কানাডায় উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন খুবই কঠিন ও নৈরাশ্যকর
টরন্টোতে বসবাসকারী লেখক বললেন, এদেশে আসার জন্য তিনি দুঃখিত
রুহুল্লা নাদেরী
আমি কানাডার টরন্টোতে এসে নামি ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এবং টরন্টোর পিয়ারসন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে একজন অভিবাসন কর্মকর্তার কাছে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করি। আমার কোনও ধারণা ছিল না যে, রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন জানালে এক দীর্ঘ ও কঠিন মনস্তাত্ত্বিক সংগ্রাম করতে হবে।
কানাডায় আসাটা ছিল একটা আঘাতের মত। এখানে শীতকাল প্রচণ্ড ঠান্ডাÑ প্রায় অসহনীয়। এসব শীতলতর ঋতুতে অনেকে মৌসুমী হাতাশায় ভুগতে পারেন। আমার প্রথম শীতকাল ঘরে আটকে থাকার কথা এখনও স্পষ্ট মনে আছে।
সামাজিক মেলামেশার সুযোগ না থাকা, কাজ না থাকা এবং কোনও বিনোদন কর্মকাণ্ড ছাড়া Ñ দিনগুলি ছিল রীতিমত ধ্বংসাত্মক এবং অন্ধকারময়। ঠিক যেন কোভিড-১৯ এর সময় আরোপিত আটকাবস্থা এবং সামাজিক সংযোগহীনতার মত।
যাহোক, প্রাথমিক পর্যায়ের যেসব বিষয় একজন আশ্রয় প্রার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে সেটি হলো আবেদন প্রক্রিয়া।
এটি দীর্ঘ, আত্মা বিনাশী এবং সময়সাপেক্ষ। বেদনাদায়ক অংশ হলো এর অনিশ্চয়তার দিক এবং নাকচ করে দেবার সম্ভাবনা।
আশ্রয়ের জন্য আবেদনের প্রক্রিয়া
অন্টারিও প্রদেশে আশ্রয়ের জন্য আবেদন প্রক্রিয়াকরণ করতে দুই বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। অনেক সময় অপেক্ষার প্রহর এতটাই হতাশাজনক ও মানসিক চাপের কারণ হয়ে ওঠে যে, আবেদনটাই প্রত্যাহার করে নিতে ইচ্ছে করে। আমার কিছু বন্ধু সামাজিক বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে সংগ্রাম, একাকীত্ব, কর্মসংস্থানের অভাব এবং অপেক্ষার সময় ইত্যাদি নানা কারণ দেখিয়ে তাদের আবেদন প্রত্যাহার করে নেন।
আবেদনের জবাবের জন্য অপেক্ষার সময় প্রার্থীরা তাদের আবেদনের কী পরিণতি হবে এবং তা নাকচ হয়ে গেলে দেশে ফিরে যাবার ঝুঁকির কথা ভেবে মানসিকভাবে স্নায়বিক পীড়নে ভুগতে থাকেন।
এসব প্রশ্ন মানসিক চাপ ও উদ্বেগের গুরুতর কারণ। কেউ এসব চিন্তা থেকে দূরে থাকার যতই চেষ্টা করুন না কেন, প্রশ্নগুলো তাকে আহত করবেই, আর প্রকৃত আশ্রয়দান সম্পর্কিত শুনানীর সময় যে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয় তার কথা না হয় না-ই বলি।
কর্মসংস্থানে বাধা
এমনকি আপনাকে যদি আশ্রয় দেয়াও হয়, তারপরও অনেক চ্যালেঞ্জ থেকে যায়, যেমন কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাব। ইংরেজি বলতে পারা নিশ্চয়ই একটি বড় সুবিধা, কিন্তু আফগানিস্তানের ইংরেজি (আমার নিজের জন্মস্থান) সম্পূর্ণ ভিন্ন, এর উচ্চারণের ধরণই এমন যা কানাডার নিয়োগদাতারা সহজেই ধরে ফেলেন। এটুকু ইংরেজি জানা কানাডায় চাকরি পাবার জন্য যথেষ্ট নয়। বেশিরভাগ লোক ভাষাগত অদক্ষতাকে একটি প্রতিবন্ধক হিসাবে উল্লেখ করেন, তবে আমি এটিকে বলি বৈষম্য।
চার দশকের সংঘাত সহিংসতায় জর্জরিত একটি উন্নয়নশীল দেশ যেখানে শিক্ষাব্যবস্থা ধসে পড়েছিল সেই দেশ থেকে আসা একজন অভিবাসী অনর্গল ইংরেজি বলবে এমন আশা করাই সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং অমূলক।
তারপরও, ধরে নিই যে, ভাষার বাধা কোনওভাবে কাটিয়ে ওঠা গেল। কিন্তু তারপরও আমার তো কানাডায় কাজের কোনও অভিজ্ঞতা এবং কানাডার বিদ্যালয় থেকে অর্জিত ডিগ্রি নেই। আমি সদ্যই কানাডায় এসেছি, কিন্তু তারপরও কানাডীয় নিয়োগকর্তাদের নজরে আমি না-ও পড়তে পারি, কারণ তারা চান কানাডার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রি।
সম্মানজনক বেতনসহ একটি ভদ্রস্থ চাকরি আপনাকে দিতে পারে জীবনের অর্থময়তা, শ্রদ্ধা এবং উদ্দেশ্য। যখন সেটা থাকে না তখন লোকেরা হতাশা, দুঃখ, উৎকণ্ঠা, অসহায়ত্ব ও বিষন্নতায় ভোগে। আবার আপনার অভিজ্ঞতার সঙ্গে খাপ খায় না এমন চাকরিতে যোগ দিতে বাধ্য হওয়াটাও আরেক চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দেয়। এটি আপনার পেশাগতভাবে সমৃদ্ধ হবার ক্ষেত্রে সহায়ক হয় না, আবার এতে যথেষ্ট অর্থও আসে না। এরকম পরিস্থিতিতে অনেকে নিজেকে অপদার্থ বলে ভাবতে পারে, যা নিশ্চিতভাবেই বিষন্নতা ও একাকীত্বের দিকে ঠেলে দেয়।
ক্ষতিগ্রস্ত হবার অনুভূতি
প্রার্থীদের ওপর আরেকটি অপরিমেয় কঠিন প্রভাব পড়ে, সেটি হলো, ক্ষতিগ্রস্ত হবার অনুভূতি। পরিচিত পরিবেশ থেকে অপরিচিত পরিবেশে এবং স্থিতিশীল অবস্থা থেকে অস্থিতিশীল অবস্থায় এসে পড়া। বেদনাদায়ক অভিবাসন প্রক্রিয়ার একটি অংশ হলো অভিবাসন ঘিরে যে পরিবেশের মধ্যে আপনি পড়বেন সেই পরিবেশ আপনার নিজের হাতে তৈরি নয়। এটি পুরো প্রক্রিয়াটিকে খুবই তিক্ত ও অমর্যাদাকর করে তোলে।
পদ্ধতিগত বিষয়গুলির সমাধান
অনেকে মনে করেন, উদ্বাস্তুরা তাদের ঘরবাড়ি, পরিবার-পরিজন, সংস্কৃতি এবং আবেগগত সমর্থন সব কিছু স্বেচ্ছায় ছেড়ে আসেন শুধু অর্থনৈতিক সুযোগের সুবিধা নেবার জন্য। কিন্তু বিদেশিদের নিয়ে শঙ্কিত ব্যক্তিরা এবং অভিবাসন-বিরোধীরা যেসব অর্থনৈতিক সুবিধার কথা প্রায়শ বলে থাকেন, তেমন সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে।
উদ্বাস্তুরা সচরাচর অর্থনৈতিক ধাপের সর্বনিম্নে পড়ে থাকেন এবং এতই সামান্য আয় করতে পারেন যা দিয়ে কেবল কোনওরকমে অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব।
তাছাড়াও, এটা কেবল কারও একার আর্থিকভাবে টিকে থাকার বিষয় নয়। নিজের জন্মস্থানে থাকলেও অর্থের প্রয়োজন হয়ই। আমার অভিজ্ঞতা বলে, আফগানিস্তানে অব্যাহতভাবে সহিংস সংঘাত চলতে থাকায়, কোনও চাকরি খুঁজে পাওয়া ভীষণ কঠিন। সেদেশে বেকারত্বের হার ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। আফগানিস্তানের বেশিরভাগ পরিবার আর্থিক সহায়তার জন্য তাদের কানাডা ও অন্যত্র প্রবাসী আত্মীয়দের ওপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল। এই চ্যালেঞ্জ আফগান উদ্বাস্তুদের ওপর বাড়তি চাপের উৎস, কারণ তাকে একইসঙ্গে নিজের, তার পরিবারের এবং বর্ধিত পরিবারেরও দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়।
প্রকৃতপক্ষে, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা শুরু হয় অভিবাসনের আগে থেকেই যখন আপনি উপলব্ধি করেন যে, আপনার অপেক্ষাকৃত কোনও নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়া দরকার। এই উপলব্ধিই মানসিক উদ্বেগ ও চাপে পূর্ণ। এমনকি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ কোথাও পালিয়ে যাবার বিষয়ে সমস্ত বিবরণ খুঁজে বের করার যে প্রক্রিয়া সেটিও আপনার
মানসিক শক্তি থেকে চরম মূল্য আদায় করে নেয়। অভিবাসনের পথে কিছু আশ্রয়প্রার্থী এমন কোনও অকল্পনীয় অভিজ্ঞতার বা কর্মকাণ্ডের মুখোমুখি হতে পারেন যা পরবর্তী জীবনে স্থায়ী ট্রমায় পরিণত হতে পারে।
ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার বহু সংস্কৃতির সমাজে একীভূতকরণ ও পরিষেবা সংস্থার (অগঝঝঅ) এক জরিপ অনুযায়ী, গড়পরতা কানাডীয়দের চেয়ে নবাগতরা সাধারণত অপেক্ষাকৃত স্বাস্থ্যবান। এই ধারণাটি “স্বাস্থ্যবান অভিবাসী প্রভাব” নামে পরিচিত।
জরিপে ব্যাখ্যা করা হয় যে, এই প্রভাব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে আসতে থাকে।
“নবাগত জনগণের স্বাস্থ্য ক্রমহ্রাসমান হতে থাকে এবং গড়পরতা কানাডীয়দের সঙ্গে মিলে যায়। অভিবাসী ও উদ্বাস্তুদের জন্য কানাডার মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের ক্লিনিক্যাল গাইডলাইনে উল্লেখ করা হয় যে, বাধ্যতামূলক অভিবাসন, স্বল্প আয় এবং ইংরেজি ও ফরাসী ভাষায় সীমিত দক্ষতা অভিবাসীদের স্বাস্থ্যহানির দিকে ঠেলে দেয় এবং তাদের জন্য প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া উচিৎ।”
একজন উদ্বাস্তু হিসাবে আমার অভিজ্ঞতা একদম এরকমই।
কানাডায় অভিবাসনের অভিজ্ঞতা এত বেশি পীড়াদায়ক হবার কারণ, আসলে কেউই এদের নিয়ে ভাবে না। এরা হলো নিছক এমন অনাহূত ও অবাঞ্ছিত উদ্বাস্তু যারা কোনও কাজ না করে শুধু সরকারি সুবিধা ভোগ করে বলে ধারণা করা হয়। যারা এধরণের
দোষারোপ করেন তাদের কোনও ধারণাই নেই যে, উদ্বাস্তুদের জন্য একটি ভদ্রস্থ চাকরি পাবার ক্ষেত্রে কী পর্বতপ্রমাণ বাধার মুখোমুখি হতে হয়।
এই সব বাধা, প্রতিবন্ধকতা, বৈষম্য ও অবহেলা ভোগ করার পর আমি খুবই সততার সঙ্গে এদেশে আসার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি, কিন্তু ফিরে যাওয়ার কোনও উপায় নেই, কারণ আমার জীবন হুমকির মুখে। কানাডায় নিরাপত্তা আর্থিক দুরবস্থা সহনীয় করে দেয়, কিন্তু তা কতদিনের জন্য?
-টরন্টো, ১৫ জুন ২০২২
সৌজন্যে : নিউ কানাডিয়ান মিডিয়া
(লেখক পরিচিতি: রুহুল্লাহ নাদেরী টরন্টোতে বসবাসকারী একজন আফগান রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক। সাবেক ফুলব্রাইট স্কলার নাদেরী যুক্তরাষ্ট্রের লেহাই ইউনিভার্সিটি থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।)