টরেটক্কা টরন্টো

চীন-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক -৭

কাজী সাব্বির আহমেদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

কম্যুনিস্ট সরকারের পক্ষ থেকে ১৯শে মে মধ্যরাতে লি পেং মার্শাল ল’-এর ঘোষণা দেন যা কিনা টিভিতে সরাসরি সস্প্রচার করা হয়। সেই ঘোষণায় বলা হয় যে মার্শাল ল’ কার্যকরী হবে পরদিন অর্থাৎ ২০শে মে থেকে। আশংকা করা হচ্ছিল যে মার্শাল ল’-এর পরিপ্রেক্ষিতে ভোর বেলা গ্রেট হল থেকে পিপলস লিবারেশন আর্মি আচমকা বের হয়ে এসে থিয়েনআনমেন-এর দখল নেয়ার চেষ্টা করবে। তাই মার্শাল ল’-এর ঘোষণাকে তোয়াক্কা না করে গ্রেট হলের সিঁড়ির প্রান্তে শত শত মানুষ পাহারায় ছিল সারা রাত। এক সময় যখন ভোর হলো তখন দেখা গেল যে আর্মির ব্যাপারটা স্রেফ গুজব ছিল। তবে এই পরিস্থিতিতে কোনটি গুজব আর কোনটি সত্যি তা আগেভাগে বলা মুশকিল। যাই হোক পরদিন ২০ শে মে সকাল নয়টায় স্টেট কাউন্সিল থেকে মার্শাল ল’ সম্পর্কিত চার দফার একটি ডিক্রী জারী করা হয়। সেই ডিক্রীতে বলা হয়, মার্শাল কার্যকরী হবে ২০শে মে সকাল দশটা থেকে। মার্শাল ল’-এর অনুশাসন অমান্য করলে পুলিশ কিংবা পিপলস লিবারেশন আর্মি যে কোন চাইনিজ কিংবা বিদেশী নাগরিককে গ্রেফতার করতে পারবে। এছাড়া সরকারি অনুমতি ব্যতীত সংবাদ সংগ্রহের ব্যাপারে বিদেশী সাংবাদিকদের উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এই ডিক্রীগুলি থিয়েনআনমেন স্কয়ারের লাউডস্পীকারগুলি থেকে অনবরত প্রচার করা হচ্ছিল। কিন্তু থিয়েনআনমেন-এ অবস্থানরত স্টুডেন্ট কিংবা জনগণকে বিন্দুমাত্র বিচলিত হতে দেখা যায়নি সেই অনবরত প্রচারণায়। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল যে হেলিকপ্টার থেকে মার্শাল ল’-এর ডিক্রীগুলি লিফটলেট আকারে পুরো শহরে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো মাটিতে পড়ার আগেই জনগণ তা লুফে নিয়ে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলতে লাগল। সামরিক আইন জারী হলো ঠিকই কিন্তু সেটা প্রয়োগের ব্যাপারে দেখা গেল সরকার পুরোপুরি উদাসীন।

চীনের সেন্ট্রাল টেলিভিশনের নিউজ রিডার সুয়ে ফেই যখন টিভিতে মার্শাল ল’-এর ঘোষণা দিচ্ছিলেন তখন তিনি ক্যামেরার দিকে একবারও তাকান নি। তার এই বডি ল্যাংগুয়েজ ছিল সরকারের এই মার্শাল ল’-এর বিরুদ্ধে এক ধরণের নীরব প্রতিবাদ, ফলে থিয়েনআনমেন স্কয়ারে কিছু স্টুডেন্টের হাতে দেখা যায় ‘লং লিভ সুয়ে ফেই’ লেখা ব্যানার। এরপর থেকে অবশ্য সুয়ে ফেই-কে আর প্রকাশ্যে দেখা যায় নি। অন্যদিকে কম্যুনিস্ট পার্টির মাউথপিস নামে পরিচিত ‘পিপলস ডেইলি’ পত্রিকাতে এমনভাবে কিছু বিদেশী খবর ছাপা হতে লাগল যা দেখে মনে হবে যে এগুলি যেন চীনের সাম্প্রতিক কালের ঘটে যাওয়ার ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত। যেমন একটা খবর ছাপা হয়েছিল, হাঙ্গেরিয়ান নেতা ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন যে জনগণের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী মোতায়েন করাটা ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। তবে চীনা সরকার তড়িঘড়ি করে সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের উপর তার কর্তৃত্ব ফিরিয়ে আনে এবং চাইনিজ ফরেন মিনিস্ট্রি আমেরিকার নিউজ এজেন্সি সিএনএন-কে জানায় যে, গর্বাচেভের সফর শেষ হওয়ার সাথে সাথে চীনে তাদের কাজও শেষ। এরপর চীনে সিএনএন-এর প্রচার বন্ধ করে দেয় সরকার। 

থিয়েনআনমেন আন্দোলনের সময় তিন ব্যক্তির দ্বারা কালি নিক্ষেপের পর চেয়ারম্যান মাও-এর প্রতিকৃতি (ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

মার্শাল ল’ জারির পরপর অবশ্য থিয়েনআনমেন স্কয়ারে অবস্থানরত স্টুডেন্ট কিংবা জনগণের মধ্যে কোন হেরফের লক্ষ্য করা যায়নি। পুলিশ বাহিনীকে দেখা গেল উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে টহল দিয়ে যাচ্ছে। সরকারি কর্মচারিরা অফিসে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না। দোকানপাট সবই খোলা রয়েছে। ইউনিভার্সিটিগুলোতে কোন ক্লাস হচ্ছে না সেই এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে। ফলে ফরেন স্টুডেন্ট হিসেবে আমার হাতে তখন প্রচুর অবসর সময়। সেই অলস সময়কে পার করার জন্য প্রতিদিনই সাইকেলে করে চলে যেতাম থিয়েনআনমেন স্কয়ারে। পথে দেখতাম বেইজিং-এর সাধারণ জনগণ সবাই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। তারা পাহারায় রয়েছে যেন কোনক্রমেই আর্মিরা থিয়েনআনমেন স্কয়ারে ঢুকতে না পারে। জনগণের দৃঢ় বিশ্বাস পিপলস লিবারেশন আর্মি কিছুতেই নিরস্ত্র জনগণ কিংবা স্টুডেন্টদের উপর হামলা চালাতে পারে না। কারণ চেয়ারম্যান মাও বলেছিলেন যে, জনগণ হচ্ছে নদী, আর সেই নদীর মাছ হচ্ছে পিপলস লিবারেশন আর্মি। চল্লিশ বছর আগে যখন চেয়ারম্যান মাও এই কথাটি বলেছিলেন তখন বেইজিং-এর জনগণ পিপলস রিপাবলিক আর্মিকে সাদরে বরণ করে নেয়ার জন্য রাস্তার পাশে জমায়েত হয়েছিল। আজকে তারা আবার জমায়েত হয়েছে ঠিকই, তবে সেই একই আর্মিকে বেইজিং-এ ঢুকতে বাধা দেয়ার জন্য। তারা যখন নিরস্ত্র আর্মিকে ইমোশনালি মোটিভেট করে তাদেরকে বেইজিং-এ ঢোকা থেকে বিরত রাখতে সফল হয়েছিল, তখন ট্রাক ভর্তি নিশ্চল সৈন্যদের এবং তাদের কমান্ডারদের চেহারায় অসহায়ত্ব ভাব ফুটে উঠেছিল। কারণ পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে তারা তাদের উপর থেকে কোন নির্দেশনা পাচ্ছিল না। তাছাড়া সৈন্যদেরকে রেডিও শোনা কিংবা পিপলস ডেইলি ছাড়া অন্য যে কোন ধরণের নিউজ পেপার পড়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। সংকটপূর্ণ এই সময়ে সরকারের নীরব ভূমিকা পরিস্থিতিকে আরো বেশী ঘোলাটে করে তুললো। প্রতিটি মুহূর্ত কাটছিল ভীষণ রকম অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে। কেউ জানে না পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিবে। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার সেই যুগে একদল স্বেচ্ছাসেবক মোটর সাইকেলে করে শহরের আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে বেইজিং শহরের সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষেণ করে সবাইকে তা জানিয়ে দেয়ার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল। শহরের মানুষেরা তাদের নাম দিয়েছিল ‘উড়ন্ত বাঘ’।

চীনের সেনাবাহিনীকে কিভাবে পরিচালনা করা হবে সেই নীতি নির্ধারণের ক্ষমতা ছিল অল্প কয়েকজন বর্ষীয়ান নেতাদের হাতে যাদের সবার জন্ম ১৯১০ সালের পূর্বে এবং যারা প্রত্যেকেই চেয়ারম্যান মাও-এর লং মার্চের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। এই নেতাদেরকে ‘গ্যাং অব এল্ডার্স’ বলে অভিহিত করা হত। অনিশ্চয়তার এই সময়কালে ‘গ্যাং অব এল্ডার্স’-এর সদস্যরা মিলিত হলেন কীভাবে আর্মিকে দিয়ে থিয়েনআনমেন আন্দোলনকে পুরোপুরি ধূলিসাৎ করে দেয়া যায় সেটার নীল নকশা প্রণয়নের কাজে। অবশ্য এই কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বর্ষীয়ান নেতা দেং শিয়াওপিং। মিলিটারি অ্যাফেয়ার্স কমিশনের চেয়ারম্যান, এই পদাধিকার বলে তিনি ছিলেন মিলিটারির সুপ্রিম কমান্ডার। এই কাজে তার ডেপুটি ছিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াং শানখ্নু, যিনি কিনা তখনকার মিলিটারি অ্যাফেয়ার্স কমিশনের ভাইস-চেয়ারম্যান। প্রাথমিকভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল যে বেইজিং-এর আশেপাশের মিলিটারি ইউনিটগুলি চতুর্দিক থেকে এসে থিয়েনআনমেন-এ প্রবেশ করে সেখানে অবস্থানরত সকল জনগণ এবং স্টুডেন্টদেরকে সেখান  থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত করবে। এতে যদি কিছু রক্ত ঝরে ঝরুক। কিন্তু প্রায় দুই মিলিয়ন জনগণ বেইজিং শহরের বিভিন্ন রাস্তায় বেরিয়ে এসে যেভাবে হিউম্যান শিল্ড বা মানব ব্যূহ তৈরি করেছিল সেটা ভেদ করে মিলিটারিরা এগুতে পারেনি। তাদের এই সহজ পরাজয় রাস্তায় এবং থিয়েনআনমেন-এ অবস্থানরত জনগণ এবং স্টুডেন্টদের মনোবলকে বহু গুণে বৃদ্ধি করে দেয়। মিলিটারির অনেক উচ্চ পদস্থ সেনা কর্মকর্তা সেই সময় জনগণের বিরুদ্ধে তাদের সেনা ইউনিট মোতায়েনের বিপক্ষে ছিলেন কারণ তাদের সন্তানরা তখন থিয়েনআনমেন-এ অবস্থান করছিল। আর্মির আটত্রিশতম ইউনিটের কমান্ডার জেনারেল সু ছিনশিয়েন ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম যাকে তার এই অবাধ্যতার কারণে কারাবরণ করতে হয়। পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট ইয়াং শানখুন-এর দেয়া এক ব্রিফিং-এ জানা যায় যে বেইজিং-এর বিভিন্ন মিলিটারি ইউনিটের একুশ জন ডিভিশন কমান্ডার, ছত্রিশ জন ব্যাটেলিয়ান কমান্ডার এবং চুয়ান্ন জন কোম্পানী কমান্ডার থিয়েনআনমেন-এ সামরিক বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণের বিপক্ষে ছিলেন। বেইজিং-এর বিভিন্ন সেনা ইউনিট থেকে যখন কোন ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন দেং শিয়াওপিং উড়ে চলে যান সেন্ট্রাল চীনের উ-হান প্রদেশে। সেখানে তিনি ২ লাখ সৈন্যের একটি সামরিক ইউনিটকে সতর্ক অবস্থায় তৈরি রাখেন যদি কোন কারণে বেইজিং-এর সামরিক ইউনিটগুলি বিদ্রোহ করে বসে। বৃদ্ধ বয়সে তিনি এই কাজগুলি করতে খুব যে উপভোগ করছিলেন তা কিন্তু নয়। পার্টির ভেতর যারা তার ঘনিষ্ঠ তাদেরকে তিনি নাকি বলেছিলেন যে তার আসলে অবসরে যাওয়া উচিৎ, কিন্তু দেশের এই অবস্থায় তিনি কারো উপর ভরসা করতে পারছেন না। তাই তাকেই এই কঠিন কাজের দায়িত্ব তুলে নিতে হয়েছে। তবে তিনি তার কাজের ব্যাপারে ‘গ্যাং অব এল্ডার্স’-দের পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছিলেন।

চেয়ারম্যান মাও-এর প্রতিকৃতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ‘গডেস অব ডেমোক্রাসি’ (ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

ছয় সপ্তাহ অবরোধের পর এসেছে মার্শাল ল’-এর ডিক্রী। ততদিনে থিয়েনআনমেন স্কয়ার ভরে উঠেছে আবর্জনায় এবং বাতাসে ভারী হয়ে উঠেছে অস্থায়ীভাবে বসানো ল্যাট্রিনের গন্ধে। ছাত্ররাও ঝিমিয়ে পড়েছে নতুন কোন কর্মসূচির অভাবে। ছাত্রদেরকে আন্দোলনের ব্যাপারে উজ্জীবিত রাখাটা একটা বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় ছাত্রনেতাদের জন্য। এর মধ্যে আরও একটি রটনা রটে যে দেং শিয়াওপিং-এর ছেলে দেং পুফাং নাকি থিয়েনআনমেন-এ তার নিজস্ব লোক মারফত সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে আশু সামরিক অভিযানের। ফলে রক্তপাত এড়ানোর জন্য সে সবাইকে থিয়েনআনমেন ত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দুইজন ছাত্রনেতা উয়ার খায়শি এবং ওয়াং তান ছাত্রদের বিজয় অর্জন হয়েছে ঘোষণা পূর্বক থিয়েনআনমেন ছেড়ে ক্যাম্পাসে ফেরত যাওয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ছাত্রনেত্রী ছাই লিং ছিলেন এই সিদ্ধান্তের ঘোর বিরোধী। তার মতে চীনের রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রছন্ন নির্ণায়ক হচ্ছে থিয়েনআনমেন স্কয়ার। বলা হয়ে থাকে যে, যাদের হাতে এই স্কয়ারের কন্ট্রোল, মূলত তারাই রয়েছে রাজনৈতিক চালকের আসনে। ফলে কোনক্রমেই এই স্কয়ারের দখল ছেড়ে দেয়া যাবে না। শেষ পর্যন্ত স্টুডেন্টরা ছাই লিং-এর সিদ্ধান্তকেই মেনে নিয়ে অবরোধ চালিয়ে যায়। এই সময় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যা কিনা ঝিমিয়ে পড়া আন্দোলনে কিছুটা উত্তেজনার সঞ্চার করে এবং ঘটনা প্রবাহকে এন্ড গেমের দিকে দ্রুত ধাবিত করে। প্রথম দুটি ঘটনা ছিল ছাত্রদেরকে অনেকটা ফাঁদে ফেলে তাদের বিরুদ্ধে সেনা তৎপরতাকে অনিবার্য হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা। তবে তৃতীয় ঘটনাটি ছিল ছাত্রদের একটি হঠকারিতাপূর্ণ সিদ্ধান্ত যা সরকারকে এমনভাবে চ্যালেঞ্জ করে বসে যে সেনা তৎপরতা তখন সরকারের একমাত্র অপশন হয়ে দাঁড়ায়।

প্রথম ঘটনাটি ঘটেছিল ২৩শে মে। থিয়েনআনমেন স্কয়ারের উত্তর দিকে অবস্থিত ফরবিডেন সিটির গেটের উপর থেকে ঝুলানো চেয়ারম্যান মাও সেতুং-এর বিশাল আকৃতির ছবিতে কারা যেন কালি ছুড়ে মারে। যেহেতু চেয়ারম্যান মাও-এর এই পোট্রেইট কম্যুনিস্ট চায়নার একটি রাজনৈতিক লেগাসির প্রতীক, তাই স্বাভাবিকভাবেই জনগণ কিংবা স্টুডেন্টদের কাছে এই কাজটি মোটেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাছাড়া দেশের সার্বিক জনমতকে থিয়েনআনমেন-এ অবস্থানরত স্টুডেন্ট এবং জনগণের আন্দোলনের বিপক্ষে নেয়ার জন্য এটা সরকারের একটা কারসাজীও হতে পারে। তাই স্টুডেন্ট মার্শালরা যে তিনজন এই কালি ছুঁড়ে মেরেছে তাদেরকে ধরে নিয়ে তাদের কমান্ড সেন্টারে নিয়ে যায় ইন্টারোগেশনের জন্য। পাশাপাশি তারা একটি খাকি তারপুলিন দিয়ে চেয়ারম্যান মাও-এর কালিমাখা পোট্রেইটটি ঢেকে ফেলে। কর্তৃপক্ষ অবশ্য পরদিনই কালিমাখা ছবিটি সরিয়ে নতুন একটি পোট্রেইট ঝুলিয়ে দেয়। ইন্টারোগেশনে জানা যায় যে কালি ছুড়ে মারাদের তিনজনই এসেছে মাও সেতুং-এর হোমটাউন হুনান প্রভিন্স থেকে। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে কারখানার শ্রমিক, দ্বিতীয় জন হচ্ছে মফস্বল থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকার সম্পাদক এবং শেষ জন হচ্ছে একজন গ্রাম্য স্কুল শিক্ষক। তাদেরকে চাইনিজ সেন্ট্রাল টেলিভিশনের সাংবাদিকের উপস্থিতিতে পুলিশের হাতে সোপার্দ করা হয়। পরবর্তীকালে বিচারে তাদের তিনজনের অবশ্য তিন মেয়াদের কারাদন্ড হয়। শ্রমিকের হয় ষোল বছরের, পত্রিকা সম্পাদকের বিশ বছরের এবং স্কুল শিক্ষকের হয় আজীবন কারাদন্ড। চেয়ারম্যান মাও-এর ছবিতে কালি ছোড়ার ঘণ্টা খানেক পরই পরিস্কার নীল আকাশ কালো ঘন মেঘে ঢেকে যায়। তার পরপরই শুরু হয় প্রবল বৃষ্টিপাত। বেইজিং-এ এই রকম মুষলধারার বৃষ্টি সচারচর দেখা যায় না। ফলে চাইনিজদের বিশ্বাস অনুসারে অনেকেই এটাকে ‘থিয়েনমিং’ বা ‘ম্যান্ডেট অব হেভেন’-এর সংকেত বলে ধরে নেয়। চেয়ারম্যান মাও-এর ছবির এই অপমান স্বর্গের দেবতাদেরকে রাগান্বিত করে তুলেছে, তাই এই প্রবল বর্ষণ হচ্ছে সেই ক্রোধেরই বহিঃপ্রকাশ।

দ্বিতীয় ঘটনাটা ছিল থিয়েনআনমেন স্কয়ারের ঠিক মাঝখানে এক সৈন্যের একটি ট্রাক রেখে পালিয়ে যাওয়া। সেই পরিত্যক্ত ট্রাক পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে সকলেরই চক্ষু চড়কগাছ। কারণ সেই ট্রাকটি রাইফেল, অ্যামুনিশেন এবং হ্যান্ড গ্রেনেড দিয়ে ভরা। বিপদ আঁচ করতে পেরেই স্টুডেন্টরা সেই ট্রাক ভর্তি গোলাবারুদ ও অস্ত্র পুলিশের কাছে জমা দিয়ে দেয়। কিন্তু সিক্রেট পুলিশ গোপনে সেই দৃশ্য ভিডিও করে এবং পরবর্তীতে সরকার সেটা এমনভাবে এডিট করে প্রচার করে যেন স্টুডেন্টরা সশস্ত্র অবস্থায় থিয়েনআনমেন-এ অবস্থান নিয়েছিল। এবং সেই কারণে সরকার বাধ্য হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালনা করতে। এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে কানাডার গ্লে­াব সংবাদপত্রের চাইনিজ বংশোদ্ভূত সাংবাদিক জেন ওং তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘রেড চায়না ব্লুজ’-তে উল্লেখ করেছেন যে তিনি তার সোর্সের মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন যে কিছু অস্ত্র স্টুডেন্টরা গোপনে সরিয়ে রেখেছে। তিনি অনুসন্ধান করে সেই নির্দিষ্ট তাঁবুতে চলে গেলেন যেখানে কথিত সেই অস্ত্রগুলি লুকিয়ে রাখা হয়েছে। পাহারারত স্টুডেন্ট মার্শাল তার কাছে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করলেও তাকে সেই অস্ত্রগুলি দেখাতে অস্বীকৃতি জানায়। শুধুমাত্র মুখের কথার উপর ভিত্তি করে সেদিন জেন ওং এই ঘটনাটি তার পত্রিকাতে রিপোর্ট করেননি। তবে পরবর্তীতে তিনি এই খবরটি রিপোর্ট না করার জন্য আক্ষেপ করেছেন। তিনি হয়ত সরকারের প্রচারিত ভিডিও দেখে কনভিন্সড হয়েছিলেন যে স্টুডেন্টদের কাছে আসলেই অস্ত্র ছিল যার খবর তিনি গোপন সূত্রে পেয়েছিলেন।

তৃতীয় ঘটনাটি ছিল ৩০শে মে অনুষ্ঠিত ফাইনাল র‌্যালিকে কেন্দ্র করে। আন্দোলনরত স্টুডেন্টদের ভোটে নির্বাচিত ‘থিয়েনআনমেন স্কয়ার ইউনিফায়েড অ্যাকশন হেড কোয়ার্টারস’-এর কমান্ডার-ইন-চীফ ছাত্রনেত্রী ছাই লিং চাচ্ছিলেন যে এই র‌্যালিতে এমন একটি ভিজুয়াল সিম্বল দাঁড় করাতে যা কিনা এই আন্দোলনের একটি বিমূর্ত প্রতীক হয়ে থাকবে। তার এই ইচ্ছাপূরণে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসে থিয়েনআনমেন-এর ঠিক পাশেই ওয়াং ফুচিং এ্যভেনিউতে অবস্থিত ‘ট্রোং ইয়াং মেই শু সুয়ে ইউয়ান’ বা সেন্ট্রাল একাডেমী অব ফাইন আর্টস-এর ছাত্রছাত্রীরা। তারা আমেরিকার ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’-এর অনুকরণে দিনরাত পরিশ্রম করে তৈরি করে সাঁইত্রিশ ফিট উঁচু এক স্ট্যাচু যার নামকরণ করা হয় ‘জিইয়ো ন্যুশেন’, যার অর্থ হচ্ছে ‘গডেস অব ডেমোক্রাসি’ বা ‘গণতন্ত্রের দেবী’। আমার ব্যাচের দুইজন বাংলাদেশী ফরেন স্টুডেন্ট এই সেন্ট্রাল একাডেমী অব ফাইন আর্টস-এর ছাত্র হওয়ায় আমি সেই আন্দোলনমুখর দিনগুলিতে প্রায়ই থিয়েনআনমেন স্কয়ার থেকে তাদের সাথে দেখা করতে সেখানে যেতাম। সেই সময় তারা আমাকে দেখিয়েছিল সেই ‘গডেস অব ডেমোক্রাসি’ কীভাবে কাজ এগিয়ে চলছে। র‌্যালির ঠিক আগের রাতে সেই বিশাল স্ট্যাচুকে তিনখন্ডে ভাগ করে থিয়েনআনমেন স্কয়ারে আনা হয়। পরদিন অর্থাৎ ৩০শে মে সকালে স্ট্যাচুর সেই খন্ডগুলিকে জোড়া লাগিয়ে দাঁড় করানো হয়। তবে স্ট্যাচুটিকে কাপড় দিয়ে আবৃত করে রাখা হয়। র‌্যালি শুরু হওয়ার সময় সমাবেত জনতার মাঝ থেকে একজন পুরুষ এবং একজন নারীকে নির্বাচন করে তাদের দিয়ে কাপড় সরিয়ে ‘গডেস অব ডেমোক্রাসি’-কে উন্মুক্ত করা হয়। জনতার তুমুল হর্ষধ্বনি-এর মাঝে দেখা যায় যে শ্বেত শুভ্র এক রমনী দুইহাতে এক মশাল উঁচু করে নির্ভীক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, চেয়ারম্যান মাও-এর বিশাল প্রতিকৃতির ঠিক মুখোমখি। আমার ধারণা কাকতালীয়ভাবে নয়, কৌশলগতভাবেই এমন স্থান নির্বাচন করা হয়েছিল যা কিনা সরকারকে অনেকটা সরাসরি চ্যালেঞ্জ করারই সামিল।

থিয়েনআনমেন স্কয়ার আন্দোলনের মঞ্চে ‘গডেস অব ডেমোক্রাসি’-এর এই নাটকীয় আগমন পরিস্থিতিতে অনেকখানি ঘোলাটে করে ফেলে। পশ্চিমা মিডিয়াগুলি ব্যাপকভাবে প্রচার করা শুরু করে ‘গডেস অব ডেমোক্রাসি’-এর বৃত্তান্ত। আর অন্যদিকে সরকার সরকার স্টুডেন্টদের উদ্দেশ্যে লাউড স্পীকারে ঘোষণা দেয় যে, তোমাদের এই আন্দোলন ব্যর্থ হবে, কারণ এই দেশটা চীন, আমেরিকা নয়। পিপলস ডেইলি তার সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করে যে, থিয়েনআনমেন স্কয়ার হচ্ছে একটি পবিত্র স্থান। দেশের প্রতিটি মানুষের উচিৎ এর পবিত্রতা রক্ষা করা। কারো কোন অধিকার নেই এখানে স্থায়ীভাবে কিছু স্থাপন করার। এই সম্পাদকীয়তে অনেকটা প্রচ্ছন্নভাবে বলা হল যে সরকার সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে থিয়েনআনমেন থেকে এই জঞ্জাল দূর করতে বাধ্য হবে। (চলবে)

তথ্যসূত্রঃ

১) ‘ডেসপ্যাচেস ফ্রম দ্য ব্যারিকেড – এ্যান আই উইটনেস অ্যাকাউন্ট অব দ্য রেভ্যুলেশনস দ্যাট শুক দ্য ওয়ার্ল্ড ১৯৮৯-৯০’, জন সিম্পসন, হাচিসন

২) ‘রেড চায়না ব্লুজ – মাই লং মার্চ ফ্রম মাও টু নাও’, জেন ওং, ডাবলডে এ্যাংকর বুকস

৩) ‘ম্যান্ডেট অব হেভেন’ – অরভিল শেল, সাইমন এন্ড শুস্টার

কাজী সাব্বির আহমেদ

কলামিস্ট

টরন্টো