টরেটক্কা টরন্টো

চীন-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক -৮

কাজী সাব্বির আহমেদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

থিয়েনআনমেন স্কয়্যারে যখন আন্দোলনরত ছাত্রদের তৈরি গণতন্ত্রের প্রতীক ‘গডেস অব ডেমোক্রাসি’ নামক স্ট্যাচুটির পর্দা উন্মোচিত হচ্ছিল, তখন ঠিক সেই সময়ে অর্থাৎ ৩০শে মে সকাল বেলায় পর্দার আড়ালে কম্যুনিস্ট পার্টির ভেতর চলছিল ক্ষমতা বদলের দাবা খেলা। সেই খেলারই একটি চাল অনুসারে তখন সাংহাই-এর পার্টি সেক্রেটারী চিয়াং জমিন-কে জরুরী তলব করা হয়। সেই মুহুর্তে তিনি পার্টির এক গুরুত্বপূর্ণ মিটিং পরিচালনা করছিলেন। কিন্তু তলব পাওয়া মাত্রই তিনি মিটিং-এর কাজ মুলতবি রেখে বিশেষ বিমানযোগে বেইজিং-এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান। তিনি যখন বিকালে বেইজিং-এ এসে পৌঁছান তখনও পর্যন্ত তাকে কেন ডেকে পাঠানো হয়েছে সেই সম্পর্কে তার কোন ধারণা ছিল না। পরদিন অর্থাৎ পহেলা জুন সকালবেলায় তিনি যখন দেং শিয়াওপিং সহ অন্যান্য ‘গ্রুপ অব এল্ডার্স’-দের সাথে মিলিত হন, তখন তিনি জানতে পারেন যে, তাকে কম্যুনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারী হিসেবে মনোনিত করা হয়েছে, যে পদ থেকে ট্রাও জিয়াং-কে সদ্যই সরিয়ে দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য যে, এই পদটি হচ্ছে কম্যুনিস্ট পার্টির সর্বোচ্চ পদ। চিয়াং জমিন-এর জন্য এই পদোন্নতি ছিল যেমন আকস্মিক তেমনি অপ্রত্যাশিত। কিন্তু নেপথ্যে যারা তাকে এই মনোয়ন দিয়েছেন তাদের কাছে কম্যুনিস্ট সরকার তথা চীনা জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে তিনিই ছিলেন এই পদের জন্য সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি। সাংহাই থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক হেরাল্ড’ পত্রিকা যখন থিয়েনআনমেন স্কয়্যারের আন্দোলনের পক্ষে একটি সম্পাদকীয় ছাপে তখন চিয়াং জমিন কঠিন হাতে সেই পত্রিকাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তার এই সাহসী পদক্ষেপের কারণেই তিনি কেন্দ্রীয় পার্টি লিডারদের সুনজরে চলে আসেন। এছাড়াও তিনি ১৯৮৬ সালে ছাত্ররা যখন দলে দলে অধিকতর গণতন্ত্রের দাবীতে সোচ্চার হচ্ছিল তখন তিনি ছাত্রদেরকে ক্যাম্পাসে ফিরে যাওয়ার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। সেই উদ্দেশ্যেই তিনি তখন সাংহাই-এর এক ছাত্র সমাবেশে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ইংরেজীতে ‘গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস’-টি পড়ে শোনান। উল্লেখ্য যে, চাইনিজ নেতাদের মাঝে তখন তিনিই ছিলেন একমাত্র নেতা যিনি কিনা অনর্গল ইংরেজীতে কথা বলতে পারতেন। ইংরেজী ছাড়া তিনি ছিলেন রাশিয়ান ভাষাতেও পারদর্শী। কারণ পঞ্চাশের দশকে কম্যুনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে তাকে যখন মস্কোর ‘স্ট্যালিন অটোমোবাইল ওয়ার্কস’-এ ট্রেইনিং-এ পাঠানো হয়েছিল, তখন তিনি রাশিয়ান ভাষাও রপ্ত করেন। সাংহাই ‘চিয়াও থোং’ ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ গ্রাজুয়েট চিয়াং জমিন ছিলেন দেং শিয়াওপিং-এর যোগ্য উত্তরসূরী যিনি কিনা থিয়েনআনমেন আন্দোলন পরবর্তী চীনের নাজুক অর্থনৈতিক কাঠামোকে ঢেলে সাজানোর ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি তার স্বভাবসূলভ বহির্মুখী আচরণের কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এবং ‘লৌহ যবনিকা’-এর অন্তরাল থেকে তিনি চীনকে ধীরে ধীরে বহির্বিশ্বের কাছে উন্মোচন করেন যা কিনা পরবর্তীতে চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। পার্টির জেনারেল সেক্রেটারীর পদ থেকে তিনি ১৯৯৩ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট পদে নিযুক্ত হন। দীর্ঘ দশ বছর এই পদে অধিষ্ঠিত থাকার পর ২০০৩ সালে তিনি প্রথমে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে দাঁড়ান এবং ২০০৫ সালে পার্টির অন্যান্য পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন।

কম্যুনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারী হিসেবে চিয়াং জমিন-এর উত্থান (ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

থিয়েনআনমেন স্কয়্যারের চলমান আন্দোলনকে কিভাবে সমূলে বিনাশ করা যায় তা নিয়ে ‘গ্রুপ অব এল্ডার্স’-দের লাগাতার মিটিং চলতে থাকে। পার্টির নতুন জেনারেল সেক্রেটারী হিসেবে চিয়াং জমিন এই সব মিটিং-এ অংশ নেয়া শুরু করেন। বিভিন্ন গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে চলমান পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করে সরকারের কী করণীয় তা নির্ধারণ করাই ছিল এই মিটিংগুলির মূল উদ্দেশ্য। পহেলা জুন প্রিমিয়ার লি পেং-এর নির্দেশে ‘স্টেট সিকিউরিটি মিনিস্ট্রি’ কর্তৃক তৈরিকৃত একটি গোয়েন্দা রিপোর্ট পেশ করা হয় এই মিটিং-এ যেখানে এই আন্দোলনের ইন্ধনদাতা হিসেবে বেশ কিছু বিদেশী সংবাদ মাধ্যম বিশেষ করে ‘ভয়েস অব আমেরিকা’-কে শনাক্ত করা হয় তাদের লাগাতার মিথ্যা প্রচারণামূলক অনুষ্ঠান প্রচারের জন্য। এছাড়াও আন্দোলনের খরচ বহন করার জন্য আমেরিকা, ইংল্যান্ড, হংকং এবং তাইওয়ান থেকে কয়েক মিলিয়ন ডলার ইতিমধ্যেই যে অবৈধ পথে আন্দোলনকারীদের হাতে চলে এসেছে তা এই রিপোর্টে বলা হয়। আন্দোলনকে সচল রাখার জন্য প্রতিদিনের খরচ ছিল প্রায় এক লাখ ইউয়ান। অর্থ সাহায্য যে শুধু বিদেশ থেকে এসেছে তা কিন্তু নয়, চীনের ভেতরের কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং থিংক ট্যাংক ইনস্টিটিউশনও এই আন্দোলনে অর্থ ঢেলেছে। বেইজিং-এর বিখ্যাত কম্পিউটার কোম্পানী ‘স্টোন’ নগদ অর্থ এবং লজিস্টিক দিয়ে যে আন্দোলনকারীদের সাহায্য করছে সেটাও উঠে আসে এই গোয়েন্দা রিপোর্টে। স্টোন কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজার ছাত্রনেতাদের সাথে একটি ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে মিটিং করে তাদেরকে সরকারের প্রতি ছয়টি শর্ত আরোপ করার জন্য উপদেশ দেয়। সেই শর্তগুলি হচ্ছে – ১) আর্মিকে ব্যারাকে ফেরত যেতে হবে, ২) মার্শাল ল’ তুলে নিতে হবে, ৩) প্রিমিয়ার লি পেং-কে ডিসমিস করতে হবে, ৪-৫) দেং শিয়াওপিং এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াং শানখুন-কে অবসরে যেতে হবে, ৬) ট্রাও জিয়াং-কে জেনারেল সেক্রেটারী পদে ফিরিয়ে আনতে হবে। স্টোন কোম্পানী ছাড়াও ট্রাও জিয়াং-এর অনুগত ‘ইনস্টিটিউশন ফর ইকোনমিক রিফর্ম ইন চায়না’-এর ডাইরেক্টর মার্শাল ল’ জারী হওয়ার পর গোপনে ছাত্রদের কাছে অর্থ সাহায্য পৌঁছে দিয়েছে, সেই খবরও উঠে এসেছে এই রিপোর্টে।

আন্দোলনকারীরা যখন চীনের ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত থিয়েনআনমেন স্কয়্যারে ‘গডেস অব ডেমোক্রাসি’-এর পর্দা উন্মোচন করার মাধ্যমে কম্যুনিস্ট সরকারকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে বসে তখন সরকারের পক্ষে আর চুপ করে থাকার উপায় থাকে না। সরকার এতদিন মার্শাল ল’ ভঙ্গের কারণে কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় নি বটে তবে এবার তাকে নড়েচড়ে বসতে হয়। প্রথম প্রতিক্রিয়া হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে থিয়েনআনমেন স্কয়্যারের উত্তরপ্রান্তে অবস্থিত বেইজিং হোটেলের ছাদ থেকে “বুর্জোয়া স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোল” লেখা সম্বলিত একটি বিশাল ব্যানার টাঙ্গানো হয়। এছাড়াও দক্ষিণপ্রান্তে অবস্থিত ‘কেন্টাকি ফ্রাইড চিকেন’-এর ট্রেড মার্ক কর্নেল স্যান্ডার্সের প্লাস্টিক মূর্তির উপর আরেকটি ব্যানার টানিয়ে দেয়া হয় যেখানে লেখা ছিল “একতা এবং স্থিতিশীলতা রক্ষা কর”। টিভিতে দেখানো হয় যে, চীনের বিভিন্ন মফস্বল শহরের স্টেডিয়ামে হাজার হাজার স্কুল ছাত্রছাত্রী এবং কৃষকেরা কম্যুনিস্ট পার্টির পক্ষে ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে র‌্যালি করছে। এই সময় তাসিং নামক এক শহরে ১৯৮৬ সালের ছাত্র অসন্তোষের ইন্ধনদাতা ফাং লিট্রি-এর কুশ পুত্তলিকা পোড়ানো হয়। ফাং লিট্রি যদিও কখনই থিয়েনআনমেন স্কয়্যারে শারীরিকভাবে উপস্থিত ছিলেন না, কিন্তু এই আন্দোলনের সময় তিনি বিভিন্ন ফরেন মিডিয়ার কাছে সরকারের সমালোচনা করে ইন্টারভিইয়্যু দিয়ে যাচ্ছিলেন। থিয়েনআনমেন ছাত্র আন্দোলনের সাথে ফাং লিট্রি-এর সরাসরি কোন সম্পর্ক না থাকলেও এই কুশ পুত্তলিকা পোড়ানোর ঘটনায় সহজেই অনুমান করা যায় যে সরকার তাকে এই আন্দোলনের সাথে পরোক্ষভাবে দায়ী করেছে এবং তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বদ্ধ পরিকর। সময়ের পরিক্রমায় আমরা এক সময় থিয়েনআনমেন নাটকের অবসানের পর সরকারের সাথে ফাং লিট্রি-এর নতুন এক নাটকের সূচনা হতে দেখতে পাব। যথা সময়ে সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করা হবে।

‘পিপলস রিপাবলিক অব চায়না’-এর জন্মলগ্নের সময় সরাসরি যুদ্ধের মাধ্যমে চীনের কম্যুনিস্ট পার্টিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই আমেরিকার প্রতিটি নির্বাচিত সরকারের একটি কমন এজেন্ডা হচ্ছে কীভাবে কম্যুনিস্ট পার্টিকে অস্থিতিশীল করা যায়। প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার-এর ‘পিসফুল ডিপ্লোম্যাসি’, প্রেসিডেন্ট রিগ্যান-এর ‘ডেমোক্রাটিক মুভমেন্ট’ কিংবা প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশ-এর ‘হিউম্যান রাইটস ডিপ্লোম্যাসি’ – যেভাবেই এদেরকে প্রচার করা হোক না কেন, প্রত্যেকটি পররাষ্ট্র নীতির আড়ালে আসলে রয়েছে একটি অভিন্ন উদ্দেশ্য। সেটা হলো কৃত্রিমভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বা কাউন্টার-রেভ্যুলেশন-এর পটভূমি তৈরি করে চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির পতন ঘটানো। চাইনিজ গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে আমেরিকার নিউইয়র্কের বাসিন্দা বিখ্যাত ফাইনেন্সার এবং ফিলানট্রফিস্ট জর্জ সরোস-এর অর্থায়নে গঠিত ‘ফান্ড ফর দি রিফর্ম এন্ড ওপেনিং অব চায়না’-এর নাম উঠে আসে তার সন্দেহজনক কার্যকলাপের জন্য। এই ফান্ডটি ‘চায়না ফান্ড’ নামেও পরিচিত ছিল। ১৯৮৬ সালে ট্রাও জিয়াং-এর অনুগত চেন ইজি-এর মাধ্যমে জর্জ সরোস এই ‘চায়না ফান্ড’-এর গোড়াপত্তন করেন বার্ষিক এক মিলিয়ন ডলারের অনুদানের নিশ্চয়তা সহ। এই ফান্ডের টাকা মূলত ব্যবহার করা হবে ট্রাও জিয়াং-এর অনুগত ‘ইনস্টিটিউশন ফর ইকোনমিক রিফর্ম ইন চায়না’-এর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের বিদেশ বিশেষ করে আমেরিকার সফরের খরচ জোগাতে। তাছাড়া পশ্চিমা ভাবাদর্শে রচিত সোশ্যাল এবং পলিটিক্যাল সায়েন্সের বই কিংবা পশ্চিমা সংস্কৃতিকে প্রমোট করার খাতে এই ফান্ডের টাকা ব্যয় করা যাবে। ১৯৮৯ সালের মে মাস পর্যন্ত মোট আড়াই মিলিয়ন ডলার ‘চায়না ফান্ড’-এ এসে জমা হয়েছে। লিয়াং হেং নামক যে ব্যক্তি নিউ ইয়র্ক থেকে জর্জ সরোস-কে চায়না ফান্ডের ব্যাপারে সহায়তা করছেন তিনি হচ্ছেন একজন আমেরিকার স্পাই। এছাড়া জর্জ সরোস-এর এই প্রতিষ্ঠানের সাথে সিআইএ-এর সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। ১৯৮৮ সালে লিয়াং হেং যখন বেইজিং সফরে আসেন তখন তাকে কম্যুনিস্ট পার্টি থেকে তাকে ডেকে পাঠানো হয় ‘চায়না ফান্ড’-এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের ব্যাপারে। কিন্তু তিনি কম্যুনিস্ট পার্টির ডাকে সাড়া না দিয়ে সফর সংক্ষিপ্ত করে আমেরিকাতে ফিরে যান। জর্জ সরোস যখন বুঝতে পারেন যে ‘চায়না ফান্ড’-এর মাধ্যমে তার আসল উদ্দেশ্য সাধন করা সম্ভব হবে না তখনই অর্থাৎ ২৩ শে মে ১৯৮৯ সালে এক চিঠির মাধ্যমে তিনি ‘চায়না ফান্ড’-এর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। যেহেতু ‘চায়না ফান্ড’-এর সাথে ট্রাও জিয়াং-এর সম্পর্ক ছিল তাই পরবর্তীতে তাকে এবং তার ডেপুটি চেন ইজি-কে দেশদ্রোহীতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে মামলা করা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে হাঙ্গেরিয়ান বংশোদ্ভূত জর্জ সরোসের সাথে কানাডার বর্তমান অর্থমন্ত্রী এবং ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার ইউক্রেনিয়ান বংশোদ্ভূত ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড-এর ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক নিয়ে খবর কয়েক বছর আগে বেশ ফলাও করে কানাডিয়ান সংবাদমাধ্যমগুলিতে ছাপা হয়েছিল। এক সময়ের কানাডিয়ান প্রাইম মিনিস্টারের পদপ্রার্থী লিবারেল দলের নেতা মাইকেল ইগনেটিয়াফের সাথেও জর্জ সরোস-এর রয়েছে গভীর সম্পর্ক। তিনি বর্তমানে হাঙ্গেরীর বুদাপেস্টে জর্জ সরোস-এর প্রতিষ্ঠিত ‘সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি’-এর রেক্টর পদে অধিষ্ঠিত। ইগনেটিয়াফের জন্য অবশ্য হাঙ্গেরী কোন অচেনা দেশ নয়, কারণ তার স্ত্রী সুসানা হচ্ছেন হাঙ্গেরিয়ান বংশোদ্ভূত।

থিয়েনআনমেন স্কয়্যারের এই ছাত্র আন্দোলন আমেরিকার কাছে ছিল অনেকটা না চাইতেই হাতে চলে আসা সুযোগের মতন একটি সুযোগ। সেই সুযোগকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর জন্য আমেরিকা তার বিভিন্ন সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাকে সক্রিয় করে তুলে। সেই কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই চীনের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে অবস্থানরত আমেরিকান প্রফেসর এবং ছাত্ররা আন্দোলনরত ছাত্রনেতাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে নিয়মিত মেলামেশার মাধ্যমে একদিকে তাদের কাছ থেকে গোয়েন্দা তথ্য যোগাড় এবং অপরদিকে তাদেরকে কীভাবে আন্দোলনকে আরো বেশী জোরদার করা যায় সেই বিষয়ে পরামর্শ দেয়া শুরু করে। এ ব্যাপারে আমার অবশ্য বেশ কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা রয়েছে। আন্দোলনের শুরুতে আমি পিকিং ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে দেখেছি বেশ কিছু পশ্চিমা মানুষজনের আনাগোনা এবং চাইনিজ ছাত্রদের সাথে তাদের আলাপচারিতা। গোয়েন্দা রিপোর্টে এটাও উল্লেখ করা হয় যে, বেইজিং ফরেন ল্যঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউটে ইংরেজী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত বেশ কিছু আমেরিকান তারা পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি চাইনিজ ছাত্রছাত্রীদেরকে আমেরিকান সমাজ ব্যবস্থা এবং মূল্যবোধের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। থিয়েনআনমেন ঘটনার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯০ সালে আমার সাথে এই রকম একজন ইংরেজী শিক্ষক মিসেস কে (কধু)-এর সাথে পরিচয় হয়। সত্তরোর্ধ বয়সের মিসেস কে এসেছেন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া থেকে বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব পোষ্টস এন্ড টেলিকম্যুনিকেশনস-এ পোষ্ট গ্রাজুয়েট চাইনিজ ছাত্রছাত্রীদেরকে ইংরেজী শিখাতে। আমি তখন সেই ইউনিভার্সিটিতে ফরেন স্টুডেন্ট হিসেবে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং-এ আন্ডারগ্রেড করছি। উনার সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠে আমাদের ফরেন স্টুডেন্ট বিল্ডিং-এর কমনরুমে টেবিল টেনিস খেলতে গিয়ে। ক্যান্সার সারভাইভার মিসেস কে জীবনের অনেকটা সময় ধরে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেরিয়েছেন তার প্রয়াত স্বামীর কর্মোপলক্ষ্যে। পশ্চিমা দেশের বয়স্কদের অমোঘ পরিণতি হচ্ছে জীবিতাবস্থায় কবরবাসের মতন নিঃসঙ্গতা, সেই নিঃসঙ্গতাকে কাটানোর জন্য তিনি এসেছেন বিশ্বের জনবহুল দেশ চীনে ইংরেজী পড়ানোর উপলক্ষ্যে। তিনি তার ছাত্রছাত্রীদেরকে হলিউডের সমসাময়িক সামাজিক সিনেমাগুলি দেখাতেন এবং সেইগুলি নিয়ে আলোচনা করতেন। তার কাছেই আমি সেই সময়ের আলোচিত ‘প্রেটি উইম্যান’ সিনেমাটি প্রথম দেখি। তিনি কেন সিনেমাটি এত জনপ্রিয় হল সেটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমাকে বলেছিলেন যে আমেরিকার সমাজ থেকে বিশ্বাস জিনিষটা উঠে গেছে কিন্তু মানুষের মনে সেই বিশ্বাসের জন্য রয়েছে একটা তীব্র হাহাকার। এই সিনেমার শেষে যেহেতু সেই বিশ্বাসের জয় দেখানো হয়েছে, তাই সর্বস্তরের মানুষের জন্য এই সিনেমাটি ছিল অনেকটা একটি মূল্যবান জিনিষ হারিয়ে তা আবার খুঁজে পাবার মতন আনন্দদায়ক। নিঃসঙ্গতা থেকে বাঁচার জন্য চীনে আসা এই বৃদ্ধা মহিলাকে আমরা ক্যান্টিনে আমাদের টেবিলের মেম্বার করে নেই। অত্যন্ত ধর্ম পরায়ণ এই মহিলাকে আমি কখনই ‘গ্রেস’ না করে খাওয়া শুরু করতে দেখিনি। হয়ত আমেরিকান অনেক ইংরেজী শিক্ষক কিংবা পাদ্রী ছদ্মবেশী গোয়েন্দা, তবে আমি খুবই অবাক হব যদি মিসেস কে তাদেরই একজন হয়ে থাকেন। সেই সময়ে বেইজিং ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত কানাডিয়ান ফরেন স্টুডেন্ট মার্ক রোসওয়েল স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান হিসেবে ছিলেন ভীষণ জনপ্রিয়। তার চাইনিজ নাম ‘তা শান’ যার অর্থ হচ্ছে বিগ মাউন্টেন। নিখুঁত বেইজিং-এর একসেন্টে তিনি যখন ম্যান্ডারিনে কথা বলেন তখন মনেই হবে না যে একজন বিদেশী কথা বলছে। চীনের এন্টারটেইনমেন্ট জগতে প্রায় ত্রিশ বছরের অবদানের জন্য তিনি চীনা সরকারের পক্ষ থেকে পেয়েছেন নানাবিধ পুরস্কার এবং সম্মাননা যা একজন বিদেশীর পক্ষে অর্জন করা প্রায় অসম্ভব। তিনি চীন এবং কানাডার কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার ক্ষেত্রেও অনেক অবদান রেখেছেন। কিন্তু সেই সম্পর্কে চিড় ধরতে একটুও সময় লাগে না যখন দুই দেশের মধ্যে কোন উত্তেজনা তৈরি হয়। আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার অনুরোধে কানাডা সরকার ভ্যাঙ্কুভারের এয়ারপোর্ট থেকে হুয়াওয়েই কোম্পানীর মেং ওয়েনট্রৌ-কে অ্যারেস্ট করে তখন স্বাভাবিকভাবেই কানাডা এবং চীনের ভিতর তৈরি হয় কূটনৈতিক জটিলতা। সেই জটিলতা আরও জটিল হয়ে উঠে যখন চীনা সরকার কানাডার দুই এক্স ডিপ্লোমেটকে এসপিওনাজের অভিযোগে গ্রেফতার করে। যথা সময়ে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয় যে, থিয়েনআনমেন স্কয়্যার আন্দোলন প্রশমিত করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরণের পদক্ষেপ নেয়া হয় কিন্তু কোনটিতেই কোন ফল হয়নি। রিপোর্টে এও বলা হয় যে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থাগুলি সুযোগ পেলেই সাধারণ জনগণের হাতে অস্ত্র তুলে দিবে যাতে জনগণ কম্যুনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করতে পারে। ফলে সরকারের পক্ষে সামরিক অ্যাকশন ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই। (চলবে)

কাজী সাব্বির আহমেদ

কলাম লেখক । টরন্টো

তথ্যসূত্রঃ ‘দ্য থিয়েনআনমেন পেপারস’, ট্রাং লিয়াং, অ্যাবাকাস