রোহিঙ্গা সংকটের পাঁচ বছর
রোহিঙ্গা সংকটের পাঁচ বছর পূর্তি হলো গত ২৫ আগস্ট। ২০১৭ সালের এই দিনে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরু হলে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এর আগেও কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছিল মিয়ানমার সরকারের অত্যাচারের শিকার হয়ে। সব মিলে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা এখন ১২ লাখের অধিক বলে ধারণা করা হয়।
বাংলাদেশ এখন রোহিঙ্গার ভারে জর্জরিত। গত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অবস্থানজনিত সংকটটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানাভাবে আলোচিত হয়েছে। জাতিসংঘেও এ সংকট নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গারও প্রত্যাবাসন হয়নি। আর এর চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রোহিঙ্গা সংকটের প্রতি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের নজরও কমে গেছে। তারা সবাই এখন ব্যস্ত ইউক্রেনের শরণার্থীদের নিয়ে।
তবে কিছুটা আশার আলো দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দেশটি কদিন আগে। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপর দমন অভিযানের পাঁচ বছর পূর্তিতে দেওয়া বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন একথা বলেছেন। তবে কবে থেকে এবং কত সংখ্যক রোহিঙ্গাকে যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়া হবে সে বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি।
উল্লেখ্য যে, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর বিশেষ দূত বব রে ইতিপূর্বে মিয়ানমারে জাতিগত নিধনের শিকার রোহিঙ্গাদের কানাডায় আশ্রয় দিতে সুপারিশ করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের শিবির পরিদর্শনেও গিয়েছিলেন। কিন্তু রোহিঙ্গা শরণার্থী গ্রহণের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণার পর কানাডা এখনো এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলেনি।
এদিকে গত পাঁচ বছরে মিয়ানমারের আচরণে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, তারা বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে একেবারেই আগ্রহী নয়। আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আমলে নিয়ে ইতিপূর্বে অন্তর্বর্তী একটি রায় দিলেও দেশটি সেই রায়ের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আসছে। বস্তুত মিয়ানমার এক চরম স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক রীতিনীতির কোন ধারই ধারছে না। এমন অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর ও জোরালো চাপের বিকল্প নেই। পাশাপাশি বাংলাদেশের উপর চাপ কমানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মতো অন্যান্য ধনী দেশও এগিয়ে আসতে পারে শরণার্থী গ্রহণের ব্যাপারে। এগিয়ে আসতে পারে কানাডাও।
বর্তমানে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি উত্থাপিত হচ্ছে তা হলো, বাংলাদেশ আর কতদিন রোহিঙ্গাদের ভার বহন করতে পারবে? আমরা মনে করি, আর্থিক সহায়তা রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান নয়। স্থায়ী সমাধান হলো স্বদেশে তাদের প্রত্যাবাসন। আর তাই রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে পৌনঃপুনিকভাবে আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে চীনকে একটি বড় ভূমিকা রাখতে হবে। মিয়ানমারের স্বেচ্ছাচরিতার বিষয়ে চীনকে তার নীরব সমর্থন প্রত্যাহার করতে হবে। তা না হলে মিয়ানমারের এই স্বেচ্ছাচারিতা ও মানবতাবিরোধী কার্যক্রম বন্ধ হবে না।
কয়েকদিন আগে অবশ্য চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এসে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তার ও তার দেশের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। তবে এই ‘আগ্রহ’ নিছক কূটনৈতিক বক্তব্য কি না তাও খতিয়ে দেখতে হবে। মূল কথা হলো-রোহিঙ্গা সংকট আরও দীর্ঘায়িত করার কোনো সুযোগ নেই। চীনসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে উচিৎ হবে যতটা দ্রুত সম্ভব এ সংকট থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য এগিয়ে আসা। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন ও তাদের মানবিক অধিকার ফিরিয়ে আনার ব্যাপারেও এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। আমরা মনে করি এ ব্যাপারে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে কানাডাও।