কানাডার পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবেন অতি ডানপন্থী নেতা পিয়েরে পোইলিভরে!

‘কানাডার সবচেয়ে বিপজ্জনক ও ভয়ঙ্কর রাজনীতিবিদ এই ব্যক্তি’

খুরশিদ আলম

কনজারভেটিভ পার্টি অফ কানাডার নতুন নেতা হিসাবে নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন পিয়েরে পোইলিভরে। সর্বশেষ এক জরিপে এরকম সম্ভাবনার কথাই বলা হয়েছে। আর এই সম্ভাবনা যদি বাস্তবে রূপ নেয় তবে তিনি হবেন কানাডার ইতিহাসে এযাবতকালের সর্বোচ্চ মাত্রার এক চরম ডানপন্থী নেতা। টরন্টো স্টার এর কলামিস্ট বব হেপবার্ন এর মতে এই পিয়েরে পোইলিভরে হলেন ‘কানাডার সবচেয়ে বিপজ্জনক ও ভয়ঙ্কর রাজনীতবিদ।’

হয়তো এমনও দেখা যেতে পারে যে, পিয়েরে পোইলিভরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও ছাড়িয়ে যেতে পারেন তার উন্মত্ত ডানপন্থী ভাবধারা ও কর্মকান্ড পরিচালনার মাধ্যমে। যদি তাই হয় তবে স্পষ্টতই কানাডার রাজনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে যাবে। তখন হয়তো কানাডার দৃশ্যমান সংখ্যালঘু বিশেষ করে এশীয় ও আফ্রিকান অশে^তাঙ্গ ইমিগ্রেন্ট ও নাগরিকদের জন্য পিয়েরে পোইলিভরে হয়ে উঠতে পারেন এক বিপর্যয়কর বিপদ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের করা দ্বৈত নাগরিকের নাগরিকত্ব বাতিলের আইনটি তিনি হয়তো আবারও ফিরিয়ে আনতে পারেন। তার সম্ভাবনাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে গত সপ্তাহে যখন স্টিফেন হারপার পিয়েরে পোইলিভরে’র প্রতি জোর সমর্থন জানান। এক টুইটার বার্তায় তিনি বলেন, পিয়েরে পোইলিভরে কনজারভেটিভ পার্টির নেতা হওয়ার জন্য যোগ্যতম প্রার্থী যিনি পরবর্তী ফেডারেল নির্বাচনে দলকে জয়ী করতে পারবেন।

পিয়েরে পোইলিভরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী হারপারের মন্ত্রী সভায় দুই দফায় মন্ত্রীত্ব করেছেন। প্রথমবার ছিলেন গণতান্ত্রিক সংস্কার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী। পরে ছিলেন কর্মসংস্থান ও সামাজিক উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী।

উল্লেখ্য যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের করা দ্বৈত নাগরিকের নাগরিকত্ব বাতিলের বিতর্কিত কালো আইনটি জাস্টিন ট্রুডো ক্ষমতায় এসে বাতিল করে দেন। ফলে কোন দ্বৈত নাগরিকের নাগরিকত্ব হরণ করা যাবে না যদি সে

-কোন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য হয়ে থাকেন বা কোন সংগঠিত সশস্ত্র গ্রুপের সদস্য হয়ে থাকেন যেটি কানাডার সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িত।

-কেউ যদি বিশ্বাসঘাতকতার জন্য সাজা প্রাপ্ত হয়ে থাকেন, গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধে অপরাধী হয়ে থাকেন এবং জাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হয়ে থাকেন।

-কেউ যদি সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য দন্ডপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন অথবা সমজাতীয় অপরাধে বিদেশে অভিযুক্ত হয়ে থাকেন এবং সেই সাজার পরিমাণ যদি ৫ বছর বা তারও বেশী হয়ে থকে।

বিতর্কিত কালো আইনটি বাতিল হওয়াতে এখন উপরে উল্লেখিত কারণে কেউ অভিযুক্ত হলে কানাডার বিদ্যমান আইনে তার বিচার করা যাবে কিন্তু নাগরিকত্ব বাতিল করা যাবে না।

অটোয়ায় ফ্রিডম কনভয়ের একটি মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন কনজারভেটিভ পার্টির এমপি পিয়েরে পোইলিভরে (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)। ছবি: জেরেমি চারন/সিটিভি

গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত ফেডারেল নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টি জয়ী হতে না পারায় দলটির সেই সময়ের প্রধান নেতা এরিন ও’টুল পদত্যাগ করেন। এরপর দলের নতুন প্রধান নেতা নির্বাচনের প্রতিযোগিতা শুরু হলে তাতে যোগ দেন পিয়েরে পোইলিভরে। পোইলিভরে ছাড়াও এই প্রতিযোগিতায় আরও চারজন প্রার্থী আছেন। ঐ চারজনের মধ্যে পোইলিভরে’র প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন জন স্যঁরে যিনি ইতিপূর্বে কুইবেক প্রভিন্সের প্রিমিয়ার ছিলেন। বর্তমানে এরা দুজনই দলের প্রধান নেতা হওয়ার দৌড়ে অন্যদের তুলনায় অনেকদূর এগিয়ে আছেন।

গত ২৩ জুলাই প্রকাশিত Ipsos poll এর জরিপে দেখা গেছে কানাডিয়ানদের মধ্যে জন স্যঁরের জনপ্রিয়তা বেশী। কিন্তু দলের সদস্যদের মধ্যে জনপ্রিয়তা বেশী পোইলিভরে’র। আর দলের নেতা নির্বাচিত হন এই দলীয় সদস্যদের ভোটে।

জরিপে দেখা গেছে কনজারভেটিভ পার্টির সাধারণ সমর্থকদের মধ্যে জন স্যঁরের প্রতি সমর্থন রয়েছে শতকরা ২২ জনের এবং পোইলিভরে’র প্রতি সমর্থন রয়েছে শতকরা ১৫ জনের। কিন্তু কনজারভেটিভ পার্টির দলীয় সদস্যদের মধ্যে পিয়েরে পোইলিভরে’র প্রতি সমর্থন রয়েছে শতকরা ৩৪ জনের। আর জন স্যঁরের প্রতি সমর্থন রয়েছে শতকরা ২৩ জনের। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, পিয়েরে পোইলিভরেই হতে যাচ্ছেন কনজারভেটিভ পার্টি অফ কানাডার পরবর্তী প্রধান নেতা।

গ্লোবাল নিউজ এর জন্য এই জরিপটি পরিচালনা করে Ipsos poll .

বর্তমানে ৪৩ বছর বয়সী পিয়েরে পোইলিভরে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন একেবারে তরুণ বয়স থেকেই। উইকিপিডিয়ার তথ্য থেকে জানা যায়, বয়স ১৮ পার হওয়ার আগেই তিনি ‘রিফর্ম পার্টি অফ কানাডা’র রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পরেন। লেখাপড়া করেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালগারিতে। সেখানে তিনি ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস বিষয়ে পড়াশুনা করেন। ‘আলবার্টা রিপোর্ট’ নামে রক্ষণশীল ভাবধারার একটি ম্যাগাজিনে তিনি কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেন। অর্থাৎ রক্ষণশীলতা বা ডানপন্থী চিন্তাধারা তাঁর মধ্যে ছিল শৈশব থেকেই।

পিয়েরে পোইলিভরে জন্মেছিলেন এক অপ্রাপ্তবয়স্কা মায়ের গর্ভে। ষোল বছর বয়সে তাঁর মা তাঁকে জন্ম দেন। পরে পোইলিভরেকে দত্তক নেন সাস্কাচুয়ানের এক স্কুল শিকক্ষক দম্পতি। পোইলিভরের নানা একজন আইরিস কানাডিয়ান।  

২০০৪ সালে পোইলিভরের মাত্র ২৫ বছর বয়সেই ফেডারেল পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন কনজারভেটিভ পার্টির হয়ে। অটোয়ার নিকটবর্তী  Nepean-Carleton  রাইডিং এ লিবারেল পার্টির এমপি ও মন্ত্রীকে হারিয়ে তিনি সেদিন জয়ী হয়েছিলেন। তারপর থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রতিটি ফেডারেল নির্বাচনেই তিনি এমপি পদে জয়ী হন।

আর এবার তিনি জয়ী হতে চলেছেন নিজ দলের প্রধান নেতা হওয়ার প্রতিযোগিতায়। যদি জয়ী হন তবে সম্ভবত আগামী ফেডারেল নির্বাচনে তিনি কানাডার প্রাধানমন্ত্রীও হয়ে যেতে পারেন।

কানাডার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন তাঁর মধ্যে ছিল সেই শৈশব থেকেই। সেই সময় এক রচনা প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে তিনি ১০ হাজার ডলার পুরস্কারও পেয়েছিলেন। রচনার বিষয় ছিল – প্রধানমন্ত্রী হলে আমি যা করবো। গাড়ির যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী কানাডার সুবৃহৎ প্রতিষ্ঠান Magna International এর উদ্যোগে ঐ রচনা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

পিয়েরে পোইলিভরে নিজেকে একজন সত্যিকারের রক্ষণশীল চিন্তাভাবনার লোক বলে মনে করেন। গত ফেব্রুয়ারিতে বেআইনীভাবে অটোয়া অবরোধকারী ফ্রিডম কনভয়ের লোকেরা কানাডা ডে’র কদিন আগে যখন পুনরায় অটোয়ায় সমাবেশ করার পরিকল্পনা করছিল তখন তিনি তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। এই চরম ডানপন্থীদের একটি মিছিলে কিছু সময়ের জন্য তিনি নেতৃত্বও দেন। মিছিলটি অটোয়ায় অবস্থিত জাতীয় সংসদের কাছে একটি স্ট্রিপ মল থেকে শুরু হয়েছিল এবং ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়ালে গিয়ে সহিংসতার মধ্য দিয়ে শেষ হয়। ঐ মিছিলে চরম ডানপন্থী ও শে^তাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদেরও অংশ নিতে দেখা যায়। এরা কভিড ভেক্সিন এর ঘোর বিরোধী। মহামারী শুরু হওয়ার পর তা মোকাবেলায় যে সকল আইন-কানুন ও স্বাস্থ্যবিধি জারী করা হয়েছিল তারও বিরোধীতা করে আসছিলেন এই ফ্রিডম কনভয়ের সঙ্গে জড়িত লোকেরা। এদের অনেকেই আবার শে^তাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী মতবাদে বিশ^াসী। ভ্যাকসিন বিরোধী আন্দোলনের নামে গত জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহে এবং ফেব্রুয়ারির প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহে কানাডার রাজধানী অটোয়ার কেন্দ্রস্থলের রাস্তাঘাট ও পার্লামেন্ট ভবনের আশপাশের রাস্তাঘাট একেবারেই অচল করে দিয়েছিলেন ফ্রিডম কনভয়ে অংশগ্রহণকারী সহস্রাধিক লরি চালক। একই সাথে কানাডার অন্যান্য শহরেও লরি চালকেরা চালিয়েছিল এই তান্ডব।

ঐ সময়ে কানাডার কেন্দ্রীয় সরকার ভ্যাকসিন বিষয়ে নতুন একটি আইন জারি করলে লরি চালকদের একটি অংশ ফ্রিডম কনভয়ের আহ্বানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে হাজির হয়েছিলেন অটোয়ায় প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নেওয়ার জন্য। প্রতিবাদের অংশ হিসাবে রাস্তায় তাঁরা নিজেদের লরি ও ট্রাক এলোপাথারিভাবে পার্ক করে গোটা অঞ্চলটাকেই কার্যত অবরুদ্ধ করে ফেলেছিলেন। সেখানে তাঁদের কয়েকজনের হাতে চরম অশ্লীল ভাষা সম্বলিত প্ল্যাকার্ড দেখা গিয়েছিল যার টার্গেট ছিলেন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। অন্যদিকে বিশ^যুদ্ধে নিহত কানাডিয়ান সৈন্যদের সম্মানে নির্মিত স্মৃতিসৌধে উঠে নাচানাচি করতেও দেখা গিয়েছিল লরি চালকদের কয়েকজনকে। এমনকি স্মৃতিসৌধের গোড়াতে মূত্রত্যাগ করতেও দেখা গিয়েছিল তাঁদের কয়েকজনকে!

শুধু তাই নয়, ভ্যাকসিন বিরোধী বিক্ষোভ চলাকালে কানাডিয়ান ক্রীড়াবিদ, মানবতা কর্মী ও ক্যান্সার রিসার্স এ্যাক্টিভিস্ট টেরি ফক্স এর ভাস্কর্যের গায়ে ভ্যাকসিন বিরোধী পোস্টার সেঁটে দিতে দেখা গিয়েছিল তাঁদেরকে। কানাডার জাতীয় পতাকাকে অবমাননা করার জন্য সেটি মাস্তুলে উল্টো করে বেধে টেরি ফক্স এর ভাস্কর্যের সাথে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। এতে নিন্দার ঝড় উঠেছিল দেশজুরে।

উল্লেখ্য যে ভ্যাকসিন বিরোধী আন্দোলনের নামে লরি চালকদের একটি অংশ পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে, বাধ্য হয়ে অটোয়ার মেয়র প্রথমে স্থানীয় পর্যায়ে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। পরে অন্টারিও’র প্রিমিয়ারও গোটা প্রভিন্সে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। সবশেষে কেন্দ্রীয় সরকারও সারা দেশে জরুরী অবস্থা জারী করতে বাধ্য হয়েছিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য।

গোটা দেশ তখন ফ্রিডম কনভয়ের বেআইনী তান্ডবে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। অথচ এই বেআইনী সমাবেশকারীদেরকে প্রধান বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টি অব কানাডার অন্তরবর্তীকালীন প্রধান ক্যান্ডিস বার্গেন সমর্থন দিয়েছিলেন এবং পার্লামেন্টের সামনে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে করমর্দনও করেছিলেন। আর এবার তাঁদের সঙ্গে গিয়ে মিছিলে নেতৃত্ব দিলেন পিয়েরে পোইলিভরে যিনি কনজারভেটিভ দলের প্রধান হতে যাচ্ছেন সম্ভবত। এবং সম্ভবত পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীও।

পোইলিভরে সেদিন অটোয়ায় যে এলাকা দিয়ে ফ্রিডম কনভয়ের সমর্থকদের মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সে এলাকার এমপিপি হলেন প্রভিন্সিয়াল নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির চন্দ্র পাসমা।

এমপিপি চন্দ্র পাসমা স্থানীয় পত্রিকা প্রেসপ্রগেস-কে বলেন, ‘একদল লোক প্রতিবাদের নামে ঘৃণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করছে তা দেখা আমাদের কমিউনিটির লোকদের জন্য ছিল বিরক্তকর এক অভিজ্ঞতা। শুধু তাই নয়, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এই ফ্রিডম কনভয়ের লোকদের উৎসাহিত করছে এবং তাঁদের মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছে এটি দেখা ছিল আরো গভীরভাবে হতাশাজনক।’

তিনি আরো বলেন, ‘জনপ্রতিনিধি হিসাবে আমাদের একটি দায়িত্ব রয়েছে এই বিষয়টি নিশ্চিত করা যে এখানে ঘৃণার কোন স্থান নেই এবং ভুল তথ্যেরও কোন স্থান নেই যা আমাদের গণতন্ত্রের হৃদয়কে বিদীর্ণ করে।’

গত ফেব্রুয়ারিতে ফ্রিডম কনভয়ের নেতৃবৃবন্দ ও তাঁদের সমর্থক লরি চালকদের একটি অংশ আন্দোলনের নামে যে ভয়াবহ তান্ডব চালিয়েছিল সেটা স্মরণ করে অটোয়ার স্থানীয় ব্যবসায়ী ও অন্যান্য লোকজন আজও আঁতকে উঠেন। তাঁদের মধ্যে আজও বিরাজ করছে চরম বিরক্তি। সেই সাথে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের লোকজনও চরমভাবে বিরক্ত হয়েছিলেন আন্দোলনের নামে কিছু সংখ্যক লরি চালকের বিবেক বর্জিত আচরণে। অবরোধের নামে এই লরি চালকরা রাত-দিন উচ্চ নিনাদে হর্ন বাজিয়েছিলেন যা তীব্র মানসিক যন্ত্রণা সৃষ্টি করেছিল স্থানীয় জনগণের মধ্যে। লোকজনের স্বাভাবিক চলাচলে বাধা সৃষ্টি করেছিলেন তাঁরা। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁদের অবরোধের কারণে।

আন্দোলনকারী লরি চালকদের কারো কারো আচরণ ছিল অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ। কানাডিয়ান পতাকায় বড় বড় অক্ষরে অশ্লীল শব্দ ‘ঋ*** ঞৎঁফবধঁ’ লিখে সেটি কাধে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে তাঁদেরকে। চরম বর্ণবাদী ও শে^তাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের প্রতীক কনফেডারেট পতাকা নিয়েও ঘুরতে দেখা গেছে আন্দোলনকারীদেরকে। আর এরাই এখন প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছেন কনজারভেটিভ পার্টির এমপি ও সম্ভাব্য প্রধান নেতা পিয়েরে পোইলিভরের কাছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এখন প্রশ্ন উঠতে পারে- পোইলিভরেও কি তাহলে শে^তাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বাবাদী ভাবধারায় বিশ^াসী? কিংবা এই ভাবধারায় যারা বিশ^াসী তাঁদের প্রতি রয়েছে তাঁর জ্ঞাতিসুলভ সহানুভূতি?

‘কানাডিয়ান এন্টি-হেট নেটওয়ার্ক’ এর নির্বাহী পরিচালক ইভান বালগর্ড গ্লোবাল নিউজকে ইতিপূর্বে বলেছিলেন, ‘অটোয়ায় মিছিলের সংগঠকরা প্রথম থেকেই অতি ডানপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। তাঁরা অতীতেও অতি ডানপন্থীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং ইসলাম বিরোধী মন্তব্যও করেছেন।’     

লরি চালকদের মিছিলটি যাঁরা সংগঠিত করেছেন তাঁদের মধ্যে দুজনের নাম দেখা গিয়েছিল চাঁদা উঠানোর ‘GoFundMe’ পেজে। এই দুজন হলেন তামারা লিচ এবং বি.জে. ডিখটার। এদের মধ্যে ডিখটার ২০১৯ সালে পিপল’স পার্টি অফ কানাডা’র এক সমাবেশে শ্রোতাদের ‘রাজনৈতিক ইসলামপন্থীদের’ বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন এবং বলেছিলেন লিবারেল পার্টি ভরে গেছে এই ইসলামপন্থীদের উপস্থিতিতে। উল্লেখ্য যে, পিপল’স পার্টি অফ কানাডা’ হলো একটি চরম বর্ণবাদী রাজনৈতিক দল যাঁরা প্রচন্ডভাবে ইসলাম বিরোধী এবং একই সাথে ইমিগ্রেন্ট বিরোধী।

লরি চালকদের যাঁরা সংগঠিত করেছেন তাঁদের মধ্যে আরেকজন হলেন প্যাট্রিক কিং। তাঁর নামেও অভিযোগ রয়েছে তিনি শ্বেতাঙ্গবাদী চরম ডানপন্থীদের একজন সদস্য। ২০১৯ সালে এক টুইটার বার্তায় তিনি শ্বেতাঙ্গ কানাডিয়ানদের সতর্ক করে বলেছিলেন, তাঁরা যদি এখনি পরিবর্তনের জন্য সজাগ না হন তবে হয়তো দেখা যাবে একসময় তাঁদের নামের সঙ্গে ইসলাম যোগ হয়েছে বা কোন চাইনিজ পদবী যোগ হয়েছে। অন্য এক ভিডিও বার্তায় দেখা গেছে প্যাট্রিক কিং বর্ণবাদী ষড়যন্ত্র তত্ব নিয়ে কথা বলছেন। টুইটারে পোস্ট করা অন্য এক বার্তায় তাঁকে আশংকা প্রকাশ করতে দেখা গেছে এই বলে যে, একটা এন্ডগেম এর পায়তারা চলছে। এই এন্ডগেম হলো- শ্বেতাঙ্গদের নিঃশেষ করে দেয়া। ফেসবুকে প্রদত্ত এক বার্তায় তিনি দাবী করেন কভিড-১৯ প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট কোন ভাইরাস নয়। এটি মানবসৃষ্ট জৈব অস্ত্র।

সুতরাং এখন বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, লরি চালকদেরকে সংগঠিত করার পিছনে কারা কাজ করছেন এবং কি তাঁদের উদ্দেশ্য। দেখা গেছে এই ভ্যাকসিন বিরোধীদের সিংহভাগই শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠির সদস্য এবং শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী মতবাদে বিশ্বাসী। করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে তাঁরা নানারকম কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসে ভুগছেন।

পোইলিভরে একজন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ তাতে কোন সন্দেহ নেই। এবং এটি ভাবারও কোন কারণ নেই যে তিনি নিছক ফটো সেশনের জন্য বা সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য অটোয়ায় ফ্রিডম কনভয়ের সদস্যদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, তাঁদের মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর সুদূরপ্রসারী কোন পরিকল্পনা অবশ্যই আছে এর পিছনে।

টরন্টো স্টার এর কলামিস্ট বব হেপবার্ন সম্প্রতি তাঁর এক কলামে লিখেছেন, ‘স্পষ্টতই কানাডায় ডানপন্থী চরমপন্থা এবং পপুলিজম গ্রহণযোগ্যতা আর্জন করছে আর পিয়েরে পোইলিভরে উৎসাহের সঙ্গে তাতে ইন্ধন যোগাচ্ছেন।’

তাঁর মতে, ‘পিয়েরে পোইলিভরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কৌশল অবলম্বন করছেন আগামীতে কানাডার প্রধানন্ত্রী হওয়ার জন্য। এখন লিবারেল পার্টি আর নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি যদি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অসৎ পোইলিভরেকে অবমূল্যায়ন করেন বা গুরুত্ব না দেন তবে তা হবে তাঁদের জন্য বিপর্যয়কর।’

আমরা দেখেছি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কানাডায় শে^তাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের উত্থান ঘটছে দ্রুত। এরা স্পষ্টতই বর্ণবাদী এবং ইমিগ্রেন্ট বিরোধী। বিশেষত অশে^তাঙ্গ ইমিগ্রেন্টদের বিরুদ্ধে তাঁদের ক্ষোভ সবচেয়ে বেশী। এরপর তাঁদের মধ্যে আরো আছে ইসলামোফোবিয়া। ইতিপূর্বে কুইবেক সিটিতে ৬ জন মুসলিম এবং অন্টারিও’র লন্ডনে এক মুসলিম পরিবারের ৪ জনকে হত্যা করেছে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা। অনলাইনে এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরা অনেক সক্রিয়।

পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় ফেডারেল লিবারেল সরকার গত বছর ৩ ফেব্রুয়ারী ‘প্রাউড বয়েস’ সহ মোট ১৩টি চরমপন্থী গ্রুপকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। কানাডার এই উদ্যোগ আদর্শিকভাবে অনুপ্রাণিত চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। আর কানাডাই প্রথম দেশ যারা প্রাউড বয়েস নামের সংগঠনটিকে সন্ত্রাস সৃষ্টির ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকি হিসাবে চিহ্নিত করেছে।

কানাডার গ্লোবাল নিউজ জানায়, ১৩ টি সন্ত্রাসী সংগঠন এর মধ্যে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদে বিশ্বাসী দল রয়েছে চারটি। এগুলো হলো- The Proud Boys, Atomwaffen Division, the Base এবং Russian Imperial Movement। আরো যে কটি সংগঠনকে তাদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য চিহ্নিত করে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে সেগুলো হলো, মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ইসলামিক স্টেট এর ৫টি অঙ্গ শাখা, আল-কায়দার ৩টি অঙ্গ শাখা এবং হিজবুল্লাহ মুজাহিদিন। সন্ত্রাসী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এই সংগঠনগুলোর পক্ষে কানাডায় কোন সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানো কঠিন হয়ে উঠবে। সরকার কানাডায় এদের কোন সম্পদের খোঁজ পেলে তা জব্দ করতে পারবে।

লক্ষ্যনীয় যে, এই শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা নানান ইস্যুতে কানাডায় তৎপর হয়ে উঠেছেন সাম্প্রতিক সময়ে। টরন্টো, মন্ট্রিয়ল ও ভেঙ্কুভার সহ নানান স্থানে তারা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছেন, র‌্যালী ও সমাবেশ করার চেষ্টা করছেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ইতিপূর্বে বলেছেন ‘যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী বা আধিপত্যবাদীদের তৎপরতার পর কানাডা এ থেকে মুক্ত থাকতে পারবে এ কথা ভাবার কোন কারণ নেই।’

সাম্প্রতিককালে কানাডায় এই শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে কানাডার মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতেও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সিবিসি নিউজে ইতিপূর্বে প্রকাশিত জনাথন মন্টপেটিট এর এক প্রতিবেদনে উল্ল্খে করা হয় “৯/১১ এর পর থেকে কানাডার গোয়েন্দা বিভাগের অধিকাংশ মনোযোগ নিবদ্ধ করা হয় ইসলামী জঙ্গীদের উপর। কিন্তু আইএস বা আল-কায়দার মত জঙ্গী গোষ্ঠির উপর যতটা গুরুত্ব দেয়া হয়ে আসছে, ততটা গুরুত্ব  কানাডিয়ান সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস এবং রয়েল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ এর পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে না শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের উপর।”

২০২০ সালের নতুন এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বেশ কিছু প্লাটফর্মে ৬৬০০-র বেশি অনলাইন চ্যানেল, পেজ, দল এবং ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে কানাডীয়রা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ এবং এ ধরণের অন্যান্য চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে দিচ্ছে। আর এদের সঙ্গে ফ্রিডম কনভয়ের কোন কোন নেতার রয়েছে সখ্যতা। এবং সেই ফ্রিডম কনভয়ের আন্দোলনকে উৎসাহ দিতে রাস্তায় নেমেছেন পিয়েরে পোইলিভরে। এখন তিনি যদি কানাডার কনজারভেটিভ পার্টির প্রধান নেতা নির্বাচত হন এবং আগামীতে যদি কোনভাবে প্রধানমন্ত্রীর পদ দখল করতে পারেন তবে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিবে তা সহজেই অনুমেয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নজীর দেখিয়ে গেছেন। এই পরিস্থিতিতে লিবারেল পার্টি আর নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি যদি আরো সক্রিয় না হয় তবে কানাডাও অদূর ভবিষ্যতে সরকারী ক্ষমতায় একজন ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প’-কে পাবে যিনি কানাডাকে আরো বিভক্তির দিকে ঠেলে দিবেন। অশে^তাঙ্গ ইমিগ্রেন্ট বিরোধীতা এবং ইসলামোফোবিয়া তখন হয়ে উঠবে সরকারের অঘোষিত গোপন নীতি।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক

প্রবাসী কণ্ঠ

টরেটক্কা টরন্টো