টরেটক্কা টরন্টো
চীন-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক -৯
কাজী সাব্বির আহমেদ
গোয়েন্দা রিপোর্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে ছাত্র আন্দোলনের যে চিত্রটি ফুটে তাতে কম্যুনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ যাদেরকে ‘গ্রুপ অব এল্ডার্স’ বলা হয়ে থাকে তাদের কাছে আর কোন দ্বিধার অবকাশ থাকে না। তারা সবাই একমত হন যে, এখন সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। পরিস্থিতি ইতিমধ্যেই ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’ অতিক্রম করে ফেলেছে। ফলে ২রা জুন সকালে ‘গ্রুপ অব এল্ডার্স’ এবং স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যদের নিয়ে বসে একটি জরুরী মিটিং। সেখানে প্রেসিডেন্ট ইয়াং শাংখুন সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘এখন পিছিয়ে আসা মানে কম্যুনিস্ট পার্টির পতন আর ক্যাপিটালিজমের উত্থান’। মিটিং শেষে দেং শিয়াওপিং সিদ্ধান্ত দেন যে, মার্শাল ল’ কার্যকরী করার জন্য নিয়োজিত সামরিক ট্রুপগুলি আজ রাতেই থিয়েনআনমেন স্কয়্যারকে দখলে নেয়ার কাজ শুরু করবে এবং দুইদিনের ভিতর আন্দোলনরত দুষ্ট এলিমেন্টদেরকে তাড়িয়ে চত্বরটি পরিস্কার করে ফেলতে হবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াং শাংখুন যিনি কিনা একই সাথে মিলিটারি অ্যাফেয়ার্স কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান, দেং শিয়াওপিং-এর নির্দেশে সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের সাথে বৈঠকে মিলিত হন এবং মিলিটারি কমান্ডারদেরকে পার্টির সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াং শাংখুনের সাথে তার ভাই আর্মির পলিটিক্যাল ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান ইয়াং পাইপিং-ও এই বৈঠকে যোগ দেন। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে মিলিটারি আর্মড পুলিশ আর পিপলস লিবারেশন আর্মি একযোগে চারিদিক থেকে এসে থিয়েনআনমেন ঘেরাও করে ফেলবে। সেই মোতাবেক ২রা জুন মধ্যরাতে যে সমস্ত মার্শাল ল’ ট্রুপগুলি বেইজিং-এর বাইরে ছিল তারা থিয়েনআনমেন অভিমুখে অগ্রসর হওয়া শুরু করে। কোন বাধাই এইবার তাদেরকে এই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না। কিন্তু বিধি বাম, বাধা আসা শুরু করে প্রতি পদে পদে।
প্রথম বাধাটি ছিল ২রা জুন রাত এগারোটায়। এটাকে বাধা না বলে বরং সরকারের জন্য একটি দূর্ভাগ্যজনক ঘটনা বলাই শ্রেয়। কারণ এই ঘটনায় জনগণ মিলিটারির গতিবিধি সম্পর্কে আগেভাগেই সতর্ক হয়ে যায়, ফলে মার্শাল ল’ ট্রুপদের বেইজিং শহরে প্রবেশ করাটা কঠিন হয়ে পড়ে। সিসিটিভি-এর ফটোগ্রাফাররা আর্মির একটি মিটসুবিসি জীপে চড়ে যাওয়ার সময় থিয়েনআনমেন চত্বরের কাছাকছি মুসিডি নামক সড়কের ফুটপাতের উপর কয়েকজন পথচারীকে চাপা দেয়। তিনজন পথচারী ঘটনাস্থলেই নিহত হন এবং একজন গুরুতর আহত হন। জনগণ এই দূর্ঘটনার মাধ্যমে ধারণা করে নেয় যে মার্শাল ল’-এর ট্রুপরা শহরে ঢোকার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে এবং তাদেরকে প্রতিহত করার জন্য সবাই সতর্ক হয়ে উঠে। রাত দু’টোর সময় থিয়েনআনমেন চত্বরের নিকটবর্তী ঠ্রাংআন সড়কে হঠাৎ যেন ভুঁইফোঁড় হয়ে উদয় হলো কয়েক হাজার জগার। সাদা শার্ট, সবুজ প্যান্ট এবং রানিং সু পরিহিত জগারদের এই সুবৃহৎ দলকে হঠাৎ দেখলে মনে হবে তারা যেন ‘আর্লি মর্নিং ওয়ার্ক আউট’ করতে বেরিয়েছে। কিন্তু আসলে তারা ছিল বেইজিং আর্মির ২৪তম ইউনিটের পদাতিক সৈন্য। অনেকটা ‘ট্রোজান হর্স’ পদ্ধতিতে তারা চেয়েছিল জনগণের বাধা অতিক্রম করে তাদের লক্ষ্যস্থল থিয়েনআনমেন স্কয়্যারের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছে যেতে। কিন্তু জনগণের কড়া নজরদারির কাছে তাদের এই সামরিক কৌশল পরাস্ত হয়। স্বেচ্ছাসেবী ‘ফ্লাইং টাইগার’-এর দল তাদের মোটর সাইকেলে করে বেইজিং-এর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ট্রুপদের গতিবিধির সর্বশেষ খবর পৌঁছে দিচ্ছিল, ফলে থিয়েনআনমেন চত্বরের কাছাকাছি অন্যান্য সকল বড় বড় সড়কগুলিতেও ছাত্র এবং সাধারণ জনগণ সতর্ক হয়ে উঠে। তাদের সম্মিলিত কড়া পাহাড়া এবং বাধার মুখে সেই রাতে সামরিক বাহিনীর কোন ইউনিটই থিয়েনআনমেন স্কয়্যারে পৌঁছাতে পারেনি। শহরের বিভিন্ন স্থানে সৈন্যদেরকে অনেকটা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় জনগণের দ্বারা ঘেরাও অবস্থায় বসে থাকতে দেখা যায়। সহজ এই বিজয়ে আপ্লুত হয়ে ৩রা জুন ভোর পাঁচটায় ছাত্ররা থিয়েনআনমেন স্কয়্যারের লাউড স্পীকারে ঘোষণা দেয় যে তাদের বিজয় অর্জিত হয়েছে। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিল যে কম্যুনিস্ট পার্টি এত সহজেই হাল ছেড়ে দেয়ার মতন প্রতিপক্ষ নয়। ক্ষণিকের জন্য হলেও তারা এটাও ভুলে গিয়েছিল যে চেয়ারম্যান মাও নিজেই বলে গেছেন ‘বন্দুকের নলই হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস’, অথচ কম্যুনিস্ট পার্টির সেনাবাহিনী কিন্তু এখনও পর্যন্ত তাদের বন্দুকের নল ছাত্র কিংবা জনগণের দিকে তাক করেনি।
ইতিহাসের পাতায় ৩রা জুন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন, কারণ এই দিনের ঘটনাক্রমের কারণেই চীন সরকারের জন্য ৪রা জুন একটি স্পর্শ কাতর দিন হিসেবে ক্যালেন্ডারের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে। ভোরবেলা থেকেই বেইজিং-এর বিভিন্ন স্থানে সামরিক বাহিনীর সশস্ত্র সৈন্যরা ছাত্র এবং জনগণের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে নিশ্চল বসে আছে। সামরিক অফিসাররা বিভ্রান্ত কারণ এই অবস্থায় সৈন্যদেরকে কি কমান্ড দিতে হবে সেই সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা নেই। দুই পক্ষই উত্তেজিত, ফলে যে কোন মুহুর্তেই পরিস্থিতি সহিংসতায় মোড় নিতে পারে। কিন্তু দিন বাড়ার সাথে তাদের ভিতরকার বরফ ধীরে ধীরে গলা শুরু করে, জনগণের দেয়া পানি কিংবা সিগারেট সৈন্যরা হাসিমুখে গ্রহণ করে এবং তাদের ভিতর বন্ধুত্বপূর্ণ কথোপকথন শুরু হয়ে যায়। এক সময় দেখা যায় যে জনগণ এবং সৈন্যরা একত্রে কালচারাল রেভ্যুলেশনের সময়কার গান গাচ্ছে – ‘উইদ আউট দ্য কম্যুনিস্ট পার্টি, দেয়ার উড বি নো নিউ চায়না’। তবে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে যেখানে কিছু কিছু সৈন্য জনগণের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছে। কিন্তু সামরিক বাহিনী ও জনগণের এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল কম্যুনিস্ট পার্টির নির্দেশিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটি বড় বাধা। সেই কারণে পার্টির শীর্ষ নেতারা আবারো রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করার জন্য। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ৩রা জুন বিকেল ৪টায় কম্যুনিস্ট পার্টির এক জরুরী মিটিং-এ প্রেসিডেন্ট ইয়াং শাংখুন জানান যে তিনি দেং শিয়াওপিং কাছ থেকে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ পেয়েছেন। প্রথমটি হচ্ছে, আগামীকাল ভোরের মধ্যে থিয়েনআনমেন স্কয়্যারকে আন্দোলনকারীদের হাত থেকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। দ্বিতীয় নির্দেশ হচ্ছে, এই পুনরুদ্ধার কাজ সমাধা করার জন্য ‘যা করা দরকার তাই করতে হবে’। তবে অবশ্যই সেনা তৎপরতা শুরু করার আগে সবাইকে শেষবারের মতন চত্বর ত্যাগ করার জন্য সতর্ক করে দিতে হবে এবং থিয়েনআনমেন স্কয়্যারের ভিতর যাতে কোন রক্তপাত না হয় সেই দিকে নজর রাখতে হবে। তিনি এটাও উল্লেখ করেন যে, যদি ছাত্ররা থিয়েনআনমেন চত্বর ত্যাগ করতে রাজী না হয় তবে সৈন্যরা তাদেরকে পিঠে করে চত্বর থেকে সরিয়ে নিয়ে যাবে। সংখ্যায় যদি তারা হাজারও হয় তবুও। এটাই হচ্ছে দেং শিয়াওপিং-এর নির্দেশ। গুলি করা যাবে শুধুমাত্র তখনই যখন অন্য সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় বেইজিং মিনিউসিপ্যাল গভর্মেন্ট এবং মার্শাল ল’ কমান্ড থেকে একটি জরুরী ঘোষণা দেয়া হয় তাতে সকল জনগণকে তাদের নিজের জীবনের নিরাপত্তার খাতিরে থিয়েনআনমেন চত্বর থেকে চলে যেতে এবং বাসা থেকে বের হতে বারণ করে দেয়া হয়। এই ঘোষণা থিয়েনআনমেন চত্বরের লাউড স্পীকার থেকে প্রচারিত হতে থাকে। একই সাথে বেইজিং সব গুরুত্বপূর্ণ ইউনিভার্সিটিগুলির ক্যাম্পাসেও লাগাতারভাবে প্রচারিত হতে থাকে। এই সময় আমি অন্যান্য সব বাংলাদেশী স্টুডেন্টদের সাথে বেইজিং ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত এক ডিনার পার্টিতে ছিলাম। বাংলাদেশ অ্যাম্বাসির তখনকার নেভাল এটাশে বেইজিং-এর সব বাংলাদেশী ছাত্রদের জন্য সেই ডিনার পার্টিটির আয়োজন করেছিলেন। আমরা সবাই যখন এই পার্টিতে কিছুটা লঘু সময় পার করছিলাম, আমাদের অগোচরে থিয়েনআনমেন স্কয়্যারে তখন রচিত হচ্ছিল ইতিহাস। তবে আমরা এক হিসেবে ভাগ্যবান, এই পার্টির কারণে আমরা কেউই সেই বিভীষিকাপূর্ণ রাতে থিয়েনআনমেন চত্বরে উপস্থিত ছিলাম না। অন্যথায় আমিও হয়ত অনেকের মতন নিত্যদিনের অভ্যাস মোতাবেক দর্শক হিসেবে সেই রাতে থিয়েনআনমেন চত্বরে উপস্থিত থাকতাম। সেই রাতে যারা সেখানে উপস্থিত ছিল তাদের সকলের জীবনের প্রতি হুমকি নেমে এসেছিল সামরিক বাহিনীর আগ্রাসনের কারণে।
থিয়েনআনমেন চত্বর এবং বেইজিং-এর বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির লাউড স্পীকারে যখন বারংবার ধাতব এবং যান্ত্রিক কন্ঠে ‘বাড়ী ফিরে যাও, জীবন বাঁচাও’ ঘোষণাটি প্রচারিত হচ্ছিল তখন সাধারণ জনগণ সেটাকে হাল্কাভাবেই নেয়। কারণ এই ধরণের ঘোষণা মার্শাল ল’ জারীর পর থেকে প্রায়ই দেয়া হচ্ছে কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি এ পর্যন্ত। জনগণ এই যান্ত্রিক কন্ঠস্বরের সাথে গত চল্লিশ বছর ধরেই পরিচিত। কম্যুনিস্ট সরকারের এই অভিব্যক্তিহীন ধাতব যান্ত্রিক কণ্ঠস্বরই তাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে সেই চেয়ারম্যান মাও-এর আমল থেকে। তারা এখন এই যান্ত্রিক কন্ঠের আদেশ থেকে মুক্তি চায়। তাই তারা আবারো রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করাটাই সমীচীন বলে ধরে নেয়। এই ঘোষণার প্রত্যুত্তরে বেইজিং নরম্যাল ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে প্রায় বিশ হাজার ছাত্রদের এক সমাবেশে ছাত্রনেতা উয়ার খায়সি দীপ্ত কন্ঠে আহ্বান জানায়, ‘আজকে প্রতিটি চীনা নাগরিকের সামনে রয়েছে একটি কঠিন পরীক্ষা – দুটি পথের মাঝ থেকে একটিকে বেছে নেয়ার পরীক্ষা। থিয়েনআনমেন স্কয়্যার হচ্ছে আমাদের জনগণের, আমরা কোনভাবেই কসাই সরকারকে এটার দখল নিতে দিব না। আমাদেরকে থিয়েনআনমেনে অবস্থানরত ছাত্রদেরকে রক্ষা করতে হবে, চীনের ভবিষ্যতকে রক্ষা করতে হবে। চীনকে রক্ষা করার জন্য আমি আমার জীবন উৎসর্গ করব।’ কিন্তু উয়ার খায়সি তার জীবন বাঁচাতেই বেশী তৎপর ছিলেন এবং বলা হয়ে থাকে যে সেই রাতে যখন সামরিক বাহিনী থিয়েনআনমেন-এর দখল নিয়ে নেয় তখন তিনি পালিয়ে হংকং-এর পথে রওয়ানা হয়ে যান। কিন্তু ছাত্রনেত্রী ছাই লিং ছিলেন তার কথায় অবিচল। রাত নয়টায় দিকে কয়েকটি হেলিকপ্টারকে ঠ্রাংআন সড়কের পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে টহল দিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি বিচার করতে দেখা যায়। তখন একজন ছাত্রকে দেখা যায় যে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে সে সবাইকে সতর্ক করে দিচ্ছে ‘বেইজিং-এর পশ্চিম গ্যারিসনের সৈন্যরা আসছে থিয়েনআনমেন দখল করতে’। এই ইউনিটের সৈন্যরা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট ইয়াং শাংখুনের প্রতি বিশেষভাবে আনুগত্যশীল ফলে তারা যে সামান্যতম বাধাতেও গুলি করতে দ্বিধা করবে না সেটা সহজেই অনুমেয়। এই চরম অনিশ্চয়তার মুহুর্তে ছাই লিং ছাত্রদেরকে দৃঢ় কন্ঠে নির্দেশ দেন ‘থিয়েনআনমেন-কে রক্ষা কর’। তিনি নিজে সারা রাত চত্বর ছেড়ে কোথাও যাননি বটে তবে তিনি ঘটনার পরবর্তী পর্যায়ে গা ঢাকা দিয়ে গ্রেফতার এড়াতে পেরেছিলেন। গ্রেফতার এড়াতে পারেননি শুধু অন্যতম শীর্ষ ছাত্রনেতা ওয়াং তান। থিয়েনআনমেন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে সরকার তার বিরুদ্ধে ‘প্রতিবিপ্লবী’-এর অভিযোগ এনে চার বছরের কারাদন্ড দেয়। অবশ্য মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ১৯৯৩ সালে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। অলিম্পিক গেমসের ভেন্যু হিসেবে বেইজিং-এর মনোয়ন পাওয়ার পথ সুগম করার জন্যই নাকি চীনা সরকার ওয়াং তানকে মেয়াদের আগেই মুক্তি দিয়েছিল বলে অনেকেই মনে করেন। এই সময় চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর বিখ্যাত পদার্থবিদ ফাং লিট্রি গ্রেফতার এড়াতে মার্কিন দূতাবাসে আশ্রয় নেন। এক বছরের অধিককাল মার্কিন দূতাবাসে আশ্রিত থাকার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের বিশেষ দূত হেনরি কিসিঞ্জারের সাথে প্যারামাউন্ট লীডার দেং শিয়াওপিং-এর মাঝে গোপন সমঝোতার ভিত্তিতে ফাং লিট্রি অবশেষে মার্কিন বিমানযোগে ব্রিটেনের উদ্দেশ্য চীন ত্যাগ করতে সমর্থ হন।
রাত নয়টার পর পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট থিয়েনআনমেন চত্বরের দিকে অগ্রসর হওয়া শুরু করে। এই সময় সবচেয়ে বেশী বাধা আসে থিয়েনআনমেন চত্বরের তিন কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত মুসিডি নামক এলাকায়। সেখানে তখন পিপলস আর্মড পুলিশের পাশাপাশি পিপলস লিবারেশন আর্মির ৩৮তম ইউনিটের সৈন্যরা ছিল। তাদের পিছনে ছিল ২৭তম ইউনিটের ‘আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার’ বা এপিসি-এর গাড়ীর বহর। জনগণের বাধাকে অতিক্রম করার জন্য পদাতিক সৈন্যরা তখন কালচারাল রেভ্যুলেশনের সময়ে পিপলস আর্মিতে প্রচলিত চেয়ারম্যান মাও-এর বাণী ‘আমাকে যদি কেউ আক্রমণ না করে তবে আমি কাউকেই আক্রমণ করব না, তবে কেউ যদি আমাকে আক্রমণ করে, আমি অবশ্যই বদলা নিব’ আওড়াতে আওড়াতে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। জনগণ তখনও বিশ্বাস করতে পারছিল না যে আর্মি আসলেই সত্যিকারের গুলি ছুঁড়বে। কিন্তু এই সময়ে তাদের প্রতি পাথর নিক্ষেপের সাথে সাথে জনগণকে তাক করে সৈন্যরা গুলি চালানো শুরু করে। ফলে অনেকেই ঘটনাস্থলে নিহত হয়। এখানে অবশ্য সৈন্যদের গুলিতে কিছু সৈন্যও নিহত হয়েছে। তাছাড়া এপিসি-এর নীচে চাপা পড়েও আরও কিছু সৈন্য মারা পড়ে। কিছু জায়গাতে আবার উল্টো ঘটনাও ঘটেছে যেখানে জনগণের হাতে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে বেশ কিছু সৈন্য এবং সেনা অফিসার। থিয়েনআনমেন চত্বরের পূর্বপ্রান্তে চিয়েনকোয়ামেন এবং ঠ্রাওইয়াংমেন সড়কের কাছে একটি ওভারব্রীজের উপর বেশ কিছু মিলিটারি কনভয় জনগণের দ্বারা বেষ্টিত অবস্থায় রয়েছে। তাদের এই নিশ্চলতা ভাঙতে সেখানে কয়েকটি এপিসি পাঠানো হলো। একটি এপিসি জনগণকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য হাই স্পীডে রাস্তার উপর দিয়ে যাওয়ার সময় বেশ কিছু পথচারীকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলে। উত্তেজিত জনগণ তখন সেই এপিসিকে হাতে তৈরি মলোটভ ককটেল দিয়ে আক্রমণ করে আগুন ধরিয়ে দেয়। এক এক করে দুইজন সৈন্য যখন সেই জ্বলন্ত এপিসি থেকে বের হয়ে এসেছিল তখন উত্তেজিত জনগণ তাদেরকে মুহুর্তের মধ্যেই পিটিয়ে মেরে ফেলে। কিন্তু তৃতীয় সৈন্যকে ছাত্ররা আধমরা অবস্থায় জনগণের হাত থেকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়। ঠ্রোংওয়েনমেন এলাকায় আরেকজন সৈন্য জনগণের হাতে প্রাণ হারায়। তার মৃতদেহের গলায় দড়ি বেঁধে প্রথমে একটি কনক্রিটের দেয়াল থেকে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। পরে তা পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে দিলে এক নৃশংস দৃশ্যের অবতারণা হয়। সৈন্যদের গুলিতে মুসিডি-তে যে বেশ কিছু মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে সেই খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়াতে জনগণ সৈন্যদের প্রতি মারমুখী আচরণ শুরু করে। আর সৈন্যদের প্রতি তাদের উপরওয়ালাদের নির্দেশ এবং সেই সাথে জনগণের মারমুখী আচরণ তাদেরকে উত্তেজিত করে তোলে এবং জনগণের উপর নির্বিচারে গুলি করার ক্ষেত্রে আর কোন বাধা থাকে না। বরং সহযোদ্ধাদের করুণ মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে তারা বদ্ধ পরিকর হয়ে উঠে। দুই পক্ষের এই একে অপরের প্রতি ক্ষোভ পরিস্থিতিকে অতি দ্রুত নরকতূল্য করে তোলে। ফলে রচিত হয় এক নৃশংস ম্যাসাকারের ইতিহাস।
ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউটের ডিনার পার্টি শেষ করে রাত এগারোটার দিকে হোস্টেলে ফিরে আসি আমি। পরদিন ৪রা জুন রবিবার সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন হোস্টেলের ক্যান্টিনের ব্রেকফাস্টের সময় পার হয়ে গেছে। এ রকম পরিস্থিতিতে সচারচর যা করি সেটা হলো সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের বাইরে। রাস্তার দুধারে রয়েছে বেশ কিছু সস্তা রেস্টুরেন্ট সেখান থেকে কিছু কিনে আনি। সেদিনও একই উদ্দেশ্যে যখন ক্যাম্পাসের পিছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে যখন ঠ্রোংকুয়ানছুন রাস্তার উপর এসেছি, দেখি কোথাও কোন দোকান খোলা নেই। চারিদিকে থমথমে একটা ভাব। হঠাৎ দেখি রাস্তা কাঁপিয়ে মিলিটারি ট্রাকের এক বিরাট কনভয় দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমি সাইকেল নিয়ে ফুটপাতের উপর যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে প্রায় চার পাঁচ শত গজ দূরে এক কিশোরী মেয়ে তার সাইকেল নিয়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। মিলিটারি কনভয় যাওয়ার সময় সেই মেয়েটিকে চাপা দিয়ে গেল। চোখের সামনে এই ঘটনা দেখে আমি অনেকটা বিবশ হয়ে পড়ি। সম্বিত ফিরে পাওয়ার পর পরই দ্রুত হোস্টেলে ফিরে আসি। ততক্ষণে মুখে মুখে খবর ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে গতরাতের কী ঘটছে থিয়েনআনমেন স্কয়্যারে। রাত একটার দিকে সেনাবাহিনীর ট্যাংক এবং এটিসি-এর বহর এসে ঘেরাও করে ফেলে থিয়েনআনমেন চত্বর। এই সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা নির্দয়ভাবে গুলি চালিয়েছে ছাত্র এবং জনগণের উপর। কয়েক হাজার ছাত্র তখন চত্বরের মাঝামাঝি মনুমেন্টের নীচে অবস্থান নিয়ে আছে। যে কোন সময় সেনাবাহিনী তাদেরকে আক্রমণ করবে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে রাত তিনটার দিকে রকস্টার হৌ তচিয়েন, ছাত্রনেতা উয়ার খাইসি-র পরামর্শদাতা লিউ শিয়াওবো এবং স্টোন কর্পোরেশনের ইকোনোমিস্ট ট্রৌ তোয়া যারা ২রা জুন থেকে অনশন পালন করে আসছে, তারা শান্তিপূর্ণভাবে চত্বর ছেড়ে চলে যাওয়ার পক্ষে তাদের সিদ্ধান্ত দিল, কিন্তু ছাত্রনেত্রী ছাই লিং তখনও চাচ্ছিলেন চত্বর ছেড়ে কোথাও না যেতে। অবশেষে হৌ তচিয়েন এবং ট্রৌ তোয়া একটি মিনিভ্যানে চড়ে সেনাবাহিনীর দিকে এগিয়ে যান ছাত্রদের নিরাপদে চত্বর ছেড়ে চলে যাওয়ার নিশ্চয়তা নিশ্চিত করার জন্য। সেনাবাহিনীর ২৭তম ইউনিটের কর্নেল চি সিংকোয়া-এর মধ্যস্থতায় ভোর পাঁচটার দিকে ছাত্ররা চত্বর ছেড়ে চলে যাওয়া শুরু করে। এরপর সেনাবাহিনী ট্যাংকবহর দিয়ে চত্বরের ভিতর গড়ে উঠা বিভিন্ন তাঁবু এবং অন্যান্য কাঠামো গুলি গুঁড়িয়ে দেয়া শুরু করে। অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর মতে এই সময় ট্যাংকের নীচে চাপা পড়ে অনেকেই প্রাণ হারায়। ভোর সাড়ে ছয়টায় ট্যাংক দিয়ে ‘গডেস অব ডেমোক্রাসি’ স্ট্যাচুটিকে ধ্বংস করে ফেলার মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটে দীর্ঘ সাত সপ্তাহব্যাপী থিয়েনআনমেন স্কয়্যারের ছাত্র আন্দোলনের।
এই আন্দোলন দমনের জন্য কতজন লোকের প্রাণহানি হয়েছিল তার সঠিক সংখ্যা আজও পর্যন্ত জানা যায়নি। ঘটনার প্রায় দুই বছর পর ৯ই এপ্রিল, ১৯৯১ সালে টেলিভিশনে প্রচারিত এক প্রেস কনফারেন্সে প্রিমিয়ার লি পেং-কে জিজ্ঞেস করা হয় কখন চীনা সরকার থিয়েনআনমেন স্কয়্যারে নিহতদের তালিকা প্রকাশ করবে। সেই প্রশ্নের জবাবে লি পেং বলেন, নিহতের পরিবারের লোকজন চায় না এই তালিকা প্রকাশ পাক কারণ যারা নিহত হয়েছে তারা হচ্ছে প্রতিবিপ্লবী। সরকার নিহতদের পরিবারদের অনুরোধ রক্ষা করে এই তালিকা কখনই প্রকাশ করবে না। সরকারের এই সিদ্ধান্তে হতাশ এবং মর্মাহত হন বেইজিং-এর বিখ্যাত পিপলস ইউনিভার্সিটির দর্শন বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক তিং জিলিন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে এই তালিকা তৈরি করে প্রকাশ করবেন একদিন। তারপর থেকে সরকারের বাধা উপেক্ষা করে তিনি নিরলসভাবে থিয়েনআনমেন স্কয়্যারে নিহত এবং আহতদের নাম ঠিকানা সংগ্রহ করে একটি লিস্ট বানিয়ে যাচ্ছেন। সেই লিস্টের প্রথমে যে নামটি স্থান করে নিয়েছে সেটা হলো সতেরো বছর বয়স্ক চৌকস ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় এবং হাই স্কুলের তুখোড় ছাত্র চিয়াং চিয়েলিয়েন, পিতা অধ্যাপক চিয়াং পেইখুন, মাতা অধ্যাপক তিং জিলিন।
৪রা জুনের পর থেকে বেইজিং শহরের স্থিতিশীলিতা ফিরিয়ে আনার জন্য শহরের বিভিন্ন স্থানে আর্মির কনভয় আর সেই সাথে ট্যাংক বহরের আনাগোনা অনেকটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ৫ই জুন বিকেল বেলায় ঠ্রাংআন সড়ক দিয়ে থিয়েনআনমেন অভিমুখে যখন যাচ্ছিল সারিবদ্ধ চারটি ট্যাংকের একটি দল তখন এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। সাদা শার্ট কালো প্যান্ট পরিহিত একজন নিরীহ পথচারী যার দুই হাতে ছিল দুইটি শপিং ব্যাগ হঠাৎ এসে দাঁড়ায় সেই ট্যাংক বহরের সামনে। সবাই ধরে নিয়েছিল যে এই নিরীহ লোকটিকে চাপা দিয়ে চলে যাবে ট্যাংকের এই বহর। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সামনের ট্যাংকটি থেমে গেল লোকটির সামনে। ফলে পিছনের সবগুলি ট্যাংকও থামতে বাধ্য হয়। সামনের ট্যাংকটি যখন লোকটিকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছিল তখন লোকটি আবারও এসে সেই ট্যাংকটির সামনে এসে দাঁড়ায়। এক সময় আশে পাশের লোকজন তাকে সরিয়ে নিয়ে যায় রাস্তা দিয়ে। চীনের কম্যুনিস্ট সরকার শক্ত হাতে যে ট্যাংক বাহিনী দিয়ে থিয়েনআনমেন আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দিল সেই অপ্রতিরোধ্য ট্যাংকগুলিকে সাধারণ একটি নিরীহ মানুয যখন
খালি হাতে প্রকাশ্য রাজপথে থামিয়ে দেয় তখন সেটা সরকারের ভাবমূর্তির জন্য একটি হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ফলে এই ছবিটি আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং কালের পরিক্রমায় থিয়েনআনমেন ম্যাসাকারের আইকনে পরিণত হয়ে উঠে।
চীন সরকার ইতিহাসের পাতা থেকে থিয়েনআনমেন স্কয়্যারের এই নৃশংস ক্র্যাকডাউনের স্মৃতি মুছে ফেলার জন্য সম্ভাব্য সব ধরণের কৌশলের আশ্রয় নিয়ে আসছে। প্রতি বছর এই সময়টায় থিয়েনআনমেন এলাকায় কার্ফ্যু জারী করা হয় যাতে কেউ কোন ধরণের শোক প্রকাশ না করতে পারে। তবে ২০১২ সালে চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি চিপিং ক্ষমতায় আসার পর থিয়েনআনমেন ম্যাসাকারের ব্যাপারে চীনা সরকার আরও বেশী কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করা শুরু করেছে। সেটারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই যখন এই বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ৪রা জুনের ঠিক আগে আগে চীনের স্যোসাল মিডিয়ার ইনফ্লুয়েন্সার লি চিয়াছি লাইভ স্ট্রীমে একজন মহিলার সাথে একটি ট্যাংক আকৃতির কেক নিয়ে উপস্থিত হন। চীনা সরকার সঙ্গে সঙ্গেই ইন্টারনেটের সাথে তার লাইভ স্ট্রীমটির সংযোগ বিচ্ছিন করে দেয়। এরপর দীর্ঘদিন তাকে আর স্যোসাল মিডিয়াতে খুঁজে পাওয়া যায়নি। চারমাস পর তিনি যখন আবার স্যোসাল মিডিয়াতে ফিরে আসেন তখন তাকে প্রশ্ন করা হয় সেই ‘ট্যাংক কেক’ লাইভ স্ট্রীমটি হঠাৎ করেই কেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তিনি তখন দায়সারা ভাবে উত্তর দেন যে সেটি ছিল একটি ‘টেকনিক্যাল গ্লিচ’। জনগণ অবশ্য ঠিকই বুঝতে পেরেছে কে তার কন্ঠকে রুদ্ধ করে রেখেছে। (চলবে)
কাজী সাব্বির আহমেদ
কলাম লেখক। টরন্টো
তথ্যসূত্রঃ
১) ‘ডেসপ্যাচেস ফ্রম দ্য ব্যারিকেড – এ্যান আই উইটনেস অ্যাকাউন্ট অব দ্য রেভ্যুলেশনস দ্যাট শুক দ্য ওয়ার্ল্ড ১৯৮৯-৯০’, জন সিম্পসন, হাচিসন
২) ‘রেড চায়না ব্লুজ – মাই লং মার্চ ফ্রম মাও টু নাও’, জেন ওং, ডাবলডে এ্যাংকর বুকস
৩) ‘ম্যান্ডেট অব হেভেন’, অরভিল শেল, সাইমন এন্ড শুস্টার
৪) ‘দ্য থিয়েনআনমেন পেপারস’, ট্রাং লিয়াং, অ্যাবাকাস