শুধু আকাশ জানে
জসিম মল্লিক
‘আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে’
প্রতিটা সম্পর্কই সার্কাসের তারের উপর দিয়ে হাঁটার মতো ঝুঁকিপূর্ণ। কোনো একটা সম্পর্কই ঝুঁকিমুক্ত না। কোনো একটা সম্পর্কই স্থায়ী না। স্থায়ী যদিওবা হয় তাও কোথাও না কোথাও একটু চির থাকে, দাগ লেগে যায়। ক্ষতমুক্ত একটা সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া কঠিন। যদিওবা পাওয়া যায় সেটা বিরল ঘটনা। বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থায়ী না, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক স্থায়ী না, আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থায়ী না, ভাইবোনের সম্পর্ক স্থায়ী না, এমনকি সন্তানের সাথে বাবা মায়ের সম্পর্কও স্থায়ী না। কোনো না কোনো তুচ্ছ কারণে সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়। ভুল বোঝাবুঝি হয়। চল্লিশ, পঞ্চাশ বছরের বন্ধুত্ব ভেঙ্গে যায়, স্বার্থের সংঘাত আর ব্যাক্তিত্বের দ্বন্দ্বে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়। বনিবনার সমস্যা, পরস্পরের প্রতি অসম্মান আর বিশ্বাসের অভাবে দাম্পত্য ভেঙ্গে যায়। অনেক স্বপ্ন নিয়ে যে ভালবাসা তৈরী হয়েছিল তা নিমিষেই উবে যায়। দু’জনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে গানের মতোই দাম্পত্য। জীবন সঙ্গী নির্বাচনে ভুল হলে সারাজীবন তার মূল্য দিতে হয়। অনেকেই আবার ভুল সঙ্গী নিয়েই জীবন পার করে দেয়। নিয়তি বলে মেনে নেয়। অনেকের ভেঙ্গে ফেলার সাহস নাই বলে মেনে নেয়। সেখানে থাকে না কোনো প্রেম, আশ্লেষ, শেয়ারিং। থাকে শুধু জীবন যাপন। দুটি পাখি একটি ছোট্ট নীরে কেউতো কারো পানে চায় না ফিরে.. টাইপ। এই ধরণের জীবন আরো দুর্বিসহ।
আমি কোনো একটা সম্পর্কও নষ্ট করতে চাই না। আমার কয়েকজন কাছের বন্ধু- যাদের সাথে অনেক সুখ দুঃখ শেয়ার করেছি, এক বিছানায় ঘুমিয়েছি, এক প্লেটে খেয়েছি, একটা সিগারেট শেয়ার করেছি তাদের কেউ কেউ দূরে সরে গেছে। তাদের অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে বলে আমাকে আর বন্ধু মনে করে না। মানুষ সাধারণতঃ তার লেভেলের লোকদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়। ধনীরা ধনীদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সম্বন্ধ করবে এটাই স্বাভাবিক। গরীবের কন্যার সাথে ধনীর ছেলের বিবাহের সম্পর্ক ঘটেনা। আমাদের সময় ছেলে বা মেয়ে শুধু মানুষটিকে দেখেই প্রেমে হাবুডুবু খেতো। আমার নিজের ক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছে। আমার প্রতি জেসমিনের আকৃষ্ট হওয়ার বিশেষ কোনো কারণ ছিল না। সে তখন সুবেশি, সুদর্শন, একমাত্র কন্যা বাবা মায়ের, আর আমি জীবন যুদ্ধে লিপ্ত এক তরুন, এক বেলা খাই তো অন্য বেলা উপোস দেই। মফস্বল থেকে এসেছি। পোষাক আশাক ভাল না, থাকার জায়গা নাই। এ ধরণের সম্পর্ক ষাটের দশকের বাংলা সিনেমায় ঘটত। জেসমিন একটু ওল্ড ফ্যাশন তাই হয়ত এমনটা ঘটেছে। আজকালকার ছেলে মেয়েরা এই ভুল করে না। তারা ভালমতো যাচাই বাছাই করে, সময় নিয়ে সঙ্গী নির্বাচন করে। ক্যারিয়ারকে প্রাধান্য দেয়। সময়ের সাথে অনেক কিছু বদলে যায়।
পৃথিবীতে সবসময় ক্লাস একটা বড় ব্যাপার। এটা সব সমাজে আছে, ছিল, থাকবে। এই শহরেই দেখেছি যাদের গাড়ি বাড়ি আছে তারা নিজেদের আলাদা ক্লাস মনে করে, বাড়িওয়ালাদের সাথেই তারা বন্ধুত্ব করে, দরকার হলে ডেকে বন্ধুত্ব পাতায়। কোথাও একত্রিত হলে তারা বসেও একসাথে, তাদের গল্পের বেশিরভাগ জুড়ে থাকে গাড়ি বাড়ির প্রসঙ্গ। ঢাকায় গেলেও এমনটা দেখতে পাই। গাড়ি বাড়ি না থাকলে নিজের আত্মীয়র কাছেও দাম নাই। শিক্ষা, রুচি, কালচার, এটিকেট এগুলো টাকার কাছে, বিত্ত্বের কাছে তুচ্ছ হয়ে গেছে। এগুলোর কোনো ভ্যালু নাই আজকাল। টাকাই সব। মানি টক। সম্পর্ক ওঠা নামা করে টাকার উপর ভিত্তি করে, সমাজে ব্যাক্তির প্রভাবের উপর। আমার সবধরণের বন্ধু আছে। গরীব আছে, মধ্যবিত্ব আছে, উচ্চবিত্ব আছে, মিলিওনিয়ার আছে, বিলিওনিয়ার আছে। সাদা আছে, কালো আছে, ব্রাউন আছে। নারী আছে, পুরুষ আছে, বৃদ্ধ আছে, তরুন আছে, দেশে আছে, বিদেশে আছে, বরিশালে আছে, ঢাকায় আছে, টরন্টো আছে, নিউইয়র্ক আছে, সিডনি আছে, টোকিও আছে, স্টকহোমে আছে, লসএঞ্জেলেসে আছে, আটলান্টা আছে, হিউস্টন আছে, অটোয়া আছে, রোমে আছে, প্যারিসে আছে, লন্ডন আছে। কোথায় নাই! সর্বত্র আছে।
কিন্তু এই যে আমার বিভিন্ন ধরণের এতো বন্ধু এটা আমি কিভাবে ম্যানেজ করি? কিভাবে সম্পর্ক রক্ষা করি? অনেক সহজ একটা কাজ আমার জন্য। কারণ আমি কারো কাছে কিছু ফেভার চাই না। হাত পাতি না। গরীবের কাছেও চাই না, ধনীর কাছেও না, মিলিওনিয়ারের কাছে চাই না, বিলিওনিয়ারের কাছেও না। কারো কাছে মাথা নত করি না। হাত কচলানোর স্বভাব আমার নাই। আমার যা আছে তাই নিয়ে আমি সন্তষ্ট। কারো প্রতি বিরাগও প্রদর্শন করি না। কাউকে অপছন্দ হলে তাকে এভোয়েড করি। এটাই বড় সমাধান। কেউ আমাকে ছেড়ে গেলে আমার মন খারাপ হয় বটে কিন্তু হাত পা ধরে সম্পর্ক রক্ষা করতে যাই না। এমনকি সে তার ভুল বুঝতে পারলেও সম্পর্ক আর আগের জায়গায় ফিরবে না। পুরুষ বা নারী আমার কাছে আলাদা মাত্রা নিয়ে আসে না। বন্ধুত্বকে বন্ধুত্ব হিসাবেই দেখতে পছন্দ করি আমি। সবার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করি। আমি শুধু চাই বন্ধুত্ব বা আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট থাকুক, স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন সুদৃঢ় হোক, সন্তানের সাথে, ভাই বোনের সাথে যে চিরকালীন বন্ধন সেটা কিছুতেই নষ্ট না হোক। কিন্তু আমার চাওয়ার মতো কিছুই ঘটবে না পৃথিবীতে। পৃথিবী তার আপন নিয়মে চলবে। ভাঙ্গা গড়ার এই পৃথিবী। সেখানে দুঃখ থাকবে, সুখ থাকবে, বিচ্ছেদ থাকে, হারানো থাকবে, না পাওয়া থাকবে। আবার ভালবাসাও থাকবে, বন্ধন থাকবে, মায়া মমতা থাকবে, নির্ভরতা থাকবে। ভাঙ্গনকে আমি ভয় পাই।
টরন্টো ২৬ আগষ্ট ২০২২
এক বিকেলে একলা মানুষ
বিকেলটা একটু অন্যরকম ছিল। বাইরে সুন্দর মনোরম পরিবেশ। ফুরফুরে হিমেল বাতাস বইছিল। শরীর মন জুড়িয়ে যাচ্ছিল। তারমধ্যেও কোথায় যেনো একটা বিষাদ ভর করেছিল! একটা দুঃখী অনুভূতি ঘিরে ধরেছিল। গাড়ি পার্ক করে রাস্তার পাশে একটা বেঞ্চিতে বাসে থাকলাম কিছুক্ষণ। উড়ুখুড়ো মন। স্বভাবগতভাবে আমি একটু অসামাজিক মানুষ। আমি মানুষের সাথে মন খুলে মিশতে পারি না। সহজ হতে পারি না। আড়ষ্ট হয়ে থাকি কারো সমনে গেলে। সবচেয়ে বিব্রতকর হচ্ছে আমি বেশিক্ষণ কথা চালাচালি করতে পারি না। আমার কথার ভান্ডার অনেক কম। একটা দুইটা কুশল বিমিনয়ের পরই কথা ফুরিয়ে যায়। আমি কি কথা বলব! আমার তো বেশি কথা থাকেনা!
এই কথাহীনতা আর গুটিয়ে থাকা স্বভাবের জন্য আমি অনেক একলা হয়ে গেছি। এমনকি ঘরেও জেসমিনের সাথে আমার বেশি কথা হয় না। ছেলে মেয়েদের সাথেও তাই। ওরাও পেয়েছে আমার স্বভাব। আমরা চুপচাপ বসে থাকি। পরষ্পরের ভাষা বুঝে নেই। না বলা কথা অনুভবে বুঝে নেই। ওরা জানে বাবাটা এমনই। জেসমিন জানে আমি কেমন ভুতুরে। আজকে বিকেলে খুব মন খরাপের। আমার কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছিল খুউব। একজন অতি পরিচিতজনকে দেখলাম আমার দিকেই আসছে। ভাবলাম কথা বলি। কিন্তু কেনো যে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখলাম! সে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।
তারপর বেশ কয়েকজনকে ফোন দিলাম। একজন বলল, সে ঘুরতে বের হয়েছে। একজন বলল, আগে বললে আসতে পারত। একজন বলল সাড়ে সাতটায় আসবে। তখন মাত্র সাড়ে ছটা বাজে। এই একঘন্টাই আমার কাছে দীর্ঘ মনে হচ্ছিল। আর একজন ম্যাসেজের রিপ্লাই দিল না। আর তখনই আকাশ কালো করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। ঠিক সেই মুহূর্তে নিজেকে আবিষ্কার করলাম আমি আসলে খুবই একলা মানুষ।
টরন্টো, ৩০ আগষ্ট ২০২২
সম্পর্কের রুপান্তর
এখনকার ছেলে মেয়েরা হুটহাট রিলেশনে জড়ায়না। বিয়ে করতেও সময় নেয়। কখনও কখনও পাঁচ সাত বছর লাগিয়ে দেয় পরস্পরকে জানতে। ক্যারিয়ার, মানুষটা কেমন এটা বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠে। বিয়ের পর সন্তান নিতেও অনেক চিন্তা ভাবনা করে। উপযুক্ত সময় খোঁজে। অনেকে আবার পছন্দমতো সঙ্গী না পেয়ে বিয়ের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ভীতিও আছে। পাশ্চাত্য কালচারে অবশ্য লিভ টুগেদার করার বিধান আছে। একসাথে তিরিশ বছর থাকার পর বিয়ের পিঁড়িতে বসে। বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া তো আমাদের সমাজে এখন ডালভাত। না পোষালে নাই। গুড বাই বলতে দ্বিধা করে না।
কিন্তু আমাদের সময় এমনটা ছিল না। আমার সাথে জেসমিনের কোনো দিক থেকেই কোনো মিল ছিল না। আমাদের পরিচয় হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। আমি এসেছি মফস্বল থেকে, হলে থাকি, আর্থিক দুর্গতি নিদারুণ, দেখতে ইম্প্রেসিভ না। জেসমিন আমার উল্টো। তাও আমাদের সম্পর্ক বা বিয়ে হতে আটাকয়নি। সন্তানও নিয়েছি দ্রুত। বন্ধুরা মজা করে বলেছিল কিউএসএস সার্ভিস। আমার প্রথম সন্তান জন্মের দুই বছর দুই মাস পর দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হয়েছিল। আমার বস বলেছিলেন টু আর্লি জসিম!
তখনও আমি স্ট্রাগল করছি। কোনো প্লান ছাড়াই সব ঘটেছে। আমি কখনও প্লান করে কিছু করিনি। পূর্বাপর পরিণতি ভাবিনি। বেশি ভাবলে জেসমিনের সাথে বিয়েই হতো না। শুরু থেকেই জেসমিন আমার মতো এলেবেলে মানুষকে মেনে নিয়েছিল। সম্পর্কের ৩৫ বছর পার হয়েছে। আমাদেরও ঝগড়া হয়, কথা বন্ধ থাকে কিন্তু আমরা পরস্পরের উপর এতোটাই নির্ভরশীল যে ঝগড়া হলে দুজনেরই লস। এই যে আমি ৪০টির বেশি বই লিখেছি সেটা সম্ভব হয়েছে জেসমিন ছিল বলে। যদিও জেসমিন আমার কোনো বই পড়েনি। আমি কি বিষয় নিয়ে লিখি তাও জানে না। পরিচয়ের আগে আমার নামও শোনেনি কখনো। কোথায় বাড়ি, অবস্থা কি এসবও জানত না।
আমাদের সময়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এমন হয়েছে। মানুষটাই মুখ্য ছিল। অন্ধকারে ঝাঁপ দেওয়ার মতো অবস্থা। রুপে মুগ্ধ বা প্রেমে অন্ধ টাইপ। কিন্তু এই প্রজন্ম অনেক বেশি ক্যালকুলেটিভ। টু দ্যা পয়েন্ট। ঘরেও যার যার কাজ ভাগ করা, আলাদা ব্যাংক একাউন্ট। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে এমন না। আমাদের জয়েন্ট একাউন্ট। কিচেন, লন্ড্রি আর বাজারের দ্বায়িত্ব তাঁর। আমাদের সবকিছুই একটু ওল্ড ফ্যাশন। আমরা নিজেদের নিয়েই বুঁদ হয়ে থাকি না, অন্যদের কথাও ভাবি। তবে শেষ কথা হচ্ছে সব সম্পর্কই টিকে থাকে ভালবাসার উপর, আস্থার উপর, নির্ভরতার উপর সেটা হোক আগের বা এখনকার। আমার সন্তানদের দেখে সেটা আমি টের পাই। ভালবাসা সবসময় অমলিন।
টরন্টো ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২
নিজের কাছে নিজের ছায়া!
সংসারের বাইরেও একটা জীবন আছে। সেই জীবনের সন্ধান করার দরকার আছে। নিজেকে চেনার দরকার আছে। নিজের মতো বাঁচার দরকার আছে। মানুষ সংসারি হতে চায়, স্ত্রী সন্তান নিয়ে জড়িয়ে থাকতে চায়। মায়ায়, স্নেহে, আশ্লেষে বাঁচতে চায়। কিন্তু সংসারই সব না। সংসারের বাইরে গিয়ে একবার হলেও বাঁচা দরকার। মানুষতো মূলতঃ একাই। একলা বাঁচার অভ্যাস করার দরকার আছে। যত বেশি মায়ায় জাড়ানো ততবেশি কষ্ট। মায়া জিনিসটা খুব পোড়ায়। সন্তানের জন্য মায়া, বন্ধুর জন্য মায়া, স্ত্রীর জন্য মায়া। আবার মায়া কখনও কখনও ঘৃণায়ও পরিণত হয়। তৈরি হয় গৃহদাহ। এই বৈপরিত্য নিয়েই আমরা বেঁচে থাকি। জীবন খুবই রহস্যময়। মানুষের চরিত্র আরো বেশি রহস্যেভরা। কে কখন কেমন আচরন করবে বোঝা যায় না। মানুষ নিজেকেই নিজে চেনে না। আমিও নিজেকে চিনিনা। নিজের কাছে নিজে অচেনা হয়ে যাই। একসময় ভাবতাম মা ছাড়া আমি কিভাবে বেঁচে থাকব! মা থাকবেন না এটা ভাবতেই পারতাম না। মাকে বলতামও সেই কথা। এই নিয়ে আমাদের মা ছেলে ঝগড়াও হতো। কিন্তু আজ মা নাই কিন্তু দিব্যি বেঁচে আছি। কষ্ট না ভুলতে পারলে মানুষ বাঁচতে পারত না।
একসময় ছেলে মেয়েরা ছিল আমার শক্তির জায়গা। ঘরে ফিরলেই তাদের সাথে দেখা হতো। দুজনকে পাশে নিয়ে গল্প করতাম, খেলা দেখতাম, খেতাম, সকালে চা বানাতাম। এখন কেউ নাই। কালে ভদ্রে সবাই একসাথে হই এখন। তাও কত তাড়া, কত ব্যস্ততা। নিরবচ্ছিন্ন সময় দেওয়ার সময় নাই। পরশু অর্ক আমাদের ডিনারে ইনভাইট করেছিল। অর্ক থাকে বোমেনভিল, আমি থাকি ইষ্টইয়র্ক। ইনভাইট করেছে পিকারিং নামক একটা জায়গায়। হাফওয়ে দূরত্ব। একটা ইন্ডিয়ান পাকিস্তানি রেষ্টুরেন্টে। রেষ্টুরেন্টর নাম ফুড টাইম। অর্ক সবসময় টাইমের ব্যাপারে সিরিয়াস। বাসায় আসবে তাও টাইম ফিক্স করা। যেনো অফিস করতে আসছে। আগেই বলবে সাতটায় আসব ন’টার মধ্যে চলে যাব। একচুলও নড়চর নাই। আমাদের টাইম দিয়েছে সাড়ে সাতটায়। আমি জিপিএসে টাইম দেখলাম ৩২ মিনিট লাগবে। সেভাবেই রওয়ানা হলাম। যখন রেষ্টুরেন্টের সামনে গাড়ি পার্ক করলাম তখন সাতটা উনত্রিশ মিনিট। আমি গাড়ি থেকে নামছি দেখি অর্কও খাতিজাকে নিয়ে নেমে আসছে। অর্ক হেসে বলল, জাষ্ট টাইম বাবা। ফুড টাইমের খাবার ভাল ছিল।
অরিত্রি এই উইকেন্ড আমাদের কাছে ছিল। আমি সারাক্ষন পিছন পিছন লেগে থাকি, কবে আসবা, কবে আসবা, এসে থাকো। তাই আমাকে খুশী করার জন্য উইকেন্ডে এসে থাকে। কিন্তু অরিত্রি যে টাইপের মেয়ে, চাপা স্বভাব, আমি নিশ্চিত একদিন এসে বলবে, বাবা আমি চলে যাচ্ছি! আমি সেই দিনের অপেক্ষায় আছি। নিজেকে প্রস্তুত করছি। অর্ক যেদিন বাড়ি কিনে বোমেনভিল চলে যাচ্ছে বলল, যদিও মাত্র এক ঘন্টার ড্রাইভ, তাও আমি বললাম, এতো দূরে চলে যাবা! চাইলেই তোমাকে পাব না। অর্ক চুপ করে ছিল সেদিন। একটাও উত্তর দেয়নি। অরিত্রির হাজবেন্ড সাদ চলে গেছে আটলান্টা জর্জিয়া। দুজনেই এখন আসা যাওয়ার মধ্যে। অরিত্রি টরন্টো ডাউন টাউনে থাকে। দুজনে দুই শহরে। আমি বলি, আমার বাসাতো খালি, তোমার রুম একই রকম আছে। এখানে এসে থাক। বাসা ছেড়ে দাও। কিন্তু তা করে না। কারণ হোম অফিস করতে হয়, সেভাবে সেট আপ করা। আমি চাপ দেই না। আমি আমার সন্তানদের তাদের মতো করেই সিদ্ধান্ত নিতে দিয়েছি সবসময়।
অরিত্রি ম্যাকডোনালস কানাডার কর্পোরেট অফিসে ম্যানেজার কমিউনিকেশন। বড় পজিশন, বড় দ্বায়িত্ব। আমেরিকায় টিএন ভিসায় স্পাউস জব করতে পারে না। অরিত্রি তার পছন্দমতো জব খুঁজছে। কালকেই বলল, বাবা, বাফেলো যাব ইন্টারভিউ দিতে। আমি বললাম কিসের ইন্টারভিউ। বলল, নেক্সাস পাসের জন্য। নেক্সাস হচ্ছে কানাডা আমেরিকা ফ্রিকুয়েন্ট যাতায়াতের জন্য ফ্লাইটে হোক বা বাই রোডে এক্সপ্রেস এন্ট্রি। এটার মানে কি! মানে হচ্ছে যে কোনো সময় উড়াল দেবে। আমি বেশি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাই না। অরিত্রির চলে যাওয়া আমার জন্য কষ্টের। জেসমিনকে কালকে বললাম, অরিত্রি চলে গেলে তো যখন তখন দেখতে পারব না। জেসমিন বলল, আমি বাস্তবতা মেনে নিয়েছি। আমিও মা বাবা কে ছেড়ে এসেছি, তুমিও এসেছো। আমরা সবাই এসেছি। সুতরাং কষ্ট পেয়ে লাভ নেই। আর আটলান্টা এমন কিছু দূরেও না। তাই মাঝে মাঝে মনে হয় সংসারের বাইরে গিয়ে বাঁচা দরকার আছে। নিজেকে চেনা দরকার। পৃথিবীতে কে কার! সবাই একলা। মায়া, মমতা, প্রেম সবই যেনো মরীচিকা। মরীচিকার পিছনে ছুটে চলেছি আমরা।
টরন্টো ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২
অভিবাসী কূটনীতি ও আমার কথা
আমার অনেক বিদেশী বন্ধু আছে। আমেরিকান আছে, কানাডিয়ান আছে, অষ্ট্রেলিয়ান আছে, জাপানীজ, আছে, ব্রিটিশ আছে, ভারতীয় আছে, শ্রীলঙ্কান আছে, আফগান আছে, নেপালিজ আছে, ভিয়েতনামিজ আছে, ফরাসি আছে, চাইনিজ আছে, স্প্যানিশ আছে। আমি অনেক দেশ বিদেশ ঘুরি। যখনই তাদের সাথে আমার কথা হয় কখনও তো দেশের বিরুদ্ধে কিছু বলতে শুনিনা। তারা নিজের দেশ নিয়ে গর্বিত। আমার সন্তানেরা কখনও বাংলাদেশ নিয়ে নেগেটিভ ধারনা পোষন করে কিছু বলে না। আমি তাদের সাথে দেশের গল্প করি, মুক্তিযুদ্ধে গল্প করি, বঙ্গবন্ধুর গল্প করি। আমার ছেলে মেয়ে প্রচন্ড পড়ুয়া, তাদের বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বা বঙ্গবন্ধুর উপর লেখা বই পড়তে বলি। দেশকে জানতে বলি। তাদের সাথে আমার শৈশবের গল্প করি, আমার স্ট্রাগলের গল্প করি। সবুজ শ্যামল বাংলাদেশের গল্প করি। আমার মায়ের গল্প করি।
দেশ বিরোধী যে কোনো প্রচারনা বিদেশের কাছে আমাদের ছোট করা। এতে নতুন প্রজন্মের কাছে ভুল বার্তা যায়। নতুন প্রজন্ম এখন সারা বিশ্বে মেনইস্ট্রম জব করছে, বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। তাদের জন্য এসব প্রচারনা ক্ষতির কারণ হবে বলে আমি মনে করি। আমি কখনও আমার কোনো পরিচিত, বন্ধু বা আত্মীয়দের সম্পর্কেও নেগেটিভ কিছু বলি না। তাতে আমি ছোট হয়ে যাই। আমি নিজের দেশ সম্পর্কে উচ্চ ধারনা পোষন করি, দেশ নিয়ে আমি গর্ব অনুভব করি। পৃথিবীতে ভাল মন্দ দুই থাকবে। কেউই ভুলের উর্ধ্বে না। ব্যাক্তির যেমন ভুল আছে তেমনি রাষ্ট্রেরও ভুল থাকে। আবার সংশোধনেরও সুযোগ থাকে। আমি খুবই আশাবাদী মানুষ। স্বপ্নবাজ মানুষ।
ফুল যখন ফোটে তখন তার সৌরভ ছড়াবেই। আকাশে চাঁদ উঠলে তার স্নিগ্ধ আলো আমাদের মোহিত করবেই। সুতরাং আমার ব্ক্তব্য পরিষ্কার। আমরা যারা অভিবাসী, যারা লেখালেখি করি, সংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত তাদের উচিত দেশের ভাল জিনিসগুলো মেইনস্ট্রিম ফেরামে তুলে ধরা। নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা। এজন্য ফরমায়েশি লেখার বা লেখক প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এটা একজন নাগরিকের দ্বায়িত্ব। নিজের দেশকে বড় করা মানে নিজে বড় হওয়া। আমি নিজে যেমন একজন কানাডিয়ান তেমনি একজন বাংলাদেশিও।
টরন্টো ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২
রান্না সমাচার
কিচেন জিনিসটা এক সময় খুউব অপছন্দের ছিল। অনেকেই কিচেন পছন্দ করেন। এর মধ্যে লেখক, সাংবাদিকরাও আছেন। রান্না করতে ভালবাসেন। অনেক কিছু করতে পারেন তারা। আমি তখন বিচিত্রায় কাজ করি। ১৯৮৪/৮৫ সালের কথা। একবার শাহরিয়ার কবিরের মহাখালীর বাসায় গিয়েছি। সেদিন তিনি আমাদের চমৎকার আলুর দম রান্না করে খাইয়েছিলেন। শাহরিয়ার কবিরের মতো একজন জনপ্রিয় লেখক রান্না পারেন! আমি তো অবাক! তখনই আমার মনে হয়েছিল আমিও রান্না শিখব। কিন্তু নানা কারণে আর হয়ে উঠেনি। কানাডা আসার পর কিচেনের গুরুত্ব বুঝেছি। অন্য সব কিছু না পারলেও চা বানানো, ভাত রান্না, ডিম ভাজা, ডাল রান্না এসব শিখে ফেলি। নিতান্তই জীবন বাঁচানোর জন্য কাজে লাগে এসব। আমার বন্ধু আলম ভাইও অনেক কিছু রান্না পারেন। তিনি মোটামুটি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন রান্নাটাকে। আমি তার দ্বারা দারুণভাবে অনুপ্রানিত। প্রায়ই বলেন, শিখে ফেলেন। ডিপেনডেন্সি কামান।
কিন্তু আমার আর কিছুতেই শেখা হয়ে উঠছিল না। আজকাল মাঝে মাঝে কিচেনে জেসমিনের আশ পাশ দিয়ে ঘুর ঘুর করি। জেসমিন নিজেও এদেশে এসেই রান্নার ট্রেনিং পেয়েছে। প্রবাসের বেশিরভাগ মেয়েই তাই। আদরের কন্যারা এখন সবকিছু দু’হাতে সামলায়। জেসমিন আমাকে একলা রেখে যখন দেশে যায় তখন হয় আত্মীয়রা না হয় বন্ধুরা খাবার সাপ্লাই দিত। সে সব মজা করে খেতাম আমি। কিন্তু এখন আমি নিজে কিছু কিছু করার চেষ্টা করছি। জেসমিন দেখলাম আমার উপর মহা খুশী। আগে কিচেনে ঢুকতেই দিতনা। সম্ভবত সেও এখন টায়ার্ড। সব কাজেই এক সময় ক্লান্তি আসে। আর মেয়েরা বাইরে কাজ করবে, সন্তান লালন পালন করবে, গ্রোসারি করবে, আবার রান্নার দ্বায়িত্ব তার! এটা কেমন কথা! এটা কিছুতেই হতে দেওয়া উচিত না। সব কাজ সমানভাবে ভাগ করে নেওয়া উচিত। পুরুষরা তো সন্তান ধারণ করতে পারেনা! যদি পারত তাহলে নারীর কষ্ট বুঝত।
টরন্টো ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২
লেখকঃ জসিম মল্লিক, লেখক ও সাংবাদিক, টরন্টো, কানাডা।