মানুষের কথা
সাইদুল হোসেন
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আজ ও আগামীকাল
আজকের দিনটা যেমন আছে, ঠিক তেমনি আগামীকালও আছে। এবং আগামীকালের অনিশ্চয়তাও আছে। এইতো জীবন।
মানুষের জীবনটা তো কতগুলো আজ এবং আগামীকালের সমষ্টি মাত্র। আগামীকালের বিজয় আমাদের এনে দেবে নিরাপত্তা, সুখশান্তি ও স্থিরতা। আগামীকালের প্রত্যাশা যাদের মনে জাগে না, তারা বেঁচে থেকেও মৃত, এদের দ্বারা উত্তম কোন কিছুই আশা করা যায় না। কারণ এরা এদের উদ্যম-উদ্দীপনা সব হারিয়ে intellectual bankruptcy-তে ভুগছে; এরা ভীতু, এদের হৃদয় অন্ধ, ফলে এদের চোখও অন্ধ, এরা সব পথহারা জীব। সাফল্যের মুখ এরা দেখবে না কখনো, অর্থহীন এদের বেঁচে থাকা।
All the flowers of tomorrow are held in the seeds of today. (Chinese Proverb)
কথাটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ, গভীরভাবে ভেবে দেখার মত। জীবনের সম্ভবনার সুফল ভবিষ্যতেই নিহিত যার চাষ করতে হবে আজ। আজ বীজ বপন, আগামীকাল শস্য আহরণ-এইতো রীতি। এটা ভুলে গেলে চলবে না। অতএব উদ্যম-উদ্দীপনা কাজে লাগাতে হবে আজ, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যে চেষ্টা করতে হবে আজ, investment করতে হবে আজ, নাহলে আগামীকাল ফসলটা ফলবে কিসের জোরে?
জীবন অনিশ্চিত, ভবিষ্যৎ সর্বদাই অন্ধকারে আচ্ছন্ন, সম্পূর্ণ অজানা। এই অজানাকেই নিজের আয়ত্বে আনতে হবে আজকের দিনটাতে সমস্ত মেধা, সমস্ত শক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিকে কাজে লাগিয়ে। চাই আত্মবিশ্বাস এবং আশাবাদী মনোভাব/ দৃষ্টিভংগী। Optimists laugh, pessimists cry. জেনেশুনে cry-baby হওয়া নিছক মূর্খতা।
মনে রাখা প্রয়োজন যে আগামীকালের ভাগ্যলিপিটা যদিও অজানা, তথাপি সেই দিনটা নিশ্চিতভাবেই দেখা দেবে “আজ”রূপে রাতের অন্ধকারটা কেটে গেলে পরদিন সূর্যোদয়ের সংগে সংগে। আর একটা আগামীকালের প্রত্যাশা জেগে উঠবে মনে। অতএব একটা আজ যেমন সত্য, পাশাপাশি আর একটা আগামীকালও তেমনি সত্য।
ইটালিয়ান ভাষায় একটা কথা চালু আছে যে “অজ্জি ত্ত্তুু আপোস্তো, দোমানি কে লো সা”? যার অর্থ হলো- আজ তো সব ঠিকঠাকই আছে, কোন অভিযোগ নেই, কিন্তু আগামীকালের কথা কে বলতে পারে?
প্রবাদটার দু’ধরনের অর্থ করা যেতে পারে- (এক) আগামীকালের কোন ভরসা করো না, সে অনিশ্চিত। (দুই) আজ সবকিছু ঠিকঠাক রাখার ব্যবস্থা কর কারণ আজ-ই হলো গুরুত্বপূর্ণ দিন। তবে যে অর্থটাই গ্রহণ করা হোক না কেন, আজকের প্রচেষ্টা যে আগামীকালের জীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করে সেটা সুষ্পষ্ট। So plant a seed today and reap its fruits tomorrow.
আজ হলো বিল্ডিংয়ের ফাউন্ডেশন বা ভিত্তি, আর আগামীকাল হলো তার superstructure. আজকের স্থাপিত ভিত্তিটা যদি মজবুত না হয় তাহলে সেই ইটালিয়ান প্রবাদের শেষ অংশটার মত “দোমানি কে লো সা”? অর্থাৎ ভবিষ্যতের কোন ভরসা নেই। ইন্ডিয়ার এক উর্দু কবি খয়াল কানপুরীর একটি কবিতার অংশ বিশেষ এরকম :
“নেহী হ্যায় জিন্কি ভরোসা খুদ আপ্নি ফানো পর
ওহ নাখুদাকে সাহারোঁকি বাৎ করতে হ্যায়॥”
অর্থটা হচ্ছে : নিজের বাহুবলের উপর (নিজের কর্মদক্ষতার উপর) যার আস্থা নেই, সে-ই শুধু অন্যের সাহায্যের প্রতি তাকিয়ে থাকে।
কিন্তু এটাতো স্বনির্ভরতা নয়, বরং পরনির্ভরতা। প্রথমটা প্রশংসনীয় একটা গুণ, আর দ্বিতীয়টা একটা নিন্দনীয় দোষ। চেষ্টা না করে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে নৌকা কোনদিনই গন্তব্যে পৌঁছবে না, ফলে জীবনের সাধ-আহলাদও অপূর্ণ থেকে যাবে। সাফল্যের জন্যে চাই চেষ্টা, অবিরাম চেষ্টা। “একবার না পারিলে দেখ শতবার” কথাটা পুরাতন বটে কিন্তু এটাই উজ্জ্বল আগামীকালের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার মূলমন্ত্র।
আগামীকালের সাফল্যের আশায় কর্মবহুল আজ নিয়েই বেঁচে থাকবো। আজ আর আগামীকাল নিয়েই তো জীবন।
নাগালের বাইরে
পত্রপত্রিকা- বই-মুভি- টিভি-ইন্টারনেট ইত্যাদি পৃথিবীর দেশে দেশে মানুষের উপর বহু অত্যাচার-অবিচার-জুলুম-নির্যাতনের বঞ্চনার-দারিদ্রের-শোষণের নিষ্ঠুর ও করুণ সব চিত্র দেখিয়ে চলেছে। নির্বাক হয়ে লোকেরা সব সয়ে যাচ্ছে কারণ তারা দরিদ্র, দুর্বল, অসহায়, তাদের পক্ষে সমর্থন করার কেউ নেই। ধনী – দরিদ্র নির্বিশেষে নির্যাতিত হচ্ছে কিছু লোক যারা ঘৃণা ও বিদ্বেষের শিকার, যারা সেই দেশে ধর্মীয় মাইনরিটি, ইমিগ্র্যান্টস অথবা বর্ণ-বিদ্বেষের শিকার অথবা শিক্ষার মানদন্ডে অনগ্রসর। আছে নারী বিদ্বেষ, আছে ভাষার ভিন্নতা। Discrimination যে কোন ধরনেরই হোক না কেন সেটা সদাসর্বদাই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠরা দুর্বলদের শোষণ ও নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। দমন নীতির শক্তিশালী অস্ত্র হচ্ছে Discrimination. ফলে দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার ও দাপট অব্যাহত রয়েছে দেশে দেশে। প্রতিবাদ করার ক্ষমতা বা সাহস কোনটাই নেই অসহায় দুর্বল শ্রেণীর। আর করলেইবা শুনছে কে?
হোক ডেমোক্রেসি, সোশ্যালিজম/কম্যুনিজম, হোক এক নায়কত্ব অথবা নামধারী ইসলামী শাসন-রাজনৈতিক ক্ষমতাধরদের সর্বত্র একই অত্যাচারী শোষকের রূপ, কোন ব্যতিক্রম নেই।
দুর্বল ও অসহায় সর্বত্র Discrimination-এর শিকার, এমনকি স্বদেশেও। ওদের সংগঠিত কোন শক্তি নেই যা দ্বারা প্রতিবাদ জানাবে, অন্যায়ের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবে। জীবন সংগ্রামে ওরা এতই ব্যস্ত যে দুবেলার অন্ন ও মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই জোগাড় করতেই সর্বশক্তি নিঃশেষিত হয়ে যায়। প্রতিবাদ – প্রতিরোধ করার সময় কোথায়? তার জন্যে আর্থিক সামর্থ্য কোথায়? পড়ে মার খাওয়া তাই ওদের ভাগ্যলিপি।
স্বাভাবিক কারণেই ওদের সন্তানেরা বিদ্যাশিক্ষায় থাকে পিছিয়ে; ওদের দু’টি হাত বইখাতার বদলে কৃষি-কলকারখানা ও অন্যান্য পেশার কায়িক শ্রমে থাকে নিবদ্ধ। এর অপর যে ক্ষতিকর দিকটা সেটা হচ্ছে এই যে, এই আবদ্ধতার কারণে ওদের স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তিটাও বিকাশের সুযোগ পায় না। মাথা উঠিয়ে চার দেয়ালের বাইরে অন্য জগৎটার দিকে তাকাবার ফুরসতটুকুও ওদের হাতে নেই। ক্রমে তারা ভারবাহী পশুর পর্যায়ে নেমে যায়, সব বঞ্চনা ও দুঃখকষ্টকে ওরা ওদের ভাগ্যলিপি/কপালের লিখন বলে মেনে নেয়, প্রতিবাদের স্পৃহা হারিয়ে ফেলে। অত্যাচার অবিচার চলতেই থাকে।
দেশের শাসক-গোষ্ঠী আপন দল-উপদল ও স্তাবকদের মন যোগাতে ব্যস্ত থাকে যাতে ক্ষমতার গদিটা তাদের দখলে থাকে। ক্ষমতার নেশা ওদের মনুষ্যত্বটাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়, ওরা তখন ন্যায়-অন্যায় জ্ঞানবিবর্জিত হয়ে অত্যাচার-অনাচার চালিয়ে যেতে থাকে, নিজেদের আখের গুছানোটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক ক্ষমতার পট পরিবর্তন যদিওবা কখনো ঘটে, তখন নূতন শাসক অথবা শাসকগোষ্ঠীও তাদের পূর্বতনদের মতই ক্ষমতাটাকে আঁকড়ে ধরে থাকে, দলের স্বার্থেই শাসনযন্ত্র পরিচালনা করে, দেশের জনগণের কল্যাণ হয়ে দাঁড়ায় গৌণ। অনাচার-অবিচারের দলীয় পরিবর্তন হয়ত ঘটে কিন্তু দরিদ্র, অবহেলিত জনগণ আগের মতই ধুঁকে মরে। দারিদ্র্য ও নিজেদের মাঝে নানা কারণে বিদ্বেষ বেড়েই চলে। সৃষ্টি হয় অস্থিরতার।
নীতিবিহীন রাজনীতিকরা ওদের মগজে ঢুকিয়ে দেয় নানা বিভেদ ও বিদ্বেষমূলক ধারণার বিষঃ ধর্ম-বিদ্বেষ, বর্ণ-বিদ্বেষ, স্থানীয়-অস্থানীয় বিদ্বেষ, এমনকি নারী-বিদ্বেষও। সুচতুর বাক্য-বিন্যাসের জালে মুগ্ধ হয়ে বিশাল অবহেলিত শোষিত দরিদ্র শ্রেণী নিজেদের বাস্তব বঞ্চনা ও অভিযোগ ভুলে গিয়ে পরিণত হয় রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ারে, নিজেদের মাঝেই হানাহানি করে নিজেদেরই পায়ে কুড়াল মারে। তাদের শত্রুরা নিরাপদ দূরত্বে থেকে ওদের মরতে দেখে, প্রতিবাদের আর কোন আশংকাই থাকে না।
শিক্ষিত ও আর্থ-সামাজিকভাবে অগ্রসর শ্রেণীর একটি দল এই শোষণ ও অন্যায়ের কথা জানে, এমনকি প্রতিবাদও করতে চায় কিন্তু নানা ধরনের লোভ ওদের বিবেক-বুদ্ধিকে অকর্মন্য করে ফেলে। অর্থের লোভে, সামাজিক প্রতিষ্ঠার লোভে ওরা শাসক- শোষকদের দ্বারস্থ হয়ে কিছু নগদ প্রাপ্তির আশায় নিজেদেরকে ওদের কাছে বিক্রি করে দেয়। তখন ওরা intellectual bankruptcy and corruption-এর আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকে। ওদের যোগসাজসে শাসকরা দরিদ্র ও অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত শ্রেণীর মাঝে ব্যবধান ও শোষণের ভিত আরো পাকা করে নেয়। তাছাড়াও রয়েছে ভাড়া করা গুন্ডা ও মাস্তান শ্রেণী যাদের দাপটে ছোটবড় সবাই থাকে সদা-সন্ত্রস্ত।
অন্য ধরণের বিভেদও সৃষ্টি করা হয়েছে- নারী ও পুরুষের বিভেদ। একই পদের/দায়িত্বের পরিশ্রমের কাজ করা সত্বেও নারী কর্মীদের বেতন/মজুরী পুরুষ সহকর্মীদের তুলনায় কম দেয়া হয়। প্রতিবাদ করলে চাকরিটা হারানোর ভয়। কাজেই চুপ করে থাকা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।
আছে শিশু শ্রমের অমানবিক প্রথা। দেশের আইন এর বিরুদ্ধে হলেও শিল্পপতিরা সরকারী কর্মচারীদেরই সহায়তায় এই অন্যায় চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে শিশুরা একাজে লেগে থাকে, মাবাবার হাতে দুটি বাড়তি পয়সা ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা।
সব না হলেও অন্ততঃ কিছু কিছু অন্যায় এবং অবিচারের প্রতিকার- প্রতিরোধ দেশের প্রচলিত আইনের মাধ্যমে হতে পারে। কিন্তু এই অসহায় ও দুঃখীদের পক্ষ হয়ে লড়বে কে? আইন প্রয়োগকারীরাই নিষ্ক্রিয় থাকে ঘুষের লোভে। প্রতিকার তাই দরিদ্রের নাগালের বাইরে থেকে যায়।
অমর জীবন
অমর জীবনের আকাক্সক্ষা মানুষের মনে চির জাগরূক যদিও সে জানে যে প্রাণীর জীবনে মৃত্যু এক অবধারিত পরিসমাপ্তি। কেউই অমর নয় এই পৃথিবীর বুকে। অতীতেও ছিল না, ভবিষ্যতেও হবে না।
অন্যদিকে মানুষের মনে মৃত্যুকে নিয়ে দ্বিমুখী চিন্তাও বিরাজ করে। কবি একবার বলেন ঃ “মরিতে চাহিনা আমি এ সুন্দর ভুবনে”, কিন্তু ভাবনা-চিন্তা শেষে তাঁর কলম থেকেই আবার বের হয় ঃ “মরণ রে, তুহুঁ মম শ্যাম সমান।”
অর্থাৎ মৃত্যুকে তিনি ভয় তো পানই না বরং তাকে বন্ধুসম জ্ঞান করেন।
এই চাওয়া এবং না-চাওয়ার মাঝেই সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনার আবর্তে ঘুরপাক খেয়ে মানব জীবনটা কেটে যায়, সে জীবন যত দীর্ঘই হোক না কেন। “চক্রবৎ পরিবর্তন্তে সুখানি চ দুখানি চ” (সংস্কৃত শ্লোক) যার অর্থ ঃ মানুষের জীবনে চক্রের মতই আবর্তন করে সুখ এবং দুঃখ; কেউই চিরসুখী নয়, কেউই চিরদুঃখীও নয়। উত্থান-পতন জীবনেরই অংশ। প্রতিবাদ করে কিছু লাভ নেই, দুঃখের, অশান্তির পরিমাণ বাড়া ছাড়া।
দৈহিক অমরত্ব তো সম্ভব নয় তবে দেশের, সমাজের, মানুষের কল্যাণের উদ্দেশ্যে উত্তম কিছু করে রেখে যেতে পারলে সেই অবদানটুকুর মাধ্যমে জনগণের স্মৃতির মাঝে অমরত্ব লাভ করে চিরস্মরণীয় হয়ে বেঁচে থাকা খুবই সম্ভব। এবং এধরনের অমর ব্যক্তিদের ভুরিভুরি দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে রয়েছে দেশে দেশে বহুদূর অতীত থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত। মৃত্যুচিন্তা বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তিকে সৃজনশীলতার দিকে ধাবিত করতে পারে। সে তখন সময়ের বা অর্থের অপচয় না করে নূতন কিছু আবিষ্কার করা, গড়ে তোলা, সৃষ্টি করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হয়, জনকল্যাণমূলক কিছু কাজে হাত দেয়। তাকে দেখে অন্যরাও উদ্বুদ্ধ হয়, তাতে দেশ ও সমাজ উপকৃত হয়।
উত্তম অবদান সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং, স্থাপত্য, চিত্রাংকন, সংগীত সব কিছুতেই হতে পারে। শিল্প-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নূতন নূতন আবিষ্কার করে, উত্তম সব উপন্যাস-কবিতা-নাটক রচনা করে, সংগীতে নূতন সুর-তাল সৃষ্টি করে, অভিনয় করে, অট্টালিকা-সেতু ইত্যাদির ডিজাইন করে অনেক মানুষ এজগতে অমরত্ব লাভ করেছেন। দুঃখী দরিদ্রের সেবা করে, বিনা পারিশ্রমিকে জনসেবা করেও বহু মহান ব্যক্তি অমর হয়ে আছেন। মাদার তেরেসা তো জগতের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দেশের স্বাধীনতা অর্জন বা রক্ষায় আত্মত্যাগ করেও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন বহু সৈনিক, রাজনীতিক ও রাষ্ট্রনায়কেরা দেশে দেশে।
এসব হচ্ছে খ্যাতি বা সুখ্যাতির দৃষ্টান্ত। অন্যদিকে অতি জঘন্য, নিন্দনীয়, নৃশংস কাজের দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েও কুখ্যাতির খাতায় নাম লিখিয়ে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে দেশ-বিদেশের বহু চরিত্র। তবে ব্যবধানটা এই যে এরা হচ্ছে ঘৃণ্য চরিত্রের দৃষ্টান্ত, এদের কেউ প্রশংসা করে না, নিন্দা করে; এদের অনুসরণ কেউ করতে চায় না কারণ এরা হচ্ছে মানবজাতির কলংক।
অমরত্বের ভিন্ন দৃশ্যপটও রয়েছে, যথা মানব-মানবীর প্রেমের জগতের অমর চরিত্রগুলো যার কিছু বাস্তব, কিছুবা কবি-সাহিত্যিকের কল্পনাপ্রসূত। Romeo and Juliet, সোহনী-মহিওয়াল, শিরি-ফরহাদ, লায়লা-মজনু, ইউসুফ-জুলায়খা, শশী-পুন্নু, হীর-রনঝা ইত্যাদি। তাছাড়া বাঙ্গালী হিন্দু সমাজের রাধা-কৃষ্ণ এবং চন্ডীদাস ও রজকিনীর প্রেমকাহিনীও যুগযুগান্তর ধরে তাদের মনে অমর হয়ে আছে।
আর সবার উপর আজ সাড়ে তিনশ’ বছর ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আগ্রার তাজমহল ভারতের মুঘল সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজ মহলের প্রেমের নিদর্শন হয়ে, যে অকল্পনীয় সৌন্দর্যময় সৌধ দেখতে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থী ভিড় জমায় সেখানে পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে।
অমরত্বের একটা আধ্যাত্মিক মাত্রাও উল্লেখযোগ্য এবং সেটা হলো ধর্মভিত্তিক মাত্রা। বহু ধর্মের লোক বাস করে এই জগতে, এবং প্রতিটি ধর্মেরই একজন প্রবর্তক রয়েছেন একমাত্র হিন্দু ধর্ম বাদ দিয়ে। কারণ এই ধর্মের নির্দিষ্ট কোন একজন প্রবর্তক নেই, যুগযুগ ধরে রচিত বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ও মহান সব ব্যক্তিদের ধ্যান-ধারণার আবর্তন-বিবর্তনের সার হচ্ছে বর্তমানের হিন্দু ধর্ম, যার অপর নাম সনাতন ধর্ম। জেসাস ক্রাইষ্ট, মোজেজ, মুহাম্মদ, গৌতম বুদ্ধ, মহাবীর, জরোয়াষ্টার, কনফুসিয়াস, গুরু নানক, বাহাউল্লাহ যথাক্রমে খৃষ্টান ধর্ম, ইহুদি ধর্ম, ইসলাম ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম, জরোয়াষ্টারিয়ান ধর্ম, কনফুসিয় ধর্ম, শিখ ধর্ম ও বাহাই ধর্মের প্রবর্তক-প্রচারক হিসেবে সারা বিশ্বে অমর হয়ে আছেন। এঁদের লক্ষ-কোটি ভক্ত ও অনুসারীদের মাঝে তো বটেই।
অমরত্ব লাভের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা হলো নিজের পরিবারের সামনে উত্তম কাজের দৃষ্টান্ত রেখে যাওয়া। জ্ঞান-বিজ্ঞানের আবিষ্কারের, সৃজনশীলতার, মেধার, ধনের, শৌর্য-বীর্যের, দানশীলতার, উদারতার, আত্মত্যাগের অথবা দেশসেবার ক্ষেত্রে স্মরণীয় কিছু করে বর্তমান পরিবারের এবং অনাগত বংশধরদের জন্য গর্ব ও উৎসাহ-উদ্দীপনার উৎস হয়ে থাকা যাতে তারাও তেমনি মহান কোন অবদান রাখার জন্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে পারে।
জগতে বহু মহান ব্যক্তিত্বের দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে রয়েছে। এঁদের অনুসরণ করে বিশেষ একটা কিছু করার জন্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে কাজে নেমে পড়লেও অমর জীবনের পথে অনেকখানি এগিয়ে যাওয়া সম্ভব; এবং তাদের অসমাপ্ত কাজটাকে সমাপ্ত করে অমর দৃষ্টান্ত স্থাপন করা অসম্ভব কিছু নয়। চাই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও সে অনুসারে নিরলস প্রচেষ্টা। Genious is ninety percent perspiration and ten percent inspiration কথাটা খুবই মূল্যবান। (সমাপ্ত)
সাইদুল হোসেন। মিসিসাগা