কানাডায় অশ্বেতাঙ্গ নারীরা মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পেতে বড় ধরণের বাধার সম্মুখিন হন

গবেষণায় দেখা যায়, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার বিষয়ে সবচেয়ে বড় বাধা সাংস্কৃতিক কুসংস্কার

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : মানসিক স্বাস্থ্য সহয়তার অপ্রতুলতা এবং সাংস্কৃতিক বাধার কারণে অনেক অশ্বেতাঙ্গ নারী মহামারির সময় সেবা বঞ্চিত হয়েছেন। নতুন এক সমীক্ষায় এই তথ্য জানা গেছে। খবর ক্লারা প্যাসিয়েকা  – সিবিসি নিউজ।

গবেষণায় দেখা যায়, কোভিড-১৯ এর অভিঘাত শুরুর আগে থেকেই গবেষণায় অংশ নেয়া অনেকে মানসিক স্বাস্থ্যসম্পর্কিত সমস্যায় ভুগছিলেন। আর সেবা দানকারীরা এখন বাড়তি চাহিদার সামাল দিতে পারছেন না।

টরন্টোভিত্তিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান ইসলামিক রিলিফ-এর সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে এই সমীক্ষা চালানো হয়। ইসলামিক রিলিফ দেখেছে, মহামারির সময় মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় সাহায্য চাওয়া ব্যক্তির সংখ্যা বেড়ে যায়। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া অনেকে যাতায়াতের এবং পারিবারিক দায়িত্ব নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আত্ম-প্রতারণায় ভুগেছেন। সমীক্ষায় নেতৃত্ব দেওয়া টরন্টোর ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে সমাজবিজ্ঞানে পিএইচডির পরীক্ষার্থী গ্রেস বারাকাত বলেন, বহু রোগী স্বাস্থ্যসেবা সহায়তা একেবারেই পাননি অথবা যৎসামান্য পেয়েছেন। এজন্যে তারা প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

মানসিক স্বাস্থ্য সহয়তার অপ্রতুলতা এবং সাংস্কৃতিক বাধার কারণে কানাডায় অনেক অশ্বেতাঙ্গ নারী মহামারির সময় সেবা বঞ্চিত হয়েছেন। জরিপে এই তথ্য জানা গেছে। ছবি: আইস্টক

তিনি বলেন, তবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ঘিরে যে সাংস্কৃতিক কুসংস্কার জড়িয়ে আছে সেটিই এখনও রোগীদের সহায়তা না চাওয়ার প্রধানতম কারণ হিসাবেই রয়ে গেছে। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক বাধাও এক্ষেত্রে অন্যতম শীর্ষ কারণ। 

‘চাহিদা ছিল বিপুল’

সমীক্ষাটি চালানো হয় অনলাইনে। এতে ১০৩ জন নারী সাড়া দেন এবং পাঁচজন সেবাদানকারীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। গবেষকরা সতর্ক করেছেন যে, সমীক্ষার সরল কাঠামো এবং সীমিত দৈবচয়নের ভিত্তিতে হওয়ায় তাদের তথ্য উপাত্তগুলো কানাডার বৃহত্তর অশে^তাঙ্গ জনগোষ্ঠীর অবস্থার প্রতিফলন হিসাবে বিবেচনা করা ঠিক হবে না। তবে তারা দেখেছেন, উত্তরদাতাদের মধ্যে ৫২ শতাংশই মহামারির আগে থেকেই মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন।

বারাকাত বলেন, লকডাউন ও বিধিনিষেধ যখন তুঙ্গে তখন আমরা নেতিবাচক মানসিক স্বাস্থ্যসম্পর্কিত ফলাফলের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে, বিশেষত উদ্বেগ ও অবসাদের স্তরে এবং মানসিক চাপে বিধ্বস্ত হবার পর্যায়ে বড় ধরণের বৃদ্ধি দেখতে পেয়েছি।

ওই তথ্য টরন্টোর রেজিস্টার্ড সাইকো থেরাপিস্ট এবং ব্লুম সাইকোলজি অ্যান্ড ওয়েরনেস এর প্রতিষ্ঠাতা মেগান ওয়াটসনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।  

তিনি বলেন, “আমি দেখেছি, সেবাপ্রার্থীদের চাহিদা ছিল প্রবল।”

ওয়াটসন ২০২০ সালে মহামারির সময় ব্লুম চালু করেন এবং মাত্র কয়েক মাসের পরই নতুন রোগী নেয়া বন্ধ করে দেন। তিনি বলেন, ব্লুম-এ তার ক্লিনিক্যাল সহকর্মীদের আরও অনেকের হাতে রোগীর জন্য বরাদ্দ সময়সূচি ছিল পরিপূর্ণ।

রেজিস্টার্ড নার্স এবং এসওসিএইচ মেন্টাল হেল্থ-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা জাসমিত চ্যাগের বলেন, মহামারি মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে নতুন ঢেউ তুলেছিল। তার অলাভজনক  প্রতিষ্ঠানটি পিল অঞ্চলে রোগীদের জন্য ইংরেজি, পাঞ্জাবি ও অন্যান্য ভাষায় স্বাস্থ্যগত কল্যাণমূলক অধিবেশন আয়োজন করে।

কিছু লোকের আগে থেকেই মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সমস্যা ছিল যা মহামারি আরও গুরুতর করে তোলে। তিনি বলেন, অন্যরা নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেননি যতক্ষণ না মহামারি নতুন চাহিদা জাগিয়ে দেয়, কিছু ক্ষেত্রে এটি সহায়তার নতুন উদার মনও খুলে দেয়।

চ্যাগের বলেন, মানুষ যখন লকডাউনের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে এবং প্রথাগত শোক জানানোর প্রক্রিয়াও যখন বাধাগ্রস্ত সে সময় দক্ষিণ এশীয় সেবাদাতাদের তরফ থেকে সহায়তার চাহিদা ছিল তীব্র। তিনি বলেন, কারও কারও কাছে তার দুরূহ পরিস্থিতি নিজের ভাষায় বলতে চাওয়াটাও ছিল আকাঙ্খিত। তবে সেটাই একমাত্র উপাদান ছিল না।

চ্যাগের বলেন, “কিছু মানুষের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি যারা এখানেই জন্মেছেন এবং বেড়ে উঠেছেন। কিন্তু তারা একজন দক্ষিণ এশীয় থেরাপিস্ট চাইতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি দক্ষিণ এশীয় পারিবারিক গতিশীলতার মত কিছু বিষয়ে সচেতনতার কথা উল্লেখ করেন যা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য সৃষ্টি করতে সক্ষম।

তিনি বলেন, মহামারির সময় এসওসিএইচ একান্নবর্তী পরিবারে বসবাসকারী নারীদের

জন্য যেসব কল্যাণমূলক অধিবেশনের আয়োজন করে তাতে উপস্থিতি ছিলো প্রচুর। জামাই-বউসহ বিভিন্ন প্রজন্মের মানুষের একসঙ্গে বসবাসের এই দক্ষিণ এশীয় ঐতিহ্য কানাডার কিছু দক্ষিণ এশীয় পরিবারে বিদ্যমান আছে। অধিবেশনগুলো নারীদেরকে ঘরে বসে কাজ করা, সামাজিক দূরত্ব এবং অন্যান্য বিষয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহায়ক হয়।

কুসংস্কারের পেছনে কী

কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় সহায়তা নেওয়ার চাহিদা বেড়ে যাবার পরও সমীক্ষায় অংশ নেওয়া সবাই এমন মনে করতে পারেননি যে তিনি সাহায্য চাইতে পারেন।

চ্যাগের বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার অনেক ভাষায়, যেমন পাঞ্জাবি ভাষায় মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়ে বিবরণ দেওয়ার মত শব্দমালা নেই।

তিনি বলেন, “আমাদের জনগণের খুব সীমিত সংখ্যকেরই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা আছে। আর একমাত্র যে শব্দ দিয়ে আমি এর তরজমা করতে পারি সেটি হলো, আক্ষরিকভাবেই ‘পাগল’ (ক্রেজি)।”

চ্যাগের বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি গভীরভাবে কুসংস্কারে ঢাকা বলে সবাই ভাবতে পারেননি যে তিনি সাহায্য পেতে পারেন।

এক্ষেত্রে কুসংস্কার কী ধরণের ভূমিকা রাখে সেটা ওয়াটসনও উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, “সাহায্য না চেয়ে উপায় থাকে না, সমস্যাটি এমন পর্যায়ে পৌঁছা পর্যন্ত লোকেরা অপেক্ষা করে।”

ওয়াটসন আরও বলেন, কোনও কোনও ক্ষেত্রে, কুসংস্কার এতটাই গভীর যে, কেউ যখন সম্পূর্ণ মানসিক রোগীতে পরিণত হয় তখনই কেবল “অনুভব করে যে পরিস্থিতি চিকিৎসকের সাহায্য নেয়ার উপযুক্ত। কিন্তু তখন চিকিৎসকদের আসলে তেমন কিছু করার থাকে না।”

করণীয় কী

সমীক্ষায় সরকারগুলোর জন্য কিছু বিকল্প খুঁজে দেখার সুপারিশ করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে:

–  মানসিক স্বাস্থ্যের আরও কিছু দিক হেল্থ ইন্স্যুরেন্সের  আওতাভুক্ত করা

–  চাকরিদাতাদেরকে বেনিফিট প্যাকেজের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য করা

–  অশ্বেতাঙ্গ জনগণের মধ্যে সাহায্য চাওয়ার ব্যাপারে যে সংস্কার রয়েছে তা নিরসনের জন্য সাংস্কৃতিক সংবেদনশীল সচেতনতামূলক প্রচারণা জোরদার করা।

ইসলামিক রিলিফের যোগাযোগ বিষয়ক পরিচালক রায়হানা প্যাটেল বলেন, অনেক অশে^তাঙ্গ নারী এই সমীক্ষার আগেই তার সংগঠনকে জানিয়েছিলেন যে, তারা বুঝতে পারছিলেন যে, মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে সহায়তা নেওয়া দরকার কিন্তু সেই স্বাস্থ্য পরিষেবা পাবার উপায় তাদের ছিল না।

প্যাটেল বলেন, কুসংস্কার দূর করার এবং মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষা সব সমাজের ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।

তিনি বলেন, “ঠিক এই মুহূর্তে এ বিষয়ে প্রচুর বড় বড় কাজ চলমান রয়েছে। সেসব কাজে সহায়তা দেওয়াও সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ।”