সম্পর্ক নিয়ে কত কথা

জসিম মল্লিক

প্রতিটা সম্পর্কের মধ্যেই একটা ভারসাম্য থাকা উচিত। ভারসাম্য ব্যাপারটা কি এটা বুঝতে হবে। কোন সম্পর্কটা টেকসই হবে, কোন সম্পর্ক কোনো ঝড় ঝঞ্ঝায় ভেঙ্গে পড়বে না, মচকাবে না, অটুট থাকবে সেটা অনুধাবন করতে হবে। তাহলেই সম্পর্ক আনন্দময় হবে, তাহলেই সম্পর্ককে হালকা মনে হবে। এমন সম্পর্ক করা উচিত না যা পাথরের মতো ভারি, এমন সম্পর্ক করা উচিত না যা নিয়ে সারাক্ষণ উৎকন্ঠায় থাকতে হয়। আস্থা ও বিশ্বাসের ঘাটতি থাকলে সম্পর্ক কখনও মজবুত হবে না। সম্পর্কে নির্ভরতা, রেসপেক্ট, প্যাশন থাকতে হবে। একতরফা সম্পর্ক করা উচিত না। সম্পর্ক হতে হবে খোলা বইয়ের মতো। সম্পর্ক হতে হবে ফুলেল সৌরভমাখা, যেখানে কোনো কালো আঁচর থাকবে না, দাগ থাকবে না। তাহলেই সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি হবে।

আমি মানুষের মনোজগৎ নিয়ে অনেক চিন্তা করি, রিলেশন ইস্যুজগুলো আমার চর্চার একটা বিষয়। সবসময়ই আমি এসব ভাবতাম। আমি স্পর্শকাতর মানুষ, আবেগি। আপাতঃ শান্ত মনে হলেও আমার ভিতরে একটা জেদি মন আছে। আমি একলা বড় হয়ে ওঠা মানুষ। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়েছি সবসময়। শৈশবকাল থেকেই আমি এমন। প্রথাবিরোধী এক বালক ছিলাম আমি। আমার উপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া হলে আমি একদম মেনে নিতে পারি না। আমার মন বিদ্রোহী হয়ে উঠে। এসব কারনে আমি জীবনে অনেক কিছু হারিয়েছি। এসব কারনে আমি অনেক একলা।

সম্পর্কের ক্ষেত্রে সামজিক অবস্থান একটি বড় ফ্যাক্টর। ধনীর সাথে গরীবের কখনও বন্ধুত্ব হবে না। যদি হয়ও সেটা বন্ধুত্ব না, সেটা এক ধরণের দয়া, করুণার সম্পর্ক। গরীবরা সবসময় হীনমন্যতায় ভোগে আর ধনীরা সেটা উপভোগ করে। ধনীরা সবসময় গরীবকে চমকে দিতে চায়, মুগ্ধ করতে চায়, প্রশংসা শুনতে চায়। তারপর একসময় আবর্জনার মতো ছুঁড়ে ফেলে দিতেও দ্বিধা করে না। গরীবের তখন নিরবে চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। সারা পৃথিবী জুড়ে ধনীদের জয়জয়কার। এই পৃথিবী তাদের। এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। এমপ্লয়ারের সঙ্গে কর্মচারির কখনও বন্ধুত্ব হবে না। পরস্পরের প্রতি নির্ভরতা থাকতে পারে কিন্তু সেটা কখনও বন্ধুত্ব না। কর্মচারি কোনো ভুল করলে এমপ্লয়ার কখনও ক্ষমা করবে না। মনে রাখতে হবে সবাই ধনী হবে না, কেউ কেউ হবে। ভাগ্যের বরপুত্র সবাই হতে পারবে না।

ক্ষমতবানদের সাথে দুর্বলের কখনও বন্ধুত্ব হবে না। দুর্বল মানুষরা ক্ষমতাবানদের সান্নিধ্যে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকে, পুলক অনুভব করে বটে কিন্তু সেটা প্রকৃতপক্ষে করুনামাখা। করুণা নিয়ে কে বাঁচতে চায়! সম্পর্ক রচনা নিয়ে আমি অনেক সতর্ক। সবসময় তাই ছিলাম। তারপরও কি আমার ভুল হয় না! অনেকই হয়! আমি কি ভুল সম্পর্ক করি না! করি। আমি অনেক সাধারণ, আমার কোনো ক্ষমতাও নাই। তা সত্বেও আমি অনেক ক্ষমতাবানদের সান্নিধ্যে এসেছি, অনেক ধনাঢ্য মানুষ আমার বন্ধু তালিকায় আছে, সেটা কি বাস্তব জীবনে কি সোশ্যাল মিডিয়ায়। অনেক সেলিব্রেটি যেমন আছে তেমনি আমার মতো সাধারণ মানুষও আছে। সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্রে আমি ইকুলিব্রিয়াম রক্ষা করে চলতে চাই। ক্ষমতাবান বা ধনীদের নিয়ে আমার আলাদা কোনো আবেগ হয় না। একজন সেলসম্যান, একজন উবার ড্রাইভার, একজন পিজা ডেলিভারিম্যান আমার কাছে যেমন তেমনি একজন সেলিব্রেটি বা মিলিয়ন ডলার বাড়িতে থাকে সেও তেমনি। করাইল বস্তিতে যে থাকে সেও যেমন গুলশান বা বাড়িধারায় যে থাকে সেও তেমন।

এসব কারণে সম্পর্ক নিয়ে আমার মধ্যে কোনো টানাপোড়েন হয় না, কোনো উচাটন নাই। রাতের ঘুম নষ্ট হয় না। কারণ আমি কারো কাছে কিছু পেতে চাই না। ক্ষমতার কাছে মাথা নত করি না। টাকা দিয়ে আমাকে কেনা যায় না। যখন আমি ঠিকমতো খেতে পেতাম না তখনও আমি এমনই ছিলাম। যে কোনো সম্পর্ককে আমি পেঁজা তুলোর মতো হালকা রাখতে চাই। অনেক ভার আমি নিতে পারি না। ধনী বা ক্ষমতাবানদের সাথে আমি উঠা বাসা করে দেখেছি কিন্তু ঠিক স্বস্তি যাকে বলে আমি পাই না। আমার তেমন কথা থাকে না তাদের সাথে। এটা কোনো হীণমন্যতা না বা অবহেলা প্রদর্শনও না, আমি ওই লেভেলের না বলে কোনো ঈর্ষাও কাজ করে না। আবার অপেক্ষাকৃত কম ভাগ্যবানদের সাথেও আমি উঠা বাসা করেছি। তারাও অনেকে আমাকে বুঝতে পারে না। তাদের মধ্যেও এক ধরণের ইনফ্রিয়ারিটি কমপ্লেক্স কাজ করে।

যতই মনোজগত নিয়ে চর্চা করি না কেনো মানুষের মনের রহস্য কিছুতেই ভেদ করা যায় না। কোনো মানুষই প্রকৃতপক্ষে পুরোপুরি মানবিক হয়ে উঠতে পারে না। আমিও পারি না। আমার মধ্যেও অনেক দ্বিধা আছে, হীনমন্যতা আছে, ঈর্ষা আছে, সীমাবদ্ধতা আছে। অবচেতনেই এসব কাজ করে। নিজেকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসাবে গন্য করতে পারি না নিজেকে। সম্পর্কের এইসব জটিল সমীকরন কিছুতেই মেলানো যায় না। জীবনে কিছুই অনিবার্য না এই থিউরিতে বিশ্বাস করি, তাই সম্পর্ক রচনা নিয়ে আমি নির্ভার থাকতে পারি।

টরন্টো ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২

সকল কন্যাদের জন্য ভালবাসা

অরিত্রি জন্মের পর দুই তিন বার বেশ কঠিন অসুখে পড়েছিল। একবারতো জীবন মরণ লড়াই শুরু হয়েছিল। অরিত্রি কথাও বলেছে অনেক দেরী করে। অর্ক যেমন দশ মাস বয়সেই আধো আধো বাক্য উচ্চারন করত। কিন্তু অরিত্রি তা না। অরিত্রি প্রথম কথা বলেছে দুই বছর বয়সে। আড়াই বছর বয়সে স্কলাস্টিকা স্কুলে ভর্তির জন্য ইন্টারভিউ দিয়েছে। ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন খোদ স্কলাস্টিকার তৎকালীন চেয়ারপরসন ইয়াসমিন মোরশেদ। এবং অবাক কান্ড অরিত্রি টিকে গিয়েছিল। সে সময় আমার আর জেসমিনের যে ইনকাম তাতে অরিত্রিকে নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ একটু দ্বিধায় ছিল যে আমরা খরচ চালাতে পারব কিনা। এই ধরণের স্কুলগুলোতে অভিভাবকের ইনকাম দেখা হতো। তার উপর আমার ছেলে অর্কও তখন স্কলাস্টিকায় পড়ছে। তাদের ভাবনা ছিল দুইজনকে পড়াতে পারবতো!

কন্যা হচ্ছে বাবাদের মনের বাতিঘর। সকল কন্যাদের জন্য ভালবাসা। ছবি : সংগৃহীত

ঠিক তিন বছর বয়সে অরিত্রি স্কুলে যাওয়া শুরু করল। স্কুলের ব্যাপারে অরিত্রি খুউব সিরিয়াস ছিল। ব্যাগ ভর্তি বইয়ের ভারে ছোট্ট শিশুটির কাঁধ নুয়ে পড়ত তাও ব্যাগ কাউকে নিতে দিতনা। ড্রাইভার বলত আপু ব্যাগ দেন, অরিত্রি দিতনা। পরীক্ষা থাকলে গাড়িতে উঠেও পড়া শুরু করত। প্রতিবছর বেষ্ট এটেনেডেন্সের এওয়ার্ড পেতো। হরতাল হলে খুব মাউন্ড করত স্কুলে যেতে পারবে না তাই। গ্রেড থ্রি শেষে আমরা কানাডা চলে আসি। কানাডা এসেও এর ব্যাতিক্রম হতে দেখিনি। যখন মাইনাস ২০/৩০ টেম্পারাচার হতো, হাঁটু পর্যন্ত বরফ কিন্তু কখনও বলেনি বাবা গাড়িতে দিয়ে আসো। দেড় কিলোমটিার হেঁটেই স্কুলে যেতো। ষোল বছর বয়সে অরিত্রি ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়েছে, ইলেভেন গ্রেডে থাকতে কাজ শুরু করেছে। কখনও আমার হেল্প নেয়নি। এখানকার ছেলে মেয়েরা এমনই। সেলফ ইনডেপেনডেন্ট।

একটা ঘটনা বলি। ছোট্ট ঘটনা। এমন কিছু উল্লেখযোগ্য না। কিন্তু এর ব্যঞ্জনা অনেক বিশাল আমার কাছে। অরিত্রি মাত্র স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। স্কুলে জেসমিনের নাম আছে পিকআপ করার জন্য। একদিন কোনো কারণে জেসমিন যেতে পারেনি। আমি গেলাম স্কুলে। স্কুল ছুটি হয়েছে। বাচ্চারা লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে। সবার এক ইউনিফর্ম। দূর থেকে চিনতে পারছিনা কোনটা অরিত্রি। একটু পর দেখি একজন সুদর্শন নারী টিচার একটি বাচ্চাকে নিয়ে আমার কাছে আসলেন। কাছে আসার পর দেখি অরিত্রি। আমি বললাম, কিভাবে বুঝলেন এটা আমার মেয়ে! টিচার হেসে বললেন, আপনাকে দেখে!

ঢাকায় থাকতে অরিত্রিকে নিয়ে গাড়িতে কোথাও যখন যেতাম অরিত্রি প্রায়ই বলত, বাবা তুমি রাস্তা চেনো কিভাবে! টরন্টোতে প্রথম যেদিন অরিত্রির সাথে গাড়িতে উঠলাম, আমি মজা করে বললাম, আম্মু তুমি রাস্তা চেনো কিভাবে! অরিত্রি শুধু হেসেছিল। রাস্তা চেনাটাই আসল কাজ। আমাকে যেমন কেউ রাস্তা চেনায়নি, একা একাই জীবনের রাস্তা চিনেছি, তেমনি আমার অরিত্রিও যেনো সঠিক রাস্তা চিনে নিতে পারে সেই চেস্টাই করেছি সবসময়।

টরন্টো ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২

কন্যা হচ্ছে বাবাদের মনের বাতিঘর

অরিত্রি বেশি কথার মানুষ না। কম কথার মানুষ। স্বল্পভাষি। অনেকটা আমার মতোই অরিত্রি। আমার স্বভাবের সাথে অনেক মিল। চেহারায়ও। আমার, আমার মা এবং আমার বোন সাজুর চেহারার কম্বিনেশন। মাঝে মাঝে আমি অরিত্রির কোনো কোনো ভাঙ্গিমা দেখে চমকে যাই, যেনো সাজু। খাওয়া দাওয়ায়ও আমার টাইপ। আমাদের পরিবারে যা কিছু কথা জেসমিন একলা বলে। সে বলে আমরা সবাই শুনি। জেসমিন অর্কর সাথে অনেক গল্প করে। অর্ক প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে একবার ফোন দেয়। জেসমিন সারাদিনের বৃত্তান্ত বর্ণনা করে। অর্কর বাবা কি কি দোষ করেছে সেগুলো বাদ যায় না। অর্ক এটা শুনে হাসে এবং অসীম ধৈর্য্য নিয়ে মায়ের সব কথা শোনে। সেই তুলনায় অরিত্রি কম কথা বলে। আমার মতোই হ্যাঁ, হু টাইপ। মুড ভাল থাকলে একটু বেশি কথা বলে।

অরিত্রির সাথে আমার যেটুকু কথা হয় তার বেশিরভাগ আমি নিজ থেকে বলি। প্রতিদিন একবার ফোন দেই।

আম্মু কি করো।

কাজ করি।

খেয়েছো!

হ্যাঁ।

কি খেলা।

এই তো পাস্তা।

নিজেই করেছো!

হুম।

ভাত রান্না করো!

করি।

ভালই তো শিখছ।

এয়ার ফ্রায়ারে করি। তুমিও শিখ।

শিখছি।

অর্কর সাথে খুব দরকারি কথা ছাড়া তেমন কথা হয় না আমার। জেসমিনের সাথে যখনই কথা বলি দুএক কথার পরই আমার ভুল ধরতে শুরু করে। যেনো ওর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য আমার ভুলত্রুটিগুলো খুঁজে বেড়ানো। আমিও এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাই যথাসম্ভব কম কথা বলার চেষ্টা করি। বোবার কোনো শত্রু নাই।

জেসমিন এখন ঢাকায়। বিমানে গেছে। ঢাকায় পৌঁছে বিমান বাংলাদেশের প্রচুর প্রশংসা করল। কেবিন ক্রদের প্রশংসা করল, খাওয়ার প্রশংসা করল। কোনো ঝক্কি নাই। লে ওভার নেই। একটানে পীয়ারসন থেকে শাহজালাল। ঢাকায় লাগেজও পেয়েছে ইমগ্রেশন শেষ করেই। প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করতেও ভুলল না। জেসমিনের প্রশংসা পাওয়া মানেই বিরাট ভাল কিছু। তবে সংশয় প্রকাশ করতেও ভুলল না। বলল, দেখো কতদিন এই ’ভাল’ থাকে।

আমরা সবাই এখন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। আমি একলা বাসায়, জেসমিন ঢাকায়, অর্ক বোমেনভিল, অরিত্রি ডাউন টাউন, সাদ আটলান্টা।

অরিত্রি ম্যাকডোনালস কানাডার কর্পোরেট অফিসে চাকরি করে। ম্যানেজার কমিনিউকেশন। আজকে যেতে হয়েছিল কোনো একটা আউটলেটে। সেখানে স্টাফরা কিভাবে কাজ করে সেটা হাতে কলমে শিখতে।

কেমন লাগল কাজ!

ভালই।

পেরেছো!

হ্যাঁ। ইন্টারেস্টিং।

ছবি তুলেছো! তোমার মা ছবি পাঠাতে বলেছে।

কাজের ফোনে আছে ছবি। পরে তোমাকে পাঠাব।

অরিত্রি সবকিছু খুলে বলবে না আগে ভাগে। এই উইকেন্ডে আমাদের সাথে ছিল। সকালে বলেছে বাবা চা বানিয়ে দাও। আমি মহা আনন্দে চা বানাই। চা খেতে খেতে বলল, নভেম্বরে আটলান্টা যাব।

আমি বিস্মিত হয়ে বলি, চলে যাচ্ছ!

না। এখনই না। ডিসেম্বরে আমি আর সাদ জাপান যাব ভ্যাকেশনে।

আমিও যেতে চাই।

যাও। ঘুরে আসো। তোমার তো টোকিওতে অনেক বন্ধু আছে।

হ্যাঁ। ডিসেম্বরে প্লান আছে।

রোববার অর্কও এসেছিল। জেসমিনকে পৌঁছাতে আমরা সবাই এয়ারপোর্ট গিয়েছিলাম। পথে আসতে বলল, বাবা আমি আর খাতিজা আগামী শুক্রবার দশ দিনের জন্য কুইবেক যাচ্ছি ড্রাইভ করে। কয়েকটা সিটিতে যাব। তারপর অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে নিউইয়র্ক।

তাই নাকি!

হ্যাঁ। জ্যাকসন হাইটসের একটা ভাল বাঙ্গালি রেস্টুরেন্টের নাম দিওতো।

আমি বললাম, আমিও যেতে পারি। ২৯/৩০ অক্টোবর ওয়াশিংটন ডিসির বইমেলার ইনভাইটেশন পেয়েছি। নিউইয়র্ক হয়ে অথবা ডিরেক্ট ডিসি চলে যাব।

হ্যাঁ যাও।

আমার কোনো কিছুতে অর্ক অরিত্রির কোনো আপত্তি নাই। সবকিছুতে সম্মতি আছে। আমার মতোই ওরাও ঘুরতে পছন্দ করে। জেসমিন আমাদের উল্টো। শুধু যেখানে সিবলিংস আছে সেখানে যায়। কিন্তু না গেলেও আমার পথ আগলে দাঁড়ায়। শুনেই বলল, এই না কয়দিন আগেই নিউইয়র্ক বইমেলা থেকে আসলা! এতো কি বইমেলা!

অরিত্রি যেদিন থাকে সেদিন বাসাটা খালি মনে হয় না। অরিত্রি পুরো বাড়ি জুড়ে থাকে। কন্যারা সবসময় বাবাদের আনন্দের উৎস। তারা সেটা প্রকাশ করতে পারে না ঠিকই। কিন্তু তাদের মনের বাতিটা উজ্জল হয়ে ওঠে।

টরন্টো ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২

বোকাদের ক্লাব!

আমি ছোটবেলা থেকেই একটু বোকা টাইপ ছিলাম। অনেক হাস্যকর বোকামী করেছি। সে সব মনে পড়লে হাসিতো পায়ই, একটু লজ্জাও করে এখনও। মানুষ এমন বোকা হয়! বোকার হদ্দ যাকে বলে। বিভিন্ন সময়ে সেইসব মোটা দাগের বোকামির কথা অনেকবার লিখেছিও। অথচ আমার চারপাশে অসংখ্য চালাক মানুষ। অতি চালক মানুষও আছে। আমি অবাক বিস্ময়ে তাদের কান্ড কারখানা দেখি। তখন নিজেকে বোকার দাদা মনে হয়। মানুষের বুদ্ধিমত্তা দেখে আমি টাসকি খাইয়া যাই। মাঝে মাঝে আমার ছেলে মেয়ের বুদ্ধিমত্তা দেখেও আমার এমন লাগে। এতো প্রাকটিক্যাল কিভাবে হলো এই বয়সে! আমিতো এই একষট্টিতেও আবেগ দিয়ে চলি, আর বোকামী করি। বোকার মতো কথা বলি, বোকার মতো মানুষকে বিশ্বাস করি। বোকার মতো সিদ্ধান্ত নেই। যেখানে যা বলা দরকার তা বলি না, যখন যেটা বলা উচিত তখন সেটা মনে পড়ে না। জেসমিন মনে করে আমার চেয়ে ওর বুদ্ধি বেশি। সব স্ত্রীরাই তাই মনে করে অবশ্য। জেসমিন যে নিজেকে আমার চেয়ে বুদ্ধিমান ভাবে তাতে আমি হ্যাপি।

যাইহোক প্রসঙ্গ এটা না। প্রসঙ্গ হচ্ছে বোকাদের নিয়ে। বোকাদের একটা প্লাটফর্ম থাকা দরকার। পাঁচ বছর আগেও এরকম একটা আহবান রেখে ছিলাম এবং যথেষ্ট সাড়াও পেয়েছিলাম। এই ভেবে অনেক ভাল লেগেছিল যে আমার মতো বোকা লোকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয় চারপাশে। তারা নিজেকে তুলে ধরতে পারে না বলে আমরা তাদের সম্পর্কে জানি না। তাদের জন্যই একটা প্লাটর্ফম থাকা দরকার। একটা ক্লাব থাকা দরকার। সেই ক্লাবে কোনো চালাকদের জায়গা নাই। সেখানে কোনো সাহিত্য থাকবে না, গান বাজনা হবে না, খেলাধূলা হবে না, জুয়া হবে না, মদ্যপান হবে না। পৃথিবীতে অনেক দামী দামী ক্লাব আছে। এই টরন্টোতেই একবার একটা ক্লাবে গিয়েছিলাম এক বন্ধুর সাথে, নাম স্পোক ক্লাব। সেই ক্লাবের মেম্বারশীপের জন্য আবেদন করতেই বছরে মিনিমাম পাঁচশ হাজার ডলার ইনকাম থাকতে হবে।

আমাদের ক্লাবের নাম হবে বোকা ক্লাব। সেখানে যত বোকা মানুষ আছে তাদের বোকামি নিয়ে কথা হবে শুধু। কে কে আছেন হাত তুলুন..!

টরন্টো ৩ অক্টোবর ২০২২

রান্না জিনিসটা যে কে আবিষ্কার করেছে!!

রান্না বান্নার কাজটাকে কেনো যে ‘আর্ট’ হিসাবে গণ্য করা হয় জানি না। সম্ভবতঃ মহিলাদের কিচেনকে স্থায়ী জায়গা বানানোর জন্য এটাকে আর্ট বলে চালানোর পুরুষদের একটা অপচেষ্টা। সেই আদিকাল থেকেই মহিলারা কিচেনে বেশি সময় ব্যয় করে। তাদের জীবনের লক্ষ লক্ষ মূল্যবান ঘন্টা কিচেনে নষ্ট হয়। তারা যে খুউব আনন্দ নিয়ে কিচেনে থাকে আমার তা মনে হয় না। বাধ্য হয়ে থাকে। সময়মতো খাবার না পেলে পুরুষের ধমকানি যেমন আছে তেমনি মারধোরের কাহিনীও আছে আমাদের সমাজে। খাবার মজাদার না হলে কথা দু’কথা শুনিয়ে দেওয়া আছে।

একবারের একটা ঘটনা বলি। মাত্র বিয়ে করেছি। সংসার শুরু হয়েছে। রান্না বান্নায় জেসমিন তখনও শিক্ষানবিশ। আমার বড় ভাই বরিশাল থেকে এসেছেন আমাদের সংসার দেখতে। জেসমিন মহা উৎসাহ নিয়ে রান্না করেছে। রাতে খেতে বসেছি। খাবার মুখে দিয়েই আমি পোলাওর সমালোচনা শুরু করলাম। সেটাই ছিল জেসমিনের প্রথম পোলাও রান্না। পোলাও রান্না যে একটু ট্রিকি সেটা অনেক পরে জেনেছি। খাবার শেষে ভাই আমাকে ডেকে বললেন, শোনো যে রান্না করে সে তার সমস্ত চেষ্টা আর আবেগ দিয়েই করে। কোনোদিন খাবার টেবিলে বসে খুত ধরবা না।

কিচেন জায়গাটাকে মহিলারা নিয়তি বলে মেনে নিয়েছে। কিচেনই যেনো তাদের সুখ দুঃখ প্রকাশের জায়গা। কিচেনে বসেই তারা হাসে, কাঁদে, আত্মীয়, বন্ধু, সন্তানের সাথে গল্প করে। তারা বাইরে কাজ করবে, রান্না করবে, সন্তান ধারন এবং প্রতিপালন করবে আবার তারাই রাস্তাঘাটে, বাসে, ট্রেনে, কর্মক্ষেত্রে নিগৃহিত হবে, ইভটিজিংএর শিকার হবে। আচ্ছা পুরুষেরা সন্তান ধারন করতে পারলে কেমন হতো! তাহলে অন্ততঃ বুঝত দশ মাস সন্তান গর্ভে ধারন করা কত কষ্টের এবং প্রসব বেদনা কত ভয়াবহ যন্ত্রণার!

জেসমিনকে দেখি কি এক অদ্ভুত কায়দায় ফোন কানে লাগিয়ে কথা বলছে আর রান্না করছে, তরকারি কুটছে। কোনো সমস্যা হচ্ছে না! ঘরে ঢুকে প্রায়ই দেখি ফোনে আছে। বিভোর হয়ে কথা বলছে। যেনো আমাকে দেখেও চিনতে পারে না। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কারণ রান্না এবং ফোন একসাথে দুটো চালিয়ে যাওয়া এতো সহজ কাজ না। তাই হয়ত ঘরের মানুষটাকে অচেনা লাগে।

পুরুষরাও যে কিচেনে থাকে না তা না। তারাও কুক করে। পৃথিবীতে বড় বড় শেফ সব পুরুষ। যদিও সেটা পেইড কিন্তু ঘরের মেয়েদের কাজটা থ্যাংকলেস। আমার ছেলে অর্ক ভাল রান্না শিখে ফেলেছে। অরিত্রি চালিয়ে নিতে পারে। সেদিন অর্ক আমাদের জন্য তেহারি বানিয়ে নিয়ে এসেছে। একেবারে বাঙালি ফ্লেভার। বললাম তুমি কিভাবে করলা! বলল, ইউটিউব দেখে। অনেক রেসিপি থাকে ইউটিউবে। অন্য একদিন রোষ্ট বানিয়ে নিয়ে এসেছিল। অর্ক লাইক করে বাংলাদেশি খাবার, খাতিজা ইন্ডিয়ান। তাই তারা পছন্দের খাবার নিজেরটা নিজেই করে নেয়।

বিদেশে যারা ব্যাচেলর পুরুষ তারা নিজেদের রান্না নিজেরাই করে। এসব দেশে মানুষ এতো বাইরের খাবার কেনো খায়! এর কারণ হচ্ছে কিচেন জিনিসটা এতো আরামের জায়গা না। সময়ের অপচয়। বাংলাদেশেও এখন এই ট্রেন্ড চালু হয়েছে। কেউই প্রায় ঘরে দাওয়াত দেয় না। রেষ্টুরেন্ট না হয় টেক আউট। আমি নিজেও এখন ব্যাচেলর জীবন যাপন করছি। জেসমিন গেছে দেশে। যাওয়ার আগে বলছিল তোমার জন্য খাবার রান্না করে যাই কয়েক দিনের! আমি বলছি, একদম না। আমি নিজে করব। ফ্রেস ফ্রেস খাবার খাব।

জেসমিন জানে আমি চুলায় খাবার বসিয়ে কম্পিউটারে গিয়ে বসে থাকব না হয় টিভিতে একশন মুভিতে বিভোর হবো। অতীতে এমন অনেক হয়েছে। যখন স্মোক এলার্ম বাজে তখন টের পাই। জেসমিন পই পই করে বলে গেছে, চুলা জ্বালাবা না। আমি মজা করে বলি, কিছু হলে এক লক্ষ ডলারের হোম ইন্সুরেন্স আছে। প্রিমিয়াম দিয়েই গেলাম সারা জীবন। রাইস কুকার, চা বানানোর জন্য হট ওয়াটার কেটলি, মাছ মাংস কুক করার জন্য এয়ারফ্রায়ার, স্যান্ডুইচ মেকার, টোষ্টার ইত্যাদি হাতের কাছে রেখে গেছে। অরিত্রি রেডি আইটেম এনে রেখে যায় ফ্রীজে। স্রিম্প, নাগেট, ডিম, সসেজ, চিকেন বার্গার, ফিশ, ফ্রাইজ, ব্রেড, আটার রুটি, মেরিনায়েড চিকেন, ফ্রোজেন সবজি, ঢেরস, করল্লা, পটল, মিক্সড ভেজিটেবলৃ.।

বাবা, একটু কষ্ট করে রেডি করে খেও।

কিন্তু আমি একটু ওল্ড ফ্যাশন। চুলায় ভাত বাসাই। ডাল রান্না করি, ডিম ভাজি। প্রথম দুই দিন ভাত জাও হয়ে গেছে। ফ্রোজেন ডাটা শাঁক রান্না করেছি কিন্তু লবনে মুখে দেওয়া যায় না। ডালের অবস্থাও তাই। কিন্তু তাও খেতে অমৃত! আজকে আমার অতি প্রিয় দুধ সেমাই রান্না করলাম। মা করে দিতেন। ওমা কোন ফাঁকে পোড়া গন্ধ পেয়ে ছুটে গিয়ে দেখি দুধ উপচে পড়ে চুলা মাখামাখি। হাঁড়ি পুড়ে কয়লা। তার উপর চিনি কম হয়েছে। কখনও কখনও ভুলে চুলা না জ্বালিয়েই রান্না করতে থাকি। রান্না জিনিসটা যে কে আবিষ্কার করেছে!

টরন্টো ৪ অক্টোবর ২০২২

জসিম মল্লিক, লেখক ও সাংবাদিক, টরন্টো, কানাডা।