টরন্টোতে এশীয়দের বিরুদ্ধে ঘৃণাজনিত অপরাধ ২০২১ সালেও অব্যাহতভাবে বেড়েছে
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : টরন্টো পুলিশের নতুন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দুই বছরের বেশি সময় ধরে কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যেও এশীয় কমিউনিটির বিরুদ্ধে ঘৃণাজনিত অপরাধ বেড়েছেÑ তবে একজন প্রবক্তা বলেন, এই পরিসংখ্যান “মোটেই বিস্ময়কর নয়।”
সম্প্রতি প্রকাশিত টরন্টো পুলিশ সার্ভিসের এক রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, এই নগরী এশীয়, কৃষ্ণাঙ্গ, ইহুদি ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণাজনিত মৌখিক হুমকি, শারীরিকভাবে আঘাত করা এবং গুণ্ডামির মত ঘটনা বৃদ্ধির আরও একটি বছর কাটালো। খবর সিবিসি নিউজের। রিপোর্ট করেছেন সারা জবাখানজি।
২০২১ সালে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা হয়েছে এমন ঘৃণাজনিত অপরাধের ঘটনা ঘটে মোট ২৫৭টি, যা ২০২০ সালের তুলনায় ২২ শতাংশ বেশি। ২০২০ সালে এমন ঘটনা ঘটেছিল ২১০টি।
রায়ান চ্যান বলেছেন, “পুলিশ যে প্রতিবেদন দিয়েছে তাতে বোঝা যায়, এ বিষয়ে তাদের কাছে এখনও অভিযোগের অপর্যাপ্ততা আছে। এ ধরণের অপরাধ বাড়ছে জেনেও বেশি কিছু না করায় আমরা আসলে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ।” রায়ান চ্যান হচ্ছেন সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য চীনা-কানাডীয় জাতীয় কাউন্সিলের অনলাইন ও সামাজিক মাধ্যমে ঘৃণা ছড়ানোর বিরুদ্ধে সক্রিয় একটি প্রকল্পের প্রধান।
পুলিশের রিপোর্টে বলা হয়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বা স্বদেশের পরিচয়ের কারণে যখন কারও ওপর ঘৃণাপ্রসূত হামলা চালানো হয় তখন সেগুলিকে প্রকৃতি অনুযায়ী জাতিগত বা জাতীয় হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।
রিপোর্টে বলা হয়, ২০২১ সালে যেসব ঘৃণাজনিত অপরাধের অভিযোগ এসেছে সেগুলোর কারণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল ধর্মীয় পরিচিতি, জাতিগত বা জাতীয় উৎস এবং বর্ণ ইত্যাদি।
পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী, তিন ধরণের ঘৃণাজনিত অপরাধ সবচেয়ে বেশি ঘটেছে; এগুলি হলো সম্পত্তির হানি করা, আঘাত করা এবং মৌখিক হুমকি। এই রিপোর্ট ৬ মে পুলিশ সার্ভিস বোর্ডের কাছে পেশ করার কথা।
সবচেয়ে বেশি হামলার শিকার হয়
পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব এশীয় কমিউনিটি
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জাতিগত বা জাতীয় পরিচয়ের কারণে সবচেয়ে বেশি হামলার শিকার হয়েছে পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় কমিউনিটি।
জাতিগত পরিচয় বা জাতীয়তার কারণে হামলার ঘটনা ঘটে ৫৭টি, যার মধ্যে ৪১টিই ছিল ওই দুটি কমিউনিটির মানুষের বিরুদ্ধে। এই হামলার সংখ্যা ২০২০ সালের সাত শতাংশের বিপরীতে ২০২১ সালে ঘটে ১৬ শতাংশ বেশি।
রিপোর্টে বলা হয়, “২০২১ সালে বৈশি^ক করোনাভাইরাসজনিত স্বাস্থ্য সঙ্কট এবং ভূরাজনৈতিক ঘটনাবলি ঘৃণাজনিত অপরাধ বেড়ে যাবার অন্যতম মূল কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।”
পুলিশ বলছে, ঘৃণাপ্রসূত হামলার চারটি ঘটনায় সন্দেহভাজন হামলাকারী “কোভিড-১৯ মহামারির জন্য চীনকে দায়ী করে।”
রিপোর্টে বলা হয়, ২০২১ সালের মার্চ মাসে এশীয়দের বিরুদ্ধে ঘৃণাজনিত অপরাধের “উল্লেখযোগ্য” বৃদ্ধি দৃশ্যত আটলান্টার একটি ম্যাসাজ পার্লারে গণ-গুলিবর্ষণের ঘটনার সঙ্গে যুগপৎ ঘটেছে, যাতে ছয়জন এশীয় নারী ও দুজন পুরুষ নিহত হন।
পুলিশ জানায়, যেসব ঘটনার তদন্ত করা হয়েছে তার সব কটিতেই হামলাকারী তার শিকারকে ঘুষি মেরেছে, ধাক্কা দিয়েছে অথবা থুথু ছিটিয়েছে। সেইসঙ্গে ছিল অপমানজনক মন্তব্য।
সর্বাধিক হামলার শিকার ধর্মীয় গ্রুপ
হলো ইহুদি ও মুসলিমরা
রিপোর্টে বলা হয়, ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি হামলার শিকার ধর্মীয় গোষ্ঠী হলো ইহুদি ও মুসলিমরাÑ অভিযোগ করা হয়েছে এমন মোট ঘৃণাজনিত অপরাধের ৫৯ শতাংশই ঘটে ইহুদিবিরোধী দুর্বৃত্তপনা-সম্পর্কিত হামলা।
৭৫টি ধর্মসম্পৃক্ত অপরাধের ঘটনার মধ্যে ৫৬টিতে হামলার শিকার ব্যক্তি ছিলেন ইহুদি। আর ১৪টি ঘটনায় মুসলমান ব্যক্তি হামলার শিকার হন।
উল্লেখিত ৭৫টি ঘটনার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ৪২টিতে অপমানকর চিত্র আঁকা এবং সম্পত্তি বিনষ্ট করাসহ সম্পদহানির মত বিষয় জড়িত ছিল।
রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয় যে, বিভিন্ন কমিউনিটিতে ঘৃণাজনিত অপরাধের তদন্ত ও প্রতিরোধের ক্ষেত্রে পুলিশের কাছে কম অভিযোগ করার বিষয়টি এখনও একটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে রয়ে গেছে।
খুব ঘনঘন আক্রমণের শিকার হওয়া একটি গোষ্ঠী হলো কৃষ্ণাঙ্গরা। এ ধরণের ৫৪টি হামলার ঘটনার ৫৪টিই ঘটেছে কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে।
২৫৭টি ঘৃণাজনিত অপরাধের মধ্যে ৩৩টির শিকার হয় এলজিবিটিকিউ কমিউনিটির লোকেরা।
টরন্টোর আইনজীবী তানিয়া ওয়াকার বলেন, ঘৃণাজণিত অপরাধের দায়ে কোনও ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা খুবই চ্যালেঞ্জিং বিষয়। আর সম্ভবত এটাই হামলার ঘটনা পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে মানুষের মধ্যে দ্বিধার আংশিক কারণ।
ওয়াকার বলেন, “অভিযোগ করার ফলে যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, মনে হয় সে কারণেই লোকেরা এ নিয়ে এগিয়ে আসতে অনীহ… আর এটা যদি ঘটে কোনও কর্মস্থলে তাহলে হয়তো তাদেরকে আরও বেশি ঘৃণার শিকার হতে অথবা উদ্বিগ্ন অবস্থার মোকাবেলা করতে হতে পারে।”
আদালতে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রমাণ দেবার দায় ভুক্তভোগীর ওপর আর রাষ্ট্রকে প্রমাণ করতে হয় যে, সত্যি সত্যি ঘৃণাজনিত কারণেই হামলা করা হয়েছিল কিনা।
ওয়াকার বলেন, “ঘৃণাজনিত অপরাধের ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যের একটা ভূমিকা থাকে আর ভুক্তভোগীকে যৌক্তিক সন্দেহের ঊর্ধ্বে থেকে সেই উদ্দেশ্য প্রমাণ করতে হয়।
“আর অন্য কোনও ব্যক্তির মনে কী উদ্দেশ্য ছিল সেটি প্রমাণ করা খুবই কঠিন একটি কাজ।”
ওয়াকার বলেন, অপরাধ যে ঘৃণাজনিত ছিল না সেটা প্রমাণের দায় অভিযুক্তের ওপরই থাকা দরকার।
চ্যান বলেন, এশীয়দের বিরুদ্ধে ঘৃণাজনিত অপরাধ বেড়ে যাওয়ার ঘটনায় তিনি বিস্মিত নন।
তিনি বলেন, “এটা অবশ্যই খুব, খুব বিচলিত হবার মত ঘটনা কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটা মোটেও বিস্ময়কর নয়।”
গত মাসে চীনা-কানাডীয় জাতীয় কাউন্সিলের টরন্টো শাখা এবং প্রজেক্ট ১৯০৭ নামের একটি তৃণমূলের সংগঠনের প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়, ২০২১ সালে সমগ্র কানাডাজুড়ে বর্ণবাদী ঘটনা বেড়েছে ৪৭ শতাংশ। ওই সমীক্ষায় দেখা যায়, এখনও অভিযোগের বেশিরভাগই পেশ করেছেন নারীরা কিন্তু শিশু ও বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের পক্ষ থেকে দায়ের করা অভিযোগের সংখ্যা বেড়েছে ২৮৬ শতাংশ।
সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, সহিংস হামলার প্রবণতা ঊর্ধ্বমুখি। এশীয় লোকেদের প্রতি কাশি বা থুথু ছিটিয়ে দেওয়ার অভিযোগ বেড়েছে ৪২ শতাংশ।
চ্যান বলেন, “সুতরাং এমনটাই মনে হয় যে, বর্ণবাদের অনেকটাই (এখনও) কোভিড-১৯ এর সঙ্গে সম্পর্কিত।”
কিন্তু, আমি মনে করি না, এরকমটাই মনে হওয়াই এর পরিধি। এশীয়বিরোধী ঘৃণার কারণ আসলে অনেক, অনেক গভীরে। হামলার পরিমাণ বেড়ে যাওয়াটা হলো নিছক এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত।”