সংকটে অন্টারিওর চিকিৎসা ব্যবস্থা
পরিস্থিতি মোকাবেলায় চিকিৎসা সেবা আরো বেশী মাত্রায় বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা
বেসরকারী এই স্বাস্থ্য-পরিচর্যা কার্যক্রমের সেবা পাওয়াটা নিন্ম আয়ের মানুষের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে : বাড়বে চিকিৎসা বৈষম্য : প্রশ্ন উঠেছে এগুলোর মান নিয়েও
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় কানাডার চিকিৎসা ব্যবস্থার রয়েছে বেশ সুখ্যাতি। বিশ^সেরা প্রথম দশটি হাসপাতালের তালিকায় প্রায় বছরই নাম আসে এখানকার বিভিন্ন হাসপাতালের। ২০১৯ সালে বিশ্বের সেরা দশটি হাসপাতালের তালিকায় ‘টরন্টো জেনারেল হাসপাতাল’ এর নাম উঠে এসেছিল। কানাডায় বিশ্বমানের হাসপাতাল আরো আছে। টরন্টো জেনারেল হাসপাতালের পাশেই অবস্থিত হসপিটাল ফর সিক চিল্ড্রেন এরকম একটি বিশ্বমানের হাসপাতাল। টরন্টোর বাইরে অন্যান্য বড় শহরগুলোতেও রয়েছে বেশ কয়েকটি খ্যাতনামা হাসপাতাল। কিন্তু সেই কানাডায় অবস্থিত বিভিন্ন হাসপাতাল এখন সংকটের মুখে। মহামারী শুরু হওয়ার পর এই সংকট চরমে উঠেছে। কানাডায় সবচেয়ে বেশী সংখ্যাক মানুষ বাস করে যে অন্টারিওতে সেখানেও ভেঙ্গে পড়ছে স্বাস্থ্য-পরিচর্যা ব্যবস্থা। প্রধানত নার্স এবং কোথাও কোথাও ডাক্তারের অভাবে সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে হচ্ছে কোন কোন হাসপাতালের জরুরী বিভাগ। ফলে রোগীরা জরুরী স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটেও পর্যাপ্ত নার্স পাওয়া যাচ্ছে না সেবা অব্যাহত রাখার জন্য। ফলে কোন কোন হাসপাতালে বন্ধ রাখা হচ্ছে ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটও। রোগীকে স্থানান্তর করা হচ্ছে অন্য হাসপাতালে। এর সঙ্গে রয়েছে অপারেশনের জন্য সুদীর্ঘ লাইন। করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর খুব জরুরী নয় এমন বহুসংখ্যক অপারেশন বন্ধ রাখা হয়েছে গত প্রায় আড়াই বছর ধরে।
টরন্টোর একটি হাসপাতালের জরুরী বিভাগের ডাক্তার রঘু ভেনুগোপাল গ্লোবাল নিউজকে বলেন, ‘অন্টারিও-সহ কানাডার অন্যান্য অঞ্চলের হাসপাতালগুলোতে জরুরী বিভাগে কর্মরত ডাক্তার ও নার্সরা ব্যাপকভাবে হতাশ হয়ে পড়েছেন এরকম পরিস্থিতির কারণে। রোগীদের জন্য জরুরী বিভাগে অপেক্ষার সময়গুলো অত্যন্ত দীর্ঘ হয়ে উঠেছে। কাজের অস্বাভাবিক চাপে সেবা প্রদানকারী নার্সরা দিশা হারিয়ে ফেলছেন।’
এদিকে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে রোগী বেড়ে যাওয়ার পিছনে কভিড-১৯ এর সপ্তম ঢেউকে দায়ী করছেন টরন্টোর একটি হাসপাতালের জরুরী বিভাগে কর্মরত ডাক্তার কাসিফ পীরজাদা। গ্লোবাল নিউজকে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিধি থেকে সরকার এবং জনগণ পিছিয়ে আসায়, বিশেষ করে জনসমাগমে মাস্ক ব্যবহার না করা এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় না রাখায় সংক্রমণ আবার বাড়ছে এবং তার চাপ পড়ছে হাসপাতালের জরুরী বিভাগগুলোতে। অন্যদিকে গত দুই-আড়াই বছরের মাহামারীকালে আমরা দেখেছি অনেক স্বাস্থ্যকর্মী মানসিক ও শারীরিকভাবে সম্পূর্ণভাবে ক্লান্ত বা অবসন্ন হয়ে পড়েছেন অত্যধিক চাপের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে। এ কারণে অনেক স্বাস্থ্যকর্মী পেশা ছেড়ে দিয়েছেন যা বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টির পিছনে কাজ করছে।’
বর্তমান পরিস্থিতিতে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, একদিকে হাসপাতালের জরুরী বিভাগগুলোতে স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব তীব্র হয়ে উঠেছে আর অন্যদিকে হাজার হাজার নার্স বেকার বসে আছেন। ফেয়ারনেস কমিশন এর অতি সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, অন্টারিওতে বর্তমানে প্রায় ২৬ হাজার নার্স রয়েছেন যারা অন্যদেশ থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত। এদের মধ্যে ১৪ হাজার নার্স এখানে নিবন্ধিত। বাকিরা এখনো নয়। এদেরকে আত্মীকরণে রয়েছে নানান জটিলতা ও বাধা।
অন্টারিও হেলথ এর সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় গত মে মাসে জরুরী বিভাগগুলোতে রোগীদেরকে গড়ে বিশ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে কোন ওয়ার্ডে বেড পাওয়ার আগে। এই অপেক্ষার সময় অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে অন্টারিতে।
জরুরী বিভাগগুলোর এই করুণ অবস্থা সৃষ্টির পিছনে রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকাও রয়েছে যথেষ্ট। ন্যাশনাল পোস্ট পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গত তিরিশ বছর ধরে অন্টরিওতে যে দলগুলো ক্ষমতায় এসেছে তারা স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করেছে সবসময়। রোগীদের সেবার বিষয়টি প্রাধান্য পায়নি তাদের কাছে। অতীতে নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা বব রে যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন তিনি মনে করেছিলেন অন্টারিতে প্রয়োজনের তুলনায় অধিক ডাক্তার রয়েছে। তখন তিনি মেডিক্যাল স্কুলের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন যা পরবর্তীতে ডাক্তার স্বল্পতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তারপর ক্ষমতায় আসেন প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টির নেতা মাইক হ্যারিস। তিনি অন্টারিওর হাসপাতালগুলোতে বেডের সংখ্যা এবং নার্সের সংখ্যা কমিয়ে দেন। এরপর লিবারেল ক্ষমতায় এসে হাসপাতালের বাজেট হ্রাস করে।’
এভাবে রাজনৈতিক নেতারা হাসপাতালের উপর চালায় তাদের অপরিকল্পিত নিয়ন্ত্রণ যা পরবর্তীতে কোন সুফল বয়ে আনেনি অন্টারিও’র স্বাস্থ্য সেবা খাতে। বরং পরিস্থিতি দিনের পর দিন খারাপের দিকে গেছে। মহামারীর সময়টাতে তা আরো প্রকট হয়ে উঠে। অন্টারিও এর সঙ্গে পেরে উঠেনি। লং-টার্ম কেয়ার হোমগুলোতে প্রচুর সংখ্যক বয়স্ক লোক মৃত্যুবরণ করে কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে। কারণ অন্টারিওর হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা সিস্টেমে মহামারী মোকাবেলায় কোন সামর্থ্য ছিল না। অন্টারিওসহ কানাডার অন্য কোন প্রভিন্সে কভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন উৎপাদনের কোন সুযোগ ছিল না। ফলে এর ভ্যাকসিন পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে অন্য দেশের উপর।
বর্তমানে ৯১১ এ কল দিলে এম্বুলেন্স পেতেও বেগ পেতে হচ্ছে। অপারেটরগণ রোগীকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর অবস্থা খুব বেশী খারাপ না হলে অন্টারিও টেলি হেলথ এর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছেন। টেলি হেলথ এর একজন নার্স তখন রোগীর সঙ্গে কথা বলেন। রোগীর বিস্তারিত জানার পর সেই নার্স সিদ্ধান্ত দেন হাসপাতালের জরুরী বিভাগে তাকে পাঠানো হবে কি হবে না।
গ্লোবাল নিউজ জানায়, কানাডার পশ্চিমের ভ্যাঙ্কুভার থেকে শুরু করে পূবের নিউফাউন্ডল্যান্ড ও ল্যাব্রাডর পর্যন্ত একই অবস্থা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় আগামী কয়েক মাস বা তারো বেশী সময় ধরে হয়তো অনেক হাসপাতালের জরুরী বিভাগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে।
কানাডিয়ান মেডিকেল এসোসিয়েশন এর সভাপতি ডাক্তার ক্যাথারিন স্মার্ট গ্লোবাল নিউজকে বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে আজ এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হলো, কানাডা জুড়ে এখন চলছে স্বাস্থ্যকর্মীদের অভাব, বিশেষ করে নার্সের অভাব।’ ডাক্তার ক্যাথারিন স্মার্টের মতে আমরা বর্তমানে যা দেখছি তা অভূপূর্ব এবং এই পরিস্থিতির মাত্রা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যা বিগত বছরগুলোতে দেখা যায়নি। তিনি আরো বলেন, ‘চিকিৎসরা চান বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় নীতিনির্ধারকরা জরুরী ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ নিক। আর তা শুধু হাসপাতালের জরুরী বিভাগের জন্য নয়, অন্যান্য ক্ষেত্র যেমন লং-টার্ম কেয়ার হোম এবং প্রাইমারী কেয়ার প্রভৃতি সেবামূলক কার্যক্রমের দিকেও নজর দিতে হবে। এতে করে লোকজন তাদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার অনেককিছু সেখানেই পাবে। খুব বেশী প্রয়োজন না হলে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে দৌড়াতে হবে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘স্বাস্থ্য সেবা যে সংকটের মধ্যে রয়েছে তাও স্বীকার করতে হবে এবং সরকারকে এই মুহুর্তেই বিবেচনা করতে হবে এই বিষয়টি খুবই জরুরী।’
কানাডার চিকিৎসা ব্যবস্থা যতই উন্নত হোক বা যতই এর সুখ্যাতি থাকুক – কিছুটা সমস্যা যে এর আছে মহামারীর আগে থেকেই তা অস্বীকার করার উপায় নেই। উদাহরণ হিসাবে হাসপতালের
ইমার্জেন্সীর কথা উল্লেখ করা যায়। রোগীদের অভিযোগ- সেখানেওয়েটিং টাইমটা সত্যিই পীড়াদায়ক। কেউ যদি কোন গুরুতর সমস্যা নিয়ে হাসপাতালের ইমার্জেন্সী বিভাগে যান তবে কম করে হলেও তাকে ৪ থেকে ৬ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয় ডাক্তারের কাছ পর্যন্ত যেতে! এমনকি লঘু বা কম জটিলতার কোন বিষয় নিয়ে ইমার্জেন্সীতে গেলেও ৪ থেকে ৫ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়। ontariowaittimes.com এর তথ্য এটি। দীর্ঘ এই অপেক্ষার সময়টা অসুস্থ রোগীর জন্য নিশ্চিতভাবেই পীড়াদায়ক। সেই সাথে রোগীর সাথে যারা যান তাদের ভোগান্তিও কম নয়।
পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, স্বাস্থ্যখাতে এই সংকটময় পরিস্থিতি হঠাৎ সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরেই একটু একটু করে সমস্যাগুলো পুঞ্জিভূত হচ্ছিল। করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর সেই পুঞ্জিভূত সমস্যাগুলো দ্রুত প্রকাশ পেতে থাকে সবার সামনে। এবং মহামারী শুরু হওয়ার পর দিন যতই পার হতে থাকে সমস্যাগুলোও ততই প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। আর এই সমস্যা মোকাবেলায় ড্যাগ ফোর্ড এর নেতৃত্বাধীন বর্তমান প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরো বেশী মাত্রায় বেসরকারীকরণ করা হবে স্বাস্থ্যখাতের সেবা। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, তাতে বর্তমান সংকটের সমাধান কতটুকু হবে? আর বেসরকারী খতের স্বাস্থ্য সেবা নিতে গেলে রোগীকে কি নিজের পকেট থেকে অর্থ যোগান দিতে হবে? পুরোটা না হোক আংশিকভাবে হলেও?
উল্লেখ্য যে, হাসপাতালগুলোতে বিদ্যমান বর্তমান কর্মী সংকটকে মোকাবেলা করার জন্য আরো বেশী মাত্রায় স্বাস্থ্যখাতকে বেসরকরীকরণের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ড্যাগ ফোর্ডের সরকার, তা নিয়ে বিতর্ক পুররুজ্জীবিত হয়ে উঠেছে গত কিছুদিন ধরে। সংকট মোকাবেলায় নতুন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন এ বিষয়ে সবাই একমত। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, সরকার ঘোষিত বেসরকারীকরণের সিদ্ধান্ত কোন সহজ সমাধান নয়।
আগস্ট এর মাঝামাঝি সময়ে এক সংবাদ সম্মেলনে অন্টারিও’র স্বাস্থ্য মন্ত্রী সিলভিয়া জোন্স স্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করার জন্য একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। ঐ পরিকল্পনার মধ্যে আছে – বিদ্যমান বেসরকারী ক্লিনিকগুলোতে সরকারী খরচে রোগীদের অস্ত্রোপচার বা অপারেশন করানো যাতে করে সরকারী হাসপাতালগুলোতে রোগীদের চাপ হ্রাস পায়। তবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি স্পষ্ট করে বলেননি কোন ধরণের ক্লিনিক এই পরিকল্পনার আওতার মধ্যে থাকবে বা কোন ধরণের অস্ত্রোপচার করা হবে।
উল্লেখ্য যে, করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর খুব জরুরী নয় এমন বহুসংখ্যক অস্ত্রোপচার বন্ধ রাখা হয়েছে গত প্রায় আড়াই বছর ধরে।
সংবাদ সম্মেলনে সিলভিয়া জোন্স আরো বলেন, Ontario Health Insurance Plan (OHIP) এর মাধ্যমে অন্টারিও-তে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান অব্যাহত থাকবে। তবে অন্টারিওতে বিদ্যমান বেসরকারী ক্লিনিকের পাশাপাশি আরো ক্লিনিককে অনুমোদন দেওয়া হবে কি না সে বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবও স্বাস্থ্যমন্ত্রী দেননি।
সিবিসি নিউজ জানায়, অন্টারিওতে গত কয়েক দশক ধরেই বেসরকারী ক্লিনিক ব্যবসা বিদ্যমান রয়েছে যারা বিভিন্ন ধরণের চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছে। পাশাপাশি কিছু জব এজেন্সিও রয়েছে যারা হাসপাতালে অস্থায়ী কর্মী সরবরাহ করে থাকে। মহামারীর সময়ও তারা হাসপাতালে কর্মী সরবরাহ করে আসছে ক্রমবর্ধমান খরচে। আর এই বর্ধিত ব্যয়ভার বহন করতে হচ্ছে করদাতাদেরকে।
বেসরকারী খাতের যারা সমর্থক তারা বলছেন এর মাধ্যমে সরকারী হাসপাতালগুলোতে চাপ কমবে এবং রোগীরা দ্রুত জরুরী সেবা পাবেন। কিন্তু যারা চিকিৎসা সেবা বেসরকারীকরণের সমর্থক নন তারা বলছেন, এর মাধ্যমে সরকারী কোষাগার থেকে অধিক অর্থ চলে যাবে এবং কানাডিয়ানদের মধ্যে চিকিৎসা বৈষম্য বাড়বে। প্রকৃতপক্ষে অধিক মাত্রায় বেসরকারীকরণ কোন সমাধান নয়, বরং এটি মূল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। অন্টারিও নার্সেস এসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাথরিন হোয় সম্প্রতি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন যে চিকিৎসা সেবা আরো বেশী মাত্রায় বেসরকারীকরণ করা হলে তা শুধুমাত্র ব্যবসায়ীদের পকেট ভারী করবে। আর সেই অর্থের যোগান দিতে হবে কারদাতাদেরকে।
কানাডিয়ান মেডিকেল এসোসিয়েশন এর সভাপতি ডাক্তার ক্যাথারিন সিবিসি নিউজকে বলেন, এই মুহুর্তে আমরা নিজেদেরকে সত্যিই এক চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। কারণ আমাদের স্বাস্থ্যপরিচর্যা ব্যবস্থা ভালভাবে কাজ করছে না। এবং দিনে দিনে তা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে।
কতটা খারাপের দিকে যাচ্ছে তার একটি উদাহরণ তুলে ধরেছে সিটিভি নিউজ। ঘটনাটি নভাস্কোশিয়ার। সেখানে লিজ লেক্লেয়ার নামের এক মহিলা রোগী দীর্ঘ ৩৬ ঘন্টা ধরে যন্ত্রণাদায়ক পেটের ব্যথায় ভুগেছেন সেই সাথে বমি। কিন্তু ৯১১ এ কল করে কোন এম্বুলেন্স পাচ্ছিলেন না।
এটি একটি মাত্র উদাহরণ যে কানাডায় স্বাস্থ্যসেবা কতটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কি পরিমাণ ডাক্তার, নার্স ও প্যারামেডিক্স এর অভাব বিরাজ করছে। লিজ লেক্লেয়ার প্রথমে ৯১১ এ কল করে অপেক্ষা করছিলেন এম্বুলেন্সের জন্য। দুই ঘন্টা পার হলেও কোন এম্বুলেন্স আসেনি তার বাড়িতে। শেষ পর্যন্ত এক অপারেটর তাকে জানান, জরুরী বিভাগে এসে ডাক্তারের দেখা পেতে হলে তাকে কমপক্ষে ১৬ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হতে পারে। তিনি ঐ প্রভিন্সের ভার্চুয়াল হেলথ লাইনেও ফোন দিয়েছিলেন। সেখান থেকে বলা হয়, একজন নার্সের সঙ্গে কথা বলার জন্য তাকে প্রায় ৯ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হতে পারে। তখন তার আর কোন উপায় ছিল না প্রার্থনা করা ছাড়া। প্রার্থনা করছিলেন যেন পেটের ব্যথা আপনা থেকেই কমে যায়।
তবে তুলনামূলকভাবে ছোট শহরগুলোতে এরকম ঘটনা ঘটছে বেশী যার উদারহণ হলো নভাস্কোশিয়ার লিজ লেক্লেয়ার এর ঘটনাটি। ব্রিটিশ কলম্বিয়ার মফস্বল শহর ক্লিয়ারওয়াটার এলাকায় অবস্থিত হেলমকেন মেমোরিয়াল হাসপাতালের জরুরী বিভাগ গত ছয় মাসে ২০ বার বন্ধ করে দিতে হয়েছিল সাময়িকভাবে। গ্লোবাল নিউজকে এ কথা জানিয়েছেন স্থানীয় মেয়র মারলিন ব্ল্যাকওয়েল।
তবে বড় শহরগুলোর হাসপাতালে কাজের ব্যাঘাত কম হচ্ছে তাও নয়। গত ১৭ জুলাই রবিবার মন্ট্রিয়লের শিশু হাসপাতালে রোগীদের ভিড় অত্যধিক বেড়ে গেলে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হন সাময়িকভাবে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে। তারা নতুন রোগীদের অন্য হাসপাতালে যেতে বলেন। ঐ একই সময় ভেঙ্গুভারের চারটি হাসপাতাল জরুরী বিভাগে আসা রোগীদেরকে পার্শ^বর্তী অন্য কোন হাসপাতালে চলে যেতে বলে। এতে করে অনেককেই জরুরী স্বাস্থ্য সেবা নেয়ার জন্য দীর্ঘ সড়ক পথ অতিক্রম করতে হয়।
কানাডিয়ান মেডিকেল এসোসিয়েশন এর সভাপতি ডাক্তার ক্যাথারিন স্মার্ট গ্লোবাল নিউজকে বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে আজ এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হলো, কানাডা জুড়ে এখন চলছে স্বাস্থ্যকর্মীদের অভাব, বিশেষ করে নার্সের অভাব।’
তিনি আরো বলেন, ‘সাধারণত গ্রীষ্মকালে হাসপাতালে রোগীর ভীড় কম দেখা যায়। কিন্তু এখন জরুরী বিভাগে রোগীর ভীড় অনেক বেশী দেখা যাচ্ছে যা শীতকালে ঘটে থাকে। বিষয়টি অস্বাভাবিক। আর এই রোগীদের অনেকেই মহামারীকালে ডাক্তারের কাছে যাননি বা কম গিয়েছেন। এখন তারা আগের তুলনায় বেশী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বা তাদের আরও বেশী যত্নের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশী অস্বাভাকি বিষয় হলো হাসপাতালের জরুরী বিভাগ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া।’
সিবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কানাডা ফ্যামিলি ডাক্তারের গুরুতর সংকটে ভুগছে আরো আগে থেকেই। লক্ষ লক্ষ কানাডিয়ানের কোন ফ্যামিলি ডাক্তার নেই। কারণ অনেক ডাক্তার অবসরে চলে গেছেন বা যাচ্ছেন। সেই পরিমানে নতুন ডাক্তারও আসছে না কানাডিয়ান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। মহামারীর কারণে হাসপাতালে জরুরী সেবা পেতে সমস্যা হচ্ছে। করোনার রোগী বেশী হওয়াতে সাধারণ অস্ত্রোপচার বহুলাংশে কমে গেছে। অপেক্ষার সময়ও বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক বেশী। মহামারীর আগে ২০১৯ সালে যে পরিমান অস্ত্রোপচার হয়েছিল কানাডার বিভিন্ন হাসপাতালে, তার তুলনায় ২০২০ সালের মার্চ থেকে শুরু করে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত তার চেয়ে ৬ লক্ষ কম অস্ত্রোপচার হয়েছে। এই তথ্য ‘কানাডিয়ান ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ইনফরমেশন’ এর।
মহামারী শুরু হওয়ার পর ২০২০ সাল থেকে শুরু ২০২১ সাল পর্যন্ত গোটা কানাডায় প্রায় অর্ধেক প্রাপ্তবয়স্ক লোকের সমস্যা হয়েছিল স্বাস্থ্যসেবা পেতে। আর ১৫% কানাডিয়ান বলেছেন তারা তাদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা একেবারেই পাননি। ২০২১ সালে স্ট্যাটিসটিকস কানাডার জরিপ থেকে এই তথ্য বেরিয়ে আসে।
কিন্তু অধিক সংখ্যক বেরসরকারী ক্লিনিককে অনুমোদন দিলেই কি বর্তমান সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? অন্টারিও’র প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ড নিজে একজন ব্যবসায়ী। সে কারণে তিনি হয়তো ব্যবসায়ীক দৃষ্টিকোন থেকেই দেখছেন বিষটিকে। তার ধারণা আরো অধিক সংখ্যাক বেসরকারী ক্লিনিকের অনুমোদন দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন অন্য কথা।
স্বাস্থ্যআইন ও নীতির একজন গবেষক এবং অটোয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক কলিন ফ্লাড বলেন বেসরকারী স্বাস্থ্য-পরিচর্যা কার্যক্রমের সেবা পাওয়াটা নিন্ম আয়ের মানুষের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বিশে^র বিভিন্ন দেশের বেসরকারী স্বাস্থ্য-পরিচর্যার উপর গবেষণা চালিয়ে অধ্যাপক কলিন এই মন্তব্য করেন। সিবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে তার এই বক্তব্য তুলে ধরা হয়। অধ্যাপক কলিন স্বাস্থ্যসেবাকে বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেয়ার পরিকল্পনাকে এক ধরণের হঠকারী সিদ্ধান্ত হিসাবে বর্ণনা করেন। এতে মূল সমস্যার সমাধান হবে না।
তিনি আরো বলেন, এটি একটি সহজ সমাধান নয়। যে সব দেশে সরকারী ও বেসকারী উভয় খাতে চিকিৎসা-সেবার ব্যবস্থা রয়েছে সেসব দেশে বেসরকারী খাতকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তা বের করতে গিয়ে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়। নজর রাখতে হয় সরকারী জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকে বেসরকারী জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা যাতে সমস্ত রিসোর্স শোষণ করে না নেয়। তাছাড়া বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম সবসময় কম জটিল রোগীদেরকে চিকিৎসা সেবা দিতে চেষ্টা করে-যেমন হাঁটু বা নিতম্বের অস্ত্রোপচার। কিন্তু অধিকতর জটিল রোগী যেমন ক্যান্সার, হৃদরোগ ইত্যাদির জন্য সরকারী হাসপাতালের উপরই নির্ভর করতে হয়। তাছাড়া জরুরী চিকিৎসার জন্যও সরকারী হাসপাতালের জরুরী বিভাগের উপর নির্ভর করতে হয়।
তবে স্বাস্থ্যসেবা খাত আরো অধিকতর মাত্রায় বেসরকারীকরণ করা হলেই যে তা খারাপ হবে সে কথাও জোর দিয়ে বলার উপায় নেই। কিন্তু সেটি নির্ভর করছে কি পরিমান খরচ হবে তার উপর এবং তার কোয়ালিটি বা মানের উপর। খরচের বিষয়টি শেষ পর্যন্ত টেক্সপেয়ারদেরকেই বহন করতে হয়। এ কথা বলেছেন কুইবেক সিটির লাভাল ইউনিভার্সিটির হেলথ ইকনোমিকস এর অধ্যাপক মাড লাবার্গ।
তিনি আরো বলেন, ‘যতক্ষণ একজন রোগীকে অর্থ দিতে হবে না, যদি একটি ক্লিনিক সত্যিই ভাল কিছু করতে পারে তবে এ ধরণের বেসরকারী স্বাস্থ্যখাত বা বিশেষায়িত ক্লিনিক থাকলে কোন সমস্যা নেই। আর যদি রোগীকে অর্থ প্রদান করতে হয় তবে সে ক্ষেত্রে সমতার প্রশ্ন উঠে।’
স্বাস্থ্যখাত বেসরকারীকরণের সমালোচকরা আরো বলছেন, ইতিমধ্যেই থাকা বেসরকারী ক্লিনিকগুলোর কারণে স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এমনটা বলার পক্ষে যথেষ্ঠ প্রমাণ নেই। তাছাড়া এই বেসরকারী ক্লিনিকগুলো কতটা মান সম্পন্ন সেবা দিতে পারছে সেই প্রশ্নও উঠছে।
পরিদর্শনে দেখা গেছে অন্টারিওর ১৩ শতাংশ প্রাইভেট ক্লিনিক প্রাদেশিক মান পূরণ করে না। ইতিপূর্বে টরস্টার নিউজ সার্ভিসের এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কসমেটিক সার্জারি, কলোনোস্কোপি এবং ব্যথার ইনজেকশন দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে অন্টারিওর এমন ক্লিনিকগুলোর মধ্যে ২০১১ সালে সেবাদান শুরুর পর থেকে ১৩ শতাংশ ক্লিনিকেই প্রয়োজনীয় মান বজায় নেই। এই ১৩ শতাংশের মধ্যে এমন ৩.৬ শতাংশ ক্লিনিক রয়েছে যেগুলো জননিরাপত্তা বিষয়ক পরিদর্শনের মান রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে।
সমালোচকরা বলছেন, এই সংখ্যা খুবই বেশি এবং এতে করে এসব ক্লিনিকের সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। চিকিৎসায় অবহেলা বিষয়ক আইনজীবী আমানি ওয়াকলে অভিযোগ করে বলেন, ‘প্রতি সাতটি ক্লিনিকের মধ্যে একটি পরিদর্শনের মান রক্ষায় ব্যর্থ হলে বা শর্তাধীনে পাস করলে সেটা নিন্দনীয়। আপনি যেভবেই দেখেন না কেন এটি রীতিমত ব্যর্থতার পর্যায়ে পড়ে।’
কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস ইতিপূর্বে ৩৩০টি ক্লিনিক পরিদর্শন করেছে। এর মধ্যে ৪৪ টিতে মান পূরণ করার ক্ষেত্রে ঘাটতি পাওয়া যায়। পরিদর্শনে ১২টি ক্লিনিক অকৃতকার্য হয়েছে এবং ৩৩টিকে শর্তাধীনে পাসমার্ক দেয়া হয়েছে। এই ৩৩টির মধ্যে কয়েকটিকে দু’বার এমনকি তিনবারও শর্তসাপেক্ষে পাস করানো হয়েছে। (একটি ক্লিনিক একই সঙ্গে অকৃতকার্য এবং শর্তসাপেক্ষে উত্তীর্ণ হওয়ার সার্টিফিকেট পেয়েছে। এর বাইরে ২২টি ক্লিনিককে উল্লেখিত ১৩ শতাংশের মধ্যে ধরা হয়নিÑ এদেরকে শর্তাধীনে উত্তীর্ণ দেখানো হয়েছে কারণ এগুলির কোনটি নতুন এবং কোনটি নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করছে। এগুলোকে মান পূরণ না করার কারণে এই শ্রেণীতে ফেলা হয়নি।)
চিকিৎসায় অবহেলা বিষয়ক আইনজীবী পল হার্টি টরস্টার নিউজ সার্ভিসকে বলেন, ‘শর্ত ছাড়া পাস না করা ক্লিনিকের যে পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে তাতে এগুলোতে সতর্কীকরণ ঘণ্টা বাজানো উচিৎ।’ হার্টি আরো বলেন, ‘পরিদর্শনে ক্লিনিকগুলোর চেয়ে টরন্টোর রেস্টুরেন্টগুলোর অবস্থা ভালো পাওয়া যায়।’
অধুনাবিলুপ্ত গ্রিড পত্রিকার ২০১২ সালের এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, টরন্টোর জনস্বাস্থ্য বিভাগের আওতায় পরিচালিত ৮.৬ শতাংশ পরিদর্শনের ফলাফল ছিলো হয় শর্তসাপেক্ষে পাসমার্ক দেয়া অথবা বন্ধ করে দেয়ার নোটিশ দেয়া হয়েছে। মাত্র ০.১৪ শতাংশকে তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধের নোটিশ দেয়া হয়েছিলো।
হাসপাতালের বাইরের প্রাঙ্গন হিসাবে পরিচিত ক্লিনিকগুলোর তুলনা করার আরেকটি উৎস হলো হাপাতালগুলো। অন্টারিওর ১৫০টি হাসপাতালের একটিও ২০১১ সালের পর থেকে হাসপাতালের মান পরীক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাক্রিডিটেশন কানাডার পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়নি।
হার্টি বলেন, ক্লিনিকগুলোর পরিদর্শনের ফলাফল খুবই উদ্বেগজনক, বিশেষ করে যখন এই প্রদেশটি স্বাস্থ্যসেবাকে হাসপাতালের বাইরে ক্লিনিকগুলোতে নিয়ে যেতে চাইছে। ২০১০ সালে অন্টারিওতে ক্লিনিক ছিলো ২০৯টি। বর্তমানে ১ হাজারের মত ক্লিনিক চালু রয়েছে। প্রাদেশিক সরকার এই খাতটির আরও সম্প্রসারণ চাচ্ছে। ক্লিনিকগুলোতে হাসপাতালের মত ভারসাম্যমূলক ব্যবস্থা নেই এবং সমালোচকরা বলেন, অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার।
সাম্প্রতিক সময়ে ক্লিনিকগুলির
ব্যর্থতার কারণের মধ্যে রয়েছে, মেডিক্যাল ডাইরেক্টর না থাকা, চিকিৎসা সরঞ্জাম যথাযথভাবে পরিষ্কার না করা এবং জরুরী পরিস্থিতিতে জীবনসঞ্চারী ওষুধ (IV resuscitation drugs) না দেয়া।
অন্যদিকে জব এজেন্সীর মাধ্যমে সরকারী হাসপাতালগুলোতে অস্থায়ীভাবে নার্স নিয়োগ করেও বর্তমান সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। এই সকল এজেন্সীর মাধ্যমে নার্স নিয়োগ করলে প্রায় দ্বিগুন অর্থ ব্যয় করতে হয় বেতনখাতে, যার একটা বড় অংশ চলে যায় জব এজেন্সীর মালিকের পকেটে। টরন্টো স্টার সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
উল্লেখ্য যে, টরন্টো ইউনিভার্সিটি হেলথ নেটওয়ার্ক ২০১৮ সালে বিভিন্ন জব এজেন্সী মাধ্যমে নার্স নিয়োগের জন্য ১ মিলিয়নের চেয়ে কিছু বেশী অর্থ খরচ করেছিল। কিন্তু মহামারী শুরু হওয়ার পর কেবল ২০২২ সালেই এ খাতে এখন পর্যন্ত ৬.৭ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে গেছে। আর এর ৪ মিলিয়নই গেছে ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটের নার্সদের জন্য যাদেরকে জব এজেন্সীর মাধ্যমে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। টরন্টোর মাইকেল গ্যারন হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিক্যাল ডিরেক্টর ডাঃ মাইকেল ওয়ার্নার বলেন, ‘আমরা দেখেছি মহামারীর সময় এই সব জব এজেন্সীগুলো নার্স সরবরাহের জন্য অনেক বেশী অর্থ নিয়েছে। এটি লুণ্ঠনমূলক এবং শোষণমূলক।
অন্যদিকে অন্টারিও’র বেসরকারী খাতের স্বাস্থ্যসেবা সবটাই ফ্রি নয়। দন্ত চিকিৎসা এর অন্যতম প্রমাণ। এটি সত্যিই খুব বিস্ময়কর ব্যাপার যে অন্টারিওর হেলথ কেয়ার সিস্টেম পুরো শরীরই কভার করে কিন্তু মুখ এবং দাঁত কভার করে না! অথচ এই বেসিক ডেন্টাল কেয়ার কোন লাক্সারীর মধ্যে পড়ে না। ডেন্টাল কেয়ার একটি অতি প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়। এর সাথে হৃদরোগেরও সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘শরীরের যে কোনও অঙ্গের মতো দাঁতের যত্ন ও সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরী। দাঁত তুলে ফেললে পাকস্থলীর সমস্যা দেখা দেয়। সমস্যা দেখা দেয় কথা বলতে এবং শব্দ উচ্চারণ করতে। চক্ষু বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘দাঁতে কোনও ইনফেকশন হলে চোখের অপারেশন করা যায় না। আগে দাঁতের ইনফেকশন কমিয় তবেই চোখের সার্জারি করতে হয়। মুখের বিভিন্ন রোগ থেকে দেহের কিছু কিছু সাধারণ রোগ হতে পারে। দেহের প্রতিটি অঙ্গের সুস্থ্যতার জন্য উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে দাঁত সুরক্ষিত রাখতে পারলে অন্যান্য চিকিৎসার ব্যয়ভারও অনেক কমে যায়।
কিন্তু অন্টারিওতে সাধারণ খেটে খাওয়া কর্মজীবী মানুষদের জন্য জরুরী এই ডেন্টাল কেয়ারের সুযোগ নেই। ফলে কোন সমস্যা তৈরী হলে চিকিৎসকের কাছে যেতে পারেন না তারা। অসুখ জিইয়ে রাখার ফলে সমস্যা ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এবং এক পর্যায়ে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে গিয়ে ভর্তি হতে হয়। এতে করে হাসপাতালের ব্যয়ভার বৃদ্ধি পায় এবং রোগীর ভোগান্তিও বাড়ে। অথচ দেশটির নীতিনির্ধারকরা কখনোই এই বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। তবে সম্প্রতি নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান জাগমিত সিং প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর উপর এক কৌশলগত চাপ সৃষ্টি করেছেন যাতে কানাডাজুরে ডেন্টাল কেয়ার ফ্রি করা হয়। তিনি বলেছেন প্রধানমন্ত্রীকে তিনি ২০২৫ সাল পর্যন্ত সমর্থন দিয়ে যাবেন। তবে তার বিনিময়ে নিম্ম ও মধ্য আয়ের কানাডিয়ানদের জন্য চালু করতে হবে বহুল প্রতিক্ষিত ডেন্টাল কেয়ার প্রোগ্রাম।
জাস্টিন ট্রুডো প্রথমবার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পরের দুই নির্বাচেন তা পাননি। ফলে পার্লামেন্টে কোন আইন পাশ করাতে গেলে কোন না কোন বিরোধী দলের সমর্থন নিতে হয়। আর তা না হলে ক্ষমতা হারানোর সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠে। জাগমিত সিং এই সুযোগটিই নিয়েছেন। জাস্টিন ট্রুডোকে তিনি আগে থেকেই সমর্থন দিয়ে আসছিলেন। তবে এখন শর্ত দিয়েছেন। পার্লামেন্টে এনডিপি’র সমর্থন চাইলে জাস্টিন ট্রুডোকে নিম্ম ও মধ্য আয়ের কানাডিয়ানদের জন্য ডেন্টাল কেয়ার প্রোগ্রাম চালু করতে হবে। এছাড়াও আরো কয়েকটি শর্ত জুরে দিয়েছেন তিনি। এই শর্তগুলো বাস্তবায়ন করলে ট্রুডোকে তিনি পার্লামেন্টে সমর্থন দিয়ে যাবেন। শর্ত বাস্তবায়ন না করলে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিবেন। সেই ক্ষেত্রে ট্রুডো যে কোন সময় ক্ষমতা হারাতে পারেন। ফলে জাস্টিন ট্রুডো জাগমিত সিং এর শর্তসমূহ মেনে নিয়েছেন। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এনডিপি ও লিবারেল এক সাথে কাজ করার বিষয়ে একমত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর অফিস সূত্রের বরাত দিয়ে সিবিসি জানায়, প্রস্তাবিত ডেন্টাল কেয়ার প্রোগ্রাম চলতি বছরই চালু হবে শুধুমাত্র যাদের বয়স ১২ বা তার নিচে। আগামী বছর চালু হবে যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে এবং যারা সিনিয়র ও যারা চলাফেরায় অক্ষম। আর ডেন্টাল কেয়ার সবার জন্য বাস্তবায়ন করা হবে ২০২৫ সালে। এতে লাভবান হতে যাচ্ছেন নিম্ম ও মধ্য আয়ের কানাডিয়ানরা। তাঁদের সুদীর্ঘ কালের দাবী ছিল ডেন্টাল কেয়ার প্রোগ্রাম চালু করা।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রস্তাবিত ডেন্টাল কেয়ার প্রোগ্রাম সীমাবদ্ধ থাকবে সেই সকল পরিবারের মধ্যে যাদের বাসৎসরিক আয় ৯০,০০০ ডলারের নিচে এবং কর্মস্থলে ডেন্টাল কেয়ার ইন্সুরেন্স নেই। আর যে সকল পরিবার বা ব্যক্তির বাৎসরিক আয় ৭০,০০০ ডলারের নিচে তাঁদের ডেন্টাল কেয়ার সম্পূর্ণভাবে কভার করবে সরকার।
এদিকে অন্টারিওতে ড্যাগ ফোর্ড এর নেতৃত্বাধীন বর্তমান প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ সরকার স্বাস্থ্যখাতের সেবা আরো বেশী মাত্রায় বেসরকারীকরণ করা হবে বলে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার বিরুদ্ধেও হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন জাগমিত সিং। শুধু ড্যাগ ফোর্ডের বিরুদ্ধেই নয়, অন্যান্য যে সকল প্রভিন্স এই একই রকম সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধেও তিনি একই হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন আমরা এ ধরণের পদক্ষেপ মেনে নিতে পারি না। গত সপ্তাহে টরন্টোতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, করদাতাদের অর্থ ব্যয় করতে হবে হাসপাতালে পরিষেবার মান উন্নয়নের জন্য এবং সরকারী হাসপাতালে কর্মরত ব্যক্তিদেরকে প্রতিযোগিতামূলক বেতন প্রদানের জন্য। এই অর্থ স্বাস্থ্যখাতের বেসরকারী ব্যবসায়ীদের পকেট ভারি করার জন্য নয়।
তিনি বলেন, ‘এটি এখন খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে আমরা স্বাস্থ্যখাত নিয়ে একটি খুব গুরুতর সংকটে রয়েছি। আর এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় কয়েকটি প্রভিন্সের প্রিমিয়ারগণ মিলে তাদের ভাষায় সৃজনশীল সমাধানের কথা বলছেন। তাদের সেই সৃজনশীল সমাধান হলো স্বাস্থ্য-পরিচর্যা ব্যবস্থাকে বেসরকারীকরণ করা। আমরা এটি হতে দিতে পারি না। কারণ এর মাধ্যমে জনগণের অর্থ আমাদের প্রিয়জনদের যত্নে ব্যয় না হয়ে যাবে ধনী করপোরেশনগুলোর পকেটে।