াল। ডিজিটালাইজেশনের যুগে বাংলাদেশে ট্রাফিক সিগনাল ম্যানুয়াল কেনো তা আমার মাথায় ঢুকছে না। প্রতিটা সিগনাল কমপক্ষে দশ থেকে পনেরো মিনিট লম্বা। ট্রাফিক সিস্টেম এতোটাই অবৈজ্ঞানিক যে একবার পথ ভুল করলে ফিরে আসতে অনেক সময় চলে যায়। উবার চালকের তাই এক ঘন্টা লেগেছে।

ঢাকার রাস্তায় বাম্পার টু বাম্পার ট্রাফিকের একটি দৃশ্য। ছবি : সংগৃহীত

উবার চালক যেতে যেতে নানা গল্প জুড়ে দিল। সরি বলল তার ভুলের জন্য। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল আমি এতোক্ষন অপেক্ষা করেছি সেজন্য। বলল, সারাদিনে মাত্র তিনটা ট্রিপ করতে পেরেছে। দুপুরে খাওয়ারও সুযোগ পায়নি।

আমি বললাম, ল্যান্ডমার্ক চিনলেন না কেনো। এতক্ষন সময় নষ্ট হলো আমার। আমাকে যেতে হবে সাতটায় আর এখানেই বেজে গেলো আটটা। আমি খুব টাইম মেইনটেইন করি।

সে আবারও দুঃখ প্রকাশ করে বলল, ম্যাপে দেখাচ্ছে সিগনালের ওপারে লোকশেন, তাই চলে গেছে।

আমি বললাম, গুগল ম্যাপ সবসময় একশত ভাগ সঠিক দেখাতে পারে না। নিজেকেই লোকেশন চিনতে হবে।

এরপর সে তার সারাদিনের কাহিনী বর্ণনা করল। দুপুরে একটা ট্রিপ নিয়ে সাভার গিয়েছিল। মনে করেছিল ওখানে কিছু খেয়ে নেবে। এরমধ্যে একটা কল ঢুকে গেছে। সেটা নিয়ে আসল যমুনা ফিউচার পার্ক। ওখান থেকে আবার কল ঢুকল। যাবে স্কয়ার হসপিটাল। কিন্তু ট্রাফিক দেখে পথেই নেমে গেছে প্যাসেঞ্জার। বলল, স্যার শিখছি গাড়ি চালানো শুধু তাই অন্য কোনো পেশায় যেতেও পারছিনা। কিন্তু জীবন চলে না। চারকোটি মানুষের ঢাকা শহরে গাড়ি চালানোই মুস্কিল।

আমি বললাম সারাদিন নিশ্চয়ই এমন থাকে না!

সে বলল, প্রতিদিনই প্রায় এমন। এমনকি শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর থেকে মধ্যরাত পর্য্যন্ত এমন থাকে।

আমি বলালাম, ছুটির দিন নানা অনুষ্ঠানাদি থাকে তাই হয়ত। আমারও তো আজ একটা বিয়ের দাওয়ার ছিল নিকুঞ্জ কনভেনশন সেন্টারে। কিন্তু যেতে পারলাম না। তবে ঢাকার ট্রাফিক এমন থাকবে না। মেট্রো আর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হলে ট্রাফিক ব্যবস্থা ভাল হবে। শেখ হাসিনার সরকার অনেক রাস্তাঘাট করেছে সারা দেশে। বলা যায় বিপ্লব হয়েছে দেশে। নাগরিকদের আইন মানতে হবে। সবকিছু সরকার করে দেয় না। আইনের প্রয়োগ ঘটাতে হবে। পুলিশকে আরো মানবিক হতে হবে।

অনেকদিন পর শ্যামলী এলাকায় আসলাম। ঢাকার কোথাও সাইলেন্ট জোন বলে কিছু নাই। গুলশান, বনানী, বারিধারা বা ধানমন্ডি যেগুলো আদর্শ আবাসিক এলাকা হিসাবে গড়ে উঠেছিল সেটা আর নাই। নাগরিক উপভোগের সুযোগ নাই বললেই চলে। পুরো শহরটাই যেনো একটা বাজারে পরিণত হয়েছে। যেখানে সেখানে ব্যাংক, এটিএম মেশিন, দোকান পাট, স্কুল, হোটেল রেষ্টুরেন্ট, ইউনিভার্সিটি। ফুটপাথ বলে কিছু নাই। সব দখলে, ভাঙ্গা। বছর বছর কাঁটা ছেড়া। হাঁটার কোনো সুযোগ নাই। ফুটপাথ থেকে এক শ্রেণীর মানুষের প্রচুর টাকা আয় হয়। পর্য্যপ্ত পার্ক নাই, রাস্তা নাই। আমি থাকি মহাখালী এলাকায়। খুবই ভয়াবহ অবস্থা মহাখালীর। আগে এমন ছিল না। রাস্তার উপর ব্রাক ইউনিভার্সিটি, স্কয়ারের অফিস। যাদের নিজস্ব পার্কিং নাই। ব্রাকের মতো প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোনো ক্যম্পাস নাই এটা ভাবতেও অবাক লাগছে। শির্ক্ষার্থীরা রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, টং দোকানে চা খায়, ছেলে মেয়েরা স্মোক করে, পরস্পর ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে থাকে। গভীর রাত পর্য্যন্ত নয়েজ করে। এলাকার পরিবেশটাই দূষিত হয়ে গেছে। ব্যাপারটা মাথায় রাখার জন্য অনুরোধ করছি ব্রাক কর্তৃপক্ষকে।

ফেরার পথে রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা ছিল। তখন রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। ড্রাইভার গল্প জুড়ে দিল। আমি খেয়াল করেছি ঢাকার উবার চালকরা গল্প করতে পছন্দ করে। আমিও উত্তর দেই তাদের প্রতিটি কথার। কথা প্রসঙ্গে কানাডার ট্রাফিক সিস্টেমের কথা উঠল। সে নানা কিছু প্রশ্ন করছিল। ওখানে স্পিড লিমিট কেমন, টিকিট দেয় কিনা, ভিআইপি আছে কিনা। রাস্তা আটকে রাখে কিনা ভিআইপিরা গেলে। মন্ত্রী এমপিদের জন্য রাস্তা বন্ধের কোনো আইন আছে কিনা।

আমি বললাম, ভিআইপিরা গেলে আমরা টেরও পাই না। মন্ত্রী এমপিরা নিজেরাই নিজেদের গাড়ি চালায়। ওখানেতো আর ম্যানুয়াল সিস্টেম না। সবাই আইন মেনে চলে। আইন ভঙ্গ করলে শাস্তি। টিকিট অবধারিত। ক্যামেরা বাসানো আছে। টিকিট খেলে কোর্টে যাওয়ার সুযোগ আছে। ডিমেরিট পয়েন্ট আছে। সবার জন্য এক আইন। জাস্টিন ট্রুডোর জন্য যে আইন আমার জন্যও সেই আইন।

উবার চালক বলল, স্যার আপনার বাংলাদেশ ভাল লাগে!

আমি বললাম, কি বলেন! খুবই ভাল লাগে। আমি তো এই দেশে জন্মেছি, এই দেশেই মরতে চাই। এখানকার আলো বাতাস, ধুলা বালি, রাস্তাঘাট, অলি গলি, ঘরের আনাচ কানাচ, মানুষ, কীট পতঙ্গ, পশু পাখী, নদী খাল সব আমার প্রিয়। দেশ নিয়ে আমার কোনো কমপ্লেন নাই। আমি খুবই হ্যাপি। আমার ছেলে মেয়েরা আমাকে বলেছে, বাবা এনজয় বাংলাদেশ। এনজয় ইয়োর লাইফ।

আমাদের একজন বঙ্গবন্ধু জন্মেছিলেন বলেই আমাদের সন্তানেরা দেশ বিদেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

ঢাকা ১৩ ডিসেম্বর ২০২২

আনন্দ বেদনার কাব্য !

অসুস্থতার কয়েকটা দিন কেমন আউলা ঝাউলাভাবে কেটে গেলো। ছিরিছুরাতহীন দিনগুলি। নিঃসঙ্গবাসের জন্যও অসুখের দিনগুলি একটু দীর্ঘ মনে হয়েছে। প্রলম্বিত মনে হয়েছে রাতগুলোকে। যখনই ঘুম ভাঙত ঘড়ির দিকে তাকাতাম! মাত্র দুইটা পয়ঁত্রিশ বা তিনটা পঁচিশ! হায় আল্লাহ কখন সকাল হবে! কখন দূরের মসজিদে ফজরের আজানের আসসালাতু খাইরুম মিনাননাউম.. ধ্বনি বেজে উঠবে! কখন সকালে উঠেই প্রথমে একগ্লাস কুসুম গরম পানি খাব! কখন নিজের হাতে চা বানাব! টোষ্ট দিয়ে চা খাব ভিজিয়ে ভিজিয়ে! অন্যান্য সময় এয়ারপোর্ট থেকে ঘরে ঢুকে লাগেজ ছুড়ে মেরেই বেড়িয়ে পরতাম বাইরে। বন্ধুদের সাথে দেখা করার জন্য প্রাণটা উসখুশ করত। কখন বিশাল এয়ারবাসটা আগুনের ফুলকি ছুটিয়ে হুস করে মসৃণভাবে রানওয়েতে নামবে সেই অপেক্ষায় তর সয় না আমার। শেষের এক দুই ঘন্টা যেনো আর ফুরোতেই চায় না। যেনো অনন্তকাল ধরে প্লেনে বসে আছি। এই গগনবিহার যেনো শেষ হবার নয়। আর কতদূর ঢাকা! কতদূর হযরত শাহজালাল এযারপোর্ট! অবাক কান্ড প্রতিবার প্লেনটা ল্যান্ড করার পরই আমার চোখটা ভিজে উঠে! আহা নিজের দেশে এসেছি!

এবার সবকিছুই ব্যাতিক্রম মনে হয়েছে। বিমান বাংলাদেশে এয়ারলাইন্সে এবার ঢাকা এসেছি। ডিরেক্ট ফ্লাইট ছিল। বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা বা যখন পীয়ারসন এয়ারপোর্টে বিলবোর্ডে বিমান বাংলাদেশ লেখাটা ভেসে উঠে তখন গর্বে বুকটা ভরে উঠে। শেখ হাসিনার জন্যেই এটা সম্ভব হয়েছে। কালকে ঢাকায় মেট্রো চালু হচ্ছে। ও মাই গড ভাবতেই পারছিনা! ঢাকা টরন্টো ডিরেক্ট ফ্লাইট। বিমান ঢাকা পৌঁছায় গভীর রাতে। তাই ঘরে পৌঁছে কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই। গভীর রাতে না পৌঁছালেও এবার আর সেই আবেগটা নেই, লাগেজ রেখে ছুট দিয়ে বের হওয়ার। কেউ আর আজকাল অপেক্ষা করে না বরং একদিন দেখা করতে হবে সেই আতঙ্কে থাকে লোকজন। একদিন দেখা করা মানে শিডিউল বিপর্যয়। এমনিতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা যাওয়া মানে বিরাট ঝক্কি। আমি নিজেও এবার পারতপক্ষে ঘর থেকে বের হইনি। কোথাও যাওয়া মানে দিন পার। কেউ জানে না কখন গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। আজকাল ঢাকার রাস্তায় উবারও হাওয়া হয়ে গেছে যেনো। কল দিলেই গন্তব্য জানতে চায়। পছন্দ না হলে লাইন কেটে দেয়। তিরিশ চল্লিশ মিনিটের কমে উবারে উঠা যায় না। এক্সপেনসিভ এই সার্ভিসে কোনো জবাবদিহিতা নাই। আজব কান্ড কারখানা!

গত এক সপ্তাহ আনন্দের সাক্ষী যেমন ছিলাম বেদনার সাক্ষীও হতে হয়েছে। আমেরিকা প্রবাসী বন্ধু পিয়াল অবশেষে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে এটা ছিল বিরাট আনন্দের ঘটনা। মোহাম্মদপুর ইকবাল রোড মসজিদে যেদিন আকত পড়ানো হয় সেদিন যেমন উপস্থিত হতে পেরেছিলাম তেমনি ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা ক্লাবের রিসিপশনেও উপস্থিত ছিলাম। অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান ছিল। সেই রাতেই আর এক বন্ধু পান্নার ছেলের রিসিপশন ছিল ধানমন্ডির একটি রেষ্টুরেন্ট। ওর মেয়ে মালিহা চলে যাচ্ছে আমেরিকা পিএইচডি করতে সেটাও একটা উপলক্ষ ছিল বটে। সেদিন ঢাকা ক্লাব থেকে গিয়েছিলাম শান্তিনগর। সেখান থেকে হাতিরঝিল গিয়েছিলাম বন্ধুদের সাথে। হাতিরঝিল থেকে ধানমন্ডি পৌঁছতে লেগেছিল প্রায় আড়াই ঘন্টা। ঢাকার রাস্তা সেদিন ছিল মিছিলের নগরী। বিজয় দিবসের আনন্দ র‌্যালি ছিল সেদিন। পুরো শহর জমে ফ্রিজ হয়ে গিয়েছিল। আমিও গাড়ির এসিতে ফ্রিজ হয়ে ছিলাম তিন ঘন্টা। ২৩ ডিসেম্বর ছিল বাংলা একাডেমির বার্ষিক সাধারণ সভা। দিনটি আমার জন্য হতে পারত আনন্দে ভরা। শুরুও হয়েছিল সেভাবে। লেখক বন্ধুদের সাথে দেখা হলো। এই ধরণের অনুষ্ঠান ছাড়া সবার সাথে দেখা হওয়া কঠিন ঢাকা শহরে। দুপুর না গাড়াতেই আনন্দ বিষাদে রূপ নিল।

হঠাৎ খবর আসল বন্ধু চিনা আর নেই। দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশদিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর চিনা আর থাকল না। দেশের খ্যাতনামা ফ্যাশন ডিজাইনার এমদাদ হক। সেদিনই বনানী গোরস্তানে চিরদিনের জন্য রেখে আসল। ২৫ তারিখ ছিল চিনার জন্য দোয়া মাহফিল। বহুবছর পর গেলাম চিনাদের উর্দুরোডের বাড়িতে। ৯ হায়দারবক্স লেনের সেই চিরচেনা বাড়িটি খুঁজে পেতে মোটেও কষ্ট হলো না। চারিপাশের অনেককিছু বদলে গেলেও বাড়িটি এখনও আগের মতোই মাধা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। চারতলা বাড়িটার প্রতিটি মানুষ, প্রতিটা কর্নার, প্রতিটি ইট বালু, খাট, চেয়ার টেবিল আমার চেনা ছিল। আমি নিজেই ওই বাড়ির একজন হয়ে উঠেছিলাম। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় যখনই বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ হয়ে যেতো ওই বাড়ির চারতলার চিলেকোঠায় আমার আশ্রয় হতো। চিনার জন্য এটা সম্ভব হলেও একসময় বাড়ির প্রতিটি সদস্য আমাকে আপন করে নিয়েছিল। খালাম্মা ছিলেন তার অন্যতম। আমি যেনো তার আর এক সন্তান হয়ে উঠেছিলাম। পরশু যখন ওই বাড়িতে গেলাম বাড়িটাকে মনে হলো একটা মৃতপুরি। বিষাদে ভরপর। খালাম্মার শুন্য রুমটায় একটু বসলাম। মনটা হাহাকার করে উঠল। কেমন ছন্ন ছাড়া লাগল বাড়িটা। কেউই আর থাকে না বলেই এমন মনে হয়েছে।

সবাই ছিল বাড়িতে শুধু একজন ছিল না সে হচ্ছে চিনা। অন্ধকারময় সিঁড়ি ভেঙ্গে যখন নেমে আসছিলাম বাইরে কখন একসময় আবিষ্কার করলাম আমি কাঁদছি!

জানিনা এ কেমন চলে যাওয়া! কী ভীষণ শূন্য লাগছে সবকিছু! আমরা বিচিত্রায় প্রায় কাছাকাছি সময় সাংবাদিকতা শুরু করেছিলাম। শামীম আজাদের হাত ধরেই তাঁর ফ্যাশন সাংবাদিকতা শুরু হয়েছিল। তারপর নিজেই ফ্যাশন ডিজাইনার হিসাবে বিশাল খ্যাতি অর্জন করেছিল। বাংলার মেলা করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল দেশে। খুবই মানবিক মানুষ ছিল। সবার পাশে দাঁড়ানোর অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। সেই সুন্দর মনের মানুষ এমদাদ হক আমাদের আদরের চিনা সবাইকে কাঁদিয়ে আজ চলে গেলো! আমার ভাই, আমার বন্ধু ওপারে শান্তিতে থাক।

ঢাকা ২৭ ডিসেম্বর ২০২২

আসুন ভালকে ভাল বলি।

আমার ক্ষেত্রে যেটা হয় কাউকে হয়ত আমার পছন্দ হচ্ছে না কিন্তু সে যখন একটা ভাল কাজ করে তখন আমি তার প্রশংসা করি। মন খুলে প্রশংসা করি। আমার প্রশংসা সে খেয়াল করছে কিনা তা নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমার অনেক বন্ধু আছে যারা আমি কিছু লিখলে লাইক কমেন্টস করে না কখনও। উল্টো আমার সমালোচনা করে। তারা আমার চেনা। অতি চেনা। দেখা হলে হাসি গল্প করি, চা খাই এক টেবিলে বসে কিন্তু তাদের অন্তরে বিষ। কিন্তু তাতে আমি মাইন্ড করি না। আমি জানি তারা আমার কোনো কিছুতে প্রতিক্রিয়া না দেখালেও আমাকে ফলো করে। কিন্তু আমাকে উপেক্ষা দেখায়। অথচ তাদের ভাল কিছুতে আমি প্রশংসা করতে দ্বিধা করি না। ঠিক তেমনি রাজনীতির ক্ষেত্রেও এমনটা হচ্ছে। একজন যতই ভাল কাজ করুক বিরোধী পক্ষ কখনও প্রশংসা করবে না। রাজনীতিতে বিরোধিতা থাকবে তাই বলে প্রশংসা করব না সেটা ঠিক না। এই যে ভাল কে ভাল বা মন্দকে মন্দ বলতে না পারার সংস্কৃতি, এটা এখন আমাদের জাতীয় চরিত্রে রূপ নিয়েছে।

এক সময় আমি খুব ঘুরে বেড়াতাম। ঘোরা ঘুরি আমার নেশা। ছাত্রাবস্থায়ই আমি পুরো দেশটা ঘুরে ফেলেছিলাম। সে সময় এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যেতে কত কষ্টই না করতে হতো। দুর্গম ছিল যাতায়াত। এক ঢাপর কাঠি মামা বাড়ি যেতেই দিন পার হয়ে যেতো। লঞ্চে বা নৌকায় মায়ের সাথে যেতাম। এবার মার্চ মাসে ৪২ বছর পর ঢাপরকাঠি গেলাম। একটানে গাড়ি নিয়ে চলে গেলাম মামাবাড়ির উঠোনে। অবাক কান্ড! দিনে দিনে ফেরত আসলাম বরিশাল। দেশের যে প্রান্তেই থাকুক না কেনো যার সাথে কথা বলি সেই বলে গাড়ি নিয়ে আসতে পারবা। গত বিশ বছর দেশের বাইরে থাকি বলি তেমন ঘুরে দেখা হয়নি আর। দেশটাকে আবার নতুন করে চেনার চেষ্টা করছি। দেখার চেষ্টা করছি। শুধু পদ্মা সেত্ ুবা মেট্রোই না, আরো অনেক কিছু হচ্ছে। যমুনা নদীতে টানেল হচ্ছে, চিটিাগাং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইন হচ্ছে, এমনকি বরিশালেও রেল লাইন হচ্ছে যা ‘একনেক’ এ পাশ হয়েছে। বরিশালে রেল চলবে কখনও কেউ চিন্তাও করেনি।

গত এক যুগে ভোজবাজির মতো বদলে গেছে দেশ। পুরো দেশ একটা সূতোয় বাঁধা পড়েছে। যে বরিশাল যেতেই রাত পার হয়ে যেতো, দিনভর প্রস্তুতি নিতে হতো, একটা টিকিটের জন্য লঞ্চের লোকদের পিছন পিছন ঘুরতে হতো, মনে আছে স্টীমারের প্রথম শ্রেনীর টিকিটের জন্য মন্ত্রী পর্যন্ত ধরতে হতো। এখন লঞ্চের মালিকরাই প্যাসেঞ্জারদের পিছন পিছন ঘোরে বলে শুনেছি। এর কারণ সবার জানা। এখন বরিশাল যাওয়া যায় চার ঘন্টায়। প্লেনে যাওয়া যায় আধা ঘন্টায়। পদ্মা ব্রিজ দিয়ে সকাল সকাল রওয়ানা হয়ে বাড়িতে গিয়ে ব্রেকফাষ্ট খাওয়া যায়। ভাবা যায়! এর সবকিছুই সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার জন্য। সম্ভব হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর জন্য। তেমনি মেট্রোও স্বপ্ন ছিল ঢাকাবাসীর কাছে। অথচ এখন তা বাস্তব। আমার যেনো বিশ্বাসই হচ্ছে না! এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হলে এই নগরীতে যোগাযোগের বিপ্লব ঘটে যাবে। এই ধরণের মেগা প্রজেক্ট করতে ভিশন লাগে, পরিকল্পনা লাগে আর লাগে সাহস। যেটা শেখ হাসিনার আছে। টরন্টোর বাথার্স্ট স্টেশন থেকে কেনেডি স্টেশন পর্যন্ত আন্ডারগ্রাউন্ড ও এলআরটি শেষ করতে যত সময় লেগেছে তারচেয়েও কম সময় লেগেছে ঢাকায় উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্য্যন্ত এমআরটি ৬ চালু হতে। টরন্টোর লাইন এখনও চালুই হয়নি। টরন্টোর প্রজেক্টটির কাজ শুরু হয়েছিল ২০১২ সালে।

দূর্নীতি না হলে দেশ আরো উন্নতি করতে পারত। দূর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স সত্বেও বা দুদকের মতো দোর্দদন্ড প্রতাপের সংস্থা থাকা সত্বেও র্দ্নূীতির লাগাম টেনে ধরা যায়নি। মূল কথা হচ্ছে এই যে শেখ হাসিনা এতো কিছু করছেন সারা দেশে আমরা কেনো সবাই মন খুলে প্রশংসা করতে পারি না! আমরা যতটা না সমালোচনা করি, টক শোতে দেশোদ্ধার করি সেই তুলনায় ভাল কাজগুলোর প্রশংসা করি না। এর জন্য দায়ী আমাদের মানসিকতা। পৃথিবীর কোথাও এমনটা দেখা যায় না। সরকার বদলায় কিন্তু নীতি বদলায় না। একজনের ভাল কাজগুলি অন্যরা এগিয়ে নেয়। এই যে রিপাবলিকান আর ডেমোক্রাটদের মধ্যে এতো বাক বিতন্ডা হচ্ছে তা সত্বেও ট্রাম্পের অনেক নীতি বাইডেন অনুসরণ করছেন। দেশটাই আসল। জনগণই শেষ কথা। সুতরাং ভাল কাজগুলোর প্রশংসা করতে হবে। একজন প্রধানমন্ত্রী শুধু তার দলের না, সকলের। সুতরাং তিনি যখন কিছু করেন সেটা দেশের প্রতিটা মানুষের কথা ভেবেই করেন! পদ্মা সেতু দিয়ে কী সবাই যাচ্ছে না বা মেট্রোতে কী সবাই চড়বেন না!

ঢাকা ২৯ ডিসেম্বর ২০২২

জসিম মল্লিক, লেখক ও সাংবাদিক, টরন্টো, কানাডা।