‘সব রৌদ্র ফিরে যায় না’

জসিম মল্লিক

সময়টা দুপুর। ইষ্টইয়র্ক মলের মধ্যে হাঁটছিলাম হঠাৎ একজন হেজাব পড়া নারী আমার মুখোমুখো হয়ে গেলেন। অনেকটা পথ আটকে দাঁড়ালেন। নারীর মুখটা কোনোরকম দেখা যায় কি যায় না। কোলে একটা শিশু। বুকের সাথে বেল্ট দিয়ে বাঁধা। যেনো একটা খেলনা নিয়ে ঘুরছেন। ছয় সাত বছরের নাদুস নুদুস একটা ছেলেও আছে সাথে। মায়ের সাথে সাথে ঘুরছে। মায়ের বডি গার্ডের মতো লেপ্টে আছে। এদেশে বারো বছর না হলে বাচ্চাদের একলা ঘরে রেখে আসা যায় না। যদি কেউ ঘরে থাকে সমস্যা নাই। আমি বের হয়েছিলাম প্রিন্টারের কাগজ কিনব এবং ফুল সাইজ এনভেলাপ। এদিকে কয়দিন থেকে ডেক্সটপে বাংলা ফন্ট কাজ করছে না ঠিকমতো। লেখালেখি কার্যত বন্ধ। অরিত্রি নতুন আরো একটা ল্যাপটপ গিফট করেছে সেটাও ইন্সটল করতে পারি নাই। কম্পিটিউটার ইউজ করি বটে কিন্তু এর নো হাউ কিছুই জানি না। কিছু হলে মাথা গরম হয়ে যায়। কেনো বিজয় ফন্ট ভৌতিক আচরন করছে বুঝতে পারছি না। অনেক বছর আগে মোস্তফা জব্বার সাহেব যখন মন্ত্রী ছিলেন না তখন একবার তার সাথে আমার সমস্যা নিয়ে কথাও বলেছিলাম। তিনি চমৎকারভাবে আমার সমস্যা সলভ করে দিয়েছিলেন। এখন মন্ত্রী মহোদয়দের প্রটোকল জানি না।

অর্ক বা অরিত্রি আগে খুব হেল্প করত। যখন তখন ওদের হেল্প চাইতাম। অর্ক চলে গেছে দূরে। আগের মতো ফোন করে পাই না। দিনেরবেলা অফিস নিয়ে বিজি থাকে। ফোন ধরবে না হয়ত। একদিন বলেছিলাম, তুমি তো দূরে চলে গেছো। চাইলেই পাই না তোমাকে। অর্ক কথাটার উত্তর দেয় নাই, চুপ করে ছিল। মনে হয় একটু মন খারাপ হয়েছে। মনে হয় একটু অপরাধবোধ হয়েছে। অর্ক নরম মনের মানুষ। অরিত্রি এখন টরন্টোতে নাই। ভ্যাকেশনে গেছে মায়ামী। ওখান থেকে গেছে আটলান্টা জর্জিয়া হাজবেন্ডের ওখানে। রোববার ফিরবে। যদিও বাংলা ফন্টের ব্যাপারে অর্ক বা অরিত্রি তেমন সাহায্য করতে পারবে না। তাই আইটি বিশেষজ্ঞ নয়ন সরকারকে কয়দিন থেকে ফোন করছি। নয়ন বিজি মানুষ আমি জানি। প্রায়ই টরন্টো থাকে না। নয়নকে না পেয়ে আমার বন্ধু সিনাকে বললাম সমস্যার কথা। সিনা প্রতিবার অসীম ধৈর্য্য নিয়ে আমার সব সমস্যা শুনবে। তারপর সমাধান করে দেবে। এবারও তাই হলো। সমস্যা সাধারণ। কিন্তু আমার কাছে পাহাড়সম। বাংলা ফন্ট কাজ করছে! এই লেখাও লিখতে পারছি।

শপিং সেন্টারে যাব জেসমিন জানত তাই কাজ থেকে ফোন দিয়ে অর্ডার দিয়েছে কিছু গ্রোসারি লাগবে। বাজার করার কথা বললেই আমার জ্বর আসে। বড় বড় গ্রোসারি স্টোরে ঢুকলে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। কোথায় কোনটা থাকে আজও বুঝে উঠতে পারিনা। তাই আমি সাধারণতঃ বাজার এভোয়েড করি। জেসমিন আমাকে কখনও বাজারে পাঠিয়ে ভরসা পায় না। ও জানে আমি নিশ্চিত ঠকে আসব। ছোটবেলায় আমার মাও তাই মনে করত। কখনও কিছু কিনতে দোকান পাটে পাঠাত না। যদিওবা পাঠাত আমি ভুল জিনিস নিয়ে আসতাম। মা রাগ করে বলত, যাও ফেরত দিয়া আসো। আমার নিজের জন্যও যদি কিছুর দরকার হয় প্রায়শই অরিত্রিকে বলি। অরিত্রি একেবারে সঠিক জিনিসটা আনিয়ে দেয়। জেসমিন সবসময় বিশ্বাস করে আমি সঠিক জিনিসটা আনতে পারব না। আসলে আমাকে এতোটা আন্ডারএস্টিমেট করা ঠিক না। খুঁজে পেতে ঠিকই আনতে পারব। একটু এদিক ওদিক হতে পারে এই যা। জেসিমনও অনেক ভুলভাল জিনিস কিনে নিয়ে আসে। তারপর রিটার্ণ করে। আমি সবসময় নিজের নিরাপত্তার জন্য বাজারের ট্রলি নিয়ে জেসমিনের পিছন পিছন ঘুরি।

জেসমিনের বিশেষ আস্থা নাই আমার উপর। কোনো কিছুতে আমার উপর ভরসা করে বলেও মনে হয় না। ওর বিশ্বাস আমি কিছুই পারি না। বাজার করতে পারি না, কাপড় কিনতে পারি না, ড্রাইভ করতে পারি না, গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, আমি লিখতে পারি না, কাউকে ম্যানেজ করতে পারি না। বুদ্ধিসুদ্ধি কিছু নাই আমার। আমি ব্যর্থ লোক। কথাটা সত্য বটে। প্রকারন্তরে আমাকে ব্যর্থই বলা যায়। মোটাদাগে সফলতা বলতে মানুষ যা বোঝে, দামী গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স সেসব আমার নাই। অন্যদের কথা জানি না তবে আমার শশুরবাড়ির লোক, আমার কতিপয় আত্মীয় ও বন্ধুদেরও এমন ধারণা আমার সম্পর্কে। আমি যে ব্যর্থ লোক সেটা আমি জানি। তাই এটা নিয়ে আমার বিশেষ মন খরাপ লাগে না। অনুশোচনা হয় না। আমি সফলও নই, মেধাবীও নই, মানুষের টুকচাল ধরতে পারি না। যে কেউ আমাকে উপেক্ষা করতে পারে। সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে। আমি কিছু চাইলে মুখের উপর না করতে পারে। কথা দিয়েও কথা না রাখতে পারে। আমার কোনো ক্ষমতাও নাই। আমার কথায় কিছুই হয় না।

কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় আশ্রয় আমার ছেলে মেয়ে। তাঁরা আমাকে অনেক ভ্যালু করে, আইডল মনে করে, আমার সবকিছুতে সায় থাকে। কখনও অভিযোগ করে না, দোষ ধরে না, তর্ক করে না। ভুল করলেও বলে না বাবা এটা ভুল হইছে। আমার সবকিছুতে প্রাউড ফিল করে ওরা। সেদিন অর্ককে ফোন করে বললাম, আব্বু, আমার নিউইয়র্ক এবং টরন্টো বইমেলা খুবই ভাল হয়েছে। আমার একার বইই প্রায় ৭৫০ ডলার বিক্রী হয়েছে।

টরন্টোর বইমেলায় লেখক ও তার স্ত্রী। ছবি : প্রবাসী কণ্ঠ

অর্ক শুনে মহা খুশী। ওয়াও বাবা। কনগ্রেচুলেশন।

অরিত্রিও খুব অভিনন্দিত করল মায়ামি বসে। জেসমিনকেও বললাম, আমার বই ভাল চলেছে। জেসমিন কোনো রিএ্যাক্ট দেখায় না বটে কিন্তু আমি নিশ্চিত ভিতরে ভিতরে খুশী হয়। আমার সাংবাদিকতার গুরু শামীম আজাদ কানাডা সফরে এসেছেন। হেমিল্টনে ভাইয়ের কাছে আছেন। কালকে ফোনে আমরা অনেক গল্প করছিলাম। তিনি এবার সফরে বের হয়েছেন কোনো সম্বর্ধনা নিতে না। তার পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। আইডিয়াটা আমার পছন্দ হয়েছে। আমার জীবনের স্ট্রাগলের বিরাট স্বাক্ষী শামীম আজাদ। তাকেও বললাম বইয়ের কথা। একটু পরেই তিনি লিখলেন, জসিম, মনটা ভরে গেলো তোমার বইয়ের গল্প শুনে।

একটা মজার গল্প বললেন শামীম আপা। আশির দশকের কথা। তখন প্রায়ই ঈদের সময় বরিশাল যেতে পারতাম না। লঞ্চভাড়া থাকত না। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেই একলা দিন পার করতাম। নামাজও পড়তে যেতাম না। সেবার ঈদের দুইদিন আগে শামীম আপার পরিবাগের বাসায় গেলাম। বিচিত্রা ঈদ ফ্যাশনের কাজ শেষ হয়েছে। আমিও তার ফ্যাশন প্রজেক্টের একজন কর্মী। পত্রিকা বাজারে। ফেরার পথে তিনি আমার পকেটে একশ টাকার একটা নোট গুঁজে দিলেন। বললেন, পাঞ্জাবী কিনে নিও। সেই পাঞ্জাবী পড়ে ঈদের নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম ঢাকা ইউনিভার্সিটি মসজিদে। জীবন এমনই। আমি ঢাকা এসেছিলাম লেখালিখি করব বলেই। লেখালেখি আমাকে অনেক দিয়েছে। লেখা আছে বলেই জীবনের অন্য দুঃখ বা না পাওয়া আমাকে স্পর্শ করে না তেমন। লেখালেখির জীবনে আমি একলাই পথ চলেছি। আমি কারো কাছে কোনো কিছুর জন্য হাত পাতিনি। লেখা প্রকাশের জন্য কোনো সম্পাদকের দ্বারস্থ হইনি। আমি সামান্য একজন লেখক হলেও আমার প্রাপ্তি অসাধারণ।

মলের মধ্যে পথ আটকে দাঁড়ানো নারীটি বললেন,

-আপনি জসিম মল্লিক না!

আকস্মিক অচেনা একজন নারীর মুখে নামটা শুনে আমি একটু বিচলিত হলাম। মুখে মাস্ক ছিলনা বলেই হয়ত সহজে চিনে থাকতে পারেন।

হেসে বললাম, হ্যাঁ কিভাবে চিনলেন! আমি নিজের অজান্তেই আমার গেটআপের দিকে তাকাই। মনে মনে বলি, এরপর থেকে বাইরে বের হলে আরো একটু ভালভাবে বের হতে হবে।

-আমি আপনার লেখা পড়ি। খুউব ভাল লাগে।

এইসব ক্ষেত্রে কি বলতে হয় আমি ভুলে যাই। আমার জীবনে এমন প্রায়ই হয়। প্রশংসার উত্তর কিভাবে দিতে হয় বুঝতে পারি না। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে।

-ওহ অনেক ধন্যবাদ।

-বিসিসিতে আপনার লেখা পড়ি। এতো বাস্তববাদী লেখা। মনে হয় যেনো আমারই কথা লিখছেন। কিভাবে লেখেন মানুষের মনের কথা!

আমি আবারও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।

তিনি বললেন, আমি সাসকাটুন ছিলাম, দুই বছর হয় টরন্টো এসেছি। তারপর ছেলেকে বললেন, আঙ্কেলকে সালাম কারো।

আমার ধারণা ছিল নারীরাই আমার লেখার বড় পাঠক। তারাই আমার বই বেশি কেনেন। কিন্তু আমার ধারনা ঠিক না। পুরুষরাও আমার বই কেনেন। এবার টরন্টো বা নিউইয়র্ক বইমেলায় এমনটাই দেখা গেছে। অনেকে বই কিনেননি বটে কিন্তু আমার লেখা পড়েন। যাদের সাথে কখনও দেখা হয়নি এমন অনেকেই এসেছিলেন আমার সাথে দেখা করতে। টরন্টো বইমেলার দ্বিতীয়দিন একজন সুদর্শন তরুণ এসে বললেন, আমি শুধু আপনাকে দেখতেই এসেছি। আপনাকে সামনা সামনি দেখতে পাওয়া বিরাট আনন্দের। নিউইয়র্ক বইমেলায়ও এমনটা ঘটেছে। প্রতিবারই এমন হয়। একটা ঘটনা বলি। মেলার তৃতীয়দিন। আমি ইত্যাদির স্টলে বসা। ইত্যাদির কর্ণধার জুয়েল ভাই আমার পাশেই। আমার পরবর্তী বই প্রকাশ নিয়ে কথা হচ্ছিল।

এমন সময় একজন বয়ষ্ক নারী আমার কাছে আসলেন।

বললেন, আমি আপনার সাথে একটু কথা বলব।

আমি বিনয়ের সাথে বললাম, জ্বি বলুন।

তিনি বললেন, আমি অনেকদূর আপস্টেট থেকে এসেছি শুধু আপনাকে দেখতে। আমি কি একটু আপনার হাতটা ধরতে পারি!

আমি হেসে বললাম জ্বি পারেন।

তিনি আমার হাত ধরে থেকে বললেন, আপনার মা নিয়ে লেখাগুলো পড়লে আমার চোখে শ্রাবনের ধারা নেমে আসে। আমি নিজেকে সামলাতে পারি না। আপনার ছেলে মেয়ে বা স্ত্রীকে নিয়ে লেখা পড়লেও আমার চোখে জল আসে। এতো আবেগ, এতো মায়া, এতো ভালবাসা থাকে লেখায়। একটু পর আবিষ্কার করলাম আমার চোখ ভিজা।

আমি জানি আমার অনেক ব্যর্থতা। অনেক কিছুই পাইনি আমি। অনেক কিছুই পাবো না। এক জীবনে সবাই সব পায় না। সব পাওয়া উচিতও না। সব পেয়ে গেলে জীবনের আনন্দই মাটি হয়ে যেতো। এইসব তুচ্ছ বস্তগত চাওয়া পাওয়া নিয়ে আমার কোনো আদিখ্যেতা নাই। যা পেয়েছি তাওতো কম না। সবচেয়ে বেশি পেয়েছি মানুষের ভালবাসা। সামান্য উপেক্ষা আর অবহেলা ভালবাসার কাছে হার মেনেছে। লেখালেখি আছে বলেই মানুষের সাথে আত্মার মিলন ঘটেছে। নিজের কান্না অপরের কান্নার সাথে মিলেছে। নিজের আনন্দ অপরের আনন্দের সাথে ভাগাভাগি করতে পেরেছি।

আবুল হাসানের কবিতার লাইন দিয়ে শেষ করছি,

‘সব রৌদ্র ফিরে যায় না, লুকিয়ে থাকে

রাতের ফাঁকে যেমন তুমি

কোথায় ছিলে? কোন পাহাড় কোন পোস্টাফিসে

চিঠির মতো।’

বন্ধুত্ব ও প্রেম!

আমি সহজে কারো ফেবার চাইতে পারি না। বিশেষকরে আত্মীয় সম্পর্কিত কারো কাছে ফেবার চাইতে আমার অনেক সঙ্কোচ হয়। দ্বিধার পাহাড় এসে সামনে ভর করে। কিছু চাওয়ার ব্যাপারে ভাইবোনদের কাছেও আমি স্বাচ্ছন্দবোধ করি না। যদি আমার কখনও সামান্য ক্ষুদের ভাত খেতে ইচ্ছা করে তাও বলতে আমার লজ্জা লাগবে। দ্বিধা কাজ করে। মায়ের কাছেও আমি সহজে কিছু চাইতাম না। মা বলতেন তুমি তো কখনও কিছু চাও না। আমি বলতাম চাইতে আমার ভাল লাগে না। মা বলতেন, না কানলে মায়েও দুধ দেয় না বোজছ!

চেয়ে না পাওয়ার অপমান আমি সহ্য করতে পারব না। আমাকে কেউ না বলুক তা আমি একদম নিতে পারি না। প্রত্যাখ্যান আমার সহ্য হয় না। তা সত্বেও জীবনে আমি কি প্রত্যাখ্যাত হইনি! অনেকই হয়েছি। এখনও কি হই না! হই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার অর্ধেক জীবন গ্রন্থে বলেছেন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সম্ভাবনা আছে এমন কারো কাছে কখনও চুম্বন প্রার্থনাও করিনি। আমিও জীবনে কাউকেই প্রেম প্রার্থনা করিনি যদি প্রত্যাখ্যাত হই এই ভয়ে। কখনও প্রেম ও বন্ধুত্বকে এক করে ফেলিনি।

আত্মীয় বা স্বল্প পরিচিত কারো কাছ থেকে কখনও যদিওবা কোনো ফেবার নেই চেষ্টা করি তার দ্বিগুন ফেরত দিতে। কেউ একবার আমাকে না বললে কখনও তার কাছে যাই না। কেউ একবার মুখ ঘুরিয়ে নিলে আর সেখানে নিজেকে যেচে উপস্থাপিত করতে পারি না। একবার মন ভেঙ্গে গেলে সে মন আর জোড়া লাগে না। এর মানে এই না যে তার সাথে আমার সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। এর মানে এই না যে সে আমার শত্রু হয়ে গেছে। শুধু হৃদয়ের ভিতরে তার জন্য যে স্থান ছিল সেটাই আর থাকে না।

আমি শুধু আমার বন্ধু আর সন্তানদের কাছে নির্দ্বিধায় যে কোনো আবদার করি। দাবী প্রতিষ্ঠা করি। বন্ধুদের জোড় করি, ঝগড়া করি, রাগ দেখাই। তবে সবার সাথে না। আসল বন্ধুর পাশাপাশি ফেক বন্ধুও আছে। লোক দেখানো বন্ধুত্ব আমি করতে পারি না। যারা আমার স্বভাব জানে তারা আমাকে মেনে নেয়। আমার সন্তানরাও তাই। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয় বটে কিন্তু আমার সবকিছু মেনে নেয়।

ভার্চুয়াল হলেও আমার অনেক ফেসবুক বন্ধুর সাথেও আমি অনেককিছু শেয়ার করি। তাদের কাছে অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলি, জানতে চাই এবং অনেকেই আমাকে গ্রহন করে, সহযোগিতা করে। বিদেশে গিয়ে আমি কখনও আত্মীয়দের কাছে যাই না। কোনো হেল্প নেই না। বন্ধুদের কাছে যাই। তারাই আমার জন্য সব করে দেয়। অনেকেই আমাকে আগে দেখেনি, এমন মানুষও আছে। কখনও দেখা হবে না এমন মানুষের সাথেও সখ্যতা হয়। তারাও আমার অনেক কথা মন দিয়ে শোনে।

কোনো তথ্য জানতে চাইলে নির্দ্বিধায় তথ্য দেয়। আমি চাই বন্ধুরা আমার উপর আস্থা রাখুক। আমাকে বিশ্বস্ত ভাবুক। ঢাক ঢাক গুড় গুড় নাই আমার মধ্যে। আমি হচ্ছি খোলা বই। আমি কখনও কারো প্রাইভাসি ভঙ্গ করিনা। আমি নিজের ক্ষতি মেনে নিয়েছি কিন্তু আমার দ্বারা কারো ক্ষতি হতে দেইনি। বছরের পর বছর আমি দোষ মাথায় নিয়ে ঘুরেছি কিন্তু অন্যের উপর দোষ চাপাইনি। বন্ধুরাই আমার প্রেরনা, আমার শক্তি।

এই যে মানুষ মুখে একটা মনে একটা…

পৃথিবীতে দুই ধরণের মানুষের বসবাস। এক ধরণের মানুষ আছে যারা শুধু নিজেকে ভালবাসে, নিজের জন্যই সব করে, নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য সব ধরণের কুটকৌশল করে। বুদ্ধির প্যাঁচে হোক আর কথার প্যাঁচে অন্যকে ফাঁদে ফেলে নিজেরটা আদায় করে নেয়। অন্যের দূর্বলতা আর ইমোশনকে কাজে লাগিয়ে ঘায়েল করে ফেলে। এই ধরণের মানুষেরা খুবই একচোখা, আত্মসুখস্বর্বস্ব। তাদের কোনো কিছুতে আটকায় না। তারা খুবই সাবলিলভাবে অন্যেরটা নিজের করে নিতে পারে। তারা প্রচন্ড মেধাবী, চৌকশ ও চতুর। এঁদের সাথে একদম পেরে উঠা যায় না। সারাক্ষণ অন্যকে ফাঁদে ফেলার ধান্ধায় থাকে। এঁদের হাত থেকে কারো রেহাই নাই। বন্ধু, আত্মীয়, ভাই, বোন, সহকর্মী ,মা বাবা কারো না। সুযোগ পেলে সবাইকেই জবাইকে করে ফেলে এবং এঁরাই জীবনে সফল হয়। সবকিছু অর্জন করে নেয়। সুখে থাকে। সাফল্য পায়।

আর এক শ্রেণী আছে শুধু অন্যকে নিয়ে ভাবে। অন্যের কিভাবে ভাল করা যায় এই চিন্তায় ঘুম হারাম তাদের। নিজের সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে হলেও অন্যের জন্য কিছু করতে হবে। কিছু করতে পারার মধ্যেই যেনো আনন্দ। যারা অন্যের জন্য করে তারা বিনিময়ে কিছু চায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের কপালে লাঞ্চনা আর সমালোচনা জোটে। তাও তারা করতে চায়। মানুষের স্বভাবই এমন। আমার মধ্যেও এই স্বভাব আছে। সবসময় অন্যের জন্য ভাবি আমি। কেউ কিছু সাহায্য চাইলে উপেক্ষা করতে পারি না। চোখ বন্ধ করে থাকিনা। অনেক সময় গায়ে পরেও করতে যাই। কেউ দেশ থেকে আসবে আমার কাছে বাসা ভাড়া করে দেওয়ার আবদার আসে। আমি করে দেই। না হয় তথ্য দেই। জব পায় না, আমি চেষ্টা করি খুঁজে দিতে। সেটা দেশে যেমন বিদেশেও। আমার ক্ষমতা অতি সীমিত তাও অন্যের কাছে ধর্না দেই। প্রয়োজনে টাকা পয়সা দিয়েও সাহায্য করি।

অনেকেই আমার কাছে অন্যের সম্পর্কে জানতে চায়। আমি দারুণ প্রশংসা করে তথ্য দেই। যোগাযোগ ঘটিয়ে দেই। বিয়ের পাত্রপাত্রীও আছে এর মধ্যে। লেখক, সাংবাদিকও আছে। আছে চাকরিপ্রার্থী। কাউকে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হয় না। আমি প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে চাই না। কারো প্রশংসা করতে আমার ভাল লাগে। আমি মন খুলে অন্যের প্রশংসা করতে পারি, কাউকে নিয়ে লিখতে পারি। আমি সহজে আমার লেখায় কারো নিন্দা করি না, সমালোচনায় মুখর হইনা। আড়ালে বদনাম করি না। কাউকে অপছন্দ হলে এড়িয়ে চলি। কিন্তু মুখ দেখা বন্ধ বা শত্রু মনে হয় না। আমার সোশ্যাল ওয়ার্কের জন্য জেসমিনকে অনেক জ্বালাতন সহ্য করতে হয়। কারো জন্য কিছু করতে হলে কিছু ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে। কিছু বোকা মানুষ সবসময় থাকবে পৃথিবীতে। আমার মা বলতেন জসিম, মানুষের জন্য যতটুকু পারো কইরো। টাকা পয়সা দিয়ে না পারলে বুদ্ধি দিয়ে, তা না পারলে গায়ে খেঁটে।

আমি স্বীকার করি আমার অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি আছে। অনেক ভুল আছে। অনেক অন্যায় আছে। আমিও যে স্বার্থপর হইনা তা না। হই। আমিও অনেক ভুল করি। আমারও রাগ, ক্ষোভ, অভিমান এসব আছে। সবাই কোনো না কোনো ভাবে স্বার্থপর হয়। আমিও হই। আমিও নিজের ভালটা দেখি। নিজের স্বার্থ দেখি। কিন্তু অন্যের জন্যও মায়া অনুভব করি, কারো একটু ভাল হোক সেটা চাই। বিনিময়ে কখনও কিছু প্রত্যাশা করি না। এমনকি প্রশংসাও না।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমি নিজেকে তুলে ধরতে পারি না। অন্যেরা যেভাবে নিজেরটা আদায় করে নেয় আমি সেটা পারি না। আমি সহজে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি না। প্রায়ই অন্যের দৃষ্টির আড়ালে থেকে যাই। সহজেই যে কেউ আমাকে উপেক্ষা করতে পারে। আমার একটা অনুরোধ সহজেই কেউ না বলতে পারে। আমার আত্মীয়রাই আমাকে উপেক্ষা করে বেশি। তখন আমি কিছুই করতে পারি না। অসহায় হয়ে দেখি শুধু।

কষ্টগুলো ছাপ ফেলে যায়

মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কগুলো নিয়ে আমি অনেক চিন্তা করি। গভীরভাবে ভাবায় আমাকে। নির্ঘুম রাত পার হয় আমার। মানুষের মনোজাগতিক বিষয় নিয়ে অনেক চর্চা করি। রিলেশন ইস্যুজ আমার প্রিয় বিষয়। মানুষ আসলে এক বিস্ময়কর প্রানী। এমন রহস্যময় প্রানী আর নাই পৃথিবীতে। মানুষ কখন কেমন আচরণ করবে কেউ বলতে পারে না। এমনকি সে নিজেও জানে না সে কেমন। পরমুহূর্তে কেমন থাকবে। প্রকৃত আমিটাকে চেনা যায় না। চিনতে পারলে ভাল হতো। আমাদের সম্পর্কগুলো তেমনি রহসম্যময়। প্রতিমুহূর্তে ভাঙচুর হয়। বদলে যায়। সকালে এক রকম, বিকেলে অন্যরকম। আজ প্রেম, কাল ঘৃণা। এই ভালবাসা, এই উপেক্ষা। আজ বুকে তুলে নেয়, কাল ছুঁড়ে ফেলে। ভেঙ্গে যায় সবকিছু। ভেঙ্গে যায় প্রেম, ভেঙ্গে যায় স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক, ভেঙ্গে যায় ভাই বোনের সম্পর্ক, ভেঙ্গে যায় বন্ধুত্ব।

পঞ্চাশ বছর একসাথে ঘর করার পরও কেউ কাউকে বোঝে না। কেউ কারো আপন হয় না। পরষ্পরকে একদিন ছেড়ে চলে যায়। সবচেয়ে মধুর যে ভাই বোনের সম্পর্ক তাও স্বার্থের সংঘাতে ভেঙ্গে যায়। মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়। এতো যে বিশ্বাস, আস্থা আর ভালবাসায় গড়ে উঠা বন্ধুত্ব তাতেও একদিন চির ধরে। তুচ্ছ স্বার্থের সংঘাতে বন্ধু আর বন্ধু থাকে না, আত্মীয় থাকে না আত্মীয়। আমার নিজের জীবনে অনেক ঘটনা ঘটে প্রতিনিয়ত। আমি কষ্ট পেলেও সহজে কারো সাথে সম্পর্ক নষ্ট করি না। ছোট খাট ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখি, মেনে নিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করি। নিজের স্বার্থটা বড় করে দেখি না। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে নিজেকে একধাপ নিচে নামিয়ে আনতে হয়, স্বার্থত্যাগ করতে হয়। ভাঙ্গা অনেক সহজ, গড়া কঠিন। ভাঙ্গনকে আমি ভয় পাই।

মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কগুলো প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটে। কোনো সম্পর্কই স্থায়ী না। কেউই প্রকৃতপক্ষে আপন না। নিজেই নিজের আপন। আসলে নিজের চেয়ে ভাল বন্ধু আর নাই। তাই প্রতিটা মানুষের একবার হলেও নিজের মতো বাঁচা উচিত, নিজের জন্য বাঁচা উচিত। কারো কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা করা উচিত না। সবকিছুর জন্য তৈরী থাকাই সভ্যতা। মনে রাখবেন অনেক না পাওয়া আর গ্ল­ানির মধ্যেও হঠাৎ আলোকচ্ছটার মতো এক টুকরো ভালবাসা জীবনে এসে ধরা দেয়। এটাই জীবনকে সতেজ রাখে। বাঁচার প্রেরণা দেয়। পৃথিবীতে কেউই অনিবার্য নয়, কিছুই অনিবার্য নয়। একজন কেউ ছেড়ে গেলেও, ঘৃণা আর উপেক্ষা দিলেও সেই শূন্যস্থান পূরন হয়ে যায়। প্রকৃতির নিয়মেই হয়। তা না হলে মানুষ বাঁচতেই পারত না। শুধু কষ্টগুলো ছাপ ফেলে যায়।

জসিম মল্লিক

কথা সাহিত্যিক ও কলামিস্ট

টরন্টো