টরেটক্কা টরন্টো

চীন-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক -৫

কাজী সাব্বির আহমেদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

সত্তুর কিংবা আশির দশকে চীনের কম্যুনিস্ট সরকারের কোন নীতির বিরুদ্ধে সরাসরি কোন আন্দোলন করার কোন সুযোগ ছিল না। কালচারাল রেভ্যুলেশনের সময় ‘রেড গার্ড’ সাধারণ মানুষকে এমনই তটস্থ করে রাখত যে, মাও সেতুং কিংবা কম্যুনিস্ট পার্টির হাই কমান্ডের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করার সাহস কারো ছিল না। সেই সময় দেশ পরিচালনার জন্য মাও সেতুং-এর নির্দেশনাগুলিকে অনেকটা দেববাক্য বলে বিবেচিত হত। সেগুলিকে আবার মাও সেতুং-এর বাণী হিসেবে ‘রেড বুক’-এ সংরক্ষণ করা হত এবং দেশের জনগণকে অনেকটা তোতা পাখির মতন করে সেই বাণীগুলিকে নিয়মিত আওড়াতে হত। কঠিন নিয়মের এক অদৃশ্য বজ্র আঁটুনিতে সবাই যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। এমন কি পার্টির লিডারদেরও এই বজ্র আঁটুনির বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। কালচারাল রেভ্যুলেশনের শেষ পর্যায়ে দেশের জনগণ যখন ‘গ্যাং অব ফোর’-এর অত্যাচারে অতিষ্ঠ, তখন তাদের মুখ ফুটে সেই কথা বলার কোন সুযোগ ছিল না। সেই সময় চীনের জনপ্রিয় প্রিমিয়ার চৌ এনলাই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার মৃত্যুতে জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে শোক প্রকাশের মাধ্যমে প্রকারন্তে ‘গ্যাং অব ফোর’-এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল। এটাই ছিল তখনকার চীনা জনগোষ্ঠীর কম্যুনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার একমাত্র পথ। সেই পথ অনুসরণ করেই ১৯৮৯ সালে ছাত্ররা হু ইয়াওপাং-এর মৃত্যুতে শোক প্রকাশের জন্য ‘থিয়েন আন মেন’ চত্বরে স্বতস্ফূর্তভাবে জড়ো হয়। তাছাড়া প্রফেসর ‘ফাং লিট্রি’ যখন চীনের জনগণের জন্য অধিকতর ‘হিউম্যান রাইটস’ আদায়ের জন্য প্রকাশ্যে সরকারকে চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন অথচ সরকার তার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না, তখন ছাত্ররা ধরে নিয়েছিল যে সরকার জনগণকে তাদের মতামতকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয় নীতি গ্রহণ করেছে। তাদের ধারণা আরও দৃঢ় হয় যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ যখন ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ‘গ্রেট ওয়াল শেরাটন’ হোটেলে এক বর্ণাঢ্য নৈশভোজের আয়োজন করেন তখন সেই নৈশভোজে অন্যান্য পাঁচশত অতিথির মাঝে প্রফেসর ফাং লিট্রি-ও একজন আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন, যা কিনা কম্যুনিস্ট সরকার অনুমোদন করেছিল। যদিও চাইনিজ সিকিউরিটি পুলিশ সে রাতে প্রফেসর ফাং লিট্রি-কে সেই নৈশভোজে যোগ দিতে দেয় নি, তবে তাকে পরবর্তীতে সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের বিরুদ্ধে খেদ প্রকাশে কোন বাধা দেয়া হয়নি। এই ঘটনাগুলি ছাত্রদেরকে থিয়েন আন মেন চত্বরে জমায়েত হওয়ার ব্যাপারে যে কিছুটা সাহসী করে তুলেছিল সেটা সহজেই অনুমেয়। আর দলবদ্ধ মানুষের সাহস স্বাভাবিকভাবেই যে সময়ের সাথে সাথে উত্তরোত্তর বেড়ে যায় সেটা বোঝার জন্য ‘মব সাইকোলজি’-এর উপর জ্ঞান না থাকলেও চলে। সে কারণেই হয়ত পৃথিবীর কোন সরকারই তার বিরুদ্ধে জনগণকে ফিজিক্যালি জমায়েত হতে দেয় না। কিন্তু কোন এক বিচিত্র কারণে চীনা সরকার ছাত্রদেরকে থিয়েন আন মেন-এর মতন বিশাল চত্বরে জমায়েত হতে প্রথমে কোন বাধা দেয় নি। যখন দিয়েছে, তখন কিন্তু জল অনেকখানিই গড়িয়ে গেছে। 

থিয়েন আন মেন চত্বর, সময়কাল ১৯৮৮বটি তোলা হয়েছে ১৯৮৭ সালে।

‘থিয়েন আন মেন’ চত্বরের বিশালত্ব নিজ চোখে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। বলা হয়ে থাকে আয়তনের দিক থেকে এটি হচ্ছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ চত্বর। অলিম্পিকের সবগুলি ইভেন্ট একসাথে পরিচালনা করার জন্য যে বিশাল আয়তনের জায়গার প্রয়োজন হবে, থিয়েন আন মেন চত্বর তার চাইতেও বড়। স্বাভাবিকভাবেই এই চত্বরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে গেলে যে কোন ব্যক্তিই ক্লান্ত হয়ে পড়বে। থিয়েন আন মেন চত্বরের বিশালত্বের সামনে দাঁড়িয়ে যে কোন মানুষই নিজেকে ক্ষুদ্র মনে করবে। ‘থিয়েন আন মেন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘স্বর্গীয় শান্তির দুয়ার’ বা ‘গেইট অব হেভেনলি পিস’। যদিও নামের সাথে এই চত্বরের বৈশিষ্টের তেমন কোন মিল নেই, কারণ এই বিশাল চত্বরের কোথাও না আছে বসার জন্য কোন বেঞ্চ কিংবা রোদ থেকে বাঁচার জন্য কোন ছাউনি। তবে বিশাল চত্বর জুড়ে রয়েছে লম্বা আকৃতির অসংখ্য ল্যাম্পপোস্ট। সেই ল্যাম্পপোস্টগুলিতে লাগানো রয়েছে বড় বড় লাউড স্পীকার এবং ভিডিও ক্যামেরা। এই গুলি যে সিকিউরিটির জন্য ব্যবহৃত হয় সেটা রাখঢাক করার কোন প্রয়োজনীয়তা চাইনিজ সরকার কখনোই অনুভব করেনি। তবে চত্বরের ভিতর  গোয়েন্দা বাহিনীর অসংখ্য লোকের যে আনাগোনা রয়েছে সেটা অবশ্য সরকার গোপন রাখার চেষ্টা করে। চত্বরের মাঝে বিশাল বিশাল ছাতা টাঙ্গিয়ে যে সমস্ত ফটোগ্রাফাররা যৎসামান্য ফি-এর বিনিময়ে ট্যুরিস্টদের ছবি তুলে দিচ্ছে তাদের অধিকাংশই যে ছদ্মবেশী গোয়েন্দা সেটা কিন্তু একটা ‘ওপেন সিক্রেট’। তারপরও দূর দূরান্ত থেকে আগত সাধারণ চাইনিজ ট্যুরিস্টরা লাইন ধরে তাদের কাছ থেকে ছবি তুলছে। তাদেরকে নিজেদের নাম ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছে অবলীলায় যাতে ফটোগ্রাফাররা সেই ঠিকানায় ছবিগুলি পাঠিয়ে দিতে পারে। ১৯৪৯ সালের পহেলা অক্টোবরে এই চত্বরের উত্তর দিকে অবস্থিত ‘ফরবিডেন সিটি’-র লাগোয়া টাওয়ারে দাঁড়িয়ে মাও সেতুং নয়া চীন অর্থাৎ পিপলস রিপাবলিক অব চায়নার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপর এই চত্বরের চারিদিকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থাপনা গড়ে তোলা হয়, যেমন চত্বরের পশ্চিম পার্শ্বে ‘গ্রেট হল অব পিপল’ এবং পূর্ব পার্শ্বে ‘ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব চায়না’। মাও সেতুং-এর মৃত্যুর সাত মাস পর ১৯৭৭ সালে থিয়েন আন মেন চত্বরের উত্তর-দক্ষিণ অংশে একটি মোসোলিয়াম বা সমাধি গড়ে তোলা হয়। এই মোসোলিয়ামের  ভূগর্ভস্থ একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে রক্ষিত কাঁচের একটি বাক্সে মাও সেতুং-এর এমবাম বা মমি করা দেহকে অতি যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করে রাখা আছে। প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টার জন্য মাও সেতুং-এর এই সমাধি জনসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এখানে ঢোকার জন্য কোন টিকেট কাটতে হয় না বটে তবে বিশাল লম্বা একটা লাইনে দাঁড়াতে হয়। যেহেতু মোসোলিয়ামের ভিতর কাউকেই দাঁড়াতে দেয়া হয় না তাই লাইন যতই লম্বা হোক না কেন সবারই সুযোগ থাকে মাও সেতুং-এর মৃতদেহকে একটু চোখের দেখা দেখার জন্য। অত্যন্ত কড়া সিকিউরিটি চেকের ভেতর দিয়ে সবাইকে যেতে হয় এই মোসোলিয়ামে ঢোকার সময়। সবাইকেই ঢুকতে দেয়া হয় তবে শর্ত হচ্ছে সাথে কোন ব্যাগ থাকা যাবে না। থিয়েন আন মেন চত্বর পরিদর্শনে আসা চাইনিজ কিংবা বিদেশী সব ট্যুরিস্টই মাও সেতুং-এর সমাধি দেখার লাইনে দাঁড়িয়ে যায়। ১৯৮৮ সালের শেষের দিকে বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব পোস্টস এন্ড টেলিকম্যুনিকেশনস-এর ফরেন স্টুডেন্টস এফেয়ার্স অফিস থেকে আমাদেরকে অর্থাৎ আমরা যারা ফরেন স্টুডেন্ট তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় মাও সেতুং-এর মোসোলিয়াম পরিদর্শনে। লম্বা লাইন ধরে ধীরে ধীরে এগুতে এগুতে এক সময় সেই ভূগর্ভস্থ কক্ষের কাঁচের বাক্সে রক্ষিত মাও-সেতুং-এর মৃতদেহের সাক্ষাৎ পেলাম। দেখে মনে হলো তার মুখটা কেউ যেন মোম দিয়ে পালিশ করে চকচকে করে রেখেছে। সেই চকচকে মুখের মৃত মাও সেতুং কম্যুনিস্ট চীনের রাজনীতিতে আজও যে বিশাল প্রভাব বিস্তার করে আছে সেটা কিন্তু বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করা যায় তার সমাধি পরিদর্শন করার সময়।

থিয়েন আন মেন স্কয়ারের উত্তর দিকে অবস্থিত ফরবিডেন সিটির লাগোয়া এই টাওয়ার থেকে ১৯৪৯ সালের পহেলা অক্টোবরে পিপলস রিপাবলিক অব চায়নার ঘোষণা দেন। আমি সেই টাওয়ারে দাঁড়িয়ে, আমার পিছনে ‘গ্রেট হল অব পিপলস’ দেখা যাচ্ছে।

২২ শে এপ্রিল তারিখে কম্যুনিস্ট পার্টির সিনিয়ার লিডাররা যখন তড়িঘড়ি করে হু ইয়াওপাং-এর ফিউনারেল অনুষ্ঠান শেষ করে গ্রেট হল অব পিপলস ফিরে যাচ্ছিলেন তখন কয়েকজন স্টুডেন্ট লিডার তাদেরকে ‘ডায়ালগ’-এ বসার জন্য অনুরোধ করে। সেদিন তারা সেই অনুরোধে কর্ণপাত করেননি। কেন করেন নি পরবর্তীতে সেই বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অনেকে বিশ্লেষকই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে সেই সময় পলিটব্যুরোর ভেতর চলছিল ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। তখনকার কম্যুনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি ট্রাও জিয়াং ছিলেন হু ইয়াওপাং-এর ঘনিষ্ঠ। এছাড়াও তিনি ছিলেন কম্যুনিস্ট নীতির ঘোর বিরোধী। তাই তিনি স্টুডেন্টদের দাবীর ব্যাপারে ছিলেন সহানুভূতিশীল। অনেক বিশ্লেষক আবার এই ধারণা পোষণ করেন যে, ট্রাও জিয়াং চেয়েছিলেন স্টুডেন্টদের দাবীর মুখে দেং শিয়াওপিং যেন সত্যিকারের রিটায়ারমেন্টে চলে যায়। কারণ স্টুডেন্টরা থিয়েন আন মেন চত্বরে জড়ো হওয়ার পরপরই দেং শিয়াওপিং-এর বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়া শুরু করে যা কিনা ছিল কম্যুনিস্ট চায়নার জন্য অভূতপূর্ব এবং অবিশ্বাস্য। তারা দেং শিয়াওপিং-কে ডিক্টেটর বা স্বৈরশাসক হিসেবে উল্লেখ করে একটি ব্যানারে তার নয়টি অপরাধের তালিকা তুলে ধরে। এই তালিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অপরাধগুলি হচ্ছে – দেশের জনগণকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানিয়ে রাখা এবং তার ছেলেকে দূর্নীতির দায় থেকে রেহাই দেয়া। তাই ট্রাও জিয়াং সময় ক্ষেপণ করছিলেন স্টুডেন্টদের আন্দোলনকে থামিয়ে দেয়ার ব্যাপারে। এই সময় ক্ষেপণের কারণে জনগণের মাঝে সরকারের মনোভাব কী সেই নিয়ে এক ধরণের বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় এবং সেই সাথে স্টুডেন্টদের মনোবল দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কিন্তু এই সময় ‘পিপলস ডেইলি’ পত্রিকায় একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয় যার শিরোনাম ছিল ‘টেইক আ ক্লিয়ার-কাট স্টান্স এগেইনস্ট দ্য ইন্সটিগেশন অব টারময়েল’ বা ‘অরাজকতার বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেয়া’। এই সম্পাদকীয়তে ষড়যন্ত্র এবং নাশকতামূলক কাজের মাধ্যমে দেশকে এক অরাজকতার দিকে ঠেলে দেয়ার জন্য স্টুডেন্টদেরকে এককভাবে দায়ী করা হয় যা কিনা জেলে যাওয়ার মতন অপরাধ। এই প্রথম স্টুডেন্টদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে কোন নির্দেশনা জনসাধারণের জন্য প্রকাশিত হলো। ফলে এটা যে কম্যুনিস্ট পার্টির হাই কমান্ড তথা দেং শিয়াওপিং-এর নির্দেশনা সেটা বুঝতে কারোই অসুবিধা হয়নি। এই নির্দেশনাতে আরেকটি জিনিষ পরিস্কার হলো যে সরকার স্টুডেন্টদের সাথে আলোচনায় বসার ক্ষেত্রে মোটেই আগ্রহী নয়। কম্যুনিস্ট পার্টির হাই কমান্ড মনে করেছিল যে এই নির্দেশনা পেয়ে স্টুডেন্টরা পাততাড়ি গুটিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে যাবে। কিন্তু হিতে বিপরীত হলো, স্টুডেন্টরা তো ক্যাম্পাসে ফেরৎ গেলোই না বরং সাধারণ জনসাধারণ স্টুডেন্টদের পাশে এসে দাঁড়াল। জনসাধারণকে পাশে পেয়ে এবার স্টুডেন্টরা প্রিমিয়ার লি পেং-এর পদত্যাগ সহ নতুন করে তিন দফা দাবী পেশ করলো। এই দাবীগুলি হলো, সরকারের সাথে ডায়ালগ, স্টুডেন্টদের উপর পুলিশি নির্যাতনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা এবং সর্বোপরি স্টুডেন্টদের কার্যকলাপের নিরেপেক্ষ মিডিয়া কাভারেজ। স্টুডেন্টদের এহেন আচরণে দেং শিয়াওপিং অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেন এবং পার্টির আভ্যন্তরীণ মিটিং-এ এই বলে মত প্রকাশ করেন যে, স্টুডেন্টদের আন্দোলন থামাতে যদি অল্প কিছু রক্ত ঝরাতেও হয় আমরা তাই করব, কারণ এই রক্তপাত বহির্বিশ্বে চীনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করবে না। পার্টির হাই কমান্ড যখন কোন রকম আলোচনা ব্যতিরেকেই সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের চিন্তা ভাবনা করছিল, তখন থিয়েন আন মেন চত্বরে এসে জড়ো হচ্ছিল সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি সংস্থার লোকজন স্টুডেন্টদের আন্দোলনের সাথে তাদের সংহতি জানাতে। ফলে জনগণ আবারও বিভ্রান্ত হলো সরকারের ভূমিকা নিয়ে। থিয়েন আন মেন চত্বর ততদিনে হয়ে উঠল গণ মানুষের মিলন মেলা। ক্লাস যেহেতু বন্ধ, আমি আরো কয়েকজন বাংলাদেশী স্টুডেন্টদের সাথে প্রায় প্রতিদিন বিকেল বেলাতে চলে যেতাম সেই মিলন মেলায় যোগ দিতে। অনেক রাত অবধি সেখানে কাটিয়ে ফিরে আসতাম আমাদের ফরেন স্টুডেন্ট হোস্টেলের নিরাপদ আশ্রয়ে। এই রুটিনেই পার হতে লাগল দিনের পর দিন।

এমন সময় অর্থাৎ মে মাসের শুরুতে আসন্ন সাইনো-সোভিয়েট সামিটের জন্য বেইজিং-এ এসে জড়ো হতে থাকল পৃথিবীর সমস্ত নামকরা সংবাদ সংস্থার সাংবাদিকেরা। তাদের জন্য থিয়েন আন মেন চত্বরের আন্দোলন হয়ে উঠল একটি বাড়তি পাওনা। আর স্টুডেন্টরাও আসন্ন এই সামিটকে উপলক্ষ করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দেয় কারণ থিয়েন আন মেন চত্বর যে পুরোপুরি তাদের কব্জায়। ফলে সরকারকে সামিটের কর্মসূচি থেকে থিয়েন আন মেন স্কয়ার পরিদর্শন, এমন কি থিয়েন আন মেন চত্বরের আশেপাশের বিভিন্ন থিয়েটার হলে অনুষ্ঠিতব্য বিভিন্ন কালচারাল অনুষ্ঠানগুলোকে কাটছাঁট করতে হয়। মোটকথা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকারের ভাবমূর্তি প্রবলভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।

রুশ প্রেসিডেন্ট গর্বাচেভের আসার ঠিক দুইদিন আগে অর্থাৎ ১৩ই মে তারিখে কয়েক শত স্টুডেন্ট বেশ ঘটা করে তাদের শেষ লাঞ্চ খায়। তারপর তারা মাথায় সাদা কাপড়ের একটি পট্টি বেঁধে নেয় যেখানে লাল অক্ষরে লেখা ‘অনশন ধর্মঘট’। তারা যখন মিছিল করে থিয়েন আন মেন চত্বরে এসে পৌঁছায় তখন তাদেরকে অনশনের শপথ বাক্য পাঠ করায় ‘ছাই লিং’ নামের একজন ছাত্রী যার নাম পরবর্তীতে দশজন ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ ছাত্রছাত্রীর তালিকায় দেখা যায়। অনশন ধর্মঘটের শপথ নেয়ার পর স্টুডেন্ট আন্দোলনে এক নতুন মাত্রার যোগ হয়। দেশের জনগণ আবেগতাড়িত হয়ে উঠে। একজন গার্ডিয়ানকে দেখা যায় হাতে এক প্ল্যাকার্ড নিয়ে ঘুরছেন যেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা, “আমাদের ছেলেরা অনশন ধর্মঘট করছে, তোমার ছেলে কী করছে, মিঃ দেং?”। এটা যে দেং শিয়াওপিং-এর ছেলের দূর্নীতির প্রতি ইঙ্গিত তা সবাই বেশ বুঝতে পারছে। এই সময় স্টুডেন্টদের হাতের প্ল্যাকার্ডে নতুন নতুন অনেক শ্লোগানের দেখা মিলে, যেমন – “সোভিয়েট ইউনিয়নের আছে গর্ভাচেভ, চীনের জন্য কে আছে?”, “গর্ভাচেভ, ৫৮; দেং শিয়াওপিং ৮৫” (অর্থাৎ বুড়ো দেং শিয়াওপিং-এর উচিৎ অবসরে যাওয়া)। ছাত্রদের এহেন কান্ডে চীনা সরকারকে ভীষণ বিপাকে পড়তে হয়। চীন কম কাঠখড় পুড়িয়ে এই সামিটের আয়োজন করেনি। অথচ ছাত্রদের আন্দোলনের কারণে অনেকটা দায়সারা ভাবে সামিটের কাজ সম্পন্ন করতে হয় চীনা সরকারকে। সামিট চলাকালে অনশনরত স্টুডেন্টদের দেখভাল করার জন্য থিয়েন আন মেন চত্বর জুড়ে ছিল সাইরেন বাজানো এ্যাম্বুলেন্সের আনাগোনা আর গ্লুকোজ নিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের ছোটাছুটি। ফলে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কাছে সামিটের চেয়ে থিয়েন আন মেন চত্বরই বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। আর সেটাই তো ছিল স্টুডেন্টদের মূল উদ্দেশ্য। যদিও অনেকেই অভিযোগ তুলেছিল যে স্টুডেন্টরা আসলে সত্যিকারের অনশন করছে না, লুকিয়ে লুকিয়ে ঠিকই খেয়ে নিচ্ছে। তাতে অবশ্য ছাত্রদের প্রতি জনগণের সহমর্মিতা বিন্দুমাত্র কমে যায়নি।

একজন সাংবাদিক এই সময় গর্ভাচেভকে সরাসরি প্রশ্ন করে বসলেন, রাশিয়ার ছাত্ররা যদি মস্কোর রেড স্কয়ারে একই রকম আন্দোলনে নামতো তবে আপনি কী করতেন? জবাবে মৃদু হেসে গর্ভাচেভ বলেছিলেন, “আমি গণতন্ত্র ব্যবহার করে সেই রকম কোন পরিস্থিতি তৈরি হতে দিতাম না”। তবে পরবর্তীতে এই গণতন্ত্রের নামে রাশিয়াতে এক অরাজক অবস্থা তৈরি হয় এবং গর্ভাচেভকে ইয়েৎসিনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করতে হয়। সামিট শেষ হয় ১৯ শে মে, গর্ভাচেভ চলে যাওয়ার পর স্টুডেন্টরা তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে মনে করে অনশন ধর্মঘটের মূলতবী ঘোষণা করে। কিন্তু সেই রাতে টিভিতে কালো মাও কোট পরিহিত রাগান্বিত প্রিমিয়ার লি পেং এসে ঘোষণা দেন যে, বেইজিং শহর জুড়ে যে অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছে সেটা প্রতিহত করার জন্য পার্টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে আগামীকাল থেকে ‘মার্শাল ল’ জারী করা হবে। এই সময় লি পেং আক্রোশে ফেটে পড়ছিলেন, বারবার শূন্যে মুষ্ঠাঘাত করে তিনি সেটারই বহির্প্রকাশ করছিলেন।

থিয়েন আন মেন আন্দোলনে যোগ হলো এক নতুন মাত্রা – মার্শাল ল’। (চলবে)

কাজী সাব্বির আহমেদ

টরন্টো