প্রবাসে পরহিতকর্ম -৯৬

ইউরোপের পথে পথে

রীনা গুলশান

(পূর্ব প্রকাশের পর)

Wengen এ নামার সময়ও ট্রেনের গাইড বললো, এখানে সবাই নেমে পড়। এখানে ২ ঘন্টা বা তার অধিক সময় থামতে পারো। কারণ যারা Kleine scheidegg এ যেতে চায় তাদেরকে আবারও (মাথাপিছু) ৪০ ফ্রাঙ্ক করে দিতে হবে। এবারে সকলে খুবই চিৎকার চেচামেচি করলো। কেমন যেন মনের আনন্দ নষ্ট হবার মত। তারপর সবার কাছে এত ক্যাশও থাকে না। খুবই চতুর এরা। কারণ এরা জানে যে পৃথিবীর ‘সবথেকে’ বেশী উচ্চতা কে, সবাই এত দূর এসে ছুঁতে চাইবে। তারপরও অধিকাংশ মানুষই ওখানে গেল না।

আমাদের টুরের প্যানারোমিক ট্রেন। ছবি : লেখক

যাইহোক, আমরা Wengen এ একঘন্টার মত কাটিয়ে তারপর ট্রেনে উঠলাম Kleine scheidegg এ যাবার জন্য। আমি আর আমার স্বামী একদম রাজী ছিলাম না। কারণ আমরা শুনলাম মাত্র আধা ঘন্টার মত পথ ট্রেনে। কিন্তু রায়হান আমাদের রাজী করালো। আমরা অতপর ওখানে রওনা দিলাম। একই সেই সুন্দরের সারি সারি ছবি। যেন সৌন্দর্যের কোন সীমা পরিসীমা নাই। সত্যিই ২০ মিনিটের মধ্য চলে এলো। নীচে নেমে প্রথমেই মাহিন একটা চিৎকার দিল। মোটুমুটি আমাদের সবারই একই অবস্থা। মনে হলো আমরা ধোয়ার বাতাসে ভাসছি। চারপাশে পাহারগুলো সব মনে হচ্ছে গায়ে সুরমা বা কালো রঙ মেখেছে। দূরে দূরে বেশ কিছু বাড়ি ঘর বা ছোট গ্রামের হাতছানি। এখানেও মানুষ থাকে? কি আশ্চার্য! আমরা এখন ইউরোপের হাইয়েস্ট উচ্চতায়, ট্রেন লাইনে আছি। এটা সী লেভেল থেকে ২০৬১ মিটার (৬৭৬২ ফুট) উচ্চতায়।

আমি রীতিমত নির্বাক হয়ে পড়েছিলাম। যদিও এটা সুইজারল্যান্ডের হাইয়েস্ট মাউনটেন পিক নয়। সেটা পরপর তিনটা আছে। তবে ১ নম্বরটা হলো Monte Rosa। সেখানে যেতে হলে আপনাকে হাইকিং বা ট্রেকিং করে যেতে হবে। আমি আমার ভাঙ্গা পা দুটোর দিকে তাকিয়ে হেসে দিলাম। তারপরও আল্লাহর কাছে কোটি কোটি শোকর যে, মানুষের তৈরী এই ট্রেন লাইনের দৌলতে আল্লাহ পাকের এই কুদরত আমি চাক্ষুস করতে পারলাম। এর আগে আমি ভারতের হাইয়েস্ট পিক (যতদূর গাড়িতে যাওয়া যায়) ‘উটি’র (Ooty) ‘এফিফেন্ট টাওয়ারে’ গিয়েছিলাম। সেটার উচ্চতা এটার মতোই। তবে আমরা প্রথমে বাসে উটি পর্যন্ত, তারপর এলিফেন্ট টাওয়ারে প্রাইভেট টেক্সীতে করে গিয়েছিলাম। সেটার উচ্চতা ছিল ২৬২৩ মিটার। এটা তামিলনাড়ু’র নীলগিরি জেলার মধ্যে পড়েছে এবং তারও ডবলের বেশী উচ্চতা।

আমাদের টুরের প্যানারোমিক ট্রেন। ছবি : লেখক

যাইহোক কষবরহব Kleine scheidegg এসে খুবই শান্তি শান্তি লাগছিল। কারণ এখানে আমরা ট্রেনে করে খুব আনন্দ করতে করতে এসেছি। রায়হান বললো, মামনি চলো সৌন্দর্য দেখার আগে একটু পেট পুজো করে নেই। আমার ছেলেটা একদম ক্ষিধে সহ্য করতে পারে না। একটু হাটতেই একটা ঝকঝকে  রেললাইনের পাশেই) রেস্টুরেন্ট চোখে পড়লো। পরপর তিনটা। আমরা যেটাতে ঢুকলাম সেটা খুব সুন্দর। ভেতরে লোকজনে বেশ ভারপুর। একটাই টেবিল খালি ছিল। রায়হান মেনু এবং তার দাম দেখে রীতিমত নড়েচড়ে বসলো। আমরা তিনজনই বললাম, আমাদের ক্ষিধে নাই। অতএব রায়হান একটা পাস্তা এবং একটা ফেঞ্চ ফ্রাই অর্ডার করলো। তার দাম ৪৬ ফ্রাঙ্ক। মজার ব্যাপার, পাস্তাটা সার্ভ করলো এরা আইসক্রিমের পাত্রে, একটু বড়। খুব কায়দা করে সার্ভ করলো বেকায়দা মূল্য নিয়ে। আমরা একটু টেস্ট করলাম। খুবই নরমাল টেস্ট। দাম দেখেতো আমার স্বামী রীতিমত মেজাজ খারাপ করে বাইরে বেরিয়ে গেল। যাইহোক আমরা বাইরে বেরিয়ে রেললাইনটা ক্রস করে পাহাড়ের সীমানায় গেলাম। সবাই এখানেই জড়ো হয়ে ছবি তুলছে এবং ভিডিও করছে। আমি ঐ কিনারায় গিয়েতো স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমাদের নীচে মনে হচ্ছে অন্য একটা পৃথিবী। মনে হচ্ছে অন্ধকার একটা গুহা। আর সেখান থেকে কুয়াশা কুন্ডলী পাকিয়ে উপরে উঠে আকাশের কাছে গিয়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আমি কি যে বলবো, ভাষা নাই। মাহিন কিছু ছবি তুললো। আমি একটা ছবিও তুলিনি। রায়হানও কিছু ছবি তুললো। পরে আমি অবশ্য কিছু ছবি আর ভিডিও করলাম। আমি শুধু চারপারে ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। মনে হচ্ছে একটা অদ্ভূত সৌন্দর্যের বলয়ের মধ্যে আমি অবস্থান করছি। এত সুন্দর এই পৃথিবী Ñ

‘মেয়েটি একদিন পাখি হতে চেয়েছিলো।

নীলাম্বরী আকাশে সে একটুখানি পাখা মেলার

আনন্দ চেয়েছিল Ñ

কিন্তু  একদিন সে হঠাৎ আকাশ হয়ে গেল।

সে হয়েছিল সব পাখিদের উন্মুক্ত ঠিকানা।’

আজ এই অসম্ভব ভাললাগার মুহুর্তে মহাদেব সাহা না এসে পারে? মনে হচ্ছে আমিও ওদের মত চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করি।

কিন্তু আমি আল্লাহকে সাক্ষি রেখে আমার ছেলেটাকে হৃদয় উজার করে দোয়া করলাম। মাত্র কিছুক্ষণ আগে যখন আমি মৃত্যুর কথা ভাবছিলাম তখন আমাকে দু’হাত ভরে বেঁচে থাকার আনন্দ দিল আমার ছেলেটা। আমার পুঞ্জিভূত স্বপ্নকে রায়হান যেন, বাস্তবে রূপ দিল ক্ষণস্থায়ি এই পৃথিবীতে। এই একটি মাত্র ক্ষণ ভঙ্গুর জীবনে, এই স্মৃতিগুলো আমার হৃদয়ে মনি মুক্তোর মত জ¦ল জ¦ল করবে। আমি আমার গোটা জীবনে খুব বেশী মানুষের সাথে আড্ডাবাজী করতে ভালবাসি না। তারচেয়ে বরং অনেক বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করি কবিতা আবৃত্তি করতে, বই পড়তে আর এরকম ঘুরে বেড়াতে।

এই ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ যেন আমার রক্তের মধ্যে মিশে আছে। বাউল গানের সুরে ঘুরে বেড়ানোর মত্ততার আনন্দ কাউকে কি বলে বোঝানো যায়??

 (চলবে)

রীনা গুলশান। টরন্টো।

gulshanararina@gmail.com