চীন-কানাডা কূটনৈতিক সম্পর্ক -৪
কাজী সাব্বির আহমেদ
চীন সরকারের বৃত্তি নিয়ে আন্ডারগ্রাজুয়েট লেভেলে পড়তে এসে প্রথম বছরে আমাদেরকে চাইনিজ ভাষা শিখতে হলো। আমরা যারা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র তারা এই এক বছরে মোটামুটি তিন হাজার শব্দ (ক্যারেক্টার) অর্থ সহকারে পড়তে ও লিখতে শিখে গেলাম। সেই শব্দগুলি দিয়ে বিভিন্ন ধরণের বাক্য গঠনের জন্য আমাদেরকে বেসিক ব্যাকরণও শিখানো হলো। ফলে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত চাইনিজ ভাষা আমাদের আয়ত্বের মধ্যে সহজেই চলে এলো। সেই ভাষাজ্ঞান দিয়ে আমরা বাজারে দর কষাকষি থেকে শুরু করে বিনয়ের সাথে অতিথি আপ্যায়নের মত সামাজিক কর্মকাণ্ডগুলি বেশ ভালোভাবেই চালাতে শিখে গেলাম। আমাদেরকে একগাদা ‘ট্রুয়ান ইয়ে ছ’ বা একাডেমিক জারগনও শিখানো হলো যাতে আমরা নির্বিঘ্নে ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারের কোর্স শুরু করতে পারি। চাইনিজ ভাষার ব্যাকরণ কঠিন না, কঠিন হচ্ছে উচ্চারণ। চার মাত্রার উচ্চারণকে বাগে আনা কিন্তু কোন সহজ ব্যাপার নয়। যেমন, চাইনিজ শব্দ ‘মা’ উচ্চারণের মাত্রা ভেদে ‘মাতা’ কিংবা ‘ঘোড়া’ অর্থ হতে পারে। চাইনিজ ভাষায় লেখার জন্য কোন বর্ণমালা নেই, ছবি থেকে একেকটা শব্দের লিখিত রূপ এসেছে যাকে কিনা বলা হয়ে থাকে ‘হায়ারোগ্লিফিক্স’ লিপি। প্রাচীনকালে কোরিয়ান এবং জাপানী ভাষায় চাইনিজ লিপিই ব্যবহার করা হত, কিন্তু বর্তমানে তারা বর্ণমালার প্রবর্তন করেছে কিন্তু মূল চাইনিজ ভাষায় এখনও যা করা হয়নি। ভবিষ্যতে যে করা হবে তার কোন লক্ষণ এখনও পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি। তবে মেইন ল্যান্ড চায়নাতে ‘সিমপ্লিফায়েড’ লিপি (ক্যারেক্টার)-এর প্রবর্তন করা হয়েছে, যেখানে হংকং কিংবা তাইওয়ানে এখনও ‘ট্র্যাডিশনাল’ লিপিই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আমাদেরকে শুধু ‘সিমপ্লিফায়েড’ ক্যারেক্টারই শিখানো হয়েছিল। তবে উচ্চারণ কিংবা লিখার চাইতেও কঠিন হচ্ছে চাইনিজ ভাষার শব্দ ভান্ডার। ‘হোং লৌ মং’ বা ‘অ্যা ড্রিম অব রেড ম্যানশনস’ নামক বিখ্যাত উপন্যাসে নাকি সত্তুর হাজার ভিন্ন ভিন্ন ‘ক্যারেক্টার’ ব্যবহার করা হয়েছে। এখান থেকে চাইনিজ ভাষার শব্দ ভান্ডার যে কত বিশাল তার একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। যেখানে খোদ চাইনিজদের পক্ষেই এই বিপুল পরিমান ‘ক্যারেক্টার’ ভান্ডারকে আয়ত্বে আনা সম্ভব নয় সেখানে বিদেশীদের পক্ষে তো আরও নয়। তবে বলা হয়ে থাকে যে পাঁচ থেকে সাত হাজার ‘ক্যারেক্টার’ জানলেই নাকি স্বচ্ছন্দে খবরের কাগজ পড়া সহ চাইনিজ সমাজে মিশে যাওয়া যায় – যাকে চাইনিজে ‘ট্রোং কোয়া থোং’ বলা হয়ে থাকে।
প্রায় তিন হাজার শব্দের পুঁজি নিয়ে ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ‘বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব পোস্টস এন্ড টেলিকম্যুনিকেশনস’-এ ব্যাচেলার ডিগ্রীর কোর্স শুরু করলাম। আমাদের ব্যাচ অর্থাৎ ‘ক্লাস অব এইটি-এইট’-কে চাইনিজে বলা হত ‘পা পা চি’। যেখানে চাইনিজে ‘পা’ অর্থাৎ ‘আট’ সংখ্যাটি একটি অসপিসিয়াস বা শুভ সংখ্যা, সেখানে আমাদের ব্যাচের সংখ্যা হচ্ছে ডাবল ‘পা’। এটা নিয়ে আমাদের ব্যাচের চাইনিজদের মধ্যে একটা গর্ব অনুভব করতে দেখেছি। পুরো ক্লাসে আমরা ছিলাম মাত্র চারজন ফরেন স্টুডেন্ট। আবার এই চারজনের ভিতর দুইজন বাংলাদেশী, আমি এবং শমসের। বাকী দুইজনের একজন নাসের, আফ্রিকার দ্বীপদেশ ‘কমোরস’ এবং অপরজন এন্টনিও, আফ্রিকার আরেক দ্বীপদেশ ‘সাও টোমে এন্ড প্রিনসিপে’ থেকে আসা। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে চীনে আসার আগে এই দুই দেশের কোনটারই নাম আমি আগে কখনো শুনিনি। আমাদের ক্লাসের চাইনিজ ছাত্র-ছাত্রীদের বেশীর ভাগই আগে কখনো বিদেশী মানুষ দেখেনি – ফলে আমাদের প্রতি তাদের সবারই ছিলো অপরিসীম আগ্রহ। আবার তারা যখন আমাদেরকে অবলীলায় বিশুদ্ধ চাইনিজে কথা বলতে দেখত, তারা তখন খুবই অবাক হয়ে যেত। কারণ তাদের অনেকেই বিশেষ করে যারা বেইজিং-এর বাইরে থেকে এসেছে, আমাদের মতন বিশুদ্ধ উচ্চারণে চাইনিজ বলতে পারত না -আঞ্চলিকতার টান থাকত। তাদের সেই অবাক হওয়া চেহারাটা হতো দেখার মতন। ফার্স্ট ইয়ারের প্রথম সেমিস্টারে আমাদেরকে পড়তে হলো বেশ কিছু সাবজেক্ট তার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন ছিল ‘কাও তোং সু সুয়ে’ বা ‘হায়ার ম্যাথমেটিকস’, পাশাপাশি আরেকটি অংকের সাবজেক্ট ‘লিনিয়ার অ্যালজেব্রা’। সেমিস্টারের শুরুতেই আমাদেরকে সতর্ক করে দেয়া হলো যে এ বছর নাকি ‘কাও তোং সু সুয়ে’-এর ‘থোং খাও’ অর্থাৎ বেইজিং-এর সমস্ত ইউনিভার্সিটির জন্য একই প্রশ্নে পরীক্ষা হবে। সেকেন্ড সেমিস্টারে আমাদের পড়ানো হবে ‘উ লি’ বা ‘ফিজিক্স’-এর পার্ট ওয়ান। সেই ফিজিক্সের অংক করতে যে ক্যালকুলাসের জ্ঞান দরকার হবে সেটা নাকি শিখতে হবে এই ‘কাও তোং সু সুয়ে’ থেকে। আমরা বাংলাদেশের ইন্টারমিডিয়েট লেভেলে যে অংক করে আসি সেই জ্ঞান দিয়ে ‘কাও তোং সু সুয়ে’-এর সারফেসে দাঁত বসানো বেশ কঠিন ব্যাপার। এই অংক নিয়ে আমি যখন হিমহিস খাচ্ছি তখন দেখি কমোরসের নাসের বেশ হেসে খেলে বেড়াচ্ছে। কোন অংকই তার কাছে কঠিন না। ঘটনা কী জিজ্ঞেস করতে জানতে পারলাম যে প্রাক্তন ফ্রেঞ্চ কলোনির দেশ কমোরসে এখনও নাকি ফ্রেঞ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে এবং হায়ার ম্যাথমেটিকসের এই অংকগুলো নাকি সে হাই স্কুলেই করে এসেছে। তবে সে যে একটা অংকের জিনিয়াস ছিল তা কিন্তু সে নিজেও জানত না। ‘কাও তোং সু সুয়ে’-এর সেই ‘থৌং খাও’-তে সে যখন অনায়াসে একশো-তে আটানব্বই পেল, তখন আমাদের প্রফেসর তাকে সমগ্র চায়নার ভেতর অনুষ্ঠিতব্য এক অংক প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য প্রস্তাব দেয়। অতীব সম্মানের সেই প্রস্তাব সে হাসিমুখে ফিরিয়ে দিয়েছিল কারণ অংক নিয়ে সে আর সময় নষ্ট করতে চায় না।
প্রথম সেমিস্টারের বৈতরণী বেশ ভালোভাবেই পার হয়ে গেলাম। উইন্টার ভ্যাকেশনের পর দ্বিতীয় সেমিস্টার শুরু হয়ে গেল, কিন্তু টেনশন হতে লাগল ফিজিক্স পার্ট ওয়ান নিয়ে। সিনিয়ররা ভয় দেখানো শুরু করে দিলো কারণ অনেকেই ‘পূ খাও’ অর্থাৎ রেফার্ড পরীক্ষাতেও পাশ করতে পারেনি ফিজিক্স পার্ট ওয়ান। তাই প্রথম দিন থেকেই সচেতন এই কোর্সের ব্যাপারে। আমাদের কোর্সগুলোর প্রফেসরেরা সাধারণত বয়স্ক, স্বভাবতই পোশাক-আশাকে তারা অনেকটাই প্রাচীনপন্থী। গলাবন্ধ মাও কোটই ছিল তাদের পছন্দের পোশাক। কিন্তু ‘ফিজিক্স পার্ট ওয়ান’-এর প্রফেসরকে প্রথম দিন ক্লাসে দেখে কিছুটা অবাক হয়েছিলাম। বয়সে অনেকটাই তরুণ, স্যুট-টাই পরে ক্লাসে এসেছেন তিনি। ক্লাসে ঢুকেই তিনি খোঁজ করলেন ক্লাস মনিটরের। চীনে দেখেছি আন্ডারগ্রেড লেভেলের ক্লাসগুলিতে একজন করে ‘পান ট্রাং’ বা ক্লাস ক্যাপ্টেন বা মনিটর থাকে। সেই ‘পান ট্রাং’-কে তিনি ফিসফিসিয়ে কিছু বলতেই, ‘পান ট্রাং’ চেঁচিয়ে বলে উঠল ‘ছি লি’। আমার চাইনিজ ভোকাবুলারিতে এই শব্দ তখনও ছিল না, তবে সবাইকে একসাথে উঠে দাঁড়াতে দেখে এর মানে বুঝতে দেরী হলো না। আমিও অন্যান্যদের মতন উঠে দাঁড়ালাম। তখন সেই প্রফেসর জাপানী কায়দায় একটা বাউ করে বললেন, ‘ছিং চোয়া’ অর্থাৎ প্লিজ টেইক ইয়োর সিট। তিনি নিজের পরিচয় দেয়ার সময় উল্লেখ করলেন যে তিনি জাপান থেকে পিএইচডি এবং পোষ্টডক শেষ করে সম্প্রতি চীনে ফেরত এসেছেন। এভাবেই শুরু হলো বিভীষিকাময় ফিজিক্স পার্ট ওয়ান কোর্স যা কিনা সেই সেমিস্টারের অন্যান্য কোর্সগুলিকে ম্লান করে দিয়েছিল।
এক সময় সেমিস্টারের মাঝামাঝিতে এসে পড়লাম আমরা। অযথা কোনদিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করার মতন সময় হাতে নেই বললেই চলে। সেই সময় হঠাৎ দেখি চাইনিজ ছাত্রদের সবার জামাতে কালো কাপড়ের একটা টুকরো বাঁধা। আমার চীনের প্রবাস জীবনের বয়স তখন দেড় বছরের কিছু বেশী। ততদিনে নিকট কেউ মারা গেলে যে শোক প্রকাশের জন্য জামার হাতায় কালো কাপড় বাঁধা চাইনিজ সমাজের যে একটি রীতি তা আমার বেশ জানা হয়ে গেছে। একই সাথে সব ক্লাসমেটদের জামায় কালো কাপড় বাঁধা দেখে স্বাভাবিকভাবেই জানতে চাইলাম ঘটনা কী। ঘটনা সামান্যই। ছাত্রদের একজন প্রিয় নেতা ‘হু ইয়াওপাং’ মারা গেছেন, সেই জন্যেই এই কালো কাপড় বেঁধেছে সবাই। হু ইয়াওপাং ছিলেন দেং শিয়াওপিং-এর একজন ঘনিষ্ঠ সহকারী যিনি কিনা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কালচারাল রেভ্যুলেশন পরবর্তী চীনের রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং সমাজকে ঢেলে সাজাতে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। বলতে গেলে তার নেতৃত্বেই ‘পো-লুয়ান ফাংট্রেং’ নামক যুগান্তকারী রিফর্মেশন কার্যক্রম সফলতার মুখ দেখেছিল। তিনি এক সময় চাইনিজ কম্যুনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারীর পদে অধিষ্ঠিত হন কিন্তু ১৯৮৭ সালে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে সেই পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয়। ‘ট্রাও জিয়াং’ তখন তাকে স্থলাভিষিক্ত করে চাইনিজ কম্যুনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারী হন। ১৯৮৯ সালের ১৫ই এপ্রিলে হু ইয়াওপাং-এর আকস্মিক মৃত্যুতে তিনি আবার আলোচনায় আসেন। বেইজিং-এর বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে স্টুডেন্টরা তার স্মরণে বিক্ষিপ্ত ভাবে শোকসভার আয়োজন করে এবং তার ছবিতে ফুল দিয়ে তাকে সম্মান জানায়। এই সময় আমিও একদিন আমার চাইনিজ ক্লাসমেটদের সাথে বেইজিং-এর নামকরা ‘রেনমিন তা সুয়ে’ বা ‘পিপলস ইউনিভার্সিটি’-তে গিয়ে সেই ফুল দেয়ার কর্মকান্ড দেখে এলাম। এই সময় বেইজিং-এর আরও কয়েকটি প্রেস্ট্রিজিয়াস ইউনিভার্সিটি যেমন ‘পেই তা’ বা ‘পিকিং ইউনিভার্সিটি’, ‘শ্রি ফান তা সুয়ে’ বা ‘বেইজিং নরম্যাল ইউনিভার্সিটি’-এর ছাত্ররা একই ধরণের শোকসভার আয়োজন করেছিল। ফলে এই সব ইউনিভার্সিটিগুলিতে বেইজিং-এর অন্যান্য ইউনিভার্সিটি থেকে আগত ছাত্রছাত্রীদের ভীড় ছিল লক্ষ্যণীয়। ছাত্রদের এই শোক প্রকাশের ঘটনা যে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে শেষমেশ যে ‘থিয়েন আন মেন ম্যাসাকার’-এর জন্ম দিবে, ঘুনাক্ষরেও তখন কেউ তা টের পায়নি।
কালচারাল রেভ্যুলেশনের কারণে চাইনিজ সমাজে যে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল সেটাকে সারিয়ে তুলতে প্রথম থেকেই দেং শিয়াওপিং বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। সেই কারণে ১৯৭৭ সালে তিনি চাইনিজ কম্যুনিস্ট পার্টির এক সভায় ‘পো-লুয়ান ফাংট্রেং’ কার্যক্রমের প্রস্তাব করেন যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অরাজকতা দূর করে চীনের সমাজে ‘অর্ডার এন্ড ডিসিপ্লিন’ ফিরিয়ে আনা। ১৯৭৮ সালে ক্ষমতায় এসে তিনি এই ‘পো-লুয়ান ফাংট্রেং’ কার্যক্রমকে বাস্তবতায় রূপ দেয়া শুরু করেন। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি ধীরে ধীরে মাও সেতুং-এর আল্ট্রা-লেফটিস্ট নীতিগুলিকে বিলুপ্ত করে সময়োপযোগী অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতি গ্রহণ করা শুরু করেন এবং সমাজে যারা কালচারাল রেভ্যুলেশনের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল তাদের পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম চালু করেন। এই সময় দেং শিয়াওপিং-এর ঘনিষ্ঠ দুই সহকারী হু ইয়াওপাং এবং ট্রাও জিয়াং ‘পো-লুয়ান ফাংট্রেং’ কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যেতে নিরলসভাবে কাজ করে যান। সেই কারণে দেং শিয়াওপিং তাদের দুইজনকে তার ‘দুই হাত’ বলে অভিহিত করেন। আশির দশকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত এই কার্যক্রম বেশ সক্রিয়ভাবে চালু ছিল এবং আধুনিক চীনের ইতিহাসে এই সময়কাল একটি গুরুত্বপূর্ণ রিফর্মেটিভ সময়কাল হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। যে কোন রাজনৈতিক রিফর্মেশন বা পরিবর্তনের পথ যেমন মসৃন নয়, ‘পো-লুয়ান ফাংট্রেং’-ও এর ব্যতিক্রম ছিল না। বিভিন্ন কারণে কম্যুনিস্ট পার্টির ভিতর এই কার্যক্রম নানা সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল। প্রথমত, পার্টির অনেক সিনিয়র লিডাররা মাও সেতুং-এর নীতির বিলুপ্তিকে সহজভাবে নিতে পারেন নি। ১৯৮৪ সালে হু ইয়াওপাং এক সংবাদ সম্মেলনে মাও সেতুং-এর কোন নীতিই চাইনিজ জনগণের জন্য মঙ্গলজনক নয় বলে মন্তব্য করেন। তিনি মাও কোটের পরিবর্তে পশ্চিমা স্টাইলের স্যুট পরার পক্ষপাতী ছিলেন। এছাড়াও তিনি হাইজিনের কারণে ‘চপস্টিক’-এর বদলে চামিচ দিয়ে খাওয়া এবং ‘সার্ভিং স্পুন’ দিয়ে খাবার তুলে নেয়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য আহ্বান জানিয়ে বেশ সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। দ্বিতীয়ত কালচারাল রেভ্যুলেশনের সময়কার চিহ্নিত আসামীদের লঘু শাস্তি কিংবা বেকসুর খালাস প্রদানের কারণে অনেকেই খুশী হতে পারেনি। তৃতীয় কারণটি ছিল সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। ‘পো-লুয়ান ফাংট্রেং’-এর কারণে চীনের শিক্ষিত বা ইন্টেলেকচুয়াল শ্রেণীর পুনর্বাসন সবচেয়ে দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হয় এবং তাদেরকে চাইনিজ সমাজের জন্য কোন নীতি উপযুক্ত সেই ব্যাপারে মত প্রকাশের সুযোগ দেয়া হয়। এই সুযোগ ব্যবহার করে ‘আনহুই’ প্রভিন্সের রাজধানী ‘হফেই’ শহরে অবস্থিত ‘ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজী’-এর ভাইস চ্যান্সেলর ‘ফাং লিট্রি’ চাইনিজ সংবিধানে অধিকতর গণতন্ত্র অন্তর্ভুক্তি যে জরুরী সেই বিষয়ে প্রথম সোচ্চার হন। তিনি ১৯৮৬ সালে আমেরিকার প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির খন্ডকালীন শিক্ষকতার দায়িত্ব শেষ করে চীনে ফিরে আসেন এবং নিজ উদ্যোগে চীনের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে একের পর এক সেমিনার দিয়ে বেড়াতে শুরু করলেন যেখানে তিনি চীনের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য অধিকতর গণতন্ত্র এবং হিউম্যান রাইটস যে প্রয়োজন সেটা উল্লেখ করতেন। তার এই ভিশন চীনের ইউনিভার্সিটি ছাত্রছাত্রীদের মাঝে বিপুল জনপ্রিয়তা পায় এবং তার রেকর্ডকৃত বক্তৃতা ছাত্রছাত্রীদের হাতে হাতে ঘুরতে থাকে। দেং শিয়াওপিং কিন্তু ফাং লিট্রি-এর এই জনপ্রিয়তাকে সুনজরে দেখেননি। পশ্চিমা সংস্কৃতি তথা পুঁজিবাদের অন্ধ পূজারী হিসেবে তিনি ফাং লিট্রি-কে অভিহিত করেন। ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বরে আনহুই প্রভিন্সের হফেই শহরে একদল স্টুডেন্ট সংঘবদ্ধ হয়ে পলিটিক্যাল রিফর্মের দাবী জানায় এবং এই আন্দোলন খুব দ্রুত সাংহাই এবং বেইজিং-এর ইউনিভার্সিটিগুলির স্টুডেন্টদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশ সহ পুরো পৃথিবীতে তখন চীনের এই ছাত্র আন্দোলন বেশ সারা জাগিয়েছিল। আমি তখন প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশের বিটিভি-এর খবরে প্রচারিত চীনের এই ছাত্র আন্দোলনের সংবাদ বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখতাম। তখন এনালিস্টরা আশঙ্কা করছিল যে এই ছাত্র আন্দোলন হয়ত চীনে দ্বিতীয় ‘কালচারাল রেভ্যুলেশন’-এর সূচনা করবে। এই সময় ছাত্র আন্দোলনকে বন্ধ করার জন্য দেং শিয়াওপিং ফাং লিট্রি-কে পার্টি থেকে বহিস্কারের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তখনকার কম্যুনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারী হু ইয়াওপাং এতে আপত্তি জানান। ফলে তাকে জোরপূর্বকভাবে জেনারেল সেক্রেটারী পদ থেকে সরানো হয়। তবে তার পলিট ব্যুরোর সদস্যপদ বহাল রাখা হয়। চীনের শিক্ষিত সমাজ হু ইয়াওপাং-এর এই সাহসিকতাকে বেশ শ্রদ্ধার সাথেই মনে রেখেছে। তাই তার মৃত্যুতে তাৎক্ষণিকভাবে বেইজিং-এর বেশ কয়েকটি বিখ্যাত ইউনিভার্সিটিতে শোকসভার আয়োজন করা হয়। আমি আমার ক্লাসমেটদের সাথে ‘পিপলস ইউনিভার্সিটি’-এর এক শোকসভাতে উপস্থিত হয়েছিলাম।
চাইনিজ সরকার আয়োজিত হু ইয়াওপাং-এর অনাড়ম্বর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চীনের চীনের শিক্ষিত শ্রেণীর মাঝে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার করে। ২২শে এপ্রিল থিয়েন আন স্কোয়ারের সংলগ্ন ‘গ্রেট হল’-এ যখন কম্যুনিস্ট পার্টির আয়োজিত হু ইয়াওপাং-এর উপর স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল তখন প্রায় ৫০ হাজার স্টুডেন্ট সেখানে গিয়ে বিনা নোটিশে উপস্থিত হয়। পুলিশ তাড়াহুড়ো করে ব্যারিকেড দিয়ে স্টুডেন্টদেরকে মূল অনুষ্ঠানে প্রবেশে বাঁধা দেয়। তবে সেই বাঁধা অতিক্রম করে চার পাঁচ জন ছাত্র অনুষ্ঠানের অঙ্গনে ঢুকে পড়ে এবং তারা প্রিমিয়ার লি পেং-এর সাথে কথা বলার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু লি পেং যখন ছাত্রদের সাথে কথা বলার জন্য ‘গ্রেট হল’ থেকে বেরিয়ে আসেননি তখন বেইজিং নরম্যাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র ‘উ আর খাই সি’ অত্যন্ত আবেগঘন ভাষায় লি পেং-কে বেরিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করে। তারপরও যখন লি পেং ছাত্রদেরকে দেখা দিতে অস্বীকৃতি জানায় তখন ছাত্ররা ঘোষণা করে ক্লাস বর্জনের। তবে তারা সেই সাথে এটাও পরিস্কার করে দেয় যে ক্লাস বর্জন মানে কিন্তু শিক্ষা বর্জন নয়।
এহেন পরিস্থিতিতে আমরা বিপাকে পড়লাম আমাদের ‘ফিজিক্স পার্ট ওয়ান’ কোর্স নিয়ে। ক্লাস হবে কী হবে না সেই অনিশ্চয়তা নিয়ে পরদিন ক্লাসে গিয়ে দেখি উপস্থিতিদের সংখ্যা অর্ধেকের চেয়েও কম। যথা সময়ে স্যুট টাই পরে তরুণ সেই প্রফেসর ক্লাসে ঢুকলেন। আমরা সবাই উঠে দাঁড়ালে তিনি বাউ করে আমাদের বসতে বললেন। তারপর তিনি চক হাতে বোর্ডে না যেয়ে ধীর পায়ে আমাদের দিকে একটু এগিয়ে আসলেন। কিছুটা আবেগ নিয়ে তিনি বলা শুরু করলেন, আজ থেকে বিশ কিংবা ত্রিশ বছর পর কেউ যদি তোমাদেরকে প্রশ্ন করে ছাত্ররা যখন রাজপথে আন্দোলন করছিল তখন তোমরা কী করছিলে। কী জবাব দিবে সেই প্রশ্নের? দেখি ক্লাসের সব ছাত্ররা উঠে দাঁড়িয়েছে ক্লাস ত্যাগ করার জন্য। আমি তাদের সাথে সাথে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলাম। শুরু হলো অনির্দিষ্ট কালের জন্য ‘পা খ’ বা ক্লাস বর্জন। রাজপথ মুখরিত হয়ে উঠল ‘অধিকতর গণতন্ত্র’ আদায়ের আন্দোলনে। শুরু হলো এক উত্তাল সময়ের যা ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে ‘থিয়েন আন স্কোয়ার’ আন্দোলন হিসেবে। (চলবে)
কাজী সাব্বির আহমেদ
কলামিস্ট
টরন্টো