প্রতিকুলতাকে জয় করে এগিয়ে যাওয়ার নামই জীবন

জসিম মল্লিক

আমার কিছু সমস্যা আছে। জটিল সমস্যা। সেটা হচ্ছে নিজেকে সঠিক মূল্যায়ন করতে না পারা। নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা না থাকা। আমি নিজেকে যতটা ভীতু মনে করি আমি আসলে ততটা ভীতু নই। আমি নিজেকে ভদ্রলোক বলে মনে করি তাই অন্যকে নিয়ে মাথা ঘামাই না। নষ্টকে নষ্ট বলতে আমার দ্বিধা হয়। আমি কারো কুৎসা গাইতে লিপ্ত হইনা। আমি সবসময় সত্যের পক্ষে। আপাত আমাকে ভীতু মনে হলেও আমি জীবনে অনেক সাহসী কাজ করেছি, সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ভীতু হলে এইসব সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারতাম না। আমি যা কিছু অর্জন করেছি সবই নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে, নিজের সাহসীকতায় এবং নিজের চেষ্টায়। আমাকে কেউ কিছু করে দেয়নি। আমি কারো কাছে কখনও হাত পাতিনি। চেয়ে নেইনি। চাইলে আমি জীবনে অনেক কিছু অর্জন করতে পারতাম, সে সুযোগ আমার ছিল। কিন্তু আমি তা করিনি। আমি কখনও অসৎ হইনি, কারো তাবেদারি করিনি। আমি যখন কারো জন্য কিছু করি ভালবেসে করি, বিনিময় চাই না। কেউ আমার সাথে চালাকি করলে আমি ঠিকই বুঝতে পারি কিন্তু কখনও তাকে সেটা বুঝতে দেই না। এটাকে কেউ আমার বোকামি বা দুর্বলতা মনে করলে সেটা ভুল।

আমার সন্তানদের আমি অনেক কষ্ট করে বড় করেছি। পরম মমতায় বড় করেছি। আমি অনেক সংগ্রাম করেছি, কঠোর পরিশ্রম করেছি। সহজে আমার জীবনে কিছু ঘটেনি। আমি কখনও কোনো অন্যায় সুবিধা নেইনি। কোনো অন্যায় কাজের সাথে আমি জড়িত নই। আমি উজান ঠেলে বড় হয়েছি। যা ঘটার কথা ছিলনা তাই ঘটেছে আমার জীবনে। বরিশালের মতো এক ছোট্ট শহর থেকে আমি একলা একদিন ঢাকায় এসেছিলাম। কুল কিনারাহীন জীবন ছিল তখন আমার। ঢাকা শহরে আমার কেউ নাই, কাউকে চিনিনা, খাওয়ার পয়সা থাকে না। সেই আমি একদিন ঢাকা বিশ্বাবদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। অথচ এর আগে আমি কখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখিনি। তখনও জানিনা কিভাবে পড়ব, কোথায় থাকব, আদৌ এটা সম্ভব কিনা আমার পক্ষে জানা ছিলনা কিছুই। বস্তুতঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই আমার জীবনটাকে বদলে দিয়েছিল। সাহসী করে তুলেছিল। সেখানে দেশের সব মেধাবীরা, টগবগে তরুন, যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তারাই শিক্ষার্থী। শিক্ষকরাও দেশের সেরা সব ব্যক্তিত্ব। মহসিন হলে থেকেছি এবং ছাত্রাবস্থায়ই একদিন দেশের সেরা নিউজ ম্যাগাজিন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজ করার সুযোগ পাই আমি।

বিচিত্রার কারনেই দেশের বড় বড় লেখক, কবি, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আমলা, শিল্পী, ব্যারিষ্টারদের সাথে চেনা জানা হয় যারা ছিল আমার কল্পনার মানুষ, স্বপ্নের মানুষ। জাতীয় প্রেসক্লাবের মেম্বার হলাম যা সব পেশাদার সাংবাদিক বা জনসংযোগ কর্মীদের জন্য আরাধ্য। বিচিত্রায় অনেক সাহসী রিপোর্ট করেছি। স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে বিচিত্রার অনেক কাজ আছে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছি। জেসমিনের মতো রুপসী মেয়ের সাথে পরিচয় হয়েছে ক্যাম্পাসে। পরিচয় থেকে পরিণয়। এটাও ছিল বিরাট সাহসী সিদ্ধান্ত। জেসমিন আমার জীবন বদলে দিয়েছে। পাশে থেকেছে সবসময়। দেশ বিদেশের সেরা পত্রিকাগুলোতে আমি লেখার সুযোগ পেয়েছি, সেরা প্রকাশনী থেকে আমার বই প্রকাশিত হয়। দেশ বিদেশের বইমেলায় আমি অংশ নেই। পত্রিকা বা টেলিভিশনে কথা বলার সুযোগ পাই। অনেক দেশ ঘুরতে পারি।

১৯৯৫ সালে ঢাকা শহরে আমি প্রথম গাড়ির মালিক হই যা ছিল প্রায় স্বপ্নের মতো। কানাডা আসা ছিল আমার জীবনে সবচেয়ে সাহসী সিদ্ধান্ত। শিকড় উপরে চলে আসাটা এতো সহজ কাজ নয়। কানাডা আসার আগেও আমি আমেরিকা, ইউরোপ ঘোরার সুযোগ পেয়েছি। ১৯৯৮ সালে সাহস করে আমেরিকান এম্বাসিতে দাঁড়িয়েছি এবং তারা আমাকে ভিসা দিয়েছে, ইউকে ভিসা দিয়েছে। সেবারই প্রথম প্লেনে চড়া আমার। ২০০৩ সালে কানাডা ইমিগ্রেশনের জন্য ইন্টারভিউ দিতে আমি লসএঞ্জেলেস গিয়েছিলাম এবং আমি কোয়ালিফাই করেছিলাম। জার্নালিষ্ট ক্যাটাগরিতে আমার ইমিগ্রেশন হয়েছিল। প্রথমে অটোয়া আসি সপরিবারে। সেখান থেকে ২০০৪ সালে টরন্টো পারি জামানোটাও ছিল সাহসী সিদ্ধান্ত। ২০১৯ এ হজ্জ করাটাও ছিল পরম সৌভাগ্যের আমার জন্য।

আমার টিকে থাকার লড়াইটা এতো সহজ ছিল না। আমি আমার অতীত ভুলি না। অস্বীকার করি না। চ্যালেঞ্জ নেওয়াটাই আমার নিয়তি। তাই আমার অল্পতেই ভেঙ্গে পড়ার মতো কোনো কারণ ঘটেনি। যেসব বিষয় আমার হাতে নেই, আমার নিয়ন্ত্রণে নেই সেসব নিয়ে আমি মাঝে মাঝে উদ্বিগ্ন হই, মাথা ঘামাই। যেটা আমার হাতে আছে বর্তমান, সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করাই হচ্ছে বুদ্ধিমানের কাজ। বিদেশে গুটিকয় লোক আছে যারা আমার প্রতি অহেতুক ঈর্ষান্বিত, আমার সাথে শত্রুটা করার চেষ্টা করে অথচ তাদের সাথে আমার কোনো সখ্যতা নাই, বন্ধুত্ব নাই, উঠাবসা নাই। যাদের ধারে কাছেও আমি ঘেষিনা। আমি সবসময় মানবিক গুনাবলী সম্পন্ন মানুষদের সাথে বন্ধুত্ব করি। আমার ভালমানুষিকে যারা দুর্বলতা মনে করে তারা ভুল করে। আমি আমার মতো থাকতে চাই। প্রকৃতি আমাকে সবসময় রক্ষা করে। বুকে আগলে রাখে। আমার সাথে মায়ের দোয়া এবং মানুষের ভালবাসা আছে। উজান ঠেলেই আমি সামনের দিকে এগিয়ে গেছি। প্রতিকুলতাকে জয় করে এগিয়ে যাওয়ার নামই জীবন। একজন যিনি আছেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী তিনি সঠিক পথ দেখাবেন।

টরন্টোঃ ৪ নভেম্বর ২০২২

মায়ের শূন্য ঘরটা আমাকে সবসময় তাড়িত করে

যখন ঢাকায় ছিলাম তখন প্রতি ঈদ, কোরবানি বা ছুটি ছাটা পেলে বাড়িতে যেতাম মাকে দেখতে। ২০০৩ সালের জুন মাসে কানাডা আসার আগে বাড়িতে গেলাম। একদিন সন্ধ্যার পর দেখি, মা তার ঘরে শুয়ে আছেন। কিছুক্ষণ আগেই মাগরিবের নামাজ পড়া শেষ করেছেন। নামাজ পড়া শেষ হলেও মা অনেকক্ষণ জায়নামাজে বসে থাকেন। আমি ঘুর ঘুর করছি মায়ের ঘরে যাওয়ার জন্য। যখন দেখলাম মা বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছেন আমি আলগোছে মায়ের পাশে গিয়ে বসলাম। জুতা খুলে মায়ের পাশে আধশোয়া হয়ে পা মেলে দিলাম।

মায়ের সাথে লেখক। ছবি : ফেসবুক

মায়ের হাতটা হাতে নিলাম। মাথার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিলাম। উড়োখুড়ো চুল, জটা লেগে আছে। মনে হয় কয়েকদিন তেল পড়েনি চুলে, চিরুনি বুলানো হয়নি। পরিস্কার ধবধবে সাদা শাড়ি, কালো পাড়। শাড়িটা আমারই কিনে দেওয়া। নীল স্ট্রাইপের বিছানার চাদর, ম্যাচিং বালিশের কভার। বিছানার চাদরটাও আমি কিনে এনেছিলাম ঢাকা থেকে। জানালার পর্দা একটু ফাঁক করা। লাল রঙের লোহার গ্রিল। সেখানে একটা পেয়ারার ডাল এসে পড়েছে। দেয়ালে পালতোলা নৌকার ক্যালেন্ডার। উপরের তাকে একটা সুটকেসে মায়ের সরঞ্জাম। পাশের টেবিলে ওষুধ, পানির জগ আর পানের ডিব্বা। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে, একটা স্বল্প পাওয়ারের লাইটের আলোতে মাকে খুউব রোগা লাগছে।

মা বললেন, কিছু বলবা!

মা জানে যখনই আমি তার খুব কাছ ঘেসে বসি তখনই কিছু একটা দাবী দাওয়া থাকে আমার। ছোট বেলা থেকেই এই অভ্যাস। মায়ের বুকের মধ্যে লেপ্টে থাকতাম। মাকে পাটানোর কৌশল। মা আমার চালাকি সব বোঝেন।

-আপনার শরীর তো ভেঙ্গে গেছে মা। শুকিয়ে গেছেন। আপনি ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করেন না!

-খাইতো।

-না খেলে শরীর আরো ভেঙ্গে পড়বে। পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। আমি যে এতো কিছু কিনে দিয়ে যাই সেগুলো তো সব মানুষকে দিয়ে দেন।

-তোমারে কে বলছে খাই না। খাই।

-আমি তো দেখি আপনি বাটিতে একটু ভাত নিয়ে ঘরময় ঘোরেন আর খান। টেবিলে বসে শান্তিমতো খেতে দেখি না কখনও। ঠিকমতো ওষুধও খান না। ফল আনি তাও মানুষকে দেন।

-তুমিওতো শুকাইয়া গেছো।

-আমি ঠিক আছি। আপনার কিছু লাগলে বলবেন।

-কিছু লাগবে না বাবা। শুধু ভাংতি টাকা দিয়া যাইও। গরীবকে দিতে হয়। তুমি আসলে সবাই আসে।

একসময় আমি আসল কথাটা বললাম, মা আমি কানাডা চলে যাচ্ছি।

মা প্রথমে বুঝতে পারেন নি। বললেন, কানাডা কি অনেক দুর! কতদিন থাকবা!

মা জানে আমি প্রায়ই বিদেশে যাই। কানাডাও সেরকম মনে করেছে।

-হ্যাঁ মা। অনেকদুর। আমেরিকার মতো দুর।

এর আগে আমি দুবার আমেরিকা গেছি মা জানেন।

-সাবধানে থাইকো।

-এবার সবাই যাচ্ছি মা। একবারে।

মাকে আগে ভাগে বলিনি যে আমি কানাডা চলে যাব। মা খুবই অবাক হলেন। বাক্যহারা হয়ে গেলেন! অনেকক্ষণ কিছু বলতে পারলেন না।

-আর আসবা না!

-আসব না কেনো, আসব। চিন্তা করবেন না।

ঢাকা থেকে যেমন বছর বছর যেতাম বরিশাল তেমনি কানাডা আসার পরও প্রতি বছর দেশে গিয়েছি, বরিশাল গিয়েছি। মাকে বুঝতে দিতে চাইতাম না যে আমি অনেক দুরের এক দেশে থাকি যেখান থেকে চাইলেই ছুটে আসা যায় না। মা একদিন বললেন, তুমি একটা পাখি, এই দেখি আবার দেখি নাই। তারপর মা কাঁদেন।

২০১০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর মা মারা যান। মা মারা যাওয়ার পরও প্রতিবছর দেশে গিয়েছি। মায়ের কবরের কাছে গিয়ে বসে থাকি। মায়ের সাথে গোপন কষ্টের কথা হয়। মানুষের অবহেলা, অপমানের কথা বলি, লেখার কথা বলি, সন্তানের কথা বলি। তারপর মন শান্ত হয় আমার। মা আমাকে ঠিক দেখতে পান। মানুষতো আর শুধু দেহেই বাঁচে না। মানুষ বেঁচে থাকে স্মরনে, মননে।

২০১০ সালের পর থেকে প্রতিবছর বরিশাল যাই ঠিকই কিন্তু কখনও বাড়িতে রাত কাটাইনি। কারণ রাতে বাড়তে থাকলেই মায়ের শূন্য ঘরটা আমাকে অনেক কষ্ট দেয়, আমি মেনে নিতে পারি না যে মা নাই। মায়ের ঘরটায় একটা পুরনো বেতের সোফা আজও আছে। সেখানে একটু বসে থাকি। তারপর হোটেলের নিঃসঙ্গ কক্ষে ফিরে আসি। মা নাই যে বাড়িতে সেই বাড়িতে আমি কিভাবে থাকব!

টরন্টো ৮ নভেম্বর ২০২২

একজীবনের গল্প

আশির দশকের শুরুর দিকে আমি ঢাকা আসি। শহরের কিছুই চিনিনা তখন। শুধু কয়েকটি পত্রিকার নাম জানি। দৈনিকবাংলা, বিচিত্রা, ইত্তেফাক, সন্ধানী, সংবাদ, বাংলাদেশে টাইমস, বেগম, অবজারভার, চিত্রালী এসব পত্রিকা। কিন্তু সেগুলোর অবস্থান কোথায় তা জানি না। জানার আগ্রহও হয়নি। এর কারণ সেখানে আমাকে কেউ চেনেনা, আমিও কাউকে চিনিনা। আমি এমনিতেই ভীতু এবং লাজুক। আমার মানুষের সাথে তেমন কথাও থাকে না। আমার একটাই কাজ পত্রিকায় চিঠি লেখা। বরিশালে থাকতেই চিঠিপত্র লেখা শুরু আমার। সেই চিঠি নিয়মিত ছাপা হয়। কোনো চিঠিই প্রায় রিজেক্ট হয় না। অবাক কান্ড!

সবচেয়ে যে পত্রিকাটি আমাকে মুগ্ধ করত সেটার নাম বিচিত্রা। পকেট খরচের পয়সা বাঁচিয়ে বিচিত্রা কিনি আমি। দুই টাকা দাম। কিনতে না পারলে বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়ি। শুক্রবারের জন্য অপেক্ষা করি। বিচিত্রায় আমার লেখার ক্ষেত্র চিঠিপত্র বিভাগ, জীবন এখন যেমন বিভাগ। আর ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন। ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন লিখতে পয়সা লাগত। প্রতিশব্দ পঞ্চাশ পয়সা। আজকে যেটা চ্যাটবক্স সেটাই বিচিত্রা শুরু করেছিল বহু বছর আগে। পয়সার বিনিময়ে তরুনদের মনের কথা প্রকাশের জায়গা ছিল বিচিত্রার ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন। চিঠিপত্র লেখার কারণে আমার অনেক পত্রবন্ধু হয়ে গেলো। প্রচুর চিঠি আসত আমার কাছে। বিচিত্রা ঘরে রাখত না এমন কোনো শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবার নাই। সেখানে আমার চিঠি ছাপা হয়। ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন ছাপা হয়। ভাবা যায়!

মাঝে মাঝে কৌতুহল হতো বিচিত্রা অফিসটা কোথায় একটু দেখে আসি। একদিন ঠিক খুঁজে বের করলাম। দৈনিকবাংলা ভবনের তিনতলায় এর অফিস। ১ ডিআইটি এভিনিউ। পর পর কয়েকদিন নিচ দিয়ে ঘুরে আসলাম। তিনতলায় উঠার সাহস পেলাম না। একদিন দোয়া দুরূদ পড়ে তিনতলায় উঠে গেলাম। দৈনিকবাংলার পুরনো লিফটে উঠে ভয় পাচ্ছিলাম। ক্যার ক্যার শব্দ হচ্ছিল। অবশেষে বিচিত্রার পিয়ন মুনির পর্যন্ত পৌঁছলাম।

-কারে চান! লোকটা প্রায় ধমকের সুরে বলল।

-কাউরে চাই না।

-আসছেন কি দরকারে।

-এমনি আসছি। দেখতে।

-দেখার কি।

-আমি চিঠি লিখি তো তাই দেখতে আসছি অফিসটা কেমন।

-আপনার নাম কি!

-জসিম।

-পুরা নাম কন।

-জসিম মল্লিক।

-অ। আপনে জসিম মল্লিক!

-জ্বি।

-আপনার লেখা তো ছাপি।

এমনভাবে বলল যেনো মুনিরই আমার লেখা ছাপার দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত। লোকটাকে আমার পছন্দ হলো। আমার লেখা ছাপে, ভালো লোক!

-ধন্যবাদ আপনাকে।

আমাকে অবাক করে দিয়ে মুনির বলল, আপনারেতো খোঁজে।

-আমারে! কে খোঁজে!

-শামীম আজাদ।

-শামীম আজাদ কে!

-শামীম আজাদকে চেনেন না!

-না চিনিনা।

-জান কালকেই দেখা করে আসেন।

-কোথায় দেখা করব!

-ধানমন্ডি পনোরো নম্বর তার বাসা।

-কেমনে যেতে হয়।

-বাসে যাবেন। তারপর ঠিকানা দিলেন।

একদিন বিকেলের দিকে গেলাম ধানমন্ডি পনেরো নম্বর। বাস থেকে নেমে পকেটে হাত দিয়ে দেখি পকেট কাটা। কয়েকটা টাকা ছিল পিক পকেট হয়ে গেছে! মনটা খরাপ হয়ে গেলো। তাও গেলাম বাসায়। দাড়োয়ান ভিতরে নিয়ে বসালো। সুসজ্জিত ড্রয়িংরুম। একটু পর চা এলো ট্রলিতে। আমি চা বিস্কিট খাই। মিনিট পনেরো পর একজন খুব সুদর্শন নারী এলেন ড্রয়িংরুমে। বসলেন আমার মুখোমুখি সোফায়। পায়ের উপর পা তুলে বাসার ভঙ্গিটা ছিল দারুণ স্টাইলের। অফ হোয়াইট জমিনের উপর ম্যাচিং পাড়ের শাড়ি পরা।

-তুমি জসিম মল্লিক!

-জ্বি। আমি শামীম আজাদের কাছে আসছি। ওনাকে ডেকে দেন।

-ভদ্র মহিলা হেসে বললেন, আমিই শামীম আজাদ।

আমার তো ভিড়মি খাওয়ার মতো অবস্থা। বিশ্বাসই হচ্ছিল না উনি শামীম আজাদ। আমি মনে করছিলাম শামীম আজাদ পুরুষ মানুষ!

তোমার লেখা তো ভাল। পরিস্কার।

আমি নত মস্তকে বসে থাকি। মুখের দিকে তাকাতে পারি না।

তুমি কোথায় থাক, কি করো!

তখনও আমার কোনো প্লান নাই। ঢাকায় উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুড়ে বেড়াই। মনের মধ্যে গোপন স্বপ্ন, আমি লেখক হতে চাই। বরিশালের নিস্তরঙ্গ জীবন থেকে মুক্তি চাই। কিন্তু কিভাবে তাঁকে কথাগুলো বলব গুছিয়ে উঠতে পারছিলাম না। মা অনেক কান্নাকাটি করবে সেটাও একটা সমস্যা আমার জন্য।

বুদ্ধি করে বললাম, লিখতে আমার অনেক ভাললাগে। আমি লেখালেখি করতে চাই। সম্ভব হলে ঢাকায় থেকে পড়াশুনা করার ইচ্ছা। কিন্তু আমার কেউ নাই। কাউকে চিনি না। মনে হয় বরিশাল ফিরে যেতে হবে।

তিনি বললেন, কেনো ফিরে যাবে! ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যাও। আর কালকে থেকে বিচিত্রা অফিসে আসবা। আমার বিভাগে কাজ করবা। ‘জীবন এখন যেমন’ বিভাগ সম্পর্কে তো তুমি জানো।

সেদিনই আমার জীবন বদলে গেলো। নিয়তি আমার ডেস্টিনি লিখে ফেলল। আমি বিচিত্রায় কাজে লেগে গেলাম। মাস গেলে পয়সাও পাই। ভুতুরে সব কান্ড ঘটতে লাগল আমার জীবনে। সে সময় ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট কিছুই চিনিনা। জীবন এখন যেমন বিভাগে কোথায় পাবেন নামে একটা সেকশন ছিল। সেখানে আজব আজব সব জিনিসের সন্ধান আনতে বলতেন শামীম আপা। আমাকে দৌড়ের উপর রাখতেন। পেরেশান হয়ে যেতাম আমি। ঠিকানা খুঁজে বের করা, লোকজনের সাথে কথা বলা এবং সেসব নিয়ে লেখা। এভাবেই ঢাকা শহরের অলিগলি এবং মানুষ চিনতে শুরু করলাম। আপন দর্পণ বিভাগের জন্য শামীম আপা রিডার্স ডাইজেস্ট থেকে কুইজ অনুবাদ করতে বলতেন। অনেকটা পরীক্ষার পড়ার মতো ছিল ব্যাপারটা আমার কাছে। আমার বন্ধু মসিউর রহমান খোকন তখন আমাকে অনেক হেল্প করেছেন।

আস্তে আস্তে কাজের ব্যাপ্তি বাড়তে লাগল আমার। পড়াশুনাও চালিয়ে যেতে লাগলাম। মহসিন হলে থাকি। বিচিত্রার ফ্যাশনের কাজে যুক্ত হলাম। ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতা বিচিত্রায়ই প্রথম শুরু করেছিল। দেশীয় তাঁতকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল বিচিত্রা। শামীম আজাদ ছিলেন এই কাজের নেতৃত্বে। বড় বড় রিপোর্ট করতে শুরু করলাম। পাশাপাশি সাহিত্যের প্রতি মনোযোগী হলাম। যদিও সে সময়টা আমার জন্য ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জের। একদিকে পড়াশুনা চলিয়ে যাওয়া, অন্যদিকে টিকে থাকার লড়াই। কিন্তু আমি আশাহত হইনি কখনও। হাল ছাড়িনি। শামীম আজাদ সবসময় আমাকে সাহস জুগিয়েছেন, পাশে থেকেছেন যতদিন দেশে ছিলেন। আমাদের আজও দেখা হয়, কখনও লন্ডন, কখনও ঢাকা, কখনও টরন্টোতে।

আজও আমার মেন্টর তিনি। আজ তার জন্মদিন। জন্মদিনের শুভেচ্ছা প্রিয় লেখক।

টরন্টো ১১ নভেম্বর ২০২২

তোমার কাছে যাওয়া

কখনও এমন হয়নি আমার। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে একটা উপন্যাসে হাত দিয়েছি কিন্তু এখনও শেষ করতে পারিনি। লেখালেখির জন্য যে নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ দরকার, বিশেষকরে উপন্যাস লেখার জন্য সেটাই হচ্ছে না। সামান্যতম ডিস্টার্ব হলেও আমার মনোযোগ ছুটে যায়। উপন্যাস লেখার মতো কঠিন কাজ আর নেই। রাতের আঁধারে নীল এই নামে একটা স্মৃতিকথার বই অবশ্য শেষ করেছি। ঘরের লোক মনে করে লেখালেখি একটা কাজ হলো! সময়ের অপচয়। দেখা গেলো গভীর মনোযোগ দিয়ে লিখছি, গল্পের মধ্যে ডুবে গেছি হঠাৎ একটা না একটা কিছু কাজের কথা মনে পরবে। একবার মনোযোগ ছুটে গেলে আর সহজে মন বসাতে পারি না। সেই কথা বোঝার মতো মানুষ কই! এমনিতে আমি খুবই অলস প্রকৃতির। বিশেষকরে লেখালেখির ব্যাপারে। নিজেকে নিজে ফাঁকি দেওয়া অনেক সহজ। নিজেকে নিজে বলি, এখন থাক পরে লিখবনে, এখন মুড ভাল নাই বা এখন একটু ফেসবুক করি বা একটু মুভি দেখি, খেলাটা মিস করা যাবে না। আচ্ছা কালকে সকাল থেকে শুরু করবনে। এই করে করে সময় পার হয়ে যাচ্ছে। সাধারণতঃ আমি সেপ্টেম্বর/ অক্টাবরের মধ্যে স্ক্রিপ্ট পাবলিশারকে দিয়ে দেই। এবার নভেম্বরের শেষ প্রান্তে এসেও উপন্যাসের অর্ধেকটাও লেখা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাস। কাজটা কঠিন বৈকি!

আজকে অরিত্রি আর সাদ এসেছিল। ওরা যখন আসে তখন আমি ওদের কাছ থেকে নড়ি না। দুনিয়ার গল্প করি। খেলার গল্প, নতুন মুভির গল্প, নতুন জায়গায় বেড়ানোর গল্প। এখন অবধারিত বিশ্বকাপ নিয়ে কথা হবে। আমি খেলা প্রিয় মানুষ, সিনেমা পাগল মানুষ, বেড়ানোর জন্য পাগল। তাই আমার লেখালেখি হয় না। লেখালেখির জন্য নিরবচ্ছিন্ন সময় দিতে পারি না। এতো লড়াই সংগ্রামের জীবন আমার তা সত্ত্বেও ৪০/৪২টা বই কিভাবে লিখলাম সেটাই বিস্ময়কর! পরীরা লিখে দিয়ে যায়!

আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, ইংল্যান্ড যে এবার ফেবারিট সেই গল্প করি আমরা। কানাডার জার্সি কোথায় কিনতে পাওয়া যাবে সেই তথ্য দেয় অরিত্রি। আর্জেন্টিনার একটা জার্সি গিফট করেছে অরিত্রি। দেড়শ ডলার দাম। এবার কানাডা আমার প্রথম পছন্দ। আমি চাইব কানাডা ফাইনাল খেলুক। নিজের দেশ বলে কথা। তারপর অবশ্যই আর্জেন্টিনা। মেসির জন্য এই বিশ্বকাপটা জেতা দরকার। এটা তার প্রাপ্য। বিস্ময়কর এক ফুটবল যাদুকর।

কালকে অরিত্রি আটলান্টা যাচ্ছে তাই দেখা করতে এসেছিল। সাদের অফিস আটলান্টা। ওখান থেকে যাবে কানকুন বেড়াতে। বললাম সাবধানে থাইক। মাফিয়াদের জায়গা, যে কোনো সময় গানফাইট শুরু হয়ে যেতে পারে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি দুই সপ্তাহের জন্য এশিয়া ট্যুরে যাবে ওরা। প্রথমে সিঙ্গাপুর, সেখান থেকে কুয়ালামপুর ও ব্যাংকক। এই সুযোগে আমিও একটা ট্যুর প্রোগ্রাম করে ফেললাম। জানুয়ারির শুরুতে ব্যাংকক-ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়া ট্যুর। বাবার কোনো আবদারে না নাই অরিত্রির। অর্ক আগামী এপ্রিলে আমাকে ভ্যাঙ্কুভার নিয়ে যাবে আগেই জানিয়েছে। ছেলেদের প্রোগ্রাম হবে ওটা। অর্ক আর খাতিজা সেপ্টেম্বরে টোকিও এবং সিওল যাওয়ার টিকেট করেও ফেলেছে। অর্ক ইতমধ্যে অনেক দেশ ঘুরে ফেলেছে। ওরা পেয়েছে আমার স্বভাব। অর্ক আমাকে খুবই উৎসাহিত করে। বাবা, যেখানে যেতে মন চায় যাও, যা করতে মন চায় করো। কারো জন্য বসে থেকোনা। তোমাকে কেউ একম্পানি না করলে একলা যাও।

আগামী জুনে নিউইয়র্ক বইমেলা আছে। তারপর জুলাইতে ইউরোপ যাওয়ার প্ল্যান। লন্ডন থেকে শুরু হবে। অরিত্রি টিকিট দেবে বলেছে। মামুন আর সুমিকে ভিজিট করতে যাব গ্রাঞ্জিতে। লন্ডন থেকে ইউরোস্টারে প্যারিস। সেখানে আছে বন্ধু পলাশ। আগেও গিয়েছি। তারপর সুইজারল্যান্ড এবং ইতালি। সবকিছুই নির্ভর করবে আল্লাহর রহমতের উপর, সুস্থ্যতার উপর। ঘোরার

তালিকা অনেক লম্বা আমার। সংসারের প্যারা থেকে মুক্তি নেওয়ার এটাই সময়। ছোট বেলা থেকেই আমার মধ্যে একটা উড়ু উড়ু ব্যাপার ছিল। কোথাও মন বসতে চাইত না আমার। শুধু ঘুরতে মন চাইত। মা বলত, তুমি একটা পাখি। এই জন্য মা আমাকে বেশি কাছে পায়নি।

বরিশাল থেকে ঢাকা, তারপর টরন্টো। এরপর কত দেশইতো ঘোরা হয়েছে। অথচ যখন বরিশাল ছিলাম তখন ভাবতাম আমি কি কখনও ঢাকা যেতে পারব! প্লেন দেখলেই মনটা উদাস হয়ে যেতো। ছোট্ট একটা ফড়িং-এর মতো জিনিস, কোথা থেকে আসে আর কোথায়ইবা যায় কে জানে! যখন কলেজে পড়ি তখন আমেরিকার ওপর লেখা শংকরের এপার বাংলা ওপার বাংলা পড়ে মনে হতো সত্যি পৃথিবীতে ওরকম একটা দেশ আছে! আমি কি যেতে পারব! তারপর কত ভ্রমণ কাহিনী পড়েছি। সুনীলের ছবির দেশে কবিতার দেশে, নীললোহিতের তিন সমুদ্র সাতাশ নদী বা সমরেশের বিনেসুতোয়। আবুল হাসানের কবিতার লাইন দিয়ে শেষ করছি,

..এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া

তোমার ওখানে যাব, তোমার ভিতরে এক অসম্পূর্ন যাতনা আছেন,

তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই শুদ্ধ হ’, শুদ্ধ হব

কালিমা রাখব না!

টরন্টো ১৭ নভেম্বর ২০২২

জসিম মল্লিক, লেখক ও সাংবাদিক, টরন্টো, কানাডা।