টরেটক্কা টরন্টো

চীন-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক -৬

থিয়েনআনমেন স্কয়ারে আন্দোলনের সময় ছাত্ররা প্রথম থেকেই কম্যুনিস্ট পার্টির নেতাদের সাথে ‘ডায়ালগ’ বা ‘আলোচনা’-এর দাবী জানিয়ে আসছিল। কিন্তু কম্যুনিস্ট পার্টির নেতারা সেই দাবীকে মোটেই গ্রাহ্য করেননি। অথচ অনেক বিশ্লেষকের ধারণা ডায়ালগের মাধ্যমেই হয়ত ছাত্রদের এই আন্দোলনকে শুরুতেই মিটিয়ে ফেলা যেত। কেন তারা ‘ডায়ালগ’-এর পথে পা বাড়ায় নি তার অবশ্য একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, যেহেতু কম্যুনিস্ট সরকার ইতিপূর্বে কখনই এ ধরণের ‘ডায়ালগ’-এ বসেনি তাই তারা মনে করতেই পারে যে এ ধরণের ডায়ালগ-এ বসা মানে জনগণের কাছে পার্টির নেতৃত্বকে দূর্বল বলে প্রতীয়মান করে তোলার সামিল। এছাড়া অতীতের ‘ডেমোক্রেসি ওয়াল’ বা ‘গণতন্ত্র দেয়াল’-এর অভিজ্ঞতাও তারা হয়ত আমলে নিয়েছিল। দেং শিয়াওপিং ক্ষমতায় এসে জনগণকে তাদের স্বাধীন মতামত প্রকাশের জন্য ১৯৭৮ সালে বেইজিং শহরের ‘শি তান’ নামক সড়কের পাশে অবস্থিত একটি লম্বা দেয়ালকে নির্দিষ্ট করে দেন। প্রথমে জনগণ মূলত সেই দেয়ালে ‘গ্যাং অব ফোর’ কিংবা ‘মাও সেতুং’-এর সমালোচনা করে পোস্টার লাগাত। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই ১৯৭৯ সালে যখন দেং শিয়াওপিং-এর সমালোচনা শুরু হয় তখন দেং শিয়াওপিং সেই ‘গণতন্ত্র দেয়াল’-এর বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। ছাত্রদের সাথে আলোচনায় বসলে হয়ত সেই বিলুপ্ত ‘গণতন্ত্র দেয়াল’-এর কথা আবার আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ফিরে আসবে যা হবে কম্যুনিস্ট পার্টির জন্য অনেকটাই বিব্রতকর। ছাত্র আন্দোলনের ব্যাপারে দেং শিয়াওপিং প্রথম থেকেই কোন প্রকার আলোচনা ছাড়াই কড়া পদক্ষেপ নেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। পরবর্তীতে প্রকাশ পায় তিনি নাকি তার ঘনিষ্ঠজনদের শুরুতেই বলেছিলেন যে, এই আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য অল্পকিছু রক্তপাত করতে হলেও আমরা সেটার পিছপা হব না। অর্থাৎ প্রথম থেকেই সেনাবাহিনীর মাধ্যমে আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়ার পরিকল্পনা তার মাথায় ছিল। কিন্তু আন্দোলনের শুরুতেই তিনি সেই রক্তপাতের দিকে যেতে পারেন নি। সেটারও অবশ্য অনেকগুলো কারণ ছিল। প্রথম বা প্রধান কারণটি ছিল ছাত্র আন্দোলনের সময়কালটি ছিল কম্যুনিস্ট পার্টির বিপক্ষে। সেই সময় দীর্ঘ প্রত্যাশিত সাইনো-সোভিয়েট সামিট ছাড়াও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের এক বিশেষ প্রতিনিধিদল বেইজিং সফরে আসেন। যেহেতু চীন এই ব্যাংকের কাছ থেকে একটি বড় ধরণের ফান্ড পাবার জন্য চেষ্টা করছিল তাই এই সময় কোন ধরণের সামরিক পদক্ষেপ নেয়াটা ছিল চীনের নিজের জন্যই ক্ষতিকর। তারপর এল গর্বাচেভের সফরের পালা। চীন এবং রাশিয়ার প্রায় তিরিশ বছরের ভগ্নপ্রায় কূটনৈতিক সম্পর্ককে জোড়া লাগানোর মাহেন্দ্রক্ষণ হিসেবে এই সফরের গুরুত্ব উভয়ের কাছেই ছিল অপরিসীম। যে কোন রাষ্ট্রীয় অতিথিকে থিয়েনআনমেন স্কয়ারে এনে সম্মান দেখানোটা হচ্ছে চীনের কূটনৈতিক শিষ্টাচারের অংশ। কিন্তু ছাত্র আন্দোলনের কারণে চীন তার বিশেষ রাষ্ট্রীয় অতিথি গর্বাচেভকে এই সাধারণ কূটনৈতিক শিষ্টাচার প্রদর্শনে ব্যর্থ হতে যাচ্ছে সেটা মেনে নেয়াটা ছিল কম্যুনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দের জন্য একটি কষ্টদায়ক ব্যাপার। এই সময় অবশ্য ছাত্রদের দুইটি গ্রুপের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় থিয়েনআনমেন স্কয়ারের যে অংশটা রাষ্ট্রীয় অতিথিদের সম্মাননা দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হয় সেই অংশটা খালি করে দেয়া হবে কিনা এই নিয়ে। ছাত্রনেতা উয়ারখায়শি চাচ্ছিলেন যে থিয়েনআনমেন স্কয়ারের যেখানে ‘মনুমেন্ট ফর পিপলস হিরো’ অবস্থিত সেখান থেকে সরে যেতে। কিন্তু আরেক ছাত্রনেত্রী ছাই লিং ছিলেন সরে যাওয়ার ঘোর বিরোধী। এক পর্যায়ে এই দুই গ্রুপের সমর্থকদের ভিতর হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম হয়। যেহেতু উয়ারখাইশি জাতিতে উইঘুর, তাই একদল ছাত্র তার দেশপ্রেম কতখানি খাঁটি সেটা নিয়েও প্রশ্ন তুলে। যাই হোক ছাত্রদের এই বিরোধ চলাকালীন সময়ে থিয়েনআনমেন স্কয়ারের এক প্রান্তে অবস্থিত গ্রেট হলের ছাদ থেকে চীনা নেতৃবৃন্দকে বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে দেখা যায়। অবশেষে যখন দেখা যায় ছাত্ররা ছাত্রনেত্রী ছাই লিন-এর কথা মেনে নিয়ে মনুমেন্ট এলাকা থেকে সরে যায়নি তখন গর্বাচেভকে বিমান বন্দরেই গার্ড অব অনার দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না চীনা সরকারের। বিমান বন্দর থেকে তাকে গ্রেট হলে আনা হয় ঘুরাপথে, বিভিন্ন অলিগলির ভেতর দিয়ে আর গ্রেট হলে প্রবেশ করানো হয় পেছনের দরজা দিয়ে। রাশিয়া অবশ্য এ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেনি। কারণ তাদের লক্ষ্য ছিল চীনের সাথে ভেঙে যাওয়া কূটনৈতিক সম্পর্ককে জোড়া লাগানো। এই সফর উপলক্ষ্যে সারা বিশ্ব থেকে নামকরা সব সংবাদ সংস্থার সাংবাদিকেরা আগে থেকেই বেইজিং-এ এসে হাজির। তাদের উপস্থিতিতে থিয়েনআনমেন স্কয়ারে যে কোন ধরণের দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়ে উঠবে সারা পৃথিবীর জন্য এক উপাদেয় নিউজ আইটেম। তাই চীনা সরকারের একমাত্র উপায় ছিল শান্তিপূর্ণভাবে আলোচনার মাধ্যমে ছাত্রদেরকে থিয়েনআনমেন থেকে বিদায় করে সেখানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। কিন্তু দেং শিয়াওপিং ছাত্রদের সাথে আলোচনায় বসার ব্যাপারে ছিলেন একেবারেই আপোষহীন। তার এই অনমনীয় মনোভাব পোষণের জন্য অবশ্য বেশ অনেকগুলো কারণ ছিল। সেই কারণগুলির মধ্যে তার ব্যক্তিগত ক্ষোভ এবং অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা অন্যতম। এছাড়া রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলকে বুদ্ধির প্যাঁচে হারিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার কৌশলগত কারণেও তিনি ছাত্রদের সাথে আলোচনায় বসতে আগ্রহী ছিলেন না।

ট্রাও জিয়াং অনশনরত ছাত্রদের উদ্দেশ্যে অনশন ভংগ করার অনুরোধ জানিয়ে ভাষণ দিচ্ছেন। এরপর তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। (ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

থিয়েনআনমেন স্কয়ারের ছাত্রদের এই বিপুল সমাবেশ দেং শিয়াওপিং-কে রেভ্যুলেশনের সময়কার ‘রেড গার্ড’-দের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। তিনি নিজে রেড গার্ডদের হাতে চরমভাবে নাজেহাল হয়েছিলেন। এই রেড গার্ডদের হাতেই তার ছেলে দেং পুফাং বেইজিং ইউনিভার্সিটিতে বন্দী হয় এবং চারতলা এক বিল্ডিং থেকে পড়ে গিয়ে সারা জীবনের জন্য প্যারালাইজড হয়ে যায়। কালচারাল রেভ্যুলেশনের সময়কার নির্বাসিত জীবনে তিনি নিজ হাতে ছেলের জন্য শাক-সব্জি চাষ করতেন একটু ভালো খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য। আর প্রতিদিন তিনি তার ছেলেকে নিজ হাতে স্পঞ্জ করে পরিস্কার করতেন। সেই সময় তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে এই দুঃসময় তার জীবনে যেন আর কোনদিন ফেরত না আসে। তিনি অবশ্য তার প্রতিজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। ক্ষমতায় এসে ১৯৮৪ সালে তিনি তার পঙ্গু ছেলেকে করেছিলেন ‘চায়না ওয়েলফেয়ার ফান্ড ফর ডিসএবলড’ নামক একটি সংস্থার চেয়ারম্যান। আর আজ সেই ছেলের দূর্নীতির বিরুদ্ধে ছাত্ররা পোস্টার টানিয়েছে থিয়েনআনমেন স্কয়ারে। তাই ছাত্রদের প্রতি ক্ষোভের কারণে দেং শিয়াওপিং কখনই তাদের মুখোমুখি হয়ে আলোচনায় বসার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না।

দেং শিয়াওপিং-এর তিক্ত অভিজ্ঞতাটি হচ্ছে, ১৯৭৬ সালে এই থিয়েনআনমেন স্কয়ারে ঘটে যাওয়া এক ঘটনায় তিনি মাও সেতুং-এর কোপানলে পড়ে সদ্য ফিরে পাওয়া ভাইস প্রিমিয়ার পদ থেকে বহিষ্কৃত হন। সেই সময় থিয়েনআনমেন স্কয়ারের ‘মনুমেন্ট ফর পিপলস হিরো’-এর সামনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অগণিত জনগণ সদ্য প্রয়াত প্রিমিয়ার ট্রৌ এনলাই-এর জন্য শোক প্রকাশের অন্তরালে ‘গ্যাং অব ফোর’-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদমূখর হয়ে উঠে। ‘গ্যাং অব ফোর’-এর নেত্রী ম্যাডাম মাও (চিয়াং ছিং) জনগণের এই বিপুল সমাবেশে আতঙ্কিত হয়ে উঠেন। পলিট ব্যুরোর সদস্যরা যখন সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে জনগণকে ছত্রভঙ্গ করার কথা বিবেচনা করছিলেন তখন দেং শিয়াওপিং ছিলেন নীরব। কারণ তিনি যে মনে মনে ‘গ্যাং অব ফোর’-এর অবলুপ্তি চাচ্ছিলেন সেটা অন্য সবার কাছে দিনের আলোর মতন পরিস্কার ছিল। ঘটনার এই পরিস্থিতিতে সদ্য নিযুক্ত অ্যাক্টিং প্রিমিয়ার হুয়া কোয়াফেং পরামর্শের জন্য মাও সেতুং-এর ভাগ্নে মাও ইউয়ানশিন-কে  মাও-এর কাছে পাঠালেন। মাও তখন তিনটি নির্দেশনা দিলেন যার প্রথমটিই ছিল দেং শিয়াওপিং-কে তার পদ থেকে বহিষ্কার করা। দ্বিতীয়টি ছিল, যে সমস্ত জনগণ থিয়েনআনমেন স্কয়ারে উপস্থিত রয়েছে তাদেরকে ‘প্রতিবিপ্লবী’ আখ্যা দেওয়া। এবং তৃতীয়টি ছিল, এই ‘প্রতিবিপ্লবী’-দেরকে থিয়েনআনমেন থেকে সরানোর জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তবে মাও সেতুং তার নির্দেশনায় উল্লেখ করেছিলেন যে, কোন অবস্থাতেই ‘বন্দুক’ ব্যবহার করা যাবে না। শেষ চেষ্টা হিসেবে দেং শিয়াওপিং প্রস্তাব করেন যে তিনি নিজে গিয়ে জনগণকে ‘বাড়ী ফিরে যাওয়া’-এর জন্য অনুরোধ করবেন। কিন্তু ‘গ্যাং অব ফোর’-এর অন্যতম সদস্য ট্রাং ঠ্রুনছিয়াও সেই প্রস্তাবের বিপক্ষে মত দিয়ে বললেন, ‘ইটস টু লেইট’। এই তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে দেং শিয়াওপিং বর্তমানের থিয়েনআনমেন স্কয়ারের এই ছাত্র আন্দোলনকে যাতে অন্য কেউ পুঁজি করে তাকে তার বর্তমান পদ থেকে সরাতে না পারে সেই জন্য সতর্ক হয়ে যান। যেখানে স্বয়ং মাও সেতুং থিয়েনআনমেন স্কয়ারে ‘বন্দুক’-এর ব্যবহার নিষেধ করেছিলেন, সেখানে দেং শিয়াওপিং সশস্ত্র সামরিক বাহিনীকে দিয়ে ছাত্র আন্দোলনকে প্রতিহত করার পরিকল্পনা করছিলেন। হয়ত তিনি মাও সেতুং-এর সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে রেখেছিলেন – ‘বন্দুকের নলই হচ্ছে সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস’।

চীনের এই অভূতপূর্ব রাজনৈতিক সংকটের যাত্রামঞ্চে এই সময় পাঁচ জন কুশীলবকে দৃশ্যমান হতে দেখা যায় যারা ছিলেন পলিটব্যুরোর স্ট্যান্ডিং কমিটির মেম্বার। এরা হচ্ছেন জেনারেল সেক্রেটারি ট্রাও জিয়াং, প্রিমিয়ার লি পেং, প্রেসিডেন্ট ইয়াং শাংখুন, হু ছিলি এবং ছিয়াওশ্রি। আর প্রধান চরিত্রের ভূমিকায় রয়েছেন দেং শিয়াওপিং স্বয়ং, যার হাতে রয়েছে সামরিক বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ড। রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় দেং শিয়াওপিং-এর প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি ট্রাও জিয়াং। সত্তুর বছর বয়স্ক ট্রাও জিয়াং-কে রং করা কালো চুলে এবং পশ্চিমা পোশাকে বয়সের তুলনায় অনেক বেশী প্রাণবন্ত এবং সজীব দেখাত। বৃদ্ধ দেং শিয়াওপিং-এর চেয়ে ছাত্রসমাজ তথা জনগণের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল অনেক বেশী যা দেং শিয়াওপিং বেশ ভালো করেই জানতেন। ১৯৮৭ সালে দেং শিয়াওপিং তার কাছে পার্টির সমস্ত ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন শুধুমাত্র সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ ছাড়া। ট্রাও জিয়াং-এর তার কর্ম জীবনে কখনও পিপলস লিবারেশন আর্মির সাথে যুক্ত ছিলেন না সেই অজুহাতে। ট্রাও জিয়াং ক্ষমতায় এসে ‘ইকনোমিক রিফর্ম’-এর উদ্দেশ্যে বেশ কিছু প্রজেক্ট চালু করেছিলেন যা কিনা আশানুরূপ ফল দেয়নি। ফলে পার্টির অনেকেই সেই ‘ইকনোমিক রিফর্ম’-এর বিপক্ষে ছিলেন, কিন্তু তিনি চাচ্ছিলেন প্রজেক্টগুলো চালু থাকুক। এই নিয়ে পার্টির ভিতর তার বিরুদ্ধে এক দল নেতা বেশ সোচ্চার ছিলেন যাদের নেতৃত্বে ছিলেন লি পেং। সেই বিরুদ্ধবাদীদের দমন করার জন্য তার দরকার ছিল নিরুঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হওয়া। সেই জন্যেই তিনি চাচ্ছিলেন দেং শিয়াওপিং-এর অবসর গ্রহণ যা থিয়েনআনমেন স্কয়ারের ছাত্র আন্দোলনের একটি অন্যতম দাবী। তাই স্বভাবতই তিনি ছিলেন ছাত্রদের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং তাদের বিরুদ্ধে যে কোন প্রকার সামরিক হস্তক্ষেপের ঘোর বিরোধী।

কিন্তু যাত্রামঞ্চের অন্যতম কুশীলব প্রিমিয়ার লি পেং ছিলেন সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে, প্রকারান্তে ট্রাও জিয়াং-এর বিপক্ষে। টেকনোক্র্যাট লি পেং ট্রৌ এনলাই-এর পালকপুত্র হিসেবে তিনি পার্টির ভিতর ছিলেন বেশ প্রিভিলেজড এবং সেই সুবাদেই তিনি তরতরিয়ে প্রিমিয়ারের পদে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন। অল্পতেই রেগে যাওয়া এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতার অভাব থাকা সত্বেও তিনি দেং শিয়াওপিং-এর প্রিয়ভাজন ছিলেন কারণ তাকে দিয়ে সহজেই অনেক অপ্রিয় কাজ করিয়ে নেয়া যেত। প্রেসিডেন্ট ইয়াং শাংখুন লি পেং-কে তার মাউথপিস হিসেবে সবসময়ই ব্যবহার করতেন। লি পেং আগের বছরের সামারে পার্টির এক সেমিনারে ট্রাও জিয়াং-এর সাথে তার ‘ইকনোমিক রিফর্ম’ নিয়ে সরাসরি তর্কে জড়িয়ে পড়েন, সেই থেকে তাদের ভিতরকার দ্বন্দ্বের ব্যাপারটা পার্টির অন্যান্য সদস্যরা জেনে যায়। থিয়েনআনমেন স্কয়ারের এই সংকটকালে দেং শিয়াওপিং এবং ইয়াং শানখুন লি পেং-কে দিয়ে ট্রাও জিয়াং-কে সাইডলাইন করে দেয়ার নকশা আঁকেন। সেই নকশার ছকে ট্রাও জিয়াং-এর সাথে বিপদে পড়েন স্ট্যান্ডিং কমিটির আরেক সদস্য হু ছিলি। সুবিধাবাদী হু ছিলি যদিও দেং শিয়াওপিং-এর হয়ে বহুল আলোচিত পিপলস ডেইলির সেই সম্পাদকীয়টি খসড়া তৈরি করে দিয়েছিলেন, তারপরও তিনি ট্রাও জিয়াং-এর সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলে পরবর্তীতে স্ট্যান্ডিং কমিটি থেকে বহিষ্কৃত হন। শুধুমাত্র ছিয়াওশ্রি অত্যন্ত কৌশলে পরিস্থিতির অনুকূলে নিজের মত দিয়ে এই জটিল নকশার ফাঁদ থেকে রক্ষা পান।

‘ফরবিডেন সিটি’-এর ঠিক পাশে অবস্থিত কম্যুনিস্ট পার্টির হেড কোয়ার্টার ট্রোংনানহাই-এর ভেতর যে নেতৃত্বের পালাবদলের পাশা খেলা চলছিল সেটা সম্পর্কে আন্দোলনকারী ছাত্ররা বেশ খানিকটা ওয়াকিবহাল ছিল এবং ট্রাও জিয়াং যে ছাত্রদের দাবীর ব্যাপারে সহমর্মী সে খবরটাও তাদের কাছে এসে পৌঁছিয়েছিল। ফলে সেই সময় থেকে তারা তাদের শ্লোগানে এবং পোস্টারে শুধু দেং শিয়াওপিং আর লি পেং-কেই টার্গেট করা শুরু করে। এছাড়া গর্বাচেভের সাথে অফিসিয়াল লাঞ্চের সময় দেং শিয়াওপিং-এর চপস্টিক থেকে খাবার পড়ে যাওয়ার দৃশ্য ধরা পড়ে লাইভ টেলিকাস্টে। বক্তৃতা দেয়ার সময় তার কথা যে জড়িয়ে যাচ্ছিল সেটাও সারা বিশ্বের মানুষ সরাসরি টেলিকাস্টে প্রত্যক্ষ করে। এই দৃশ্য দেখার পর পুরো জাতির কাছে পরিস্কার হয়ে যায় যে দেং শিয়াওপিং বুড়ো হয়ে অথর্ব হয়ে গেছেন। এছাড়াও ১৬ই মে সন্ধ্যায় গর্বাচেভের সাথে কথোপকথনের সময় ট্রাও জিয়াং উল্লেখ করেন যে, দলের ভিতর দেং শিয়াওপিং-এর কোন অফিসিয়াল পজিশন নেই যদিও কোন কোন ব্যাপারে তার সিদ্ধান্তকেই শেষ সিদ্ধান্ত হিসেবে গণ্য করা হয়। তার এই মন্তব্যে সবাই ধারণা করে যে দেং শিয়াওপিং-এর সময় এখন শেষ। ফলে তার পদত্যাগের দাবী আরও বেশী বলিষ্ঠ হয়ে উঠে। এবং এই দাবী আর শুধুমাত্র ছাত্রদের দাবী থাকে না। দেশের আপামর জনসাধারণ একাত্ম হয়ে এই একই দাবী জানাতে কাতারে কাতারে এসে জমায়েত হয় থিয়েনআনমেন স্কয়ারে। এই পরিস্থিতিতে ১৮ই মে তারিখে হঠাৎ গুজব রটে যায় যে সন্ধ্যা সাতটায় দেং শিয়াওপিং পদত্যাগের ঘোষণা দিবেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটনা ঘটছিল ঠিক উল্টো। দেং শিয়াওপিং কোনভাবেই পদত্যাগের জন্য প্রস্তুত নন। ১৭ই মে রাতে দেং শিয়াওপিং স্ট্যান্ডিং কমিটির সাথে সারা রাত ধরে মিটিং করে তিনি সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে তার সিদ্ধান্তের কথা জানান। ট্রাও জিয়াং যখন বিপক্ষে মত দেন তখন তার দোসর হু ছিলি তাকে সমর্থন দিতে ব্যর্থ হন। অপরদিকে ছিয়াওশ্রি এবং লি পেং সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে ভোট দেন। ফলে ভাগ্যের চাকা এখন অনেকটাই দেং শিয়াওপিং-এর দিকে ঘুরে যায় যদিও তারা সেই রাতে কোন পাকা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন নি। পরদিন ১৮ই মে দুপুরে লি পেং গ্রেট হলের সামনে একদল ছাত্রদের মাঝে এসে উপস্থিত হন। সবাই ধরে নেয় যে ছাত্রদের সেই বহুল প্রতিক্ষীত ‘ডায়ালগ’-এর জন্য লি পেং এসে উপস্থিত হয়েছেন যা কিনা সরাসরি টেলিকাস্ট করা হবে। লি পেং যখন ছাত্রদেরকে ক্যাম্পাসে ফিরে যাওয়ার উপদেশ দিয়ে বক্তব্য দেয়া শুরু করেন তখন ছাত্রনেতা উয়ারখায়শি কিছু বলার চেষ্টা করেন। এই সময় তাকে বাধা দেয়ার জন্য শর্ট টেম্পারড লি পেং রেগে যান। কিন্তু সবাইকে হতবাক করে দিয়ে উয়ারখায়শি রাগান্বিত লি পেং-কে বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে উল্টো তাকে ধমক দিয়ে বলেন, আমাদের দাবী না মানা পর্যন্ত কেউ এখান থেকে ফিরে যাবে না। এই পর্যায়ে হঠাৎ লি পেং তার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান এবং গ্রেট হলের দিকে হাঁটা শুরু করেন। ছাত্রদেরকে কনভিন্স করে ক্যাম্পাসে ফেরত পাঠাতে ব্যর্থ হওয়াতে তাকে তখন বেশ নার্ভাস দেখাচ্ছিল। সেই রাতে স্ট্যান্ডিং কমিটির জরুরী মিটিং বসে। মিটিং-এ সামরিক হস্তক্ষেপকে এড়ানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে ট্রাও জিয়াং প্রস্তাব করেন তিনি স্ট্যান্ডিং কমিটির অন্যান্য সদস্যকে সাথে নিয়ে ছাত্রদেরকে অনশন ভাংগানোর উদ্যোগ নিবেন। ঠিক যেভাবে দেং শিয়াওপিং ১৯৭৬ সালে ‘গ্যাং অব ফোর’-এর কাছে শেষ চেষ্টা হিসেবে অনুরোধ করেছিলেন। তখন দেং শিয়াওপিং-কে সেই সুযোগ দেয়া হয়নি। সেই হিসেবে ট্রাও জিয়াং-এর ভাগ্য ভালো, লি পেং অনিচ্ছা সত্বেও যেতে রাজী হন। অনশনরত ছাত্ররা থিয়েনআনমেন স্কয়ারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটি পাবলিক বাসের মধ্যে অবস্থান করছিল। কড়া ইস্ত্রি করা মাও কোট পরিহিত ট্রাও জিয়াং যখন এ রকম একটি বাসে ছাত্রদের উদ্দেশ্য কথা বলার জন্য উঠলেন তখন তাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। জোরে কথা বলার শক্তিটুকুও যেন তিনি পাচ্ছিলেন না। হ্যান্ড মাইক হাতে ছাত্রদের উদ্দেশ্য প্রথমেই বললেন, আমি দুঃখিত যে তোমাদের এখানে আসতে আমাদের অনেক দেরী হয়ে গেছে। সমবেত ছাত্ররা জানত কার করণে এবং কেন দেরী হয়েছে। তিনি ছাত্রদেরকে অনশন ভেঙে বাড়ী ফিরে যেতে বলেলন। এই সময় বেশ কিছু ছাত্রকে তার অটোগ্রাফ সংগ্রহ করতে দেখা যায় যা থেকে বোঝা যায় যে তিনি ছাত্রদের কাছে কতখানি জনপ্রিয় ছিলেন। এরপর তাকে লি পেং-এর সাথে একত্রে একটি গাড়ী করে কম্যুনিস্ট পার্টির হেড কোয়ার্টার ট্রোংনানহাই-এ ফেরত যেতে দেখা যায়। সেটাই ছিল তার শেষ পাবলিক এপিয়ারেন্স, এরপর থেকে তাকে আর কোথাও প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।

পরদিন ১৯শে মে ছাত্ররা অনশন ধর্মঘট যদিও প্রত্যাহার করে নেয় তবে তারা থিয়েনআনমেন স্কয়ার ছেড়ে যাওয়া থেকে বিরত থাকে। এ সময় বেইজিং মিলিটারির চব্বিশ ডিভিশনের প্রায় পঞ্চাশ ট্রাক সৈন্যকে বেইজিং-এর পশ্চিম প্রান্তে এসে অবস্থান নিতে দেখা যায়। সামরিক হস্তক্ষেপ আসন্ন দেখে ট্রাও জিয়াং তার পদত্যাগ পত্র জমা দেন। অর্থাৎ পাশার দান সম্পূর্ণ উল্টে গিয়ে দেং শিয়াওপিং ক্ষমতার মঞ্চে মূল অভিনেতার ভূমিকায় আবির্ভূত হন। সে দিন সন্ধ্যায় বেইজিং-এর পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত মিলিটারি লজিস্টিক ডিপার্টমেন্টের অডিটরিয়ামে পলিট ব্যুরোর স্টান্ডিং কমিটির চারজন সদস্য উচ্চ পদস্থ মিলিটারি অফিসার এবং পার্টির নেতাদের সাথে মিলিত হন। এই প্রথম ট্রাও জিয়াং স্টান্ডিং কমিটির মিটিং থেকে বাদ পড়লেন। মিটিং শেষে সেই মিটিং-এর গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ মধ্যরাতে টেলিভিশনে প্রচার করা হয়। প্রথমে দেখা যায় যে কালো মাও কোট পরিহিত লি পেং একটি লিখিত বক্তব্য দিচ্ছেন দাঁড়িয়ে। তাকে গত দিনের মতন মোটেই নার্ভাস দেখাচ্ছিল না। তিনি তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে, সরকার গত একমাসের বেশী সময় ধরে সংযত আচরণ করেছে, কিন্তু এখন বাধ্য হচ্ছে থিয়েনআনমেন ছাত্র আন্দোলনের নামে যারা সমাজে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। এরপর ক্যামেরা ফোকাস করে প্রেসিডেন্ট ইয়াং শাংখুন-এর দিকে। তিনি তার চেয়ারে বসেই এবং কোন লিখিত স্ক্রিপ্ট ছাড়াই তার বক্তব্য

শুরু করেন। বক্তব্যের এক পর্যায়ে যখন তিনি বলেন যে, পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার বাধ্য হচ্ছে পিপলস লিবারেশন আর্মির ট্রুপসকে থিয়েনআনমেন স্কায়ারে আনতে তখন শোনা গেল বিপুল করতালির শব্দ। ক্যামেরা সেই শব্দকে অনুসরণ করে ফোকাস করল গ্যালারীতে বসে থাকা করতালিরত মিলিটারি অফিসার আর কম্যুনিস্ট পার্টির নেতাদেরকে। ইয়াং শাংখুন টেবিলের উপর রাখা চায়ের পেয়ালা নাড়াচাড়া করতে করতে আরও বললেন যে সাধারণ ছাত্ররা ইতিমধ্যেই থিয়েনআনমেন স্কয়ার ত্যাগ করে চলে গেছে, যারা এখনও রয়েছে তারা আসলে মিসক্রিয়েন্ট বা ট্রাবলমেকার। তিনি তার বক্তব্যে এটাও নিশ্চিত করলেন যে মিলিটারি সাধারণ ছাত্রদেরকে কোন প্রকার হেনস্থা করবে না। ইয়াং শাংখুন-এর এই ঘোষণা থিয়েনআনমেন স্কয়ারের লাউড স্পীকারগুলিতে অনুরণিত হওয়া মাত্রই সেখানে অবস্থানরত ছাত্র, শ্রমিক এবং সাধারণ জনতার মাঝে এক তীব্র আলোড়নের সৃষ্টি হয়। যেন চীন সরকার তার নিজের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। দেং শিয়াওপিং কিছুদিন আগে তার ঘনিষ্ঠজনদেরকে বলেছিলেন, যদি কৃষক, শ্রমিক এবং সাধারণ জনগণ কম্যুনিস্ট পার্টির পাশে থাকে তবে আমি ছাত্রদের উপর মিলিটারি মোতায়েন নিয়ে আমি মোটেই চিন্তিত নই। কিন্তু কৃষক, শ্রমিক এবং জনগণের দোহাই দিয়ে কম্যুনিস্ট পার্টি যে গত চল্লিশ বছর ধরে তাদেরকেই পিষ্ট করে আসছিল সেটা এখন জনগণের কাছে অনেকটাই দিনের আলোর মতন পরিস্কার। তাই ছাত্রদের এই আন্দোলনে তারা দলে দলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেয়া শুরু করেছিল সেই প্রথম থেকেই। কিন্তু কম্যুনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ সেটা বুঝেও না বোঝার ভাণ করে ছিল এতদিন। ফলশ্রুতিতে দেং শিয়াওপিং-এর এই মিলিটারি মোতায়েনের সিদ্ধান্তের কারণে থিয়েনআনমেন স্কয়ারে সংঘটিত হয় এক ভয়ঙ্কর গণহত্যা। (চলবে)

তথ্যসূত্রঃ

১) ‘ডেসপ্যাচেস ফ্রম দ্য ব্যারিকেড – এ্যান আই উইটনেস অ্যাকাউন্ট অব দ্য রেভ্যুলেশনস দ্যাট শুক দ্য ওয়ার্ল্ড ১৯৮৯-৯০’, জন সিম্পসন, হাচিসন

২) ‘রেড চায়না ব্লুজ – মাই লং মার্চ ফ্রম মাও টু নাও’, জেন ওং, ডাবলডে এ্যাংকর বুকস

কাজী সাব্বির আহমেদ

কলামিস্ট

টরন্টো