অন্টারিওতে কিছু ভাড়াটিয়া ভাড়ার অর্থ দিচ্ছে না, বাড়িও ছাড়ছে না : ছোট বাড়িওয়ালারা ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ছেন

ল্যান্ডলর্ড এ্যান্ড টেনেন্ট বোর্ডে জমা পড়েছে বিপুল অভিযোগ : হেয়ারিং ডেট পেতেই সময় লাগছে আট থেকে দশ মাস

তোজেগ রোশঙ্কর বলেন, অন্টারিও মিসিসগায় তার বাড়ির একটি ইউনিট ভাড়া নেয়ার জন্য যে মহিলা আবেদন করেছিলেন, তাকেই দৃশ্যত উপযুক্ত প্রার্থী বলে তিনি মনে করেছিলেন: চমৎকার ক্রেডিট স্কোর, চাকরির প্রমাণপত্র, সাম্প্রতিক সময়ের তিন মাসের বেতনের রশিদ এবং আগের বাড়িওয়ালার রেফারেন্স ইত্যাদি সবই তিনি দিয়েছেন এজেন্টের মাধ্যমে। রোশঙ্কর বলেন, সবচেয়ে বড় কথা, এই মহিলা একজন সিঙ্গেল মাদার বা একক মা, আর এজন্যেই তিনি তার বিষয়ে জোরালোভাবে চিন্তা করেছিলেন।

এপ্রিল মাসে বাড়িটি ভাড়ার তালিকাভুক্ত করেন রোশঙ্কর। সিবিসি নিউজকে তিনি বলেন, “তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি এমনকি ভাড়ার বাড়িতে পর্যন্ত চলে যাই Ñ আমিও সিঙ্গেল মাদার হিসাবে নিজের মেয়েকে বড় করেছি। একক মায়ের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে আমি ভালো রকমের সতর্ক আর আমি আপনাকে সাহায্য করবো।

তিনি বলেন, বাড়ির ভাড়া ২,৪৫০ ডলার নিয়মিত পরিশোধ করা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা তিনি ভাড়াটে মহিলাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন। রোশঙ্কর নিজেও সিঙ্গেল মাদার, তাকে তার মেয়ে ও বৃদ্ধা মাকে আর্থিক সহায়তা দিতে হয়।

অন্টারিওতে কিছু ভাড়াটিয়া ভাড়ার অর্থ দিচ্ছে না, বাড়িও ছাড়ছে না। ছবি : সংগৃহীত

কিন্তু রোশঙ্করের বক্তব্য অনুযায়ী, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সেরকমটা ঘটতে যাচ্ছে না। তিনি দাবি করেন, ভাড়াটে মহিলা মে মাসের ভাড়া দেরিতে দিয়েছেন এবং পরের দুই মাসের ভাড়ার চেক বাউন্স করেছে।

“এমন পরিস্থিতিতে আমি সত্যিই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি,” বলেন রোশঙ্কর। তিনি একটি কন্ডোতে বাস করেন এবং ভাড়া দেওয়া বাড়িটি ভাড়া দেওয়ার মত তার একমাত্র সম্পত্তি।

এর অল্পদিন পরেই, তিনি বলেন, সিবিসি নিউজের একটি খবর তার নজরে আসে যেখানে একজন বাড়িওয়ালা দাবি করেন যে, ভাড়াটেরা জাল নথিপত্র দিয়ে তার বাড়ি ভাড়া নিয়েছে, পরে ভাড়া পরিশোধ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ওইসব ভাড়াটের মধ্যে একটি নাম Ñ শাস্তেভেন রেইড Ñ তার নতুন ভাড়াটের নামের সঙ্গে মিলে যায়।

রোশঙ্কর বলেন, “আবেগের দিক থেকে এটি আমার কাছে ছিলো এক বিরাট আঘাত।” তিনি আরও যোগ করেন, বকেয়া ভাড়া ও ইউটিলিটির বিল বাবদ তিনি এখন ওই ভাড়াটের কাছে ১৩,০০০ ডলার পাবেন।

গত আগস্টে তিনি অন্টারিওর ল্যান্ডলর্ড অ্যান্ড টেনান্ট বোর্ডের (LTB) কাছে ভাড়াটে উচ্ছেদের আবেদন করেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত শুনানীর কোনও তারিখ পাননি। তাকে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে শুনানির তারিখ পেতেও আট থেকে ১০ মাস সময় লাগতে পারে। ল্যান্ডলর্ড অ্যান্ড টেনান্ট বিষয়ক কিছু আইনজীবী বলেন, রোশঙ্কর যে পরিস্থিতিতে

পড়েছেন সেটি খুব ব্যতিক্রমী নয়। আর উচ্ছেদের শুনানির ওপর দুই বছরের  অস্থায়ী স্থগিতাদেশ শেষেও যে বিলম্ব চলছে তার নিষ্পত্তির জন্য আরও অনেক কিছু করা দরকার। শুনানির ওপর স্থগিতাদেশ ২০২০ সালের মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত স্থায়ী ছিল যা চালু করা হয়েছিল কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে।

ভাড়ার আবেদনে জালিয়াতির অভিযোগ

সিবিসি নিউজ রোশঙ্করের কাছে পেশ করা ভাড়ার আবেদনের সঙ্গে দেওয়া নথিপত্র এবং আগের বাড়িওয়ালার কাছ থেকে পাওয়া নথিপত্র মিলিয়ে দেখেছে। আবেদনপত্রের নথিতে কিছু ভিন্নতা দেখা গেছে, যার মধ্যে অন্টারিওর দুটি ড্রাইভিং লাইসেন্সে একই নাম কিন্তু আলাদা জন্ম তারিখ দেখানো হয়েছে।

রোশঙ্করের জন্য আরও হতাশার বিষয় এই যে, কথিত জালিয়াতির বিষয়ে অভিযোগ করার জন্য পিল অঞ্চলের পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকে জানানো হয় যে, এই নথি পর্যালোচনার জন্য তাদের এক বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে। তিনি বলেন, মে মাস থেকে ভাড়া না পাওয়া এবং – সেইসাথে ইউটিলিটির কিছুটা মিলে Ñ ইতিমধ্যে তার আর্থিক ক্ষতি ব্যাপক।

রোশঙ্কর, ডানে, কথা বলছেন সিবিসি রিপোর্টার ফারাহ মেরালির সঙ্গে। এসময় রোশঙ্কর তার মিসিসগার বাড়ি ভাড়া নেওয়ার আবেদনের সঙ্গে ভাড়াটে যেসব নথিপত্র জমা দেন সেগুলি দেখান। ছবি : সিবিসি

রোশঙ্কর বলেন, “সুতরাং প্রতি মাসে… আমার ২,৫০০ ডলার ঋণ হয়ে যাচ্ছে,” আর ব্যয় নির্বাহের জন্য আগে বাড়ি ভাড়ার ওপর নির্ভর করলেও এখন দুই ইউনিটের বাড়ির বন্ধকীর অর্থ পরিশোধ করতে তিনি ক্রেডিট লাইন ব্যবহার করছেন।

টরন্টোর কেএলপি প্যারালিগ্যাল সার্ভিসেস-এর মালিক ক্যাথলিন লোভেট বলেন, এ ধরণের ঘটনা তিনি প্রায়শ দেখেন, যেখানে ভাড়া পরিশোধ না করা ভাড়াটেরা ক্ষুদে বাড়িওয়ালাদেরকে আর্থিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে ঠেলে দেন।

তিনি বলেন, “মাত্র একদিন আগেই আমার একজন ক্লায়েন্ট ফোন করেছিলেন, যিনি অত্যন্ত মরিয়া হয়ে উঠেছেন কারণ নিজের দুটি বন্ধকীর পেমেন্ট তিনি আর পরিশোধ করতে পারছেন না বলে দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন করার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছেন। এখন শুধু খেয়ে পরে বাঁচার জন্য তিনি তার রেজিস্টার্ড রিটায়ারমেন্ট প্ল্যানের সব অর্থ ক্যাশ করিয়ে নিয়েছেন।”

লোভেট বলেন, মহামারির আগে তিনি এলটিবির শুনানির তারিখ পেতেন ছয় থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে আর এখন লাগে সাত থেকে আট মাস।

তিনি বলেন, এই বিলম্বের একটি প্রতিক্রিয়া হলো, কিছু বাড়িওয়ালা তাদের বাড়ি বিক্রি করে দিতে অথবা ভাড়া দেয়ার ব্যবসায় থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চাচ্ছেন।

“গত কয়েক বছরে আমি অনেক, অনেক ক্লায়েন্টকে সব বন্ধ করে দিতে দেখেছি, এবং সেটাই চূড়ান্ত। আর আমাদের গোটা সমাজের ওপর এর একটা নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যই পড়ছে, কারণ, আমাদের বাড়ি ভাড়ার বাজার ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়ে আসছে।”

পরিবর্তনের জন্য সক্রিয় ল্যান্ডলর্ডদের সংগঠন

বিদ্যমান অবস্থার পরিবর্তনের জন্য কিছু সংগঠন প্রাদেশিক সরকারের সঙ্গে কাজ করছে।

অন্টারিওর রেন্টাল-হাউজিং প্রোভাইডার্স ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট টনি ইরউইন বলেন, “সম্প্রতি আমরা সদস্যদের বক্তব্য শুনেছি… যারা তাদের সমস্যা নিয়ে বোর্ডের কাছে প্রতিকার পেতে কত দীর্ঘ সময় লাগছে সে বিষয়ে নিয়মিতভাবেই তাদের হাতাশার কথা আমাদের কাছে বলে আসছিলেন… আমরা তা অব্যাহতভাবে সরকারের কাছে তুলে ধরছি। টনির সংগঠন মানসম্মত ভাড়ার বাড়ির পক্ষে কথা বলে।

ইরউইন বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন যে, কনজারভেটিভ দলের প্রাদেশিক সরকার এলটিবিতে আরও বেশি সংখ্যক বিচারক নিয়োগ এবং আরও তহবিল বরাদ্দের মাধ্যমে কিছুটা অগ্রগতির সূচনা করেছে, তবে এ নিয়ে এখনও অনেক কিছু করার রয়েছে।

ইরউইন বলেন, “আমাদের অবশ্যই একটি অধিকতর যৌক্তিক সময়সীমার মধ্যে শুনানি শেষ করতে সক্ষম হওয়ার দরকার আছে।” তিনি আরও বলেন, এটা কেবল বাড়িওয়ালাদের জন্য নয়, ভাড়াটেদের জন্যও দরকারি।

গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের মুখে বোর্ড

অন্টারিওর ট্রাইব্যুনাল এক বিবৃততে বলেন, এলটিবি ‘গুরুতর চ্যালেঞ্জের’ মোকাবেলা করেছে- সেইসঙ্গে উচ্ছেদের শুনানীর ওপর ২০২০ সালে দেয়া পাঁচ মাসের স্থগিতাদেশÑ  এই দপ্তরের মামলাজটকে প্রভাবিত করে।

ট্রাইব্যুনাল বলেছে, তখন থেকেই বোর্ড আরও কিছু কর্মী নিয়োগসহ তার পরিষেবার মানোন্নয়নের জন্য ‘বড় ধরণের অগ্রগতি’ অর্জন করেছে।

প্রাদেশিক সরকার এপ্রিল মাসে ঘোষণা দেয় যে, বোর্ডের জমে থাকা কাজ কমিয়ে আনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ত্বরান্বিত করতে আগামী তিন বছরে এক কোটি ৯০ লাখ ডলার ব্যয় করা হবে।

বোর্ড জানায়, ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তার অধীনে ৩৬ জন পূর্ণকালীন এবং ৪৭জন খণ্ডকালীন বিচারক রয়েছেন।

বিবৃতিতে বলা হয়, “এলটিবি স্বীকার করে যে, বর্তমানে মামলা প্রক্রিয়াকরণে যে সময় লাগছে তা আমাদের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি দীর্ঘ। এই বিলম্বের কারণে আমাদের সেবা নিতে আসা ব্যক্তিদের ওপর যে প্রভাব পড়ে সেটাও আমরা অনুধাবন করি। আমাদের পরিষেবার মান উন্নয়ন এবং গ্রাহকদেরকে সময়মত কার্যকর সেবাদান নিশ্চিত করতে আমরা আমাদের কার্যক্রম আধুনিকায়নে সক্রিয়ভাবে কাজ করছি।”

সিবিসি নিউজ রোশঙ্করের ভাড়াটে শাস্তিভেন রেইডের সঙ্গে কথা বলেছে, কিন্তু তিনি তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর বিষয়ে সরাসরি কোনও জবাব দেননি, তবে বলেন, মিডিয়ার কারণে তিনি হয়রানির শিকার হয়েছেন।

রোশঙ্কর জানান, বাড়ির মর্টগেজের কিস্তি পরিশোধের জন্য তিনি যে ক্রেডিট লাইন ব্যবহার করছেন সেটিও ফুরিয়ে যাবে। এরপর কিভাবে দায় শোধ করবেন তিনি জানেন না।

তিনি বলেন, আমার পরিবার চালানোর মত আমিই একমাত্র ব্যক্তি। আমার একটি মেয়ে আছে যে আমার ওপর নির্ভরশীল। আমার মা আছেন, তিনিও আমার ওপরই নির্ভর করেন।

“আমি আর কত ঋণগ্রস্ত হবো?”

সূত্র : ফারাহ মেরালি – সিবিসি নিউজ