কানাডার যে স্কুলবোর্ড সর্বপ্রথম ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কৌশল নিয়েছে

সাম্প্রতি বছরগুলিতে মুসলিমবিরোধী মনোভাবের দুরূহ পরিস্থিতির পর নীতি প্রণয়ন করা হয়

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক, ২৬ জানুয়ারি ২০২৩ : কানাডায় ইসলামোফোবিয়া দূর করা এবং মুসলিম শিক্ষার্থীদের স্বতন্ত্র পরিচিতির স্বীকৃতি দেওয়ার লক্ষ্যে প্রণীত কৌশল সর্বপ্রথম গ্রহণ করে পিল ডিস্ট্রিক্ট স্কুলবোর্ড (চউঝই)। এই বোর্ডের অধীন স্কুলগুলিতে ধর্মীয় বিশ্বাসভিত্তিক পরিচয়ের দিক থেকে মুসলিম শিক্ষার্থীরাই সংখ্যায় বৃহত্তম- ছাত্র-ছাত্রীদের এক -চতুর্থাংশই মুসলিম। খবর সিবিসি নিউজের।

উল্লেখ্য যে, ছয় বছর আগে টরন্টোর পশ্চিমাঞ্চলের একটি স্কুলবোর্ড অনেকগুলি ভুলের কারণে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে।

ওই স্কুলবোর্ডের বোর্ডসভায় ধর্মীয় সহাবস্থান বিষয়ে আলোচনার সময় বিস্ফোরণাত্মক বর্ণবাদী আচরণ প্রকাশ পাওয়ায় নিরাপত্তা জোরদার করতে হয়, আলোচনার সময় এক ব্যক্তি পবিত্র কুরআনের পাতা ছিঁড়ে ফেলেন এবং মুসলিম শিক্ষার্থীদেরকে শুক্রবারের জুম্মার নামাজে প্রচলিত খুৎবা বাদ দিয়ে স্কুলবোর্ডের অনুমোদিত খুৎবা থেকে পাঠ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

২০১৬ সালে পিডিএসবির স্কুলবোর্ডের এক সভায় উপস্থিত মুসলিম বাবা-মায়েরা। সভায় তারা বোর্ডের অনুমোদিত খুৎবা থেকে বেছে নেওয়ার নির্দেশ দেবার পর মুসলিম শিক্ষার্থীরা কীভাবে নিজেদেরকে অপমানিত বোধ করছে সেই বিষয়ে আলোচনা করেন- এর পরই নির্দেশটি প্রত্যাহার করা হয়। ছবি : নিক বোইসভার্ট/সিবিসি

পিল ডিস্ট্রিক্ট স্কুলবোর্ডের কর্মকৗশল সম্পর্কে কানাডার ন্যাশনাল মুসলিম কাউন্সিল বলেছে, যে সময়ে স্কুলবোর্ড এই কৌশল গ্রহণ করলো তা তাৎপর্যহীন নয়।

কাউন্সিলের শিক্ষা বিষয়ক পরিচালক আসিয়া খান এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছেন, “পিডিএসবি ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো এবং সারাদেশের স্কুলবোর্ডগুলির জন্য এটি নিয়ে গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অনুসরণ করা বিজ্ঞজনোচিত হবে।”

‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’

আসিয়া খান আরও বলেন, কুইবেক সিটিতে মুসলিমদের গুলি করে হত্যার ঘটনার ষষ্ঠ বার্ষিকীতে পিডিএসবি’র এই ঘোষণা সত্যিই যথোপযুক্ত পদক্ষেপ। ওই গুলির ঘটনা দেশকে বদলে দেয়। এই কৌশল আগামীর দিকে এক “ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।”

২০২০ সালে অন্টারিওর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক পর্যালোচনায় উল্লেখিত বোর্ডের স্কুলগুলিতে কৃষ্ণাঙ্গ-বিরোধী বর্ণবাদ গুরুতর চ্যালেঞ্জ বলে দেখতে পাবার পরই পিডিএসবি’র এই কৌশল ঘোষণা করা হলো। আর গত বুধবারের এক রিপোর্টে স্কুলবোর্ড আরও উল্লেখ করে যে, তাদের স্কুলগুলিতে “শ্রেণীকক্ষে ভয়ঙ্কর ইসলামবিরোধী শিক্ষণসামগ্রী ও উপকরণ ব্যবহার” করা হয়ে থাকে যা মুসলিম শিক্ষার্থী ও স্টাফদের জন্য ক্ষতিকর।

ইসলামোফোবিয়া-বিরোধী এই কৌশলের উদ্ভব ঘটে পিডিএসবি’র প্রাক্তন ট্রাস্টি নোখা ডাকরোবের ২০২১ সালের এক প্রস্তাব থেকে। প্রস্তাবে বোর্ডের সব স্টাফের জন্য ইসলামোফোবিয়া-বিরোধী প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা বলা হয়।

পিডিএসবি’র প্রাক্তন ট্রাস্টি নোখা ডাকরোব

মূলত কৌশলটির ভিত্তি হলো অন্টারিওর মানবাধিকার কমিশনের সংজ্ঞা, যাতে বলা হয়েছে, ইসলামোফোবিয়া হলো: মুসলিম ব্যক্তিবিশেষ অথবা সাধারণভাবে ইসলামের অনুসারী সব মানুষের প্রতি বৈরিতা বা পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিন্ন বৈশিষ্ট্য। অসহিষ্ণুতা এবং জাতিগত বিদ্বেষমূলক ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ড ছাড়াও ইসলামোফোবিয়ার মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে দেশের প্রতিষ্ঠানসমূহ, সামাজিক-রাষ্ট্রিক ব্যবস্থা এবং সমাজের জন্য ইসলামকে বৃহত্তর নিরাপত্তাজনিত হুমকি বলে ধরে নেয়া।

পিডিএসবি বলেছে, এই পদ্ধতিগত মনোভাব মুসলিম ব্যক্তিবর্গ ও মুসলিম সমাজের প্রতি সন্দেহ ও নজরদারি করার এক অযৌক্তিক সংস্কৃতির জন্ম দেয়। এ প্রসঙ্গে বোর্ড একটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করে। সেটি হলো, জুম্মার নামাজের জমায়েতের সময় মুসলিম ছাত্রদের ওপর নজরদারি করার জন্য নগদ অর্থ দিয়ে লোক রাখা হতো।

‘স্কুলে ইসলামোফোবিয়া বিষয়ে ‘প্রায় প্রতিদিন ফোনকল’

আসমা খান তার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, ইসলামোফোবিয়ার বিষয়টি আজকের যুগেও স্কুলগুলোতে টিকে আছে।

তিনি বলেন, “গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রায় প্রতিদিনই আমরা আমাদের স্কুলগুলিতে ইসলামোফোবিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত ঘটনা নিয়ে ফোনকল পেয়েছি। এসব ঘটনার কিছু ভয়ঙ্কর, কিছু খুবই সিস্টিমেটিক।”

দক্ষিণ এশীয়দের নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক সামিয়া হাসান শিক্ষাজীবনে এ ধরণের মুসলিমবিরোধী বৈষম্যমূলক আচরণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। তিনি বলেন, এসব ঘটনা একজন মুসলিম শিক্ষার্থীকে তার আত্মপরিচয় নিয়ে প্রশ্নের মুখে ফেলতে এবং তার আত্মসম্মান খর্ব করতে পারে।

সামিয়া বলেন, “আমরা শত শত তরুণ-তরুণী ও তাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে সেইসব ঘটনা শুনে থাকি যেখানে তাদেরকে সন্ত্রাসী বলে গালি দেয়া অথবা মেয়েদের মাথার হিজাব টেনে খুলে ফেলা কিংবা স্কুলের শিক্ষক বের করে দেন শিক্ষার্থীকে। আর প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে যে অগণিত ছোটখাটো আক্রমণাত্মক ঘটনা ঘটে সেগুলির কথা না-ই বা বলি।”

অংশত একারণেই কৌশলটির সাফল্য পরিমাপের জন্য এতে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের প্রতিশ্রুতিও রাখা হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, এসব ঘটনার ফলাফল মুসলিম শিক্ষার্থীদের কতভাগ নিজের স্কুলকে নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশসম্পন্ন বলে মনে করে সেটিরও পরিমাপ করবে। সেইসঙ্গে এতে বোর্ডের দফতরে জমা পড়া মানবাধিকার লংঘনের মত অভিযোগের সংখ্যা, ঘৃণামূলক আচরণ এবং মুসলিম স্টাফদের কল্যাণের তথ্য-উপাত্তও সংগ্রহ করবে।

বোর্ডের কৌশল সম্পর্কিত নথিতে বলেছে, “মুসলিম পরিচয়ের স্বীকৃতি দেওয়া এবং ইসলামোফোবিয়া নির্মূলের কৌশল প্রণয়ন একটি চলমান যাত্রার প্রথম পদক্ষেপ।”