টরেটক্কা টরন্টো

চীন-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক -১০

কাজী সাব্বির আহমেদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির ভাষ্যমতে সাত সপ্তাহব্যাপী থিয়েনআনমেন চত্বরের এই ছাত্র আন্দোলনটি ছিল একটি ‘তোং লুয়ান’ যার অর্থ হচ্ছে ‘টারময়েল’ বা ‘গণ্ডগোল’। এই ‘তোং লুয়ান’-কে কঠিন হাতে দমন করার আড়াই দিন পর অর্থাৎ ৬ই জুন পার্টির গ্রুপ অব এল্ডার্স-এর সক্ষম সদস্যবৃন্দ, পলিটব্যুরোর সদস্যেরা এবং নব নিযুক্ত পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি চিয়াং জমিন এক বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকের উদ্দেশ্য হচ্ছে বেইজিংসহ চীনের অন্যান্য শহরে ছাত্ররা থিয়েনআনমেন ম্যাসাকারের প্রতিবাদে বিচ্ছিন্নভাবে যে বিক্ষোভ প্রকাশ করে যাচ্ছে তা কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া। সেই সাথে সেন্ট্রাল কমিটির আসন্ন চতুর্থ প্লেনম মিটিং-এর এজেন্ডা নির্ধারণ করা। গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুসারে বেইজিংসহ সমগ্র চীনের মোট তেষট্টি শহরে ছাত্রদেরকে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে। বিক্ষোভের সময় ছাত্রদের হাতে শোভা পাচ্ছিল ‘লি পেং একজন হত্যাকারী’ কিংবা ‘রক্তের বিনিময়ে রক্ত-ঋণের বদলা হবে’ এই ধরণের লেখা সহ বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড যা কিনা পার্টির নেতৃত্বের প্রতি হুমকি স্বরূপ। এছাড়াও কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়া রিপোর্টে সরকারের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ হতে দেখা গেছে। চায়না রেডিও ইন্টারন্যাশনালের ইংরেজী বিভাগের খবর পাঠক ৪ঠা জুন ভোর সাড়ে ছয়টায় সংবাদ পরিবেশনের সময় থিয়েনআনমেন ম্যাসাকারকে ‘সবচেয়ে দুঃখজনক’ ঘটনা হিসেবে মনে রাখার জন্য বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানান। সরকারী টিভি চ্যানেল সিসিটিভি-তে খবর পরিবেশনার সময় নিউজ এনকোর সুয়ে ফেই এবং তু সিয়েন-এর মুখের অভিব্যক্তি ছিল ডোলফুল বা শোকার্ত। উপরন্তু দুজনেরই পরনে ছিল শোক প্রকাশের প্রতীক কালো পোশাক। কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপাত্র ‘পিপলস ডেইলি’ পত্রিকার খবর পরিবেশনের মধ্যেও দেখা গেছে পার্টির পলিসির সাথে সংঘাত। যেমন, ‘চীনা সরকারের ম্যাসাকারের প্রতিবাদে সিউলের ছাত্রদের অনশন’ – সরকারের জন্য বিব্রতকর এই খবরটি লক্ষ্যণীয়ভাবে বড় ফন্টে শিরোনাম হিসেবে ছাপিয়েছিল পিপলস ডেইলি। তবে সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয় হচ্ছে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের ভিতর উত্তেজনা দানা পাকিয়ে উঠা করেছে। ৩রা জুন রাতে মুসিডি-তে সেনাবাহিনীর ৩৮তম ইউনিটের সৈন্যরা যখন সাধারণ জনগণকে ছত্রভঙ্গ করতে গুলি করা শুরু করে তখন একই উদ্দেশ্যে ২৭তম আর্মার্ড ইউনিট তাদের গাড়ী নিয়ে জনগণকে ধাওয়া করে। এই সময় জনগণের পাশাপাশি তাদের গাড়ীতে চাপা পড়ে বেশ কিছু সৈন্যও নিহত হয়। ফলে এই দুই ইউনিটের ভিতর তিক্ততার সৃষ্টি হয়। সেই তিক্ততা থেকেই তারা একে অপরের বিরুদ্ধে শহরের বিভিন্ন স্ট্রাটেজিক পয়েন্টে ট্যাংক মোতায়েন করা শুরু করে। ৬ই জুনের এই বৈঠকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যে কোন মূল্যে সমগ্র চীনে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। চতুর্থ প্লেনম মিটিং-এর দিন নির্ধারিত হয় ২৩ শে জুন থেকে ২৪শে জুন। প্লেনম মিটিং-এর পূর্বে পলিটব্যুরোর সদস্যদের মিটিং-এর জন্য সময়কাল ধার্য করা হয় ১৯শে থেকে ২১ জুন। চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির ভবিষ্যত লীডারশীপে কারা আসবে এবং চীনের রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের রোডম্যাপ কী হবে তা নির্ধারণের জন্য এই মিটিং দুইটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে থিয়েনআনমেন ম্যাসাকারের কারণে ১৯৮৯-এর সেন্ট্রাল কমিটির প্লেনম মিটিং-টি ছিল খুবই ক্রিটিক্যাল। সেই সময়কার পরিস্থিতি কম্যুনিস্ট পার্টির লীডারদেরকে একেবারে ইতিহাসের ক্রসরোডের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। এই জটিল সময়ে নেতাদের নেয়া একটি ভুল সিদ্ধান্ত পুরো জাতিকে ছুঁড়ে দিতে পারত ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। বর্তমানকালে বিশ্ব রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অঙ্গনে শক্তিশালী চীনের যে উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই তা কিন্তু এই ক্রান্তিলগ্নে কম্যুনিস্ট পার্টির নেতাদের বিজ্ঞতাপূর্ণ নেতৃত্বেরই ফসল। পরবর্তীতে এই নিয়ে বিশদ আলোচনা থাকবে।

দেং শিয়াওপিং মার্শাল ল’ ট্রুপদের সেনা সদস্যদের সাথে করমর্দন করছেন (ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

শহরের কেন্দ্রস্থল চিয়েনকোয়ামেন সড়কের যে অংশটিতে ডিপ্লোমেটিক রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া অবস্থিত সেটার আশে পাশে সারিবদ্ধ ট্যাংকের বহর দেখে চারিদিকে রটে যায় যে ‘গৃহযুদ্ধ আসন্ন’। এই গুজব আরও বেশী জোরালো হয়ে উঠে যখন একজন ডাক্তার তার আলসারের চিকিৎসার জন্য তার নিজেরই হাসপাতালেই ভর্তি হতে ব্যর্থ হন। তাকে বলা হয় যে উপর থেকে নির্দেশ এসেছে সম্ভাব্য ‘বোম্ব ভিক্টিম’-দের জন্য সিট খালি রাখতে হবে, তাই তাকে ভর্তি করা যাচ্ছে না। অরাজক এই পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার খাতিরে এই সময় চীনে অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের নাগরিকেরা তাদের নিজ নিজ দূতাবাসের উদ্যোগে দেশ ত্যাগ করা শুরু করে। যদিও দেশ ত্যাগ করাটা সেই মুহুর্তে অতটা সোজা ছিল না। কারণ বিমান বন্দরে যাওয়ার পথে ছিল সেনাবাহিনীদের চেক পোষ্ট। সেখানে তল্লাশীর নামে চলত হয়রানি। কানাডা সরকার তখন নিরাপদে বেইজিং ত্যাগ করা নিশ্চিত করার জন্য তার নাগরিকদের জন্য একটি বিশেষ বিমান পাঠায়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সেই ক্রান্তিকালে বিমান পাঠানো সম্ভব না হলেও ২০২০ সালে কোভিডের কারণে চীনের উহান যখন ভূতুড়ে শহরে পরিণত হয়েছিল তখন কিন্তু সরকার বিশেষ বিমান পাঠিয়ে উহানে অবস্থানরত বাংলাদেশী ছাত্রদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছিল। ১৯৮৯ সালের থিয়েনানমেন সংকটকালে বাংলাদেশ সরকার বিমান না পাঠালেও বেইজিংস্থ অ্যাম্বাসীর মাধ্যমে সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশের নাগরিকদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। বেইজিং শহরে তখন আমরা মুষ্টিমেয় কয়েকজন বাংলাদেশী ছাত্র ছিলাম। ৬ই জুন বিকেলবেলা আমাদেরকে আমাদের নিজ নিজ ইউনিভার্সিটির ডরমেটরী থেকে ডিপ্লোম্যাটিক ট্যাগ লাগানো গাড়ীতে করে প্রথমে অ্যাম্বাসীতে আনা হয়। তারপর ডিপ্লোমেটিক রেসিডেন্সিয়াল এরিয়ার ভেতর বাংলাদেশী অ্যাম্বাসীতে কর্মরত বিভিন্ন কর্মকর্তাদের বাড়ীতে একজন অথবা দুইজন করে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। আমার এবং আমার ব্যাচের আরেকজন ছাত্রের থাকার ব্যবস্থা হয় খোদ অ্যাম্বাসেডর ফারুক সোবহানের বাসভবনে। তার কলেজ পড়ুয়া ছেলেকে কিছুদিন কম্পিউটারে প্রোগ্রামিং শিখানোর সুবাদে আমি অ্যাম্বাসেডর ফারুক সোবহানের সাথে ব্যক্তিগতভাবে আগে থেকেই পরিচিত ছিলাম। বোধহয় সেই কারণেই আমার জায়গা হয়েছিল তার বাসভবনে। অ্যাম্বাসীর মূল ভবনের সাথে লাগোয়া তার বাসভবনটির পিছন দিকে ছিল একটি গেস্টরুম, সেখানেই সাময়িকভাবে আমাদের দুজনের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। দোতলায় অবস্থিত এই গেস্টরুমে আসা যাওয়ার জন্য আলাদা সিঁড়ি থাকাতে আমরা ছিলাম মূল বাসা থেকে বিচ্ছিন্ন। পরদিন অর্থাৎ ৭ই জুন দিনের বেলাতে আড্ডা দেয়ার জন্য অন্যান্য ছাত্ররা আমাদের এখানে উপস্থিত হয়। এই সময় খবর আসে যে চীনা সেনাবাহিনীর সদস্যরা ডিপ্লোমেটিক এরিয়ার ভিতর অবস্থিত বেশ কিছু অ্যাপার্টমেন্টকে টার্গেট করে গুলি চালিয়েছে। আমাদের এক সিনিয়র ভাই যে অ্যাপার্টমেন্টে ছিলেন সেটার ব্যালকনিতে বেশ কিছু বুলেট এসে আঘাত করে। একটি বুলেট আবার জানালার কাঁচ ভেঙে ড্রয়িং রুমের ছাদে আঘাত করে। চীনা সেনাবাহিনী কোন অবস্থাতেই ডিপ্লোমেটিক এরিয়ার ভেতর গুলি চালাতে পারে না। কী উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের এই গুলি বর্ষণ সেটা নিয়ে কানাঘুষা চলতে থাকে এবং এই ধরণের আরও গুলি বর্ষণ চলতে পারে সেই আশংকায় চারিদিকে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে চীনা মিলিটারীর পক্ষ থেকে বলা হয় যে একজন স্নাইপার নাকি ডিপ্লোমাটিক এরিয়া থেকে গুলি করে সেনাবাহিনীর একজন সৈন্যকে মেরে ফেলেছে। সেই স্নাইপারকে মারার জন্যই নাকি সেনাবাহিনী পাল্টা গুলি চালিয়েছে। তবে সেই গুলিতে তিনজন জাপানী নাগরিক মারাত্মকভাবে আহত হয় আর সেটার প্রতিবাদে জাপানের রাষ্ট্রদূত তীব্র ভাষায় বিবৃতি দেন। সেই সাথে জাপান সরকার চীনের জন্য চলমান সব ধরণের সাহায্য সাময়িকভাবে বন্ধের ঘোষণা দেয় এবং একই সাথে সমস্ত জাপানী নাগরিকদের চীন ত্যাগ করার পরামর্শ দেয়। শুধু জাপান একাই নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকেও একই ধরণের হুমকি আসা শুরু করে। চীনা সরকার অনুধাবন করতে পারে যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদেরকে আবার একঘরে করে দেয়ার পাঁয়তারা শুরু হয়ে গেছে। তাদেরকে এখন ড্যামেজ কন্ট্রোল মুডে যেতে হবে।

এই ড্যামেজ কন্ট্রোলের প্রথম ধাপ হচ্ছে নিজের ঘরকে আগে সামলানো। আর নিজের ঘর সামলানোর জন্য প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে আসন্ন গৃহযুদ্ধের আশঙ্কাকে দূর করা। জুন মাসের ৮ তারিখে দেং শিয়াওপিং-এর কড়া নির্দেশে সেনাবাহিনীর ৩৮তম ইউনিট এবং ২৭তম আর্মার্ড ইউনিট, এই দুই ইউনিটের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা পারস্পরিক করমর্দনের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যকার বিরোধ মিটিয়ে ফেলে। থিয়েনআনমেন আন্দোলনকে সফলভাবে নির্মূল করা এবং সেই সাথে জাতিকে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত গৃহযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করার উপলক্ষ্যে ৯ই জুন বিকেলবেলা দেং শিয়াওপিং কম্যুনিস্ট পার্টির হেড কোয়ার্টার ট্রোংনানহাই-তে পলিটব্যুরোর সদস্যবৃন্দ এবং মার্শাল ল’ ট্রুপদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদেরকে নিয়ে এক মিটিং-এর আয়োজন করেন। এটাই ছিল আর্মি ক্র্যাকডাউনের ঘটানার পর দেং শিয়াওপিং প্রথম পাবলিক এপিয়ারেন্স। ফেডেড নীল রঙের মাও কোট পরিহিত পঁচাশি বছর বয়স্ক দেং শিয়াওপিং-কে সেদিন তার বয়সের তুলনায় বেশ প্রাণবন্ত দেখাচ্ছিল। নিহত সৈনিকদের প্রতি সম্মান জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালনের পর মিটিং শুরু হয়। বক্তব্যের শুরুতে দেং শিয়াওপিং মার্শাল ল’ ট্রুপদের সাহসিকতা এবং আত্মত্যাগের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তারপর তিনি চীনের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, এই গণ্ডগোলের কারণে চীন যেমন তার বর্তমান ইকোনমিক রিফর্ম পলিসি থেকে সরে আসবে না, তেমনিভাবে তার ওপেন ডোর পলিসি থেকেও সরে আসবে না। কিন্তু পলিটিক্যাল রিফর্মের ব্যাপারে সরকারকে সতর্কভাবে এগুতে হবে যাতে ভবিষ্যতে এই ধরণের গণ্ডগোলের পুনারাবৃত্তি না ঘটতে পারে। সেই জন্যই পলিটিক্যাল রিফর্মের ব্যাপারে অন্ধভাবে পশ্চিমাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ১৯৭০ সালের মে মাসের ৪ তারিখে কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটিতে একদল ছাত্রছাত্রী যখন ভিয়েতনামের যুদ্ধের বিরোধিতা করে শান্তিপূর্ণ মিছিল করছিল তখন ওহাইও ন্যাশনাল গার্ডের সদস্যরা তাদের উপর বিনা প্ররোচনায় গুলি চালায়। ফলে ৪ জন নিরীহ ছাত্রের প্রাণহানি ঘটে। এই ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে দেং শিয়াওপিং তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে, ‘তোং লুয়ান’ বা গণ্ডগোলকে রুখতে চীন নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে প্রতিবিপ্লবীদেরকে প্রতিহত করেছে কিন্তু আমেরিকা তার ছাত্রদের মুখ বন্ধ রাখতে গুলি করতে দ্বিধা করে না। সেই রাতেই তার বক্তৃতার সারাংশ মিডিয়াতে প্রকাশ করা হয়। ফলে জনগণ বুঝতে পারে যে, দেং শিয়াওপিং এখনও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন।

কিন্তু দেং শিয়াওপিং নিজেই আর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে চাচ্ছিলেন না। থিয়েনআনমেন আন্দোলনের গোড়ার দিকেই একজন যোগ্য উত্তরসূরির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে অবসরে যাওয়ার ইচ্ছে তিনি ব্যক্ত করেছিলেন। সেই সূত্র ধরেই তিনি জুনের ১৬ তারিখে নতুন গঠিত পলিটব্যুরো সদস্যদের সাথে মিটিং-এ উল্লেখ করেন যে, পার্টির জন্য এখন দরকার তৃতীয় প্রজন্মের সম্মিলিত নেতৃত্ব। তিনি কম্যুনিস্ট পার্টির গোড়ার দিককার ইতিহাস তুলে ধরে বলেন যে ১৯৩৫ সালে লং মার্চ চলাকালীন সময়ে মাও সেতুং পার্টির নেতৃত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেয়ার আগ পর্যন্ত কম্যুনিস্ট পার্টি অনেকটা নেতৃত্ববিহীন অবস্থায় ছিল। চেয়ারম্যান মাও একক হাতে পার্টির নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন কালচারাল রেভ্যুলেশনের সময়কাল বা ১৯৭৬ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। এই সময়কালকে দেং শিয়াওপিং ফার্স্ট জেনারেশনের দেয়া নেতৃত্ব বলে অভিহিত করেন যার মূল নেতা ছিলেন মাও সেতুং নিজে। মাও যদিও মৃত্যুর আগে হুয়া কোয়াফেং-কে তার উত্তরসূরি করে যান, কিন্তু গ্যাং অব ফোর-এর পতনের ফলে ১৯৭৮ সালের ১১তম সেন্ট্রাল কমিটির তৃতীয় প্লেনম মিটিং-এর সময় পার্টির নেতৃত্বে চলে আসেন দেং শিয়াওপিং। সেই সময় থেকে ১৯৮৯ সালের ‘থিয়েনআনমেন তোং লুয়ান’-এর সময়কালের নেতৃত্বকে তিনি সেকেন্ড জেনারেশন নেতৃত্ব বলে উল্লেখ করেন যার মূল নেতা হচ্ছেন তিনি নিজেই। এই ধারাবাহিকতায় তিনি প্রস্তাব করেন যে নব গঠিত পলিটব্যুরোর সদস্যদেরকে পার্টির নেতৃত্বের হাল ধরতে হবে যার মূলে থাকবেন সদ্য নির্বাচিত জেনারেল সেক্রেটারি চিয়াং জমিন। তিনি ইচ্ছে প্রকাশ করেন যে আসন্ন ১৩তম সেন্ট্রাল কমিটির চতুর্থ প্লেনম মিটিং-এ তিনি নতুন প্রজন্ম বা থার্ড জেনারেশন নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা তুলে দিবেন। এখানে উল্লেখ্য যে চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির লীডারশীপের ট্রানজিশন অনেক সময় বেশ জটিল আকার ধারণ করে। তার জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে চীনের বর্তমান ফোর্থ জেনারশন লীডারশীপের মূল নেতা সি চিনপিং-এর তৃতীয়বারের মতন পার্টির নেতৃত্বকে নিজের হাতের মুঠোয় রাখার ঘটনা। এই জন্য তাকে দলের মধ্যে যারা তার প্রতিপক্ষ তাদেরকে সতর্কভাবে সরিয়ে দিতে হয়েছে। ভিন্ন মতাবলম্বীদেরকে সরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে সি চিপিং অত্যন্ত কঠোর এবং আপোষহীন। সম্প্রতি কম্যুনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেস অধিবেশন চলাকালীন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হু চিনথাও যখন অফিসিয়াল কিছু কাগজপত্রের সন্ধান করছিলেন তখন অসুস্থতার দোহাই দিয়ে সিকিউরিটির লোকজন তাকে এসকর্ট করে বের করে দেয়। পুরো পৃথিবী সরাসরি এই দৃশ্য দেখে এটাই বুঝতে পেরেছিল যে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে তার নেতৃত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ কাউকেই সি চিনপিং পার্টির ভেতর জায়গা দেবে না।

‘পাই মা পি’ (এখানে প-এর উচ্চারণ হবে প এবং ফ-এর মাঝামাঝি) হচ্ছে চীনের একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ যার আক্ষরিক অনুবাদ হল ‘ঘোড়ার পশ্চাদদেশ চাপড়িয়ে দেয়া’। ক্ষমতাবান লোকদেরকে তোষামোদ করাকে এই প্রবাদ দ্বারা বুঝানো হয়। প্লেনম মিটিং-এর ঠিক আগে পলিটব্যুরোর সদস্যরা যখন পূর্ব নির্ধারিত ১৯শে জুন তারিখে এক প্রস্তুতি মিটিং-এ মিলিত হন তখন দেং শিয়াওপিং উল্লেখ করেন যে যদিও অর্থনৈতিক সংস্কারে সদ্য বহিষ্কৃত জেনারেল সেক্রেটারি ট্রাও জিয়াং-এর কিছুটা অবদান রয়েছে কিন্তু থিয়েনআনমেন আন্দোলনে তার কার্যকলাপ ছিল পার্টির জন্য ক্ষতিকর। তিনি এই প্রসঙ্গে পলিটব্যুরোর অন্যান্য নেতাদের মতামত জানাতে আহ্বান করেন। এই সময় প্রত্যকেই অত্যন্ত কঠোর ভাষায় ট্রাও জিয়াং-এর কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেন কারণ দেং শিয়াওপিং সেটাই শুনতে চাচ্ছেন। ফলে তাদের প্রত্যেকের বক্তব্য হয়ে উঠে ‘পাই মা পি’ দ্বারা পূর্ণ এবং এই ‘পাই মা পি’-তে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা থাকে প্রবল। এটাই হচ্ছে কম্যুনিস্ট পার্টিতে টিকে থাকার কৌশল যা নেতারা শিক্ষা নিয়েছে সেই মাও-এর আমল থেকে। এখানে মূল নেতার মতের বিরুদ্ধে কোন কথা বলা মানেই দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়া। যেমনটি আসন্ন প্লেনম মিটিং-এ হতে যাচ্ছে ট্রাও জিয়াং।

পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ২৩শে জুনে অনুষ্ঠিত ১৩তম সেন্ট্রাল কমিটির চতুর্থ প্লেনম মিটিং-এ প্রিমিয়ার লি পেং তুলে ধরেন ট্রাও জিয়াং-এর ভুল কর্মকাণ্ডের এক দীর্ঘ তালিকা। আত্মপক্ষ সমর্থনের সময় ট্রাও জিয়াং তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলি যথাযথ তথ্য এবং উপাত্তসহ একে একে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খণ্ডন করেন। কিন্তু যেখানে তার ভাগ্য আগেই নির্ধারিত হয়ে গেছে পার্টির আভ্যন্তরীণ পলিটব্যুরো মিটিং-এ সেখানে তার এই অভিযোগ খণ্ডন অনেকটা ছিল অরন্যে রোদনের নামান্তর মাত্র। প্লেনম মিটিং শেষে ট্রাও জিয়াং-কে পার্টির সকল পদ থেকে বহিষ্কৃত করা হয়, যদিও তার পার্টির মেম্বারশীপ বহাল থাকে। তার প্রতি সহানুভূতিশীল প্রায় তিরিশজন মন্ত্রীকেও বহিষ্কার করা হয়। মিডিয়াতে ট্রাও জিয়াং-এর নাম উচ্চারণের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। সরকারি ছবিগুলো থেকে তাকে যেমন এয়ারব্রাশ করে মুছে ফেলা হয় তেমনি পাঠ্যবই থেকেও তার অতীত কীর্তির কথা মুছে ফেলা হয়। সেই সাথে তাকে বরণ করে নিতে হয় গৃহবন্দিত্ব। দীর্ঘ পনেরো বছর গৃহবন্দী থাকার পর ২০০৫ সালের জানুয়ারীতে তিনি পঁচাশি বছর বয়সে মারা যান। এভাবেই পতন ঘটে একজন একনিষ্ঠ কম্যুনিস্ট নেতার যার সম্পর্কে এক সময় মন্তব্য করতে গিয়ে দেং শিয়াওপিং নিজেই বলেছেন যে, ট্রাও জিয়াং-এর কর্মকাণ্ডের সত্তুর ভাগ ভালো আর ত্রিশ ভাগ খারাপ। তার মৃত্যুর পর ২০০৯ সালে ‘প্রিজনার অব দ্য স্টেট – দ্য সিক্রেট জার্নাল অব প্রিমিয়ার ট্রাও জিয়াং’ টাইটেলে ইংরেজীতে একটি বই প্রকাশিত হয়। গৃহবন্দী থাকাকালে অত্যন্ত গোপনে ট্রাও জিয়াং ত্রিশটি অডিও ক্যাসেটে তার জীবনী নিজের জবানীতে রেকর্ড করে গিয়েছিলেন যার ভিত্তিতেই এই বইটি রচিত হয়।   (চলবে)

তথ্যসূত্রঃ

১) ‘রেড চায়না ব্লুজ – মাই লং মার্চ ফ্রম মাও টু নাও’, জেন ওং, ডাবলডে এ্যাংকর বুকস

২) ‘দ্য থিয়েনআনমেন পেপারস’, ট্রাং লিয়াং, অ্যাবাকাস

কাজী সাব্বির আহমেদ

কলাম লেখক। টরন্টো