কুইবেকে নতুন ভাষা আইনের কারণে অভিবাসীদেরকে কিছু অধিকার পেতে লড়াই করতে হতে পারে

আইনের একটি ধারায় নবাগতদেরকে ছয় মাসের মধ্যে ফরাসী ভাষা শিখে নেয়ার বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়েছে

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক, ২৭ মে ২০২২ : মন্ট্রিলে অভিবাসী, প্রবাসী শ্রমিক ও উদ্বাস্তুদের সহায়তাকারী গ্রুপগুলো বলছে কুইবেকের পুনর্গঠিত ভাষা আইনের কারণে সেখানে তাদের গ্রাহকদেরকে কিছু মৌলিক অধিকার পেতে লড়াই করতে হতে পারে। খবর ভেরিটি স্টিভেনসন/ সিবিসি নিউজ।

কুইবেক প্রদেশের ফরাসী ভাষা সম্পর্কিত সনদ ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে আনীত বিল ৯৬ গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে আইন হিসাবে পাস করা হয়েছে। এই আইনে ব্যাপকতর অর্থে আদালত ও সরকারি পরিষেবায় ইংরেজি ভাষার ব্যবহার সীমিত করা হয়েছে এবং সাধারণ শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষায়তনের শিক্ষার্থী, ক্ষুদ্র ব্যবসায় এবং পৌরসভার জন্য ফরাসী ভাষা ব্যবহারের বিষয়ে আরও কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে।

আইনের একটি ধারায় নবাগতদেরকে এখানে আসার ছয় মাসের মধ্যে ফরাসী ভাষা শিখে নেয়ার বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়েছে। ছয় মাস পর তারা আর অন্য কোনও ভাষায় সরকারি সেবা পাবে না।

সমাজকর্মীরা বলছেন, এই আইনের কারণে তাদের গ্রাহকদের ন্যায়বিচার লাভের সুযোগ পাওয়া এমনকি দৈনন্দিন কাজকর্ম সম্পাদনও কঠিন হতে পারে এবং তাদেরকে আরও বেশি বিচ্ছিন্নতা ও বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

তাদের বিশ্বাস, কুইবেক একটি দুই স্তরবিশিষ্ট অভিবাসন ব্যবস্থা তৈরি করছে যেখানে সঙ্কট থেকে পালিয়ে আসা সেইসব লোকদের আগমন নিরুৎসাহিত করা হবে যারা শুধু ইংরেজি বলতে পারে, যদিও এই প্রদেশে শ্রমিকের চাহিদা দিন দিন বাড়ছেই। অন্যদিকে উল্লেখযোগ্য শ্রমিক ঘাটতি পূরণে প্রদেশটি নিম্ন-মজুরির চাকরিতে বিদেশি অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগের ওপর নির্ভর করছে।

পাইনে (PINAY) নামের একটি ফিলিপিনো নারী অধিকার গ্রুপ পরিচালনাকারী ইভেলিন ক্যালুগে বলেন, “আমরা সত্যিই বৈষম্যের শিকার বলে বোধ করছি।”

ক্যালুগে ব্যাখ্যা করে বলেন, কুইবেকে আসা ফিলিপিনোদেরকে প্রায়শ বাধ্য হয়েই গৃহকর্মীর মত অনিশ্চিত কাজে নিয়োজিত হতে হয়। এতে তারা ফরাসী ভাষা শেখার মত সময় করতে পারে না। তারা এমন একটি দেশ থেকে আসেন যেখানে আটটি আলাদা উপভাষা রয়েছে।

বর্তমানে ৭৬ বছর বয়সী ক্যালুগে কুইবেকে আসেন ১৯৭৫ সালে যখন প্রদেশটি নার্সের চরম সঙ্কটে ছিল। তিনি বলেন, ফরাসী ভাষা বুঝতে এবং এই ভাষায় মনোভাব প্রকাশ করার মত পর্যায়ে পৌঁছাতে তাকে পূর্ণকালীন ফরাসী ভাষার ক্লাস করতে হয়েছে পুরো এক বছর।  

ক্যালুগে বলেন, “আমরা স্কুলে ইংরেজি শিখেছি, কারণ এটা আমেরিকার ব্যবস্থা থেকে নেয়া, সুতরাং ভাষাটা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর এর আগে আমাদের পূর্ব-পুরুষদেরকে স্প্যানিশ ভাষা বলতে বাধ্য করা হয়েছিল।” ফিলিপাইন প্রথমে স্পেনের এবং পরে আমেরিকার উপনিবেশ ছিলো। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর দেশটি স্বাধীনতা পায়।

ক্যালুগে বলেন, ফরাসী ভাষা সংরক্ষণের ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়ার তিনি প্রশংসা করেন এবং কুইবেক ও কানাডার আইন ও রীতিনীতি অনুসরণও করেন, কিন্তু সংশোধিত ভাষা সনদটি এখন ফরাসী ভাষা সংরক্ষণের উপায় নয় বরং জোর-জবরদস্তি বলে মনে হচ্ছে।

তিনি বলেন, “আমরা এখন এমনকি অস্থায়ী শ্রমিকদেরকেও কুইবেকে আসতে উৎসাহিত করছি না।”

প্রিমিয়ার অভিবাসনের দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন

কুইবেকের প্রিমিয়ার François Legault গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, ভাষা সম্পর্কিত আইন পাশের পর, এখন তিনি বৃহত্তর সংখ্যক এমন অভিবাসী আনার ব্যাপারে মনোযোগ নিবদ্ধ করতে চান যারা আগে থেকেই ফরাসী জানে। এই বিষয়টিকে তিনি আসন্ন নির্বাচনে প্রচারণার ইস্যু করবেন বলেও উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, তার সরকার অভিবাসী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ফরাসীভাষীদের অনুপাত ৫৫ থেকে ৮৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রদেশে ফরাসীভাষী অভিবাসীর অনুপাত অনুমোদন করে মাত্র ৫০ শতাংশের মত।

কুইবেক অর্থনৈতিক অভিবাসন কার্যক্রম পরিচালনা করে যেটা কানাডার অন্য কোনও প্রদেশ করতে পারে নাÑ আর উদ্বাস্তু বিষয়ক সব দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের আওতায়।

ক্যালুগে উল্লেখ করেন যে, কুইবেক যদি উদ্বাস্তুদের আনার ক্ষমতাও পায় তাহলে তারা খুব কার্যকরভাবেই ফরাসী ভাষায় দক্ষতার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট কিছু দেশ থেকে লোক আনা সীমিত করতে পারবে এবং প্রধানত মেক্সিকো, গুয়াতেমালা ও হন্ডুরাসের মত দেশগুলি থেকে আরও বেশি সংখ্যক অস্থায়ী শ্রমিক আনতে পারবে।

তিনি বলেন, “কারণ, এটা হবে সস্তা- পুঁজিবাদ কী চায়? সস্তা শ্রমিক, নিঃসন্দেহে।”

ক্যালুগের সঙ্গে একমত পোষণ করে মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স সেন্টারের মোস্তফা হেনাওয়ে বলেন, সরকার দৃশ্যত তার ভোটারদের তুষ্ট করতে অস্থায়ী অভিবাসী শ্রমিক আনার বিষয়ে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

টেলিফোনে দেয়া সাক্ষাৎকারে হেনাওয়ে বলেন, “এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, সরকার অস্থায়ী এবং এক ধরণের ছুঁড়ে ফেলার মত, নমনীয় শ্রমশক্তির ওপর প্রাধান্য দিচ্ছে।”

প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো কুইবেকে অভিবাসন প্রক্রিয়ার ওপর প্রদেশটির পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দেয়ার জন্য লেগল্ট-এর আহবান এ যাবৎকাল নাকচ করে এসেছেন তবে, তিনি কেন্দ্রে লিবারেল দলের উত্থাপিত সি-১৩ বিলের কথা উল্লেখ করে যেটির আংশিক লক্ষ হলো ফরাসী-ভাষী দেশগুলো থেকে অভিবাসন বাড়ানো।

সিবিসি নিউজকে দেয়া এক বিবৃতিতে কুইবেকের অভিবাসন, শ্রম ও ফরাসীকরণ বিষয়ক মন্ত্রী জিন বাওলেট বলেন, কুইবেকের ফরাসী চরিত্রদান এবং এখানকার দাপ্তরিক ভাষা টিকিয়ে রাখার জন্য কুইবেকে ফরাসী-ভাষীদের অভিবাসনে অগ্রাধিকার দেয়া জরুরী।”

বাওলেট বলেন, “অস্থায়ী শ্রমিকদের দায়িত্ব আবশ্যকীয়ভাবেই কেন্দ্রীয় সরকারের এবং এই শ্রেণীর অভিবাসীদের আগমনে কোনও প্রান্তিক সীমা বেঁধে দেয়া নেই।”

২০২১ সালে কুইবেকে প্রায় ২৪ হাজার অস্থায়ী বিদেশি কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এটিই এই প্রদেশে এযাবৎকালের সর্বোচ্চ সংখ্যা এবং এটি আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৭ হাজার বেশি। কুইবেক গত বছর ঘোষণা করে যে তারা কেন্দ্রের সঙ্গে এমন চুক্তি করেছে যাতে প্রদেশের কোম্পানিগুলি ওই অঙ্কের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি জনবল নিয়োগ দিতে পারবে।

শিশুরা যখন অনুবাদক

মন্ট্রিলের পার্ক-এক্সটেনশন এলাকার Afrique au Féminin নামের সংগঠনের পরিচালক মিজ. রোজ নজেল-এর মতে ভাষা সম্পর্কিত বাড়তি বিধিনিষেধ সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে ফেলবে সেই সব মানুষকে যারা কয়েক বছর ধরে কুইবেকে বসবাস করছেন কিন্তু সময় ও অর্থাভাবে ফরাসী ভাষা শেখার কোর্স করতে পারেননি।

নজেল স্থানীয় অনুবাদকদের একটি গ্রুপকে সহায়তা করেন। এই অনুবাদকদের মধ্যে রয়েছেন এমন লোকেরা যারা পার্ক এক্সটেনশন এলাকায় বসবাসরত ১৩০ টিরও বেশি ভাষার মানুষের অনেকগুলি ভাষা বলতে পারেন। ভাষাগুলোর মধ্যে রয়েছে স্প্যানিশ, পাঞ্জাবি, হিন্দি, লিঙ্গালা, উর্দু এবং তামিল।

নজেল বলেন, নতুন আইন পাস হবার আগে স্থানীয় স্কুলবোর্ডের একজন কর্মচারী, স্কুলের শিক্ষক সভার কার্যক্রম অভিভাবকদের কাছে তরজমা করার জন্য অনুবাদক চেয়ে তার সাথে যোগাযোগ করেন।

নজেল বলেন, “পার্ক-এক্সটেনশন এলাকায় যারা ফরাসী বলেন তারা অন্য জায়গা থেকে এখানে এসেছেন।”

“এর বাইরে ফরাসী ভাষার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে যাওয়া শিশুরা এই ভাষায় কথা বলে।”

তিনি বলেন, কিছু বাচ্চা অনেক সময় স্কুল কামাই করতে বাধ্য হয় ফরাসী ভাষার অনুবাদক হিসাবে কাজ করার কারণে। যেমন, তাদেরকে ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে ফরাসী ভাষায় বাবা-মা অথবা দাদু-দিদার সমস্যার ব্যাখ্যা দিতে হয়।

ফরাসী ভাষায় নজেল বলেন, “বর্তমানে যে আইন করা হলো তার ফলে ওই ধরণের ঘটনা আরও বেশি ঘটবে। বাচ্চাদের সহায়তা ছাড়া বাবা-মায়েরা কিছুই করতে পারবেন না। দুর্ভাগ্য যে, এটাই আমাদের প্রকৃত অবস্থা।”